শব্দহীন_অনুভূতি পর্ব_১৩

#শব্দহীন_অনুভূতি পর্ব_১৩
#পলি_আনান
#

রুমের দ্বারের সামনের পর্দাটায় আড়াল হয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হৃদিতা।তার সামনেই আরাফ আর সুফিয়া বাক্যালাপ করছে।আরাফ শান্ত হয়ে সুফিয়ার প্রতিটা কথাই হজম করছে। কথার তালে তালে আরাফকে বিভিন্ন ভাবে অপমান করে যাচ্ছে সুফিয়া।পর্দার আড়াল থেকে হৃদিতা আরাফের চোখ মুখের অবস্থা দেখছে।কি করে এত কথা সহ্য করছে আরাফ।শুধু কি বাড়ির জামাই হওয়ার ভদ্রতায়?নাকি দাদীকে কিছু বললে হৃদিতার অপমান বোধ হবে সে জন্য।

নেহা বেশ কয়েকবার সুফিয়াকে এমন অকথ্যকথনে বারন করেছে।ওয়ালীদ বার বার তার মায়ের দিকে অনুনয় চোখে তাকিয়ে ছিল শুধুমাত্র আরাফকে যেন কথা না শোনায়।কিন্তু রাগী রুক্ষভাষী সুফিয়া সবাইকে অগ্রাহ্য করে, আরাফকে কথার তালে তালে অপমান করেই যাচ্ছে।আরাফ সবাইকে চোখ ইশারায় সরে যেতে বলে।কিছুক্ষণ পর ওয়ালীদের লজ্জানত অবস্থা দেখে আরাফ মিষ্টি করে হেসে বলে,

– আমার দাদী শাশুড়ী আমার মুরব্বী। তিনি আশা করি কোন কথাই মন্দ বলেন নি।আপনারা আপনাদের কাজে যান। আমি বরং ওনার সাথে একটু গল্প করি।

সবাই চলে গেলেও হৃদিতা থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আর সেটা দেখেও আরাফ না দেখার ভাব নিয়ে বসে আছে।

– হুনো, মাইয়াডারে জলে ভাসাইয়া দিসে এটা আমি আগেই বুইঝা গেসি।
– আপনার কোন দিক থেকে মনে হলো হৃদিতা জলে ভেসে গেছে যদি একটু বলতেন।
আরাফের কথায় তড়াক করে তাকায় সুফিয়া।কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে পানের বাটা থেকে পান মুখে পুরে বলে,

– এই যে দেহ,তোমার চাকরি-বাকরি নাই,কয়বার যানি ইস্কুল কলোজের লাত্তি উষ্ঠা খাইয়া ফাশ করছো।তোমায় মতো পোলারে কোন হানে চাকরি দিবো?আর আমগো মাইয়াডা দেহো,শিক্কিত দেখতে হুনতে মন্দ না। আবার এই বয়সে টিউশনি কইরা রোজাগার করে।আর তুমি…..
সুফিয়ার কথায় দাড়ি বসিয়ে আরফা এক গাল হেসে দেয়।দুই হাটুর উপরে হাত রেখে জোরে জোরে দুইটা ধাপ্পা দিয়ে বলে,

– ওহ আচ্ছা,মেয়ে শিক্ষিত, দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ এই জন্য কি এমন অর্ধ-বুড়ো ধরেই বিয়ে দিচ্ছিলেন?আর শুনলাম আগের ঘরের নাকি দুই বাচ্চা ছিল!
আরাফের প্রত্যুত্তের থতমত খেয়ে যায় সুফিয়া। কথার ভাবভঙ্গি আবার কাটিয়ে বলেন,

– হুনো পোলা,মাইয়া গো রুজিরোজগার না করলেও চলে, তাও আবার এত পড়াশোনাও লাগেনা। রোজকার করবো পোলারা। আর সংসার সামলাইবো মাইয়ারা।হেই মাইয়ার যদি ওই হানে বিয়া হইতো মাইয়াডা আমার সুখেই থাকতো।ওই পোলাডার কম টেকা উপার্জন করেনা।চালের আড়তদার সে।আগের ঘরের দুইডা পোলাপাইন নিয়া ভালোভাবেই সংসার সামলাইতে পারতো।

