ধূসর রঙে আকাশ পর্ব_৪৯

0
972

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৪৯
লিখা: Sidratul Muntaz

নীলাভ্র একটু জোরেই শব্দ করে বললো,” কি এতো মহান কাজ তোমাদের যার জন্য দুটো জলজ্যান্ত মানুষের জীবন নিয়ে গেইম খেলতে হলো?দু’টি জীবনের সমস্ত সজীবতা কেড়ে মরুভূমির মাঠ বানাতে হলো? এর চেয়ে যদি আমাদের মেরে ফেলতে অথবা এইরকম রুমে বছরের পর বছরও ধরে আটকে রাখতে তাও ভালো ছিল। কিন্তু মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় করে ধোকা দেওয়ার মতো নিকৃষ্ট কাজটা কেন করলে? আর মিথ্যে বিয়ের প্রতিশ্রুতিটা দেওয়া কি খুব জরুরী ছিল?নিজের পরিবারের সাথে, মায়ের সাথে কত যুদ্ধ করেছি তোমাকে পাওয়ার জন্য। তুমি কি দেখোনি? তখনো কি একটাবার দয়া হয়নি তোমার? এতো নিষ্ঠুরভাবে স্বপ্নগুলো ভেঙে দিতে পারলে?এই আমার কথা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু তোহা? এই মেয়েটার কি দোষ ছিল বলোতো? তুমি তো নিজের চোখেই দেখেছো গত একমাস ও কিভাবে বেঁচে ছিল। প্রতি মুহুর্তে আমীর আমীর বলে জান দিয়ে ফেলতো দেখোনি? ওর জন্য কি একবারও মায়া হয়নি তোমাদের? আমরা কি অপরাধ করেছিলাম? কেনো এতোবড় শাস্তি দিলে? কেনো?”
নীলাভ্র তীব্র গর্জন করলো। ওর রক্তিম চোখ দু’টো সূর্যশিখার মতো তেজস্বী হয়ে উঠেছে। রিম্মি অপরাধবোধের আড়ষ্টতা নিয়ে মাথা নত করে ছিল এতোক্ষণ। আচমকা নীলাভ্রর গর্জন শুনে মৃদু কেঁপে উঠলো। নীলাভ্রর বুকের ভিতরটা খুব জ্বলছে। পৃথিবীর বাতাসটাকেও বিষাক্ত মনে হচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতেও এতো কষ্ট হয় কেনো? সামনে বসে থাকা মেয়েটি, যাকে সে এতোদিন বউ বানানোর স্বপ্ন দেখেছে সে আজ বড়ই অচেনা! বিশ্বাসঘাতক! এই নির্মম সত্যিটা মানা যাচ্ছে না বলেই কি এতো কষ্ট? রিম্মি মাথা নত করে অপরাধী কণ্ঠে বললো,
” আমরা তোমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাইনি। এর পেছনে আমাদের একটা বড় উদ্দেশ্য আছে। আমাদের দিক থেকে চিন্তা করলে সে উদ্দেশ্যটা অবশ্যই ভালো। কিন্তু তোমাদের দিক থেকে ভালো নাও হতে পারে। তাছাড়া এই উদ্দেশ্যের কথা তোমাদের বলা যাবে না। আমাদের সংস্থা থেকে এ বিষয়ে কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে। আমি সেটা অমান্য করতে পারবো না।”
নীলাভ্র শক্ত চোয়ালে কঠিন দৃষ্টিতে রিম্মির দিকে চেয়ে আছে। তোহা ছটফট করছে। ও জানেনা কি করা উচিৎ। শুধু জানে, ওর পৃথিবীটা অন্ধকার লাগছে। হুট করেই এ পৃথিবী বড় অচেনা, বড় নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে। স্বার্থ হাসিলের জন্য মানুষ এতো খারাপ হতে পারে? ঘৃণা লাগছে! তোহা কাতর কণ্ঠে জড়িয়ে যাওয়া গলায় বললো,
” তাহলে সেদিন সকালে আমীরের মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল? ও নিশ্চয়ই বেঁচে আছে তাইনা? তাহলে সেদিন মরে যাওয়ার ঘটনা কেনো সাজানো হয়েছিল? পুরো বিশ্ব জানে ও মৃত। ওর লাশ আমি নিজের চোখে দেখেছি। এসবকিছুই কি তোমাদের পরিকল্পিত? ”
রিম্মির মুখ চুপসে যায়। চোখের পানি আলতো হাতে মুছে অপ্রতিভ স্বরে বললো,” এই ঘটনাও আমাদের সেই উদ্দেশ্যের সাথে জড়িত। তাই বলতে পারবো না৷ স্যরি তোহা, এসব আমাদের অত্যন্ত গোপনীয় তথ্য।”
তোহা হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়ে। রিম্মির কথাগুলো এই মুহুর্তে সহ্য হচ্ছে না। একটু পর আবারও কাতর কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,” আচ্ছা তাহলে অন্তত এইটুকু বলো, আমীর বেঁচে আছে?”
