বাঁধন ছেঁড়া প্রেম শেষ পর্ব :

0
1742

#বাঁধন_ছেঁড়া_প্রেম
শেষ পর্ব:
#যারিন_তাসনিম

“আজ আমরা বিয়ে করছি, রাহা।”
এই লাইনটা বার চারেক পড়ে ফেলেছে রাহা। মন আকাশে হু হু করে সুখের বাতাস বইছে। লাইনটা বারবার পড়ে সুখের বাতাসের তীব্রতা বাড়াচ্ছে সে। মুহূর্তেই সে হাজারটা কল্পনা করতে শুরু করলো। নিয়াজ আর রাহার একটা সংসার হয়েছে। খুব ভোরে উঠে রাহা চা বানিয়েছে নিয়াজের জন্য।

রাহা কেঁপে উঠলো। ভয় পেয়ে গিয়েছে। পিছন থেকে কেউ ধাক্কা মেরেছে। পিছে তাকিয়ে দেখলো, নিয়াজ হো হো করে হাসছে। কত সুন্দর একটা কল্পনার রাজ্যে ছিল সে। আর ছেলেটা এসে সব ভেঙে দিল। রাহা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। থুতনিতে হাত রেখে মুখ উঠিয়ে নিয়াজ বলল,
“সেদিন ছাদে তোমাকে যখন আমি জড়িয়ে ধরেছিলাম, ভেবেছিলাম, সেই সুখময় সময়টা স্বল্প। খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে। তাই নীরব থেকে সেই সময়টায় শুধু তোমাকে অনুভব করেছিলাম। যাতে ছেড়ে দেওয়ার পরও সুখের রেশ বহুবছর ধরে না কাটে। তুমি ছাদ থেকে চলে আসার পরও সেই স্পর্শ তুমিবিহীন অনুভব করতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু সেদিন আমার করা সব ধারণা ভুল ছিল। তুমি আমার কাছে সবসময়ই শুধু আমার ছিলে। আর আজ পুরো পৃথিবীর কাছে তোমাকে কাগজে কলমে আমার করবো। আমাদের বাঁধন ছেঁড়া প্রেমের সমাপ্তি আজ ঘটাবো।”
কথাগুলো বলে রাহার কপালে পুলকিত স্পর্শ এঁকে দিল নিয়াজ। রাহা চোখগুলো দৃঢ়ভাবে বন্ধ করে ফেলল। নিয়াজও চোখ বন্ধ করে শুধু রাহাকে অনুভব করতে শুরু করলো। রাহার গালে নিয়াজ তার ঠোঁট স্পর্শ করতেই জল অনুভব করলো। চোখ খুলেই বলল,
“তুমি কাঁদছো?”
রাহা চোখ খুলে নিয়াজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমাকে জড়িয়ে ধরো, প্লিজ।”
নিয়াজের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। আজ জড়িয়ে ধরার জন্য সেদিনের মতো অনুমতি চাইতো না নিয়াজ। কিন্তু রাহাই এখন নিজ থেকে তাকে জড়িয়ে ধরার জন্য বলছে। নিয়াজও দু’হাত দিয়ে রাহাকে জড়িয়ে নিল।