– বাহ বাহ!এক মুখে দুই কথা।একটু আগে নাতনির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর এখন বলছেন পড়ালেখা না করলেও চলে।
– হুনো পোলা বেশি কইয়ো না।তোমরা আগে আইছো দুনিয়ায় নাকি আমরা।আমগো জ্ঞান তোমগো থেইকাও তুরুক।এই যে তোমার নিজেস্ব কোন সম্বল নাই, এহন তোমার বাড়ির মাথা কিন্তু ওই পোলার,
– কোন পোলার দাদী?
আরাফের সন্দিহান প্রশ্ন।
– ওই যে মাইর পীট করে,রাউজনীতি করে নাম কি যানি ওহ হ নোমান!হেই পোলারে এলাকার হজ্ঞলে বাঘের লাহান ডরায়।হেই পোলা যদি তোমারে বাইর কইরা দেয় তহন কি হইবো।আমার নাতনি রে নিয়া কই যাইবা তুমি?

– এইসব ফালতু কথা আপনার মাথায় এলো কেন আমি তো বুঝলাম না দাদী।তাছাড়া ওই বাড়িতে কে বলেছে নোমান ভাইয়ের একার পাওয়ার।আমার বাবা চাচার সম্পত্তির অংশীদার আছে। আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান সেই দিক থেকে শুধু একার মালিক আমি।
– উহহহ দেহুম কত পাও তুমি।দেইখো ওই পোলা তোমগোরে গাঙ্গে ভাসাই সব নিজের হাতে কইরা নিবো।কোন কানা কড়িও তোমগো জুটবো না। আকাইম্মা পোলার থেইকা মাইয়া বিয়া দিয়া ওয়ালীদ ভুল করছে।তোমার কি বিশ্বাস যদি ছাইড়া যাও আমগো মাইয়ারে।

সুফিয়ার কথায় মাথা নামিয়ে নেয় আরাফ।কেউ বুঝলো না তার ভালোবাসা,কেউ যানলো না তার অনুভূতির কথা। অব্যক্ত ভালোবাসাটা গাঢ় হলেও সবাই ভেবে নেয় হয়তো দুজনের কোন মনের মিল নেই। এই সম্পর্কে কোন ভালোবাসা নেই, কিন্তু কেউ কোনদিন হয়তো দেখবে না আরাফের ভালোবাসা।চাইলেও নিজেকে উজার করে ভালোবাসতে পারবেনা আরাফ।তার হাত পা যে অদৃশ্য শেকলে আটকা পরা।তবে দেহের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও আরাফ চাইবে,সে হৃদিতাকে মন প্রাণ দিয়ে চাইবে।

আরাফের নত মুখ খানা দেখে হৃদিতার টনকনড়ে।আরাফ কি সুফিয়ার কথায় কষ্ট পেয়েছে? নাকি আর শুনতে পারছে না এই চরম অপমানের কথা।আরাফকে চুপ থাকতে দেখে সুফিয়া পানের পিক জানলা দিয়ে ছুড়ে মেরে বলে,
– হুনো পোলা কাজ কাম কিছু করো, আর কত দিন বইয়া বইয়া খাইবা।কাম কাজ না পাইলে দোকানের কাপ পিরিজ ধুইবা দিনে একশ টাকা পাইলেও পাইতে পারো।না হইলে তরকারির ক্ষেত কাম করো।

আরাফের ভিষণ হাসি পাচ্ছে হাসির কারন তার অজানা।হয়তো ভাবনার চাদর থেকে বেরিয়ে আসছে তার জীবনের গতির কথা। হাতের ঘড়িয়ে বিক্রি করলেও বেশ কয়েক হাজার টাকা পাওয়া যাবে।যার বাবার অফিসে এত শত কর্মী কাজ করে সে কি না আরেক জনের কামলা খাটবে।

