ধূসর রঙে আকাশ পর্ব_৫৩

0
1017

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৫৩
লিখা: Sidratul Muntaz

আমীর হঠাৎ ল্যাবরুমে এসে দেখলো তিরান তোহার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু তাই নয়, তোহার ডানহাতের উল্টোপিঠে চুমু দিয়ে ধরে রেখেছে। অদ্ভুত! আমীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,
” তুই এখানে কেনো?”
আমীরের কণ্ঠ শুনে তিরান ঝাড়ি মেরে তোহার হাত ফেলে দিল। তারপর গুটিশুটি মেরে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো। ওর চোখ দুটো লাল টকটকে। দেখে মনে হচ্ছে মাত্র কেঁদেছে। আসলেই কি কেঁদেছে? নাকি আমীর নিজে কেঁদেছে বলে সবার চেহারাতেই কান্না কান্না ভাব দেখতে পাচ্ছে? তোহার দিকে তাকিয়ে তিরানের তো কাঁদার কথা না। আমীর তিরানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাশভারী গলায় প্রশ্ন করলো,
” কি হয়েছে তোর? এখানে কেনো এসেছিস?”
তিরান নতমাথায় অকপটে জবাব দিল,” এমনি।”
” এমনি মানে?”
তিরান কিছু বললো না। আমীর বললো,
” আর আসবি না এখানে। ওকে ধরবিও না।”
তিরান হঠাৎ ফুসে উঠলো,” ধরবো না কেনো? একশোবার ধরবো, হাজার বার ধরবো। তুমি আটকাতে পারবে না।”
তিরান এক নিঃশ্বাসে কথা শেষ করে বের হয়ে গেল। আমীর তিরানের আচরণে হতভম্ব।

নীলাভ্র রিম্মির উদ্দেশ্যে বললো,” শুধু আমীরই দুঃসাহস দেখাচ্ছে এইটা বললে ভুল হবে। দুঃসাহস তোমরা সবাই দেখাচ্ছো। কি করে নিশ্চিত হলে তোমরা অন্যগ্রহে পৌছাতে পারবে? যদি এটা সম্ভব হতো তাহলে অন্যগ্রহের ব্যক্তিরা কেনো আমাদের গ্রহে আসছে না?
” ওরা আসছে না বলেই আমরা ধারণা করছি আমাদের পৃথিবীই সময়ের দিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে। তাই প্রথম পদক্ষেপটা আমাদেরকেই নিতে হবে। একটা সময় হয়তো এমনও হতে পারে এক গ্রহ থেকে অন্যগ্রহে মানুষের যাতায়াত এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াতের মতোই সহজ হয়ে যাবে।”
” কিন্তু তোমরা তো অন্য গ্রহে যাচ্ছো না। যাচ্ছো অন্য একটা সৌরজগতে।”
রিম্মি মৃদু হেসে বললো,
” তা অবশ্য ঠিক।”
” তুমিও যাচ্ছো ওদের সাথে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াচ্ছো। আমীরের না হয় মৃত্যু হবে কিন্তু তোমাদের পরিণতি যে আরও ভয়ংকর হবে না তার কি গ্যারান্টি আছে?”
রিম্মি নীলাভ্রর বাধন খুলে দিতে দিতে বললো,” তুমি কি চাও? আমি না যাই?”
নীলাভ্র তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিল,” আমি সাধারণ মানুষ। তোমাকে আটকানোর কে?”
রিম্মি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
” আসলেই, কেউ না তুমি আমার। তবুও আমাকে একটা পরামর্শ দাও তো।”
” কিরকম?”
” আমাকে ছাড়া সঠিক টাইমলাইনের গ্রহ খুঁজে বের করা অসম্ভব। তাই আমি যদি না যাই, কেউ যাবে না। আমার জন্য সবার যাওয়া ক্যান্সেল হতে পারে। তবে আমীরের যাওয়া ক্যান্সেল হচ্ছে না। সে আওয়ানকে নিয়ে ঠিকই চলে যাবে। ওর সাথে আমাদের কিছু স্পেশাল রোবট থাকবে। কিন্তু এতে ওর ফিরে আসার চান্স একদম নেই বললেই চলে। এখন তোমার কি অভিমত? আমার কি ওর সাথে যাওয়া উচিৎ? নাকি আমীরকে একাই যেতে দেওয়া উচিৎ? আমি গেলেই কিন্তু ও ফিরে আসতে পারে। আর একা গেলে কখনও ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। হয়তো সময়ের পাকে অনন্তকালের জন্য আটকে যাবে!”