রিম্মি দ্বিধায় পড়ে যায়। পৃথিবীতে আমীরের মৃত্যুর ভুল খবর প্রচার হয়ে গেছে। সেটাও সংগত কারণেই প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু সে তো তোহাকে বলেছিল আমীরের সঙ্গে তাকে দেখা করাবে। কিন্তু প্রফেসর ট্রুডোর কাছে ধরা পড়ে যাওয়ায় সেটা আর সম্ভব হবে বা হয়তো৷ এখন আমীরের বেঁচে থাকার খবরটা কি তোহাকে জানানো ঠিক হবে? রিম্মি অনেক ভাবনা-চিন্তা করে বললো,
” হ্যা, বেঁচে আছে।”
তোহার আটকে থাকা শ্বাস খুব জোরে বেরিয়ে আসে। আনন্দ হওয়া উচিৎ নাকি ঘৃণা করা উচিৎ নাকি অন্যকিছু? এই অনুভূতির নাম কি? তোহা জানেনা! নীলাভ্র বললো,
” সত্যিটা না জানালেও পারতে। সারাজীবন ভুল জানতাম। ভাবতাম তোমরা দুজনই হারিয়ে গেছো৷ সারাজীবন তোমাদের খুঁজে বেড়াতাম। সেটাও হয়তো ভালো ছিল।”
রিম্মি মৃদু হেসে বললো,” তুমিই তো বলেছিলে নীল, যে আশা কোনোদিন পূরণ হবে না সেই আশা পুষে রাখার চেয়ে ভেঙে ফেলাই ভালো? এতে নাকি কষ্টও কম?”
” প্লিজ আমাকে নীল ডাকবে না।”
” ঠিকাছে, না ডাকলাম!”
নীলাভ্র দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সে ভুল বলেছিল। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কষ্টের চেয়ে আশা নিয়ে অপেক্ষা করাই শ্রেয়। সে অপেক্ষাতেও শান্তি থাকে। এইযে নীলাভ্রর এখন এতো কষ্ট হচ্ছে, রিম্মি হারিয়ে গেলে ওর জন্য অপেক্ষা করতেও এতো কষ্ট লাগতো না হয়তো। নীলাভ্র তার সারাটিজীবন রিম্মির জন্য অপেক্ষা করেই কাটিয়ে দিতে পারতো। রিম্মি বললো,
” সবকিছু আজকে কেনো স্বীকার করলাম জানো?”
নীলাভ্র বললো,” কেনো?”
” কারণ এটা আমার একটা শাস্তি ছিল। তোহাকে এখানে আমি বিনা অনুমতিতে নিয়ে আসার শাস্তি পেয়েছি।”
” এইটা তোমার শাস্তি ছিল নাকি আমাদের?”
” আমার চেয়ে তোমরাই হয়তো বেশি শাস্তি পেয়েছো।”
” কিন্তু তোমার শাস্তি এটা কিভাবে হলো?”
