জীবনের অন্যরঙ পর্ব-১৬

0
666

#জীবনের অন্যরঙ [১৬তম পর্ব]
#আজিজুর রহমান

নব সহকার-মঞ্জরী সহ ভ্রমরী!
চুমে ভোমরা নিপট, হিয়া মরে গুমরি’।
কত ঘাটে ঘাটে সই-সই
ঘট ভরে নিতি ওই,
চোখে মুখে ফোটে খই,-
আব-রাঙা গাল,
যত আধ-ভাঙা ইঙ্গিত তত হয় লাল!

ভারী অসভ্য তো লোকগুলো,দেখেছো ইস্ত্রি করা জামাটা কুচকে-টুচকে কি করে দিয়ে গেল,ছেড়েনি ভাগ্যিস। অনিমান টেনেটুনে জামার ভাজ ঠীক করতে থাকে। অনুমান করার চেষ্টা করে এরা কারা? তাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাইছিল। অর্নির দিকে তাকিয়ে বলল,তুমি না থাকলে আজ কিযে হতো।
অর্নি গাড়ীতে স্টার্ট দিয়ে বলল,উফস এত বকতে পারে।
অনিমান আর কথা বলে না। চুপ করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।
অর্নিতা আড়চোখে দেখে মনে মনে হাসে,বা-হাতটা অনির কাধে রেখে বলল,আজ সবে স্বামীটাকে বের করেছি কি অবস্থা হতো তাই ভাবছি।
–সব ব্যাপারে তোমার ঠাট্টা।
–ধরে নিয়ে গেলে বুঝতে পারতে কেমন ঠাট্টা। প্রেমের কি টান? জীপ টার্ণ নিল।
অর্নির কথা বোধগম্য হয়না জিজ্ঞেস করে, তোমার বডিগার্ড এল না?
-সব উইথড্র করে নিয়েছে। উনি আমার পারশোন্যাল নয় এসপির বডিগার্ড ছিল।
–এদিকে কোথায় যাচ্ছো?
–রাতের শহর দেখতে।
–পাড়ায় যাবে না?
–চুপ করে বোস। এত বকবক করো কেন? আমি ভাবছি তুমি এত অমূল্য হলে কি করে? রাকিব হোসেন এখনো হাল ছাড়েনি?

অনুষ্ঠানে বয়স্ক যারা ছিলেন তারাও একে একে বিদায় নিচ্ছেন। দেখতে দেখতে ঘড়ির কাটা দশটার ঘর পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে। বাশার মঞ্চের একদিকে ছেলেরা অন্যদিকে মেয়েরা চেয়ার নিয়ে বসে। বাশার এক কোনে বসে নারকেল ছোবড়া কাটছে। এক পাশে সারি সারি ধুনুচি সাজানো। কয়েকটি উৎসাহী ছেলে ধুনুচি নিয়ে নেচে চলেছে।
কিন্তু আসল লোক কোথায়? সুবীর খোচাচ্ছে হিমেশকে, কিরে তোর লোক কোথায়?
হিমেশ এদিক-ওদিক তাকায় ঝণ্টে শালার পাত্তা নেই।তাসাপার্টির সঙ্গে নাচতে দেখেছে হেভি নাচে। ধুনুচি নাচ কেমন নাচবে কে জানে। শালা মনে হচ্ছে ডোবাবে।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চে লোক বাড়তে থাকে। খেয়ে দেয়ে একে একে সব আসে। মুনমুন আণ্টি চেয়ার নিয়ে সামনে বসে আছে আগেভাগে। লাইন ধারের মেয়েদের মধ্যে ললিতাও আছে। শুভ বলল, কিরে শুরু করে দে আর কত রাত করবি?
বাশার জিজ্ঞেস করে,হিমেশ কোথায়?

দূর থেকে একটা জীপ আসছে দেখে উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে যায়,ঝণ্টে শালা এল মনে হয়। মঞ্চের ভীড় চঞ্চল হয়। জীপ কিছুটা কাছে আসতে হিমেশের মনে হল পুলিশের জীপ। দ্রুত ভীড়ে সেধিয়ে গেল। পুলিশ কেন? রাজু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। শুভ গিয়ে বেলা চৌধুরিকে বলল,ভাবি বিজয় ভাইকে খবর দিন।
বেলা চৌধুরী হাত তুলে আশ্বস্থ করে,আগে দেখি কি ব্যাপার?