” রিম্মি, এটা কেমন প্রশ্ন? আমীর যদি তোমার বন্ধু হয় তাহলে অবশ্যই ওর সাথে তোমার যাওয়া উচিৎ। এতোবড় বিপদে ওকে একলা ঠেলে দিতে পারবে?”
রিম্মি একটা মুচকি হাসি দিয়ে নীলাভ্রর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আচমকা ওর গলা জড়িয়ে ধরে ডানগালে ছোট্ট করে চুমু দিল। নীলাভ্র কঠিন চোখে তাকিয়ে বললো,
” হোয়াট দ্যা হেল ইজ দিস?”
রিম্মি সেই ঝলসানো দৃষ্টির তোয়াক্কা না করে হাসিমুখে বললো,
” আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে। এজন্যই আই লভ ইউ।”
রিম্মি হাসতে হাসতে রুম থেকে বের হয়ে গেল। নীলাভ্র কিছুক্ষণ তব্দা লেগে বসে রইল। তারপর যখন উঠে দাঁড়াতে নিবে তখন পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
” এক্সকিউজ মি, আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। খুব জরুরী।”
নীলাভ্র কপালে সুক্ষ্ম চিন্তার ভাজ ফেলে পেছনে তাকালো। ছেলেটি হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পূর্বে এই ছেলেকেই রিম্মির সাথে কথা বলতে দেখেছিল নীলাভ্র। ছেলেটি কোমল হাসি দিয়ে বললো,
” আমি বিদেশী হয়েও কিভাবে ভালো বাংলা বলতে পারছি এটা ভেবে অবাক হচ্ছেন? আসলে এখানে আমরা প্রায় সবাই ভিন্ন দেশী। তাই আমাদের সবার কাছেই একটা ট্রানজিস্টর থাকে। এর মাধ্যমে আমরা যেকোনো ভিন্ন ভাষী মানুষের সাথে কথা বলতে পারি। এখন কিন্তু আমি আমার ভাষাতেই কথা বলছি। কিন্তু আপনি আপনার ভাষায় শুনছেন। আবার আপনি কথা বললেও আমি আমার ভাষায় শুনতে পাবো। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন?”
” বুঝলাম। এখন আপনি কি বলতে চান?”
ছেলেটা কাছে এসে নীলাভ্রর সামনের চেয়ারটায় আয়েশ করে বসলো। এতোক্ষণ রিম্মি এ জায়গায় বসেছিল। ছেলেটা হ্যান্ডশেকের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে বললো,
” আমি রিড ব্রাউন।”
নীলাভ্রও নিজের হাত বাড়িয়ে দিল,” আমি নীলাভ্র পাটোয়ারী। ”
” মিস্টার নীলাভ্র পাটোয়ারী, আপনি কি জানেন? আজকে যদি আপনাকে এখানে তুলে আনা না হতো মানে আপনি যদি বাংলাদেশেই থাকতেন আর এসব কিছুই জানতে না পারতেন তাহলে সন্ধ্যায় রিম্মির সাথে আপনার যে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল সেটা হয়ে যেতো।”
নীলাভ্র কৌতুহলে চোখ ছোট করে বললো,” মানে? ঠিক বুঝলাম না।”
” বুঝিয়ে বলছি, আমরা সবাই সংস্থার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। যদি আমাদের জন্য বাছাইকৃত এক্সেস নোরিপিনাফ্রাইনের ব্যক্তিটির প্রতি আমরা কোনোভাবে দূর্বল হয়ে পড়ি তাহলে তাদের সাথে সারাজীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারবো। তবে সেজন্য এই প্রতিষ্ঠান থেকে আমাদের পদত্যাগ কর‍তে হবে। মানে দুইটার মধ্যে একটা বেছে নেওয়া। হয় প্রতিষ্ঠান না হয় ভালোবাসা। রিম্মি তার ভালোবাসাকেই বেছে নিয়েছিল। ও আপনাকে বিয়ে করে সুখে থাকতে চেয়েছিল। যদিও