#বাঁধন_ছেঁড়া_প্রেম
#যারিন_তাসনিম
#পর্ব :০৮
ড্রেসিংটেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রাহা শাড়ির কুচি ঠিক করছে। আর পাশে রাব্বি অসহায়ভাবে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে আছে। কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। শাড়ির কুচি ঠিক করে আঁচল ঠিক করতে করতে রাহা বলল,
“কি হয়েছে?”
রাব্বি ড্রেসিংটেবিলের উপর বসে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো, আপু?”
রাহা রাব্বির মাথা আয়নার সামনে থেকে সরিয়ে আঁচলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি আর সিদ্ধী সারি ঘাট যাচ্ছি।”
রাব্বি দাঁড়িয়ে বলল,
“আমাকেও নিয়ে চলো না।”
আড়চোখে তাকিয়ে রাহা বলল,
“এস.এস.সি এক্সাম নিয়ে তো কোনো মাথা ব্যথা নেই তোর। অথচ, আমি টেনশনে পাগল হয়ে যাচ্ছি। যার বিয়ে, তার খবর নেই; পাড়া-পড়শীর ঘুম নেই।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তোমাকে ঘুমাতে কেউ নিষেধ করে নি। তুমি ঘুমাও, আমি আমার বিয়ে নিয়ে অনেক ভাবি।”
চুল সবগুলো পিছনে নিয়ে ক্লিপ দিয়ে বেঁধে রাহা বলল,
“তুই যে কেমন ভাবিস, তা আমার জানা আছে ভালোভাবে। এখন এসব বলে লাভ নেই। তোকে অন্য কোনোদিন নিয়ে যাবো।”
রাব্বিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাহা ব্যাগ নিয়ে আবার বলল,
“আর কোনো কথা নয়। যা পড়তে বস। আমি কথা দিচ্ছি, তোকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবো। আমার দেরি হচ্ছে। মা আসলে মা’কে বলে দিস, সারি ঘাট যাচ্ছি সিদ্ধীর সাথে।”
রাহা বেরিয়ে গেল। গাড়িতে উঠে সিদ্ধীকে ফোন দিয়ে জানালো, সে বেরিয়ে গেছে। সিদ্ধী যেন দ্রুত বাসার নিচে আসে। সিদ্ধীকে নিয়ে দুজন প্রথমে কেরানীগঞ্জ যায়। কেরানীগঞ্জ গিয়ে গাড়ি থেমে যায়। সিদ্ধী ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে,
“আংকেল, গাড়ি থামালেন কেন? এখনো অনেকটা পথ বাকি।”
ড্রাইভার পিছন ফিরে বলে,
“ম্যাডাম বলেছে, কেরানীগঞ্জ অবধিই আসবে।”
সিদ্ধী রাহার দিকে তাকায়। রাহা হেসে বলে,
“আগে নাম। পরে সব বলছি।”
গাড়ি থেকে নেমে সিদ্ধী রাহাকে বলে,
“এখানে কেন নামাতে বলেছিস?”
রাহা আঙুল দিয়ে কিছু একটা দেখায়। সিদ্ধী সেদিকে তাকিয়ে দেখে, বেশ কয়েকটা লেগুনা দাঁড়িয়ে আছে। সিদ্ধী লাফিয়ে উঠে বলে,
“আমরা লেগুনায় যাবো?”
সিদ্ধীর লাফানো দেখে রাহা হেসে উঠে। বলে,
“হ্যাঁ। এতদিন পর সারি ঘাট যাচ্ছি। গাড়িতে গিয়ে মজা নষ্ট করবো নাকি।”
সিদ্ধী রাহার হাত ধরে দৌড় দেয় লেগুনার দিকে। দুজন লেগুনার দুপাশে বসে। সিদ্ধী ঝুঁকে বসলো। বলল,
“আমার নাচতে ইচ্ছে হচ্ছে। পাবলিক প্লেস দেখে নাচতে পারছি না।”
রাহাও ঝুঁকে বলল,
“তুই পাবলিক প্লেসকে কবে থেকে পাবলিক ভাবা শুরু করলি?”
“যেদিন তাশরিকের প্রেমে পড়েছি, ঠিক সেদিন থেকেই।”
বলেই মুখে হাত দিল। আওয়াজ করে হেসে রাহা বলল,
“নেশায় ভরা সাগরে ডুব দিয়েছিস। যেই নেশা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবি।”
মুখ থেকে হাত সরিয়ে ফেলল সিদ্ধী। রাহাকে একবার দেখলো। লেগুনার হেল্পারকে ১০০ টাকা দিল। জন প্রতি ভাড়া ৫০ টাকা।
১১ টা বাজতেই গরম বাড়তে শুরু করলো। রাহা তার শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে নিল। ২০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেল দু’জন।
লেগুনা থেকে নেমেই সিদ্ধী ঘাটে গিয়ে নৌকা ভাড়া করে।
নৌকায় শুধু সিদ্ধী আর রাহা। অপরদিকে মাঝি। সিদ্ধী রাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“জানতে চাইবি না কেন সারি ঘাট আসতে চেয়েছি?”