হাইইইইচ্চু…….
কাশির শব্দে নিয়াজ রাহাকে ছেড়ে দিল। রাহার মনে পড়লো, এখানে রাব্বি, সিদ্ধী, চন্দ্রিমা আছে।
আড়াল থেকে সবাই বেরিয়ে পড়লো। রাব্বি বলল,
“সরি, ভাইয়া। একটু ঠান্ডা লেগেছে, তাই কাশিটা আপনাদের রোমান্সের সময় এসে পড়লো।”
সিদ্ধী রাহাকে বলল,
“কিরে, তুই এত বেলাজ হয়ে গিয়েছিস যে, নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড, ভাই, বোন সবার সামনে রোমান্স শুরু করে দিয়েছিস।”
রাহা লজ্জায় নুয়ে পড়ছিলো। তার মনে থাকলে সে কখনোই এমন কিছু করতো না। নিয়াজ রাহার লজ্জা ঢাকতে বলল,
“অন্তত আমার পিচ্চি শালা এখানে ছিল, তা জানলে আমি কখনোই এখানে রোমান্স করতাম না।”
রাব্বি মুখ ফুলিয়ে বলল,
“দুলাভাই, আই এম এনাফ ম্যাচিউরড। আর আপনি খুব খারাপ, আপনাকে বলেছিলাম আমার এস.এস.সির পর ডেট ফিক্সড করতে। আর আপনি কিনা আজই আমার বোনকে নিয়ে বিয়ের পিড়িতে বসছেন।”
নিয়াজ কিছু বলার আগেই রাহা রাব্বির কাছে গিয়ে কান মলে দিয়ে বলল,
“বেয়াদব ছেলে, আমার ভাই হয়ে তুই ওর হয়ে কাজ করেছিস। আর আমাকে কিছু জানাসও নি।”
রাব্বি ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
“আরে আপু, তোমাকে বললে তো এতকিছু হতোই না। আর এইযে, আব্বু আম্মুকে রাজি করানো, ওই বুইড়া বেটার সাথে বিয়ে ভাঙা সব তো আমিই করেছি।”
রাহা রাব্বির কান ছেড়ে দিয়ে বলল,
“আম্মু, আব্বু জানে?”
রেশমি মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে এসে বলল,
“হ্যাঁ গো, জানে। তবে রাব্বি একা সব করে নি, ওকে আমিও সাহায্য করেছি।”
কথাগুলো বলেই রেশমি একটা মিষ্টি রাহার মুখে পুরে দিল। রাহা রেশমিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“রেশমি আপু, তুমি সবসময় আমাদের আগলে রেখেছো। বিশেষ করে আমাকে। এতবছর আমি কতটা ডিপ্রেশনে ছিলাম, তুমি জানোই। এত এত ঋণ আমি কীভাবে শোধ করবো, আমার জানা নেই। আজ তুমি আমায় দোয়া করে দাও, যাতে ওই ঘাড়ত্যাড়া ছেলের সাথে আমি সুখী হই।”
সবাই হেসে দিল। রেশমি রাহাকে ছেড়ে দিয়ে রাহার মাথায় হাত রেখে বলল,
“তোমরাও যে আমাকে এতবছর আগলে রেখেছো, তাতেই সব ঋণ শোধ হয়ে গিয়েছে। আর এই রেশমি দোয়া করে দিল, সেই উত্তম ঘাড়ত্যাড়া ছেলেটার সাথে যাতে তুমি আজীবন সুখী হও।
চন্দ্রিমা হঠাৎ বাহিরে গিয়ে ফিরে এসে বলল,
“কাজী এসে গিয়েছে।”

অনেক অপেক্ষার পর রাহা, সিদ্ধী আর তাশরিকের পরিবার উপস্থিত হলো।
রাহার জন্য যেই পাত্রকে ঠিক করা হয়েছিলো, সে নিয়াজের থেকেও ভালো পদে আছে। তাই শিউলি আমিন খুব একটা খুশি ছিলেন না। তবুও মেয়ে এতবছর যেই ছেলের জন্য বিয়ে করেনি, এখন সেই ছেলেকে পাওয়ার পর তিনি তার মেয়েকে জোর করে অন্য কারো কাছে বিয়ে দিয়ে অসুখী বানাতে চান না।

বিয়েটা অনানুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হলো। একটা সময় রাহার খুব ইচ্ছে ছিল, ধুমধাম করে হলুদের অনুষ্ঠান করবে। নিয়াজের হাতে হলুদের ছোঁয়া পাবে। এরপর বিয়ে হবে। অনেক ফটোসেশন হবে। কিন্তু সেসবের কিছুই হয় নি। তবুও নিয়াজ কমসময়ের মধ্যে ফটোগ্রাফার এনেছে। এই অল্প কয়েকজনকে নিয়েই ফটোসেশন হয়েছে।
মানুষের সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। কিন্তু রাহার জীবনের সবথেকে বড় স্বপ্নটাই পূরণ হয়েছে। তাই আজ তার খুশির অন্ত নেই।