কাজটা স্বার্থপরের মতো, তবুও আপনার প্রতি ওর ভালোবাসাটা নিখাদ। এটা আমরা সবাই সম্মান করি। আজকে কিন্তু শেষবারের মতো আমাদের সবার সাথে দেখা করে রিম্মির পদত্যাগ করার কথা ছিল। কিন্তু তোহাকে এখানে এনে ঝামেলা করার কারণে প্রফেসর ওকে শাস্তি দিয়েছেন। এখন আর চাইলেও ও আপনার সাথে ফিরে যেতে পারবে না। হয়তো আপনিই ওকে নিতে চাইবেন না। এই সংস্থা আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা শুধু আমরা জানি। কারো জন্য এই সংস্থা ছেড়ে দেওয়া মানে জীবন ছেড়ে দেওয়া। তাহলে বুঝেই নিন কেউ আমাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হলে আমরা তার জন্য প্রাণের সংস্থা পর্যন্ত ছাড়তে রাজি হয়ে যাই। নীলাভ্র, আমি আপনাকে এটাই বুঝাতে চাইছি রিম্মি আপনাকে ভালোবাসে। অনেক বেশিই ভালোবাসে। তাই দয়া করে ওকে ভুল বুঝবেন না।”
নীলাভ্র জবাব না দিয়ে ভ্রু কুটি করে চেয়ে আছে। মনে হয় কথাগুলো ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। রিড বললো,
” আপনাকে এসব বলে কিন্তু আমাদের কোনো লাভ নেই। বরং না বললেই আমাদের লাভ৷ কারণ রিম্মি যদি আমাদের সাথে অভিযানে যায় তাহলে আমাদেরই সবচেয়ে বেশি লাভ। ও না গেলেই আমাদের ক্ষতি হবে।”
” আমি তো ওকে যেতে নিষেধ করিনি।”
” জানি। সেজন্যই আপনাকে সত্যিটা জানাতে এলাম। এই সত্যিটুকু জানার অধিকার আপনার আছে। আর.. আমীরও তোহাকে ভালোবাসে। তবে ওর ব্যাপারটা আলাদা। ও ভালোবাসলেও প্রকাশ করতে পারবে না, কাউকে চাইতে পারবে না। ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে স্বপ্নও দেখতে পারবে না। সেই স্বাধীনতাটুকু ওর নেই।”
” নেই কেনো?”
” কারণটা হচ্ছে মা-বাবা।”
” কার মা-বাবা?”
” আমীরের মা-বাবার কথা বলছি। আমাদের ধারণা এই অভিযানের মাধ্যমে জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার সানাফ সাইফানকে আমরা ফিরে পেতে পারি। আর আমীর ওর মা-বাবাকে ফিরে পেতে পারে। এজন্যই ও অভিযানে যাচ্ছে। কিন্তু তোহার জন্যও কষ্ট পাচ্ছে।কিছুক্ষণ আগেও আমি ওর রুম থেকে ঘুরে এলাম। অবুঝের মতো হু হু করে কাঁদছে বেচারা৷ অথচ আজকে ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন হওয়ার কথা ছিল। নয় বছর ধরে মহাশূন্যে যাওয়ার স্বপ্ন আমাদের আজকে পূরণ হতে চলেছে৷ এইক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উৎসাহই ছিল আমীরের। আমরা কেউ না গেলে ও হয়তো একাই চলে যেতো। ওর এই অদম্য স্পৃহা দেখে আমরাও যাওয়ার আগ্রহ পেয়েছি। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। যদি বেঁচে থাকি তাহলে আপনাদের সাথে হয়তো আবার দেখা হবে। নাহলে..”
” আপনাদের সকলের জন্য শুভকামনা রইলো। সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসুন এই দোয়া করি।”
” ধন্যবাদ।”
নীলাভ্র এখনো বুঝতে পারছে না, ওর কি রিম্মিকে আটকানো উচিৎ? যদি আটকায় তাহলে কাজটা কি স্বার্থপরের মতো হবে?