রিম্মি নিশ্চুপ হয়ে রইল। নীলাভ্রর চোখে চোখ রেখে সব সত্যি স্বীকার করা তার জন্য কতটা কষ্টের এটা নীলাভ্র হয়তো বুঝবেও না।নীলাভ্র অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। রিম্মির দিকে চাইতে আর ইচ্ছা করছে না। রিম্মি যখন উঠে দাঁড়াতে যাবে তখন নীলাভ্র ছ্যাত করে বলে উঠলো,
” এক মিনিট! সব প্রশ্নের উত্তর এখনো পাইনি। অনেক অনেক কনফিউশন আছে। সব ক্লিয়ার না করে তুমি চলে যেতে পারো না।”
রিম্মি বিরস মুখে বসলো। হতাশ ভঙ্গিতে বললো,
” বলো আর কি জানতে চাও?”
” তুমি একবার বলেছিলে, মিথ্যা বললে তোমার গালে লাল আভা সৃষ্টি হয়। এইটাও মিথ্যা তাইনা?”
” হুম। তোমার বিশ্বাস অর্জনের জন্য বলেছিলাম। তখন এমন একটা পরিস্থিতি ছিল যে আমি যাই বলতাম তুমি বিশ্বাস করতে। সেই বিশ্বাস যেন ভেঙে না যায় তাই এটা একটা ট্রিক্স।”
” তোহা কিডন্যাপ হওয়ার তিনমাস পরই কেনো ফিরে এসেছিল? এই তিনমাস ওর সাথে তোমরা কি করেছো?”
” আমি তো তখন তোমার সাথে তোহাকে খুঁজতে ব্যস্ত।”
নীলাভ্র কটাক্ষ করলো,” খুঁজতে? না খোঁজার অভিনয় করতে?”
রিম্মি কুণ্ঠিত গলায় বললো,” হ্যা। অভিনয়ই তো। তবে আমার জানামতে তিনমাস তোহাকে শুধু অচেতন অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়েছিল। আমরা কারো শারীরিক ক্ষতি করিনা। আমীর তোহাকে তিনমাস পর ফিরিয়ে এনেছিল কারণ ওর ব্রেইন কন্ট্রোল করে একবছরের স্মৃতিহরণ করতে একমাস লাগে, আর বাকি দুইমাসের দেরিটা ছিল ইচ্ছাকৃত। আমীরের বানানো গল্পটা যেন তোহা আর ওর বাড়ির সবাইকে বিশ্বাস করানো সহজ হয়। আমীরের সাথে তোহার একবছরের প্রেমের সম্পর্ক, তিনমাসের বিয়ে, তোহার এক্সিডেন্ট করে স্মৃতিশক্তি হারানো। এসব মিথ্যে গল্প বিশ্বাস করানোর জন্যই তিনমাসের ইচ্ছাকৃত দেরি।”
” তাহলে এসব আমীর চিঠিতে প্রকাশ করলো কেন? আর এখন তোহার স্মৃতিও আছে। তাহলে এতো কাহিনি করার কি প্রয়োজন ছিল?”
” আমরা সবকিছু খুব সুক্ষ্ণভাবে পরিকল্পনা করেছি। যেনো কোনোভাবেই ধরা খাওয়ার রিস্ক না থাকে। আমরা যখন তোমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যেতাম তখন তোমরা তো অবশ্যই আমাদের খুঁজতে। তাই একটা স্ট্রং এক্সকিউজ তৈরী করা হয়েছিল। যেন আমরা হারিয়ে গেলে তোমরা ধরে নিতে পারো আমীর আমাকে নিয়ে চলে গেছে৷ আর তোহাকে এতোদিন ধোকায় রেখেছে। আসল ঘটনা যেন তোমাদের সামনে কখনও না আসে।”
নীলাভ্র উপহাস করলো,” বাহ, সুন্দর প্ল্যান তোমাদের। তাহলে আমীরের মৃত্যুর পর তো তুমি মুক্ত হয়ে গেছিলে। তাহলে এবার হারিয়ে গেলে আমি কি তোমাকে খুঁজতাম না? নাকি এবার নতুন কোনো একটা মিথ্যে গল্প বানাতে?”
” এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারবো না। ভিন্ন প্রশ্ন করো।”
নীলাভ্র কি যেন একটা চিন্তা করে বললো,
” যেদিন রাতে আমি আর তোহা তোমাকে আর আমীরকে একরুমে আবিষ্কার করলাম এরপরদিনই তুমি বলেছিলে আমীর তোহাকে ঔষধ খাইয়ে ওর ক্ষতি করছে। তাই ঔষধ ছুড়ে ফেলতে বলেছিলে। ওর পায়ের পায়েলটাও ছুড়ে ফেলতে বলেছিলে। কেনো? এতে তো তোমাদেরই ক্ষতি।”
রিম্মি ফুস করে একটু হাসলো। তারপর বললো,
” আমাদের ক্ষতি না। আমার বানানো গল্পে তোমার বিশ্বাস যেন আরও দৃঢ় হয় তাই বলেছিলাম।”
” কিন্তু এতে কি আমীরের প্ল্যান নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল না? তুমি বন্ধুর ক্ষতি কেন করলে?”
” আমি আমীরের ক্ষতি করিনি। আমীর তোহার ব্রেইন কন্ট্রোলে রেখেছিল। ও মানুষের ব্রেইনওয়াশ খুব ভালো পারে। কিন্তু ওর এই ব্রেইনওয়াশের প্ল্যান আমার পছন্দ হয়নি। আমার মনে হতো তোহার হঠাৎ করেই সব মনে পড়বে। আর আমাদের প্ল্যান ভেস্তে যাবে৷ আমার সন্দেহ দূর করতে আমীর নিজেই বলেছিল তোহাকে মাঝে মাঝে বাজিয়ে দেখতে। আমীরের কনফিডেন্স অনেক হাই। সে জানে তোহা ততদিন কিচ্ছু বিশ্বাস করবে না যতদিন না আমীর ওকে বিশ্বাস করতে দিবে। আমি মাঝে মাঝে শুধু একটু পরীক্ষা করতাম। আর ঔষধ, পায়েল এসব ছুড়ে ফেলতে বলেছিলাম এইটা টেস্ট করার জন্যই যে তোহা কারো কথায় বিভ্রান্ত হয় কিনা। যদি দেখতাম তোহা বিভ্রান্ত হচ্ছে তাহলে আমীর আরও শতর্ক হতো। কিন্তু সৌভাগ্যবশত তোহা আমীরকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিল। তাই আমার কাজে আমীরের ক্ষতি হতো না, লাভই হতো।”
” তোহার অন্ধের মতো বিশ্বাস নিয়ে তোমরা এতো জঘন্য খেলা খেললে?”
রিম্মির দৃষ্টি নত। নীলাভ্রর চোখে চোখ রাখার সাহসটুকুও নেই। নীলাভ্র তোহার দিকে তাকালো। তোহা চেয়ার থেকে নেমে মেঝেতে চলে গেছে। হাটু জড়িয়ে ধরে ঝিম মেরে বসে আছে। গাঁয়ের বোরখা খুলে রেখেছে। এখন ওর গায়ে একটা সাদা কূর্তি। ওকে একদমই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। এতোক্ষণ নীলাভ্র রিম্মির আলোচনা সে শুনেছে নাকি শুনেনি সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। নীলাভ্র হঠাৎ ভ্রু কুচকে পুনরায় বললো,
” আচ্ছা, একদিন তুমি হঠাৎ আমার ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে অদ্ভুত আচরণ শুরু করেছিলে, মনে আছে? তোহার সাথে নিজেকে কম্পেয়ার করে আমার কাছে জানতে চেয়েছিলে কে বেশি সুন্দর। সেটা কি ছিল?”
” উফফ, বললাম তো সব পরিকল্পিত। একইরকম প্রশ্ন বারবার কেনো করছো? তোহার সাথে আমাকে কম্পেয়ার করেছিলাম যেন আমার গল্পটা বলার পর তুমি বিশ্বাস করো। এর আগে এই কাজটা জরুরী মনে হয়েছিল।”
” তোমার জীবনের যে গল্প আমাকে বলেছো পুরোটাই মিথ্যে ছিল? তুমি কি তিলু ভাবীর মামার মেয়ে না?”