এই মুহূর্তে রাহা আর নিয়াজ হাতিরঝিলের ফাঁকা রাস্তায় আছে। নিয়াজ গাড়ি চালাচ্ছে। আর হালকা সাজে পাশে রাহা বসে আছে।
এখন ঘড়িতে রাত ১২টা বাজছে। রাহা নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তখন ছোট ছিলাম। আর সেই ছোটবেলায় একটা বড় স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেটা হচ্ছে, তোমায় বিয়ে করে আমরা বিয়ের রাতে লং ড্রাইভে যাবো। আর স্বপ্নটা শুধু মনে পুষে রাখিনি, তোমাকেও জানিয়েছিলাম। তাই আজ সেই স্বপ্নটা নিজ দায়িত্বে পূরণ করছো, তাই না?”
নিয়াজ হ্যাঁ-বোধক উত্তরে মাথা নাড়ালো। রাহা আবার বলল,
“ভেবেছিলাম, তুমি ইরেসপন্সিবল। এখন দেখছি, একদমই ইরেসপন্সিবল নয়। ইরেসপন্সিবল হলে আমার স্বপ্নটা মনে রাখতে না। আচ্ছা তোমারও তো রাতের জার্নি খুব পছন্দ, তাই না?”
নিয়াজ হেসে জবাব দিল,
“হুম, খুব। আমরা যে গ্রামে গিয়েছিলাম না? তখন রাতের সময়টা আমিই নির্ধারণ করেছিলাম। ভেবেছিলাম, তোমার সাথে হয়তো কখনো জার্নি করা হবে না। তাই সেদিন আমার পছন্দের সময়টা নির্ধারণ করেছিলাম।”
রাহা অবাক হয়ে বলল,
“আমি আরো সেদিন ভাবছিলাম, কে এই রাতের সময় ঠিক করলো। এত দূরের রাস্তায় রাতে গাড়ি চালানো খুব ঝুঁকিপূর্ণ।”
কথাগুলো বলেই রাহা নিয়াজের এক হাত জড়িয়ে হাতের উপর মাথা রাখলো। আবারও কথা বলতে শুরু করলো।
নিয়াজ একহাত দিয়ে ড্রাইভ করছে। আর যেই হাত রাহা জড়িয়ে রেখেছে, সেই হাত দিয়েই রাহার হাত ধরে রাখলো। ভাবতে থাকলো, আজ নিয়াজের করা সব কাজ সার্থক হয়েছে। কারণ, রাহা তার আগের রূপে আবার ফিরে এসেছে। আবার আগের মতো মন খুলে কথা বলছে।
আজ তার করা কাজগুলোই শুধু সার্থক নয়, তার জীবন সার্থক।
হাতিরঝিলের রাস্তায় জ্বলা আলোগুলো যেন তার গোটা জীবনে ছিটকে পড়ে আলোকিত করে দিচ্ছে।