আমীরের ব্যাক্তিগত ল্যাবরুমে যে লম্বা-চওড়া বিছানাটিতে তোহাকে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে, সেই বিছানার নিচের মেঝে চারপাশ থেকে খানিক উঁচু। বাউন্ডারি দেওয়া স্টেজের মতো। আমীর সেই উঁচু জায়গাতেই হাঁটু বিছিয়ে বসে আছে। ওর মাথাটা দেয়ালে ঠেকানো। একহাত দিয়ে মাঝে মাঝেই তোহার কপাল স্পর্শ করছে সে। তোহার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অতীতের কল্পনায় ডুবে যাচ্ছে। না চাইতেও চোখের কোণায় পানি জমে যাচ্ছে বারবার৷ কান্না আটকে রাখাই যাচ্ছে না। তোহার সাথে দেখা হওয়ার একদম প্রথম দিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত সমস্ত স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। স্মৃতিগুলো ধরা যাচ্ছে না, শুধু অনুভব করা যাচ্ছে। এই মিষ্টি অতীত তাকে প্রখর যন্ত্রণা দেয়। এতো যন্ত্রণা নিয়েই কি অনন্তকাল বাঁচতে হবে? প্রথমদিন তোহার ভীত চেহারা, কম্পিত ঠোঁট, আতঙ্কমাখা চাহনী, স্টেজে প্রাইজ নিতে এসে আমীরকে দেখে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা,আমীরের বুকে ঢলে পড়া, জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর তোহা কেমন উদভ্রান্তের মতো আচরণ করছিল। ওর কথাগুলো এখনো আমীরের কানে ঝংকার তুলে,” মারবেন না, আমায় মারবেন না প্লিজ।”
তারপর হঠাৎ আমীরের গাঁয়ে বমি করে ভাসিয়ে দেওয়া। ওর সেই অসহায় ভয়মাখা চাহনী আমীরের হৃদয়ে কাটার মতো গেঁথে আছে। কিছুতেই ভোলা যায়না৷ তারপর আস্তে আস্তে ওদের মিথ্যে সংসার শুরু হয়, তোহার বাধভাঙ্গা পাগলামী আমীরকে প্রতিনিয়ত ভাবতে বাধ্য করতো, এই মেয়েটিকে রেখে সে কিভাবে চলে যাবে? তোহা যেদিন পূর্ণ ভেজা শাড়িতে অভিমানী মুখে আমীরের সামনে দাঁড়িয়ে আদুরে গলায় বলেছিল, দেখুন কত সুন্দর একটা মেয়ে আমি! আমাকে আপনার আদর করতে ইচ্ছা করে না? আমীরের খুব হাসি পেয়েছিল সেদিন। সে খুব কষ্টে ভ্রু কুচকে আম্ভরিক মুখ বানিয়ে হাসি চেপে রেখেছিল। তখনের কথা মনে পড়লে এখনো হাসি পায় তার। আমীরকে খুশি করার জন্য কত শত কৌশল খাটাতো তোহা। শিউলির কাছে কত কষ্টে রান্না শিখেছিল। কিন্তু তোহা জানে না, সে যেমনই রাধুক আমীরের কাছে তেমনই অমিয়।
বিছানায় দুইহাত রেখে হাতের উপর থুতনি ঠেকিয়ে অনেকটা বাচ্চাদের মতো মুখ করে আমীর বলতে লাগলো,
” জানো তোহা, জীবনে প্রথম যখন তোমাকে দেখেছিলাম, আমি বুকে একটা ধাক্কা অনুভব করি। সেই ধাক্কার পাওয়ার এতোই বেশি ছিল যে আমাকে বাংলাদেশ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছে। কোনো মানুষ এতো আশ্চর্য সুন্দর কিভাবে হয় বলোতো? ছবিতে তোমাকে দেখে আমি প্রথমে মুগ্ধ হয়েছিলাম আর বাস্তবে দেখে তো আমি মোহেই পড়ে যাই। তারপর তোমার সরলতা,পাগলামী,বাচ্চামি আর ছিঁচকাদুনে স্বভাব, সবকিছু ভালোবাসতে শুরু করি। মায়ের মৃত্যুর পর যে হৃদয় পাথর হয়ে গেছিল তোমাকে দেখার পর সেই শুকনো মরুভূমির জগতে প্রথমবার বর্ষণ হয়। কত যে আনন্দের ছিল সেই মুহুর্ত, বলে বুঝাতে পারবো না। তুমি আমার বসন্তকাল। এই তপ্ত মরুভূমির মাঠের মতো জীবনে এক পশলা শীতল বৃষ্টি তুমি। আমার মনের বাগানের সবচেয়ে দামী ফুলটি হচ্ছো তুমি। ও সুগন্ধা, তোমার মন মাতানো সুভাষে আমার মনের বাগান সুভাষিত করতে আরও আগে কেনো এলে না? আমার আহ্লাদী, তোমার কোমলতায় আরও আগে কেনো ঘায়েল করলে না আমায়? অবশ্য তাতেও কোনো লাভ হতো না। আমি দূর্ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে জন্মেছি। আমার অভিশপ্ত জীবনের সাথে তোমার সুন্দর ভবিষ্যৎ জড়িয়ে তোমার নিষ্পাপ জীবনটা কলুষিত করতে চাইনা। তুমি আমাকে ছাড়াই সুখে থাকবে। থাকতেই হবে। যদি জানতাম, আমি ছেড়ে যাওয়ার পর তোমার এই হাল হবে তাহলে কখনও তোমার জীবনে আসতাম না বিশ্বাস করো! তোমার জীবন নিয়ে খেলেছি আমি। অনেক বড় পাপ করেছি। এর শাস্তি তো আমার প্রাপ্য। আমি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো তোহা। আর কোনোদিন হয়তো ফিরে আসা হবে না। তোমায় নিয়ে সংসার বাঁধার স্বপ্ন আমার পূরণ হলো না। এই নিষিদ্ধ স্বপ্ন আমি কেনো দেখেছিলাম? আমারই ভুল, এমন স্বপ্ন তো আমার জন্য নয়। আমার মতো মানুষদের পিছুটান থাকতে নেই। আমাদের জন্য কারো মায়ায় জড়ানো হারাম!”