হঠাৎ আরাফ অনুভব করে কেউ তার হাত ছুয়ে দিয়েছে।এবং হাত টা ভিষণ ঠান্ডা। দ্রুত দৃষ্টি ফেলতেই আরাফ দেখতে পায় হৃদিতা তার হাত টেনে দাড় করাচ্ছে।তৎক্ষনাৎ আরাফ দাঁড়িয়ে যায়।বাম হাতের উল্টা পীঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে হৃদিতা সুফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– অনেক হয়েছে।সেই ছোট বেলা থেকে আপনার গায়ে লাগানো অপমান জনক কথা শুনে এসেছি আর আজ আপনি আমার স্বামীকে নিয়ে শুরু করেছেন।আজ একটা কথা না বললেই নয় নেহা আপুর স্বামী কোন দিন এই বাড়িতে এলে আপনি কি এইভাবে অপমান করতে পারতেন?না পারতেন না কোন দিন পারতেন না।আমি এতিম বলে আমার শেষ আশ্র‍য় আপনারা বলে যা নয় তাই বলছেন। এই ছেলেটাকেও ছাড় দিচ্ছেনা না।

হৃদিতা অশ্রুসিক্ত নয়নে আরাফের দিকে তাকায়।আরাফ তো তাজ্জব বনে দাঁড়িয়ে আছে হৃদিতার চোখের দিকে তাকিয়ে।হঠাৎ করেই হৃদিতা আরাফের বুকের বাম পাশে ধুম করে কিল বসিয়ে দেয়। হালকা ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে আরাফ তবুও তা প্রকাশ না করে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।

– তোর সমস্যা কি?তুই এইসব কেন শুনছিস?সেধে সেধে অপমান গায়ে লাগাচ্ছিস কেন তুই?এই বাড়ি থেকে তোকে শাসন করার অধিকার একমাত্র আমার খালুজান আর খালামনির আছে।তারা আমায় লালন পালন করেছে আমার মা বাবা তারা।তাই এই বাড়ির অভিভাবক হিসেবে তারা দুইচারটা কথা তোকে বলতে পারবে অন্য কেউ নয়।বিশেষ করে তারা নয় যারা আমার খারাপ চেয়েছে আমাকে ধ্বংস করতে চেয়েছে।

সুফিয়া নির্বাক হয়ে গেছে। এত দিনের চুপচাপ মেয়েটি কি আজকের হৃদিতা।
আরাফকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে হৃদিতা। আরাফ হৃদিতার হাতের বন্ধনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতে থাকে,
কে যেন বলেছিল,বাঙালি মেয়েরা বাপের বাড়িতে তাদের স্বামীদের অপমান মোটেও সহ্য করতে পারেনা।তখন তারা হয়ে যায়
রায়বাঘিনী। আজকের হাতেনাতে প্রমাণ পেলো আরাফ।তার জন্য হৃদিতার এই রাগ ক্ষোভ সত্যি মুগ্ধ করেছে তাকে।

বিছানার এক কোনে কাদঁছে হৃদিতা অন্যকোনে বসে আছে আরাফ।আরাফ কিছুটা এগিয়ে হৃদিতার সামনে বসে,
– কিরে কাদঁছিস কেন?আমার গায়ে লাগেনি দাদীর কথা।তিনি মুরব্বি বলতেই পারেন। এই মেয়ে আর কাদিঁস না।
– তুই নেহার কাছে যা আরাফ। আমায় একা থাকতে দে।
আরাফ হৃদিতার একটা হাত বাড়িয়ে ধরে,হৃদিতার মাথায় হাত বুলিয়ে কানে ফিসফিস করে বলে,
– কখনো যদি কেউ আমাদের আলাদা করতে চায় আগলে রাখতে পারবি আমায় তুই?
আরাফের কথায় বেগবান দৃষ্টিতে তাকায় হৃদিতা হেচঁকি তুলে বলে
– কে আলাদা করবে? আমরা নিজেরাই আলাদা হবো। ভুলে গেলি এতদিনের কথা। তুই নাকি শুধু মাত্র আমাকে পড়াশোনার জন্য বিয়ে করেছিস।তবে তোর পড়া শেষ হলেই আমরা আলাদা হয়ে যাবো।আর দেখবো না দুজন দুজনকে। হয়তো বা এইভাবে আর হাতটাও ধরা হবে না।
– ধর আমি ছেড়ে যেতে চাই না তুই ও না তখন?তখন পারবি তো আমায় আটকে রাখতে।

