হৈমন্তীকা
২৯.
সকালে উঠে তুষারকে পায় না হৈমন্তী। ঘড়িতে তখন প্রায় ন’টা বাজছে। বিছানায় জুবুথুবু হয়ে ঘুমিয়ে আছে হেমন্ত। হৈমন্তী এগিয়ে গেল সেদিকে। আলতো করে কাঁধে থাক্কা দিয়ে বললো, “হেমন্ত? এই হেমন্ত? স্কুলে যাবি না? ৯টা বেজে গেছে তো!”
হেমন্ত উঠলো না। বিরক্ত সমেত ক্ষীণ নড়েচড়ে উঠল। পাশ ফিরে শুলো। হৈমন্তী রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে সাবধানী গলায় বললো, “আমি কিন্তু তোকে আর ডাকতে পারবো না হেমন্ত। পরে স্কুলে দেড়ি হলে আমাকে কিছু বলতে পারবি না।”
ওপাশ থেকে কোনোরুপ জবাব এলো না। হৈমন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইদানিং ছেলেটা একটু বেশিই ঘুমোয়। পৃথিবী উলটে গেলেও তার ঘুম আর ভাঙ্গে না।
রাবেয়া ডাইনিং টেবিলের জুঠা প্লেট গুলো এক এক করে রান্নাঘরে নিয়ে যাচ্ছিলেন। হৈমন্তীকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,
— “আজকে এত দেড়ি করে ঘুম থেকে উঠলি যে? শরীর ঠিক আছে?”
— “আছে। বাবা কি অফিসে চলে গেছে?”
উত্তরে তপ্ত নিশ্বাস ফেললেন তিনি,
— “হ্যাঁ। এইমাত্র বেরুলো।”
এটুকু বলে অল্প সময়ের জন্য থামলেন রাবেয়া। তারপর ফের প্রশ্ন করলেন,
— “তোর কি তুষারের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ আছে হৈমন্তী?”
হৈমন্তী হকচকালো। অপ্রস্তুত হলো ভীষণ। এই প্রথম তুষারকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলেন রাবেয়া। এর প্রতিউত্তরে কি বলবে, তা ভেবে পেল না সে। ভয়, লজ্জা আর অস্থিরতায় এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। উত্তর না পেয়ে রাবেয়া হতাশ নয়নে চাইলেন। আবার জিজ্ঞেস করলেন,
— “কথা বলছিস না কেন? যোগাযোগ রেখেছিস? দেখ হৈমন্তী, ছেলেটা তোর থেকে ছোট। যদি মনের মধ্যে ওর প্রতি সামান্য পছন্দও থাকে, তবে সেটা এখনি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। তোর বাবার কথা শোন। তোর বাবার তোকে নিয়ে অনেক আশা। সেই আশা এইসব কারণে নষ্ট হতে দিস না। তুষার ছোট। বুঝ কম। কিন্তু তুই তো বড়? কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক ভালো করেই জানিস। সমাজ, পরিবার, আত্মী-স্বজন এদের কথাও মাথায় রাখতে হবে। কথা দেয় আমাদের মান-সম্মান, আশা-ভরসা হারাতে দিবি না। কথা বল!”
আঁখিজোড়া জ্বলে উঠল হৈমন্তীর। অসহায় দৃষ্টি মেলে ধরল। শুকিয়ে যাওয়া গলায় কাঁপা স্বরে বলতে চাইলো, “আমি জানি না মা। আমি জানি না।”
তবে অকপটে কিছু বলবে, তার পূর্বেই ফোনের খুব ক্ষীণ আওয়াজ কানে এসে বাজলো হৈমন্তীর। মায়ের মুখপানে একপলক তাকিয়ে রুমের দিকে ছুটলো সে। ছোট্ট টি-টেবিল থেকে ফোন হাতে নিলো। তুষার কল করেছে। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে কল রিসিভ করে কানে রাখতেই অচেনা পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে আসলো ওপাশ হতে,
— “হ্যালো, তুষার তৈমুরের স্ত্রী বলছেন?”
হৈমন্তী চমকালো। অচেনা কণ্ঠস্বর শুনে ভ্রু কুঁচকালো। একটু ভেবে উত্তর দিলো, “জ-জি, আপনি কে বলছেন?”
— “আমি থানা থেকে বলছি। আপনার স্বামীকে মারামারির জন্য থানায় আনা হয়েছে। কললিস্টে সর্বপ্রথম নম্বরটি আপনার ছিল বিধায় আপনাকে কল করা।”
হৈমন্তী যেন ভাষা হারিয়ে ফেললো কথা বলার। গলা কাঁপছে। হাত-পা আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। সময় নিয়ে কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— “কোন থানা?”
ওপাশ থেকে ব্যক্তিটি থানার ঠিকানা বলতেই কল কেটে দিলো হৈমন্তী। এলোমেলো ভঙ্গিতে ওড়না গায়ে জড়ালো। ততক্ষণে ঘুম থেকে জেগে গেছে হেমন্ত। বাসি মুখে বিছানায় বসে পিটপিট করে দেখছে নিজ উত্তেজিত বোনকে।
হৈমন্তী ফোন হাতে ড্রইংরুম পেরুতেই রাবেয়া হাঁক ছেড়ে উঠলেন,
— “সকাল সকাল কই যাচ্ছিস হৈমন্তী? এইসব কি জামা পরেছিস? জামা পাল্টে যা। এই হৈমন্তী।”
হৈমন্তী যেন শুনলো না। উদভ্রান্তের মতো দিশেহারা পায়ে চলে গেল।
_____
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটালো হৈমন্তী। অস্থির পায়ে থানার ভেতর ঢুকতে ঢুকতে আশেপাশে তাকালো। হঠাৎ চোখ গেল একটু দূরত্বে থাকা সাদা শার্ট পরনের ছেলেটির দিকে। অনেকটা তুষারের মতো দেখতে। দ্বিধান্বিত পায়ে হৈমন্তী আরেকটু এগোতেই স্পষ্ট হয়ে এলো মুখ। ওটা তুষারই। বয়স্ক একজন কনস্টেবলের সঙ্গে কি যেন কথা বলছে। হৈমন্তীর পা থামকে গেল। অবশ হয়ে গেল যেন। আর এক কদমও এগোচ্ছে না। ঢিমে যাওয়া গলায় সে ডাকলো, “তুষার।”
সঙ্গে সঙ্গে পাশ ফিরে তাকালো তুষার। হৈমন্তীকে দেখে কেমন শান্ত নয়নে তাকালো। কনস্টেবলকে বললো, “আঙ্কেল আপনি যান। আমি আপনার সঙ্গে পরে কথা বলছি।”
কনস্টেবল চলে গেলেন। তুষার ধীর স্থির পায়ে কাছে এসে দাঁড়ালো। একরাশ প্রগাঢ়তা নিয়ে চেয়ে রইলো হৈমন্তীকার ক্রন্দনরত মুখপানে।
হৈমন্তী হাপাচ্ছে। চোখে দিয়ে গড়িয়ে পরছে অবিরাম অশ্রুপাত। তুষারের বুকে তীব্র ব্যথা সৃষ্টি হলো। ফোলা চোখ দু’টো আহত করলো তাকে। লাল নাকটা যেন কেমন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলছে, “দেখ, মেয়েটা তোর জন্য কাঁদছে। তোকে কত ভালোবাসে। অথচ তুই কি-না পাষাণের মতো মেয়েটাকে কাঁদাচ্ছিস।”
কাল্পনিক কেউ তুষারকে কথাটা বলতেই ঠোঁটে হাসির রেশ ফুটে উঠল তার। শীতল স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— “এখানে কেন এসেছেন হৈমন্তীকা?”
এতক্ষণের নিঃশব্দের কান্না এবার সশব্দে হাজির হলো। কান্নার তেজ বাড়িয়ে আটকে আসা কণ্ঠে বললো,
— “আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তুষার। আপনার নম্বর থেকে একজন পুলিশ ফোন করেছিল আমায়। আপনাকে নাকি থানায় নিয়েছে। আপনি— আপনি মারপিট করেছেন? মানা করেছিলাম না? তবুও শুনেন নি কেন?”
একটু থামলো সে। আশেপাশে তাকালো,
— “আপনাকে কি পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে?”
তুষারের তেছরা উত্তর,
— “কার সাহস আমাকে আটকানোর?”
হৈমন্তী বিস্ময় নিয়ে তাকালো। জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললো,
— “মানে?”
— “মানে, যে আপনাকে ফোন দিয়েছে সে আমার বন্ধুর বড় ভাই।”
হৈমন্তী কান্না ভুলে গেল। বার দুয়েক পলক ফেলে বললো, “তারমানে মারামারি, থানা এসব মিথ্যে?”
তুষার জবাব দিলো না। বিস্তর হাসলো। যা বোঝার বুঝে গেছে হৈমন্তী। তার কান্নায় কাতর মুখশ্রী মুহুর্তেই ক্রোধে ফুলে উঠল। তুষারের বুকে শক্ত হাতে চড় লাগালো। বেশ কয়েকবার, লাগাতার। তুষার থামালো না তাকে। নেত্রের প্রগাঢ়তা বাড়িয়ে, অল্প একটু বেহায়া হয়ে কোমল স্বরে আওড়ালো,
— “আজ প্রমাণ হয়ে গেল হৈমন্তীকা। আপনি আমাকে মিথ্যে হলেও ভালোবাসেন, সত্য হলেও ভালোবাসেন।”
___________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
[একদম খাপছাড়া পর্ব। আমি ক্ষমাপ্রার্থী।]