আমীর কিছুক্ষণ রুদ্ধশ্বাস ছাড়লো। তারপর আবার বললো,
” জানো তোহা, আমি মাকে কথা দিয়েছিলাম, যেভাবেই হোক মায়ের ভয়ানক রোগটি নির্মূলের ফর্মুলা আবিষ্কার করবোই। আমার মাকে আমি নিশ্চয়ই বাঁচাবো। এতো সহজে আমাকে ছেড়ে যেতে দিবো না। আমি তো মায়ের সাহসী ছেলে। আমার প্রতি মায়ের অনেক বিশ্বাস। আমি সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারিনি তোহা। আমি আমার কথা রাখতে পারিনি। মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন বহুদূরে। আমি সেই বিরল রোগের ফর্মুলা ঠিকই আবিষ্কার করেছি কিন্তু অনেক দেরিতে। চৌদ্দ বছর আগেই না ফেরার জগতে হারিয়ে গেছে আমার মা। মা এই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু মাকে দেওয়া আমার প্রমিস এখনো আছে। মনের ছোট্ট কোণে সেই আশার আলোটি উজ্জ্বল শিখা হয়ে টিপটিপ করে জ্বলছে যে আমি আমার মাকে অবশ্যই বাঁচাবো। আমি মায়ের খোঁজে যাচ্ছি তোহা, যদি কখনো মাকে ফিরে পাই তাহলে আমাদের জীবনটা হয়তো বদলে যেতে পারে। তখন হয়তো ধোকাবাজ হয়ে তোমার জীবনে আমায় আসতে হবে না আমায়। আমি ভালো প্রেমিক হয়ে আসার চেষ্টা করবো। নকল স্বামী না, এবার আমি তোমার আসল স্বামী হতে চাইবো। নির্দ্বিধায় তোমাকে ভালোবাসার অধিকার নিয়ে জন্মাতে চাইবো। প্রকৃতি আমায় সেই সুযোগ দিবে তো তোহা?”
আমীরের নিঃশ্বাস আটকে আসছে। সে আর নিজেকে সামলাতে না পেরে বারান্দায় চলে গেল। মায়ের মৃত্যুতেও তার কান্না আসেনি। তাহলে আজ কেনো এতো কান্না আসছে? লায়ভান্টিকা ভালোবেসে একমাত্র ছেলেকে ‘সাহসী সিংহ’ নাম দিয়েছিলেন। কারণ ছোটবেলা থেকেই আমীরের অসীম সাহস। সেই সাহসী ছেলেটা আজকে এতো দূর্বল কেনো হয়ে পড়ছে? মায়ের জন্য পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে যার এক মুহুর্ত ভাবতে হয়নি সে এখন একটা সাধারণ মেয়ের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারছে না? তোহা কি আসলেই সাধারণ মেয়ে? পৃথিবীর কাছে ও সাধারণ হতে পারে কিন্তু আমীরের কাছে তোহা জীবনের আরেক নাম।
আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকালো আমীর। ছলছল চোখে অজস্র নক্ষত্রপুঞ্জ দেখে তার মনে হয় আকাশটা যেন বিরাট এক সমুদ্র। সেখানে মুক্তভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে নক্ষত্ররা। আচ্ছা, লোকে বলে মানুষ মারা গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়? আসলে তারা হয়না। কিন্তু তারাদের মধ্যেই তারা অবস্থান করে। আমীর জানে, এতো লক্ষকোটি গ্রহ-নক্ষত্রের সমাহারে কোথাও না কোথাও তার মা নিশ্চয়ই আছে৷ হয়তো তার অপেক্ষাতেই প্রহর গুণছে। সেই মূল্যবান গ্রহটির খোঁজেই আমীর পৃথিবীত্যাগ করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। এতে যদি তাকে জীবন দিতে হয়, সে দিবে। কিন্তু মায়ের জীবন ফিরিয়ে আনবেই। প্রকৃতির নিয়ম বদলানো অতো সহজ না। কিন্তু এই কঠিন কাজটি আমীর অবশ্যই করে দেখাবে! হঠাৎ পেছনে কারো উষ্ণ স্পর্শ টের পেয়ে অবাক হলো আমীর। পেছনে ঘুরে দেখলো তোহা ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। আমীর সামনে ঘুরতেই তোহা টলমল চোখে আকুল কণ্ঠে বললো,
” কোথায় চলে যাচ্ছেন আপনি? প্লিজ যাবেন না। আর যদি যেতেই হয় তাহলে আমাকেও নিয়ে যান!”