কিছুটা দূরে জীপ দাড়ালো। সালোয়ার কামিজ পরা এক মহিলা নামলো জীপ হতে। তারপর মঞ্চের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। এতো পুলিশ মনে হচ্ছে না।বাশার ভীড় থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে যায়। হিমেশ ভাবে ব্যাটার বেশি ওস্তাদী। সুলতা খচে গেছে কেউ যাচ্ছে না উনি সাহস দেখাচ্ছেন। হঠাৎ বাশার পিছন ফিরে চেঁচিয়ে উঠল,অর্নিতা আপু।

স্তব্ধ ভীড় আন্দোলিত হল। শুভ এগিয়ে গিয়ে দেখল তাই তো অর্নিতা আপু। রাজু এগিয়ে যেতে অর্নিতা হাত বাড়িয়ে দিল,রাজু হাত চেপে ধরে বলল,অনেকদিন পর। কেমন আছো?
–আছি একরকম। পাড়ার কথা সব সময় মনে পড়ত,ভুলিনি। অর্নিতা হেসে বলল।

উশা অবাক হয়ে ভাবে ছেলেদের মত ছাটা চুল মহিলা কে? শুভ্রতাকে দেখে অর্নিতা বলল,কেমন আছিস?ডাক্তার সাহেব কেমন আছেন?
–ভাল,বাবা কিছুক্ষন আগে চলে গেল। তুমি কেমন আছো অর্নিতা আপু?
মিতা এগিয়ে এসে বলল,চিনতে পারছো?
–মিতাকে চিনব না?কি ঠিক বলেছি তো?
–তুমি চুল এত ছোটো করেছো কেন?
–আমার বরেরও পছন্দ নয়। দু-হাত কাধ পর্যন্ত তুলে বলল,এবার এতটা রাখবো।
–ধ্যৎ তুমি সেই আগের মতই আছো।
সারি দিয়ে চেয়ারে বসা বেলা ভাবি মুন্নী ভাবিদের দেখে বলল,আরে ভাবীলোগ সব এখানে বসে?
–বর কি বলছিলে,সত্যি বিয়ে করেছো নাকি?বেলা চৌধুরী জিজ্ঞেস করে।
–হি-হি-হি। বচপনের পেয়ার বিয়ে করে ফেললাম।
সকলে পরস্পর মুখ টিপে হাসে। অর্নিতা সেই আগের মতই আছে।

জীপে বসে ঘামছে অনিমান। অর্নি বলে গেছে যতক্ষন না ডাকবে জীপ থেকে যেন না নামে। রিভলভার হাতের তালুতে ঘামছে। অর্নি বলেছে লক আছে,গুলি চলবে না। অর্নিকে পেয়ে জীপের দিকে তাকাচ্ছে না কেউ।

অর্নিতা মজা করতে ভালবাসে মুন্নী জানে। কারো সঙ্গে প্রেমট্রেম ছিল বলে শোনেনি। যে মজা করতে ভালবাসে তার সঙ্গে মজা করে আনন্দ। মুন্নী বলল, সাহেবকে আনতে পারতে। মুন্নী মুখ টিপে হাসে।

অর্নিতা বলল,আপনাদের কি যেন বলে,ওগো?তারপর গলা তুলে জীপের দিকে তাকিয়ে বলল,ওগো মেহেরবানি করে একবার আসবে?তোমাকে আমার ভাবীলোক দেখতে চায়।
বুকের মধ্যে ছ্যৎ করে ওঠে, অনিমান কি করবে নামবে কি নামবেনা ইতস্তত করে। ইচ্ছে করছে নেমে উল্টোদিকে দৌড় লাগায়। ভীড়ের চোখ জীপের দিকে। মুন্নীর দিকে তাকিয়ে অর্নিতা বলল,বহুৎ সরম।বাশার জীপের দিকে যাচ্ছিল অর্নিতা বলল,এই বাশার মৎ যানা-যাস না।