” হ্যা। আমি তিলুআপুর মামারই মেয়ে। আমার মা মারা গেছে এটাও সত্যি। ছোটবেলায় সৎমায়ের কাছে থেকেছি তাও ঠিক। কিন্তু সৎমা হলেও তিনি আমার উপর খুব অত্যাচার করতেন না। ওসব আমি সিমপ্যাথির জন্য বলেছিলাম। মা আমাকে পছন্দই করতেন কারণ আমি ছোট থেকে পড়াশুনায় ভালো ছিলাম। সবসময় ক্লাসে ফার্স্ট হতাম। এতোই মেধাবী ছিলাম যে স্যার ম্যাডাম বাড়ি বয়ে এসে আমার প্রশংসা করতো। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে সাইন্সের প্রতি অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও আমাকে কমার্সে ভর্তি হতে হয়। কিন্তু আমীরের সাথে ফ্রেন্ডশীপ হওয়ার পর ও নিজেই আমাকে সাইন্স পড়াতে শুরু করে। আমীরের সাথে সাহিলের মাধ্যমেই পরিচয়টা হয়েছিল। আর সাহিলের যে ভয়ংকর মৃত্যুর কথা বলেছি সেটাও সত্যি। আমীর অপরাধীদের শাস্তি দিতে ভালোবাসে। যেকোনো অপরাধীকে খুব ভয়ংকরভাবে উপযুক্ত শাস্তি দেয় ও। ওর সেই পদ্ধতিগুলোও খুব ইউনিক। এজন্যই প্রফেসর ট্রুডো ওর নাম দিয়েছেন রিব সিকেন্ট। আমীর প্রফেসরের খুব প্রিয়। ইন্টারে উঠে আমি কমার্স ছেড়ে সাইন্স নিয়েই এই সংস্থার সদস্য হয়ে যাই। আমীরই আমাকে এখানে এনেছে। তারপর যখন টাকা কামাতে শুরু করলাম, মা, আপু, আমাকে খুব ইম্পোর্ট্যান্স দিতো। সবই আমীরের ক্রেডিট। ও না থাকলে আমি কখনো এই পথে আসতে পারতাম না। শুধু আমাদের ভালোবাসার সম্পর্কের বিষয়টা আর আমীর আমাকে আমার পরিবারের থেকে টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে এটুকু মিথ্যে ছিল। একটা মনগড়া কাহিনি তৈরী করেছিলাম তোমাকে দূর্বল করতে। সবই সংস্থার আদেশ। আর এই সংস্থার স্বার্থেই আমীর আমার উপর খুব বড় একটা মস্তিষ্কের এক্সপেরিমেন্ট করেছিল। তারপর থেকে আমি সময়ের হিসাব-নিকাশ খুব ভালো পারি। আমি তোমাকে বলেছিলাম আমাকে জোর-জবরদস্তি এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছে৷ এইটা ভুল। বরং আমারই সবচেয়ে উৎসাহ ছিল। আর এই এক্সপেরিমেন্ট আমাদের সংস্থার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেনো গুরুত্বপূর্ণ সেটা বলা যাচ্ছে না। তুমি খেয়াল করেছো কিনা জানিনা, প্রথমদিন আমি তোমাকে দেখে ভয় পাওয়ার অভিনয় করেছিলাম। কারণ তখন আমাদের প্ল্যান ছিল আমি খুব সহজ-সরল একটা ভীতু মেয়ে থাকবো। কিন্তু তোহা কিডন্যাপ হওয়ার পর আমাদের প্ল্যান চেঞ্জ হয়ে যায়। মূলত আমীরের জন্যই ওই প্ল্যান চেঞ্জ করতে হয়েছিল। কারণ তোহার ব্যাপারে আমাদের ধারণা ভুল ছিল। সেটা আগেও বলেছি। তোহাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলার জন্য আমীরের প্রয়োজন ছিল ওর বিশ্বাস অর্জন করা। তাই এর চেয়ে ভালো প্ল্যান আর মাথায় আসেনি৷ তাছাড়া তোমার মনেও এই প্রশ্ন জাগতে পারতো যে প্রথম প্রথম তোমাকে দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু হঠাৎ আমি স্মার্ট গার্ল হয়ে গেলাম। যে নাকি কিছুতেই ভয় পায়না। তাহলে প্রথম দেখায় আমার ওই অস্বাভাবিক আচরণের মানে কি? এর উত্তর দিতেই আওয়ানের এক্সকিউজ দিয়েছিলাম। আসলে আমরা কোনো রিস্ক নিতে চাইনি। তোমাদের মনে যেন সরিষা পরিমাণ সন্দেহও না জন্মায় সেদিকেই খেয়াল রেখেছি বেশি।”
নীলাভ্র দুইহাত মাথায় হাত ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বললো,” তুমি এখন সত্যি বলছো তারই বা প্রমাণ কি? আওয়ান বলতে আদৌ কি কেউ আছে?”
” আছে। আওয়ানকে সানাফ আঙ্কেল সৃষ্টি করেছিলেন। সে একটা অনুভূতিহীন বিশেষ প্রাণী। অনুভূতিহীন বলতে দয়া-মায়া, ভালোবাসা এসব ওর মধ্যে নেই। কিন্তু হিংস্রতা, আনুগত্য এগুলো খুব বেশি পরিমাণে আছে। একটা মানুষের মনে যদি দয়া-মায়া কিংবা ভালোবাসা না থাকে তাহলে সে ঠিক কেমন হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আওয়ান।”
রিম্মি একটু থেমে জিজ্ঞেস করলো,” আর কি কোনো প্রশ্ন আছে? নিষেধাজ্ঞা ছাড়া আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিবো।”
নীলাভ্র মাথায় দুইহাত রেখে একইভাবে বললো,” এইযে এখন সব স্বীকার করলে, এখন কি তোমাদের উদ্দেশ্যের ক্ষতি হবে না?”
” না। কারণ আমাদের উদ্দেশ্যে সফল হয়ে গেছে।”
তোহা হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। রিম্মি আর নীলাভ্র চমকে উঠলো। তোহা দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। রিম্মিও তোহার পেছনে ধাওয়া করতে যাচ্ছিল তখন নীলাভ্র ওর হাত ধরে বললো,
” দাঁড়াও রিম্মি, আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও।”
নীলাভ্রর চোখ দু’টো টলমল। রিম্মি নরম কণ্ঠে বললো,
” বলো।”
” যদি নিবরাস ভাইয়া বেঁচে থাকতো তাহলে আরও আগেই আমাদের বিয়েটা হয়ে যেতো। তখন কি হতো? তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে?”
” হ্যা করতাম। তখন আমাদের একটা ফুটফুটে বাচ্চা হতো। আর সেই বাচ্চাটাও সংস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।”
নীলাভ্র বিকৃত মুখে উচ্চারণ করলো,” ছি, এতো বেইমান?”
তোহা বের হতেই সামনে আমীরকে দেখতে পেল।তারপর আচানক চড় দিল। ওই চড়ের শব্দ এতোই তীক্ষ্ণ ছিল যে অনেকদূর পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হয়। প্রফেসর ট্রুডোসহ আরও অনেকেই বেরিয়ে আসলো। সবাই হতভম্ব! আমীর আহত দৃষ্টিতে ডানদিকে মাথা ঘুরিয়ে নিচের দিকে চেয়ে থাকে। তোহার চড়ে ওর মাথা ডানদিকে ঘুরে গেছে। রিম্মি আর নীলাভ্রও রুম থেকে বের হয়ে এলো। সবার থমথমে মুখ দেখেই ঘটনা আন্দাজ করে নেয় ওরা। তোহার জন্য রিম্মির মায়া হচ্ছে। ও এটা কি সর্বনাশা কান্ড করলো? তোহা হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমীরের দিকে। কালনাগিনীর মতো ফোস ফোস করে শ্বাস নিচ্ছে। এইরকম গুমোট পরিবেশ ছাপিয়ে তিরান ফিক করে হেসে দেয়। এই ঘটনায় তার ভীষণ মজা লেগেছে। এর চেয়ে মজার দৃশ্য ইহজীবনে সে আর দেখেছে কিনা সন্দেহ!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here