“হ্যাপি ফিফথ ম্যারেজ এনিভার্সারি, সিদ্ধী।”
বলেই গিফটের বক্সটা সিদ্ধীর হাতে দিল, রাহা। আজ সিদ্ধীর পঞ্চম বিবাহবার্ষিকী। তাশরিক প্রত্যেকবারের মতো এবারও বেশ বড় করে আয়োজন করেছে।
তাশরিকের মা এসে সিদ্ধীকে বলল,
“মা, রাহাকে বসতে বলো। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি।”
বিয়ের প্রথম বছরেই সিদ্ধী নিজের গুণ দিয়ে মানুষটার মন জয় করে নিয়েছে। তাশরিক ঠিকই বলেছিল, তার মা অতটাও খারাপ নয়। তাই সিদ্ধীর আপন করে নিতে বেশি সময় লাগেনি। আর মানুষটাও খুব জলদি তাকে নিজের দ্বিতীয় মেয়ে ভেবে নিয়েছে।
সিদ্ধী মাথা নাড়িয়ে রাহাকে বসতে বলল।
“হ্যাপি পিপথ ম্যালেজ এনিভার্সালি, খালামনি।”
গলার স্বর অনুসরণ করে সিদ্ধী নিচে তাকালো। এরপর হেসে রাত্রীকে কোলে নিয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ, মামুনি। কত্ত বড় হয়ে গিয়েছে আমার মামুনিটা।”
রাহা সিদ্ধীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“সঙ্গে বেশ দুষ্টুও হয়েছে।”
রাত্রী সিদ্ধীর কোল থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে রাহার গাল ধরে বলল,
“আমি দুষ্টু হইনি, মাম্মাম। তুমি দুষ্টু। তুমি আমাল সামনে পাপ্পাকে আদল কলো, আমাকে কলো না।”
রাহা আশেপাশে তাকিয়ে সিদ্ধীকে বলল,
“দেখেছিস, এই মেয়ে একদিন মান সম্মান খাবে। যদি কেউ শুনে ফেলতো।”
অহনা সিদ্ধীর কোল থেকে রাত্রীকে নিয়ে বলল,
“একদম আমাদের সোনাপাখিটার দোষ দিবা না। তুমি আমাদের সোনাপাখিটাকে আদর না করে অন্য কাউকে করবে,আর সে সেটা অভিযোগ করবে না?”
রাত্রী অহনার গলা জড়িয়ে বলল,
“এইত্তো, আমাল ফুপিটা সবথেকে ভালো।”

“অহনা, একটু এদিকে আসবে?”
একটা ছেলের ডাকে অহনা রাত্রীর গালে চুমু দিয়ে সিদ্ধীর কোলে দিয়ে চলে গেল। রাহা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে সিদ্ধীর দিকে তাকালো।সিদ্ধী বলল,
“এটা অহনার হবু হাজব্যান্ড। তাশরিক বলেছে, আমাদের বিবাহবার্ষিকী শেষ হলে ওদের বিয়ের ডেট ফিক্স করা হবে। জানিস, ছেলেটা খুব ভালো। অনেক কপাল করে এমন একটা ছেলে পেয়েছে অহনা। খুব ভালোবাসে। শুধু বাসেই না, অহনাকেও ভালোবাসিয়ে ছেড়েছে। আল্লাহ ওদের ভালো রাখুক।”
রাহা খুশি হয়ে বলল,
“ইন শা আল্লাহ, ভালো রাখবে।”

তাশরিক নিয়াজকে অহনার বিয়ের ব্যাপারে বলল। নিয়াজও বেশ খুশি হলো। পরপরই নিয়াজ বলল,
“কিন্তু ব্যাটা, তুই বাচ্চা নিবি কবে?”
তাশরিক জিহবায় কামড় দিয়ে বলল,
“এমন সব প্রশ্ন করিস তুই। তোদের মিষ্টিমুখ করাবো খুব শীঘ্রই।”

রাতে রাত্রীকে ঘুম পাড়িয়ে নিয়াজ রাহাকে ডেকে অন্য রুমে আনলো। এরপর রাহাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আজ তোমার মেয়েকে আমি ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। এবার আমি তোমাকে অনেকগুলো আদর দিবো।”
কথাটা বলেই নিয়াজ রাহার ঠোঁটে ঠোট বসালো।
“পাপ্পা, তুমিও আমাকে আদল না কলে মাম্মাকে কলছো?”
রাত্রীর গলা পেতেই নিয়াজ দূরে সরে গেল।।মাথায় হাত চাপড়ে বলল,
“তোমার মেয়ের পায়ে একটা নূপুর লাগিয়ে দিয়ো, যাতে ও আসার সময় আমরা আগেই টের পেয়ে যাই।”

সমাপ্ত,

গল্পের শেষে শুধু একটা জিনিস জানতে চাইবো, সবার গল্পের কোন চরিত্রটা সবথেকে ভালো লেগেছে? 🙃
আসলে প্রত্যেকটা চরিত্র আমি মনের মতো করে সাজিয়েছি। 😇কোনো চরিত্রকেই অবহেলা করিনি। তাই এটা জানতে চাওয়া।
যারা কখনো মন্তব্য করেননি, তারাও উত্তরটা দিয়ে যাবেন।☺️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here