তোহা এতোক্ষণ হুশেই ছিল। বেহুশের ভান করে আমীরের সবকয়টি কথা শুনেছে। আমীর কি উত্তর দিবে এবার? সে যেই জগতে পা বাড়াচ্ছে সেই জগৎ তোহার জন্য নয়৷ এ পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার তোহার কাছ থেকে কেনো কেড়ে নিবে আমীর? তোহা বললো,
” আমাকে না নিলে আমি আপনাকেও যেতে দিবো না।”
আমীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,” তুমি আমাকে আটকাতেও পারবে না।”
তোহা শক্তমুখে বললো,” কে বলেছে পারবো না? আপনি দেখতে চান?”
তোহার কাঠখোট্টা উত্তরে আমীরের বড় হাসি পেল। এবার আর হাসি চেপে রাখলো না আমীর। সত্যি হেসে দিল। তোহা ভ্রু কুচকে বললো,
” হাসছেন কেনো?”
” এমনি।”
” এমনি কেনো হাসবেন? আচ্ছা, আপনি আমাকে ভালোবাসেন না? তাহলে কিভাবে এতো কষ্ট দিতে পারলেন? ছেড়ে যাবেন ভালো কথা, কিন্তু আপনার মৃত্যুর ভুল খবর প্রচার করে যাওয়াটা কি খুব জরুরী ছিল? একবারও মাথায় আসেনি আপনার রক্তাক্ত লাশ আমি কিভাবে সহ্য করবো? আমাকে এতো কষ্ট দিয়ে এখন নিজেই কাঁদছেন? কষ্ট পাচ্ছেন? এসবের মানে কি?”
আমীর জবাব দিল না। তার দৃষ্টি তোহার কোমল ঠোঁটে আটকে গেছে। খুব ইচ্ছে করছে শেষবারের মতো এই ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে দিতে৷ আর কখনো হয়তো সুযোগ হবে না। এইটুকু স্মৃতি নিয়েই সে মহাশুন্যে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দিতে পারবে। আমীর তোহার চিবুক স্পর্শ করে ক্রমশ কাছে আসতে লাগলো। তোহা কিছুটা পিছিয়ে বললো,
” কি হয়েছে?”
আমীর এবারও জবাব দেয়না। সে আসলে তোহার প্রশ্ন শুনতেই পায়নি। একটা ঘোরের মধ্যে হারিয়ে গেছে। তোহার ঠোঁট স্পর্শ করার সৌভাগ্য আমীরের হলো না। ধারালো শব্দে দুজনেরই মনোযোগ নষ্ট হয়ে গেল। বারান্দার দরজার বাহিরে কেউ দাঁড়ানো। আমীর-তোহা একসাথেই বের হয়ে দেখলো তিরান। আমীরের সাদা ডেস্ক টেবিলে একটা ফুলের টব ছিল। সেটা মেঝেতে পড়ে আছে। তিরান টবটা ফ্লোর থেকে তুললো। তারপর ওদের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো। এই হাসি দেখে তোহার মনে হলো ছেলেটা একদম আমীরের মতো হাসে। দেখতেও অনেকটা আমীরের মতো। ও কি আমীরের ছোটভাই? যদি হয়, তাহলে ওকে জুনিয়র আমীর বলা যেতে পারে।

চলবে

( এখন থেকে প্রতিদিন এই সময় গল্প দিবো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here