ধূসর রঙে আকাশ পর্ব_৫৫

0
1017

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৫৫
লিখা: Sidratul Muntaz

পৃথিবীটাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। সবকিছু অন্ধকার, গ্রহগুলোকে ছোট ছোট বলের মতো লাগছে। কত বিচিত্র এই মহাবিশ্ব। কত বিচিত্র ধরণের গ্রহ ভেসে বেড়াচ্ছে কালো আকাশে। মহাশূন্যের এতো লক্ষ-কোটি গ্রহের সমাবেশে কাঙ্ক্ষিত সেই গ্রহটি খুঁজে বের করা কি সম্ভব? আমীরের মায়াবী চোখ দুটো টলমল করছে। শরীরটাকে খুব হালকা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, সে পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হাঁটার প্রয়োজন নেই। ভেসে ভেসেই চলে যাওয়া যাচ্ছে। সবকিছুই ভাসছে। চোখের চশমাটা খুলে কোথাও রাখার প্রয়োজন নেই। হালকা হাতে ছেড়ে দিলেই সেটা ভেসে বেড়াবে৷ দেখতে ভালোই লাগবে। মহাশূন্যে থাকাকালীন মানুষের ক্ষুধা-তৃষ্ণাও হয়তো কমে যায়। তাইতো দীর্ঘ আটঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও আমীর একটুও তৃষ্ণা অনুভব করেনি। শুধু কি তার সাথেই এমন হচ্ছে? হ্যা, শুধু তার সাথেই এমন হচ্ছে। অন্যরা তো খাওয়া-দাওয়া করছে। আমীরই এক জায়গায় চুপ করে বসে আছে। একটু আগে রিড এসে বলে গেল সমস্ত খাবার বিস্বাদ। কিছুই খাওয়ার যোগ্য নেই। কোনোকিছুর স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে না। মহাশূন্যে খাবারের স্বাদগ্রহণের ক্ষমতাও কমে যায় নাকি? এতোকিছু কমে যায়, অনুভূতিগুলো কমে না কেনো? কেনো অনুভূতিগুলো এতো প্রখর থেকে প্রখরতর হয়ে উঠে। বুকের মধ্যে সূচের মতো গেঁথে থাকা ব্যথাগুলো থেকে থেকেই অসহ্য যন্ত্রণা দেয়। কিছুক্ষণ পরই ওরা সবাই একটা শীতলঘরে ঢুকে যাবে৷ সেখানে সবাই নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাবে৷ সেই ঘুম ভাঙবে কোটি বছর পর। তখন হয়তো ওরা নির্দিষ্ট গ্রহটিতে পৌঁছে যাবে। কিন্তু এতোগুলা বছর কেটে যাওয়ার পরেও তাদের মনে হবে মাত্র কয়েক মুহুর্ত অতিবাহিত হয়েছে। একটিবার চোখের পলক ফেলতে যতটুকু সময় লাগে ঠিক ততটুকুই। ওদের বয়স একই থাকবে, শারীরিক অবস্থাও এক থাকবে। পুরোটা সময় ওরা একটা মিষ্টি সুভাষ অনুভব করবে। আমীরের শুধু একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছে। তাদের কাছে যে সময় চোখের পলক ফেলার মতো পৃথিবীতে সেই সময়টুকুই কোটি বছরের সমান। তারমানে আমীর যখন নিদ্রা থেকে জেগে উঠবে তোহা তখন পৃথিবীতেই থাকবে না। কথাটা ভাবতেই আমীরের বুকে তীক্ষ্ণ ব্যথা শুরু হয়। সে বুকের বামপাশ চেপে ধরলো। একটু পানি খাওয়া দরকার। পানির স্বাদও কি বিস্বাদ লাগবে? আমীর অস্পষ্ট গলায় ডাকলো,
” রিড, একটু পানি লাগবে আমার।”
রিড এলো না, পানি নিয়ে এলো সানভী। ওর মুখে আমীরের আঘাতের চিহ্ন স্পষ্টভাবে ফুটে আছে। মাথা নিচু করে আমীরকে কাচের বোতলে পানি দিল সানভী। আমীর একহাত দিয়ে এখনো বুকের বামপাশ চেপে ধরে আছে। ব্যথায় মুখ কুচকানো। এ অবস্থাতেই সানভীর কাছে গিয়ে ওর কাধে হাত রাখলো। অনুতপ্ত হয়ে বললো,
” স্যরি, তোকে আমি মারতে চাইনি। তখন মাথা কাজ করছিল না আমার৷ কি করতে কি করেছি নিজেও বুঝিনি৷ তুই কি কিছু মনে করেছিস?”
সানভী নির্লিপ্ত জবাব দিল,” পানি খা।”
আমীর সামান্য হেসে বললো,” শুনেছি সব খাবারের টেস্ট নাকি পাল্টে গেছে? পানির টেস্ট ঠিকাছে তো?”
সানভী কঠিনমুখে বললো,” জানিনা।”
আমীর দুই ঢোক পানি খেয়ে আর খেল না। তৃষ্ণা মিটে গেছে৷ তার গলা দিয়ে কিছু নামছে না। চোখ বন্ধ করলেই তোহার চেহারা কল্পনায় আসছে। শীতলঘরে গিয়ে যখন সে চোখ বন্ধ করবে তখনও কি তোহার মুখ দেখবে? তাহলে বলা যায়, আমীরের জীবনের কোটি-কোটি বছর কেটে যাবে তোহাকে ভেবেই। সেটাও ভালো। তোহাকে কল্পনা করে সে কোটিবছর কাটিয়ে দিতে পারলে এটাও তার সৌভাগ্য। আমীর যখন এসব ভাবছিল সিপিউরুম থেকে হঠাৎ তীব্র গর্জন ভেসে এলো। রিম্মি, রিড চিৎকার করতে করতে এদিকেই আসছে। স্পেসশীপে মানুষ বলতে মাত্র চারজন। রিম্মি, রিড, সানভী,আমীর। ইউজান, হাসাদ আর হিরোশ ওদের সাথে আসেনি। একদম লাস্ট মোমেন্টে এসে ওদের বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণটা এখনো কেউ জানেনা। আমীরদের সাথে এসেছে সবচেয়ে শক্তিশালী রোবট রায়ান আর আওয়ান। ওরা সিপিউরুমে ছিল। সেখান থেকেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো। রিম্মি আর রিডও ওদের সঙ্গে এসেছে। দু’জনই হাপাচ্ছে। আমীর আর সানভী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমীরই প্রথম জিজ্ঞেস করলো,
” কি হয়েছে?”
রোবট রায়ান বললো,” দ্যা গ্যাস ইজ লিকিং। আফটার সাম টাইম দ্যা স্পেসশীপ উইল স্টপ।”
আমীর ভ্রু কুচকে বললো, ” হোয়াট? এটা কিভাবে হলো? এখন কি হবে?”
রিড বললো,” এখনি মহাকাশ স্টেশনে খবর পাঠাতে হবে। সেইম আরেকটা রকেট পাঠানোর জন্য।”
সানভী বললো,” সেইম আরও একটা রকেট? এই রকেট মহাকাশ স্টেশনে দ্বিতীয়টা আছে?”
রিড বললো,” জানিনা, এছাড়া আমি আর কোনো উপায় দেখছি না। আদারওয়াইজ আমাদের পৃথিবীতে ফিরতে হবে। আর কোনো উপায় নেই।”
আমীর অনেকটা গর্জনের সহিত বললো,” অসম্ভব। পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার জন্য সবকিছু বিসর্জন দিয়ে এখানে আসিনি আমি।”
রিম্মি বললো,” তাহলে আর কি করতে চাও তুমি? আমরা কেউই বাঁচবো না এখানে থাকলে।”
আওয়ান বললো,” যে পরিমাণে গ্যাস লিক হচ্ছে তাতে একটু পর সবাই এমনিই মরে যাবে৷ মহাকাশ স্টেশনে খবর পৌঁছানোর আগেই বিষাক্ত গ্যাস তোমাদের গ্রাস করে ফেলবে।”
আমীর চিৎকার দিয়ে বললো,” ওহ নো, মহাকাশ স্টেশনের লোকগুলো এতো কেয়ারলেস কিভাবে হয়? এই বিপজ্জনক রকেট কেনো আমাদের সাথে পাঠানো হলো?”
সানভী ভয়ে কাবু হয়ে গেছে। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,” তাহলে এখন বাঁচার উপায় কি?”
আওয়ান ভারী গলায় জবাব দিল,” কোনো উপায় নেই। সবাই মরে যাবে তোমরা।”
রিম্মি অবাক হয়ে জানতে চাইলো,” শুধু আমাদের কথা কেনো বলছো? তুমি নিজে কি মরবে না? অমর থাকবে?”
আওয়ান দানবের মতো উচ্চশব্দে হাসলো। এরপর বললো,” আমার জন্য আমার বস বিশেষ নেবুলাইজার তৈরী করে দিয়েছেন। যার সাহায্যে আমি রকেটের বাহিরেও ভেসে ভেসে শ্বাস নিতে পারবো। তারপর উপযুক্ত সময়ে মহাকাশ স্টেশন থেকে স্পেসশীপ এসে আমাকে আর রায়ানকে উদ্ধার করবে। ততক্ষণে আমার কাজ হলো তোমাদের সবাইকে মেরে ফেলা। ”
আমীর আওয়ানের কথায় প্রচন্ড চমকে উঠে। আওয়ানকে এই মুহুর্তে খুব বিভৎস দেখাচ্ছে। কি বিদঘুটে ভঙ্গিতে হাসছে সে! সানভী কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
” তোমার বস মানে? আমীরই তো তোমার বস। ওকেও তুমি মেরে ফেলতে চাও?”
আওয়ান বাঁকা হেসে বললো,” সে আমার বস ছিল। কিন্তু সেটা পাঁচমাস সতেরো দিন পনেরো ঘণ্টা এগারো মিনিট আর বাইশ সেকেন্ড আগে। এখন আমার বস সে-ই যে আমাকে এই মহাকাশ থেকে উদ্ধার করবে।”
রিড বললো,” কে সে?”
আওয়ান বললো,” স্যার হাসাদ আর্সলান, মাই বস।”
রিম্মি ক্ষোভ নিয়ে বললো,” তাহলে এইসব কিছু হাসাদের কাজ? ও ইচ্ছে করেই রকেটের ফুয়েল লিক করিয়েছে যাতে আমরা সবাই এখানে আটকা পড়ে যাই। আমীর তুমি কি কিছু বুঝতে পারছো? সে আওয়ানকেও হাত করে ফেলেছে আমাদের মেরে ফেলার জন্য। ”
রিড বললো,” কিন্তু হাসাদ এমন কেনো করবে? ও তো আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড। ”
রিম্মি বললো,” মনে নেই? আমীরের সাথে হাসাদের রেষারেষি ছিল। তোহার বায়োডাটা নিয়ে। প্রফেসর ট্রুডো যখন তোহার বায়োডাটা ডিস্কে রেখেছিলেন তখন আমীর আর হাসাদ দুজনে একই বায়োডাটা চুজ করেছিল। ওদের একই মেয়ে পছন্দ হয়। তারপর দুজন ঝগড়া লেগে যায়। প্রফেসর আমীরকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেদিন থেকেই হাসাদ আমীরের উপর ক্ষোভ পুষে রেখেছে। আর সেই ক্ষোভ এতো জঘন্যভাবে প্রকাশ করছে। সবকিছুর শোধ তুলছে ও। আমীর মরে গেলে তো ওর লাভ। তোহাকে সহজেই পেয়ে যাবে।”
রিড তাচ্ছিল্যতার সাথে বললো,” সো লেইম! সামান্য একটা মেয়ের জন্য হাসাদ আমাদের সাথে এতোবড় বেঈমানী করবে? এটা আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।”
সানভী বললো,” আমার কষ্ট হচ্ছে না। আমি বিশ্বাস করি এই কাজ হাসাদই করেছে। ও একটা চরম বিশ্বাসঘাতক।”
রিড আওয়ানের উদ্দেশ্যে বললো,” তাহলে তো বিশ্বাসঘাতক তুইও। তুই আমাদের সাথে কি করছিস? এতোদিন আমীরের পা চাটা কুকুর হয়ে ছিলিস। আর এখন হাসাদের হয়ে গেলি? এতো সহজে পল্টি মারলি? এখন তুই আমাদের মেরে ফেলতে চাস?”
সানভী বললো,” ওকে এসব বলে লাভ নেই। আরে ওর মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে? ও তো দয়া-মায়াহীন একটা জন্তুর মতো। কৃতজ্ঞতার সংজ্ঞা ও জানেনা। ও শুধু জানে স্বার্থবাজী।”
এতো কথার মাঝখানেও আওয়ান নির্বিকার। সে নেবুলাইজার পড়ে অপেক্ষায় আছে কখন বিষাক্ত গ্যাস সম্পূর্ণ স্পেসশীপে ছড়িয়ে পড়বে। একে একে সবাই লুটিয়ে পড়বে। না, লুটিয়ে পড়বে না। ওদের দূর্বল শরীরটা মহাকাশে ভেসে বেড়াবে। এই মুহুর্তে আওয়ানের কাছে সেই দৃশ্য দেখার চাইতে আনন্দায়ক আর কি হতে পারে? আমীর আচমকা ধেয়ে আসলো আওয়ানের দিকে। প্রবল আক্রোশে আওয়ানের গলা চেপে ধরে চিৎকার দিয়ে বললো,
” বিশ্বাসঘাতক!”
আমীর আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। আওয়ান তার গাবদা গাবদা হাতে আমীরকে উঠিয়ে ছুড়ে ফেললো জানালার দিকে। কাচের জানালায় মাথা লেগে আমীরের কপাল কেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। চোখ দুটো নিভু নিভু হয়ে যায়। রিম্মি, সানভী, রিড দ্রুত এগিয়ে আসলো আমীরকে ধরতে। রোবট রায়ান বুঝতে পেরে এগিয়ে যেতে নেয়। কিন্তু আওয়ান ওকে আটকে ফেলে। রোবট রায়ানকে নিয়ে সিপিউ রুমে ঢুকে যায় আওয়ান। এখন ওদের অপেক্ষা চারটি ভাসমান লাশের। আমীরের মাথা ফেটে বাহিত রক্তগুলো ভাসছে৷ প্রতিটা কণা আলাদা হয়ে চোখের সামনেই উড়ে বেড়াচ্ছে। কি নিদারূণ দৃশ্য! রিম্মি কাঁদছে। ওর চোখের পানিগুলো টুপটুপ করে গড়িয়ে পড়ছে না। চোখ থেকে গড়িয়ে গাল স্পর্শ করার আগেই সেগুলো ভেসে যাচ্ছে। একটু পরেই সবাই শ্বাস নিতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়।নাক থেকে ফুসফুস পর্যন্ত বিষের যাতনায় ক্লিষ্ট হয়ে সকলে নাকমুখ ঢেকে শ্বাসরোধ করে রাখলো। এভাবে আর কতক্ষণ বেঁচে থাকা যায়? সর্বোচ্চ পাঁচমিনিট! তারপরই সব শেষ। সবাই শেষ!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here