পা গুটিয়ে বসে রাহা বলল,
“নাহ, জানতে চাওয়ার কি আছে। আমি জানি যে, তুই আজ কোনো বিশেষ মুহূর্তের কথা বলবি। তাই তোর পছন্দের জায়গায় নিয়ে এসেছিস।”
সিদ্ধীও পা গুটিয়ে বসল। বলল,
“হুম। জানিস, সেদিন তাশরিককে খুব বেশিই সুন্দর লাগছিল। একদম নায়কের মত। নাহ, নায়কের থেকেও বেশি সুন্দর লাগছিল। আমি ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছি। মনটা উড়ুউড়ু করছিল। আফসোস করছিলাম যে, কেন শাড়ি পরে যাই নি। শাড়ি পরলে ওর সাথে আমাকে একটু হলেও মানাতো। ও কি সুন্দর, কি ফর্সা গায়ের রং! সাদা-কালো পাঞ্জাবিটা একদম ফুটে উঠেছিল ওর গায়ে।”
সিদ্ধীর গলা কাঁপছে। রাহা সিদ্ধীর দিকে তাকিয়ে দেখে, সিদ্ধীর চোখ টলমল করছে। সিদ্ধীর হাত চেপে ধরে রাহা বলল,
“কাঁদছিস কেন?”
অপরদিকে থাকা কাশফুলের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধী বলল,
“আমার গায়ের রং ময়লা। ওর সাথে আমাকে একটুও মানায় না। মনে আছে, কলেজের অনুষ্ঠানের সময় তুই আর আমি কালো রঙের শাড়ি পরেছিলাম। সবাই তোর কত প্রশংসা করেছিল। কিন্তু আমাকে দেখে সবাই মুখ খিঁচেছিল। যেন কি পাপ করেছিলাম, সেদিন কালো রঙের শাড়িটা পড়ে।”
রাহা সিদ্ধীর হাত থেকে জোরে নিজের হাত সরিয়ে বলল,
“তোকে কতবার বলবো, বাহ্যিক সৌন্দর্য আসল নয়। আর সমাজের নিচু মনের মানুষদের মুখ সারাজীবনই খিঁচানো থাকে। আসলে তোর মন-মানসিকতাও নিচু। এজন্য সুন্দর সুন্দর করিস। তাশরিক ভাইয়ার মন অনেক ভালো। তোর মত নিচু না। যদি নিচু মনের মানুষ সে হত, তবে তোকে এভাবে মনেপ্রানে ভালোবাসতো না। ভাইয়া যখন তোর সাথে কথা বলে, তখন ভাইয়ার চোখের দিকে তাকাবি। চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা থাকলে বুঝে যাবি, ভাইয়া তোকে কতটা ভালোবাসে। আমার সাথে আর কথা বলবি না।”
চোখে পানি থাকা সত্ত্বেও সিদ্ধী হাসলো। বলল,
“রাগ করিস না। আসলে তাশরিকের আম্মুও আমাকে পছন্দ করেন না। গায়ের রং আর আর্থিক অবস্থার কারণে। একপ্রকার জোর করেই বিয়েটা করছে তাশরিক। এভাবে নিজের মা-কে কষ্ট দিয়ে বিয়ে করা উচিত?”
রাহা পানি নিয়ে সিদ্ধীর মুখে ছিটিয়ে বলল,
“ভাইয়ার আম্মু তোকে কতটুকুই বা চিনে যে, তোকে পছন্দ করবে?”
পা দুটো পানিতে ডুবিয়ে বসলো সিদ্ধী। রাহাও পানিতে পা দিল। বলল,
“কিরে? উত্তর দে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিদ্ধী বলল,
“তুই বুঝতে পারছিস না।”
ফোনের রিংটোন বাজতেই সিদ্ধী ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ভয়ার্ত চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ভ্রুকুটি করে রাহা বলল,
“কে ফোন করেছে?”
কাঁপা গলায় সিদ্ধী বলল,
“তাশরিক।”
রাহা চোখ বড় করে বলল,
“তাড়াতাড়ি ফোন ধর। লাউডস্পিকার দে।”
ফোন রিসিভ করে লাউডস্পিকার দিল সিদ্ধী। ওপাশ থেকে তাশরিকের কণ্ঠ আসলো,
“সিদ্ধী, তুমি কোথায়?”
সিদ্ধী রাহার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি বলবে। রাহা ইশারা দিয়ে বলতে বলল, সে বাসায়ই আছে। সিদ্ধী আমতা আমতা করে বলল,
“বা..সা..য়।”
তাশরিক জানালার গ্রিলে হাত রেখে এক নিঃশ্বাসে বলল,
“শোনো, সিদ্ধী। আমরা খুলনা যাবো। মানে আমি, নিয়াজ আর তুমি। আমার দাদু খুব অসুস্থ। তিনি আমাদের বিয়েতে আসতে পারবেন না। তাই আমার দাদুর ইচ্ছে, তোমাকে দেখার। তোমার বাসায় আমি জানিয়েছি। আন্টি, আংকেল মানে তোমার বাবা, মা রাজি আছেন। তুমি রাজি তো?”
চলবে,