হৃদিতার হঠাৎ আরাফের আবেগী কথাতে দুনিয়া ঘুরে যাচ্ছে। আরাফ তো এমন কথা বলে না।চোখের পানি মুছে ঘাড় কাত করে হৃদিতা বলে,
– যদি তুই না ছাড়িস আমিও না ছাড়ি তবে আমাদের আলাদা করবে কে?
– আছে আছে এমন অনেকেই আছে।সামনে যা দেখছিস আশা করি একটু হলেও বুঝতে পারবি।
গল্পটি লেখনীতে পলি আনান।
রাত গভীরে বাড়ি ফিরে নোমান রুমে ডুকতেই চেয়ারে হেলান দিয়ে মাইশাকে দেখেই ভড়কে যায় সে।
– এই মেয়ে তুমি?
– ওহ তুমি ফিরেছো!আমি তো তোমার চিন্তায় ঘুম হারাম করে বসে আছি। কয়বার ফোন করেছি দেখো তো?
– কিন্তু আমার আশায় বসে থাকার কারনটা কি?
মাইশা মাথা নিচু করে নেয়।আমতা আমতা সুরে বলে,
– বাবা আমার ঠিক করে নিয়েছে নোমান।তিনি চান দেশে ফিরে আমি বিয়েটা করে নি।
– বাহ বেশ ভালো সংবাদ।তোমার বিয়ে তুমি করে নাও তাতে আমার কি?
– দেখো নোমান আমি তোমাকে চাই।আমি জানি তুমি বুঝবেনা।একটি বার অন্তত ভালোবেশে দেখো । প্লিজ নোমান আমায় ফিরিয়ে দিও না। আমি তোমায় কাল দুপুর পযন্ত সময় দিলাম যদি তুমি সম্মোতি না দেও তবে বেশ আমি আমার রাস্তায় তুমি তোমার রাস্তায়৷ একটু ভাবো,আর কতদিন এই ভাবে চলবে এবার অন্তত বিয়ে করে সংসার সামলাও।
– আমার জীবন ঘুছিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমার তোমার নয়।
– তা অবশ্য ঠিক।তবে আমি কালকেই চলে যাবো।
এটাই আমাদের শেষ কথা।আর বিরক্ত করবো না তোমায়।
হঠাৎ করেই মাইশা নোমানের পায়ের সামনে বসে যায় হুহু করে কেঁদে উঠে। নোমান দুই পা পিছিয়ে যায়। হাসিখুশী মাইশার চোখের পানি দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। যার মুখে লাগামহীন কথা আর হাসি লেগে থাকতো তার চোখে জল যেন বেমানান।
মাইশা ঘাড় নুইয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় কিন্তু নোমানের বুকে যেন ভারী পাথর তুলে দিয়ে যায়৷ অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে বুকের ভেতরটায়। মাইশা চলে যাবে যাক না তাতে তার কি? এই সব ভাবতে ভাবতেই দুচোখে আর ঘুম নামেনি নোমানের।অদৃশ্য চিন্তারা তাকে গ্রাস করে নেয়।

কেটে যায় দুইদিন মাইশা নিজেকে আড়াল করে নেয়। এই বাড়িতে এখনো তার অবস্থান কিন্তু নোমানের সাথে ভুলেও দেখা করেনি।কিন্তু নোমান আসতে আসতে মিস করতে থাকে মাইশাকে।মেয়েটা কেন তাকে আর বিরক্ত করছে না।এইসব ভেবেই উল্টো বিরক্ত হচ্ছে সে।কোন কাজে মন বসাতে পারছে না।খাওয়ার টেবিলে মাইশার কথা ভাবতে ভাবতে বাড়িতে প্রবেশ করে তার ভাই নিয়াজ।নিয়াজকে দেখে নোমানের আর তার বাবার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে কিন্তু বাকিরা যেন আতংকিত হয়ে যায়।আইদা ঢোক গিলে তার একবছরের বড় ভাই আদীবের দিকে তাকায়।আদীব তার হাতে হাত রেখে বোনকে আস্বস্ত করে।বাড়িতে যেন আরেকটা তান্ডব আসতে চলেছে।
#চলবে….
🌼পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here