রাতে অনুষ্ঠানের আনন্দ অর্নিতা জমিয়ে দিল। সত্যিই মেয়েটা খুব জলি। মুন্নী মনে মনে ভাবে। চেহারায় আগের থেকে অনেক বেশি জেল্লা এসেছে।
সুবীর বলল,অর্নিতা আপু পাড়ায় থাকলে হেভি জমতো। পিকনিকে যাবার সময় সারা পথ বাসে অর্নিতা আপুর জন্য বোর হতে হতো না।
বেলা চৌধুরি বলল,শান্ত হয়ে বোসো অর্নিতা। দরকার নেই তোমার বরের, তুমি এখন কোথায় থাকো?
–কি বলছেন ভাবি?শান্ত হয়ে বসবো?তারপর গলা চড়িয়ে বলল,ওগো তুমি আসবে নাকি আমি যাবো?আমি গেলে নসিবে বহুৎ দুঃখ আছে।
সবাই হো-হো করে হেসে উঠল। মহিলাকে উশার বেশ লাগে। অনিমান ভাবল বসে থাকা সমীচীন হবেনা।অর্নিকে বিশ্বাস নেই,গুণ্ডাগুলোর সঙ্গে যা করল। ধীরে ধীরে জিপ থেকে নামে। হাতে রিভলবার চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। পাড়ায় আসার জন্য যে উৎসাহ ছিল এখন মনে হচ্ছে না এলেই ভাল ছিল। মিতা অল্প আলোতেও চিনতে পারে। হাতে রিভলবার দেখে রাজু ভাবে অনি কি গুণ্ডাদলে ঢুকেছে?অর্নিতা ওকে কোথায় পেল? অর্নিতার মুখে কৌতুকের হাসি উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে মজা দেখছে। অনিকে চিনতে পেরে মুন্নী বলল,এতো আমাদের অনি । তুমি যে বললে–।

অনিমান ততক্ষণে অর্নির কাছে দাড়িয়েছে। অর্নিতা বলল,মুন্নী ভাবি বিশ্বাস করছে না, আমাদের সাদি হয় নাই?অনিমান ঘাড় নাড়ে।
–আমি তোমার বউ আছি কি না?
অনিমান আবার ঘাড় নাড়ে। মিতার চোখে জল এসে যায়। অর্নিতা সবার দিকে তাকিয়ে বলল,কই শক?
অনিমান অস্বস্তিতে পড়ে যায়। বাশার এসে জড়িয়ে ধরে বলল,কিরে রিভলবার নিয়ে ঘুরছিস?আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম।
–এটা ওর। ও পুলিশের এসপি।
–এই ও-ও কি করছো?তুমি আমাকে কি নামে ডাকো বলো।
অনিমানের মাথা গরম হয়ে যায় বলে,না বলবো না।
অর্নিতার চোখ বড় করে মুন্নী ভাবিকে বলল,গোসসা হয়েছে, বহুৎ জিদ্দি।
বেলা ভাবি বিস্ময়ে হতবাক,অর্নিতা কি সত্যিই অনির বউ?
একটা রিক্সায় দুটো ছেলে এসে নামতে হিমেশ বলল,এইতো এসে গেছে। এত দেরী করলি?
–যুব সঙ্ঘ ক্লাবে ছিলাম। কিছুতেই ছাড়তে চাইছিল না,কিরে বটাই বল।
–ওরা বলছিল হোলনাইট প্রোগ্রাম করবে। বটাই বলল।
–ধুর শালা প্রোগ্রাম। ঝণ্টূ বলল।
–এ্যাই গালি দিবি না। হিমেশ থামাতে চেষ্টা করে।
–স্যরি দোস্ত। পুলিশের গাড়ী মনে হচ্ছে কি ব্যাপার কোনো ঝামেলা নেই তো?
–না না অর্নিতা আপুর গাড়ী।
ফিস ফাস আলোচনায় সবাই জেনে যায় অর্নিতা আই পি এস অফিসার। রাজু একটু একা পেতে চাইছে অনিকে। সবাই এখন নাচ নিয়ে মেতে,অর্নিতার ইচ্ছে সেও নাচে। বাশার ছোবড়ায় আগুন দিয়ে ধুনো ছিটিয়ে দিল। ধোয়ার কুণ্ডলি পাকিয়ে ধুমায়িত মঞ্চ।ঢাকীরা ঢাক নিয়ে তৈরী। ঝণ্টূ জামা খুলে ফেলেছে,পরণে স্যাণ্ডো গেঞ্জী হাফ প্যাণ্ট। মাথায় রুমালের ফেট্টী। এক নজর মেয়েদের উপর চোখ বুলিয়ে নিল। অনিকে ডেকে পাশে বসালো বেলা চৌধুরী। ব্যাপারটা অর্নিতার নজর এড়ায় না। একটু সরে গিয়ে দাড়ালো,যাতে ওদের নজরে না পড়ে।
ঝণ্টূ নাচ শুরু করেছে বটাই মাঝে মাঝে ধুনোচিতে ধুনো ছিটিয়ে দিচ্ছে। বাস্তবিক ছেলেটি নাচছে ভালই।শরীরটাকে এমনভাবে বাকাচ্ছে যেন হাড়পাজড়া নেই। হিমেশ খুব খুশী সেই এনেছে ঝণ্টূকে। সবাই রুদ্ধশ্বাসে নাচ দেখছে।
বেলা ভাবি জিজ্ঞেস করে,তুই অর্নিতাকে বিয়ে করেছিস?
–কি করবো বলো,ও না থাকলে জীবনটা শেষ হয়ে যেতো।
–তুই পারবি একটা অর্নিতাকে সামলাতে?
অর্নিতার কান খাড়া,কি বলে অনি শোনার জন্য। অনি বলল,আমি না পারি ও আমাকে সামলাবে। একজন পারলেই হল।
অর্নিতার ইচ্ছে হল আনন্দে হাততালি দিতে। উত্তরটা সম্ভবত বেলা চৌধুরির পছন্দ হয়নি। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,এবারের সবুজ পত্রিকায় তোর উপন্যাস ছাপা হয়েছে?
–হ্যা তুমি পড়েছো?ওটা বই আকারে বের হবে।
ঝণ্টূকে ঘিরে অন্যরাও নাচছে বটাই তাদের সরিয়ে দিচ্ছে। কেননা ঝণ্টূর নাচতে অসুবিধে হয়। ঝণ্টূ ঘামে ভিজে গেছে,মেয়েদের দেখে তার একশো শতাংশ উজাড় করে দিচ্ছে। ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভাংড়া নাচের ভঙ্গীতে কোমর দোলাচ্ছে অর্নিতা। বাশার এসে ডাকে অর্নিতা আপু চলে এসো। অর্নিতা আড়চোখে অনির দিকে তাকাতে ইশারায় নিষেধ করল অনি।বেলা ভাবি নজর এড়ায় না,মনে মনে ভাবে কদিন থাকে দেখব স্বামী আনুগত্য।
একসময় শুভ্রতা কাছে এসে বলল,অভিনন্দন।
অনিমান মুচকি হাসল। শুভ্রতা বলল,তোমাকে দোলাভাই বলব না অর্নিতা আপুকে ভাবি বলব?
–আমি ঘরের ছেলে ও পাড়ার মেয়ে।
শুভ্রতা খিলখিল করে হেসে উঠল। বেলা ভাবি জিজ্ঞেস করল,আচ্ছা শুভা কে রে?
বিষয়টা নিয়ে কানাঘুষো শুভ্রতার কানেও এসেছে,প্রসঙ্গটা উঠতে সে স্থানত্যাগ করল।
–শুভা মানে পবিত্র, আনন্দ। একটা সুন্দর মেয়ে।
–শুভা মানে জানতে চাইনি। বাস্তবের কেউ তো?
–অবশ্যই,বাস্তব থেকেই নিয়েছি না হলে আমার সাধ্য কি?
–হেয়ালি না করে বল কে সে?
অনিমান হাসল। বেলা ভাবি জিজ্ঞেস করল,হাসছিস যে?
–ভাবি যেমন ধ্বনি পাশাপাশি সাজিয়ে একটা পদ কিম্বা সুর সাজিয়ে হয় একটা সঙ্গীত হয় তেমনি কিছু ভাবের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে একটা চরিত্র।
–তাহলে বলছিস শুভা আমাদের পাড়ার কেউ নয়?
–তা কখন বললাম?সবার মধ্যে সুপ্তভাবে শুভা আছে। আমি সেগুলোকে চয়ন করে শুভাকে লোক সমক্ষে এনেছি।
–আমার মধ্যে শুভা আছে?
–নেই?তোমার কি মনে হয়?
–কি জানি,আছে হয়তো। বেলা ভাবির মুখটা করুণ মনে হল।
বাশার এসে বলল,তুই এখানেই বসে থাকবি? রাজু ভাই তোকে ডাকছে।
–ভাবি আমি আসি?
–আবার আসিস। তোদের ফ্লাট তো হয়ে গেছে।
উশা নাচ দেখতে দেখতে খেয়াল করে অনি ওর দিকে যাচ্ছে। অনি অত্যন্ত সঙ্কুচিত, রাজু ভাইকে বলল,নাচ দেখছো না এখানে বসে আছো?
–জীবনে অনেক নাচ দেখেছি। রাজুর গলায় অভিমান।
–আমাকে ক্ষমা কোরো। হাতজোড় করে বলল অনি।
উশা এসে উপস্থিত। রাজু বলল,কি হল চলে এলে,নাচ দেখলে না?
–আপনি উশা?আমার নাম–।
–জানি অনিমান চৌধুরী ।
–আপনি খুব সুন্দর। অনি বলল।
–বাইরে দেখে বলে দিলেন?উশা হেসে বলল।
অনান ঠেক খায়। বেশ কথা বলে উশা।
রাজু বিরক্তি নিয়ে বলল,আমি ওকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব ডেকেছি।
–উশা থাকুক না। তুমি জিজ্ঞেস করবে এতদিন কোথায় ছিলাম?
রাজু চোখ তুলে তাকালো। অনিমান বলল,নরকের পথ এত মসৃন এত মোহময় চিক্কণ জানা ছিল না।গরলকে অমৃতময় অন্ধকারকে আলো বলে ভ্রম হয়।সেই পথে চলতে চলতে–না বরং বলব নামতে নামতে পূতিগন্ধময় পাঁকে মাখামাখি। এমন সময় মাতৃরূপে–।
উশা জিজ্ঞেস করল,মাতৃরূপে?
–নয় কেন? নারী অন্তরে উকি দিলে বুঝতে পারবেন সেখানে সুপ্ত মাতৃসত্তা।
–মনে ছিলনা আপনি তো আবার ভিতরে উকি দেন।উশা খিলখিল করে হাসল।
অর্নিতা এসে পাশে দাড়ালো। অনিমান বলতে থাকে,মাতৃরূপে এল এক জলপরী।
–যেভাবে দস্যু থেকে রক্ষা করেছে কোনো মহৎ ব্যক্তি?উশা যোগ করল।
অনিমান চমকে উশার দিকে দেখল। রাজু বলল,অর্নিতা পরশু দিন এসো।
–স্যরি রাজু ঐদিন সিলেট যাচ্ছি। তারপরের দিন আমাকে জয়েন করতে হবে।
সবার কাছে বিদায় নিয়ে অর্নিতা জিপে উঠল। হাত নেড়ে বিদায় জানালো।

মুন্নী অনেক ভেবে সিদ্ধান্তে পৌছালেন, অর্নিতাই উদ্যোগী হয়ে ঘটনাটা ঘটিয়েছে। পাড়ায় ওদের দুজনের ভাব ছিল ঠিকই কিন্তু বিয়ের কথা কখনো মনে হয়নি।

অনিমান ভেবে চলেছে আপন মনে। মানুষ মরণ শীল। ইচ্ছে অনিচ্ছে নিরপেক্ষ,প্রতিদিন আমরা তিল তিল করে এগিয়ে চলেছি অসহায় সেই মৃত্যুর দিকে। কিন্তু ঝড়ের হাত থেকে প্রদীপ শিখার মত চেষ্টা করা উচিত যাতে নিভে না যায়। প্রদীপ শিখা কি জানো? আমাদের মনুষ্যত্ব। শারীরিক মৃত্যু না হলেও মনুষ্যত্বের মৃত্যু হতো। একবার পা পিছলে যেতে যেতে বেঁচে গেছি কে আমাকে রক্ষা করেছিল জানো? আমাকে রক্ষা করেছিল পাশে বসে থাকা আমার অর্নি।

সব মানুষের জীবনে এইরকম এক একটা বাঁক আসে তখন থমকে দাড়াতে হয়। সিদ্ধান্ত নিতে হয় দৃঢ়তার সঙ্গে যারা নিতে পারে না তারা হারিয়ে যায় সাধারণের ভীড়ে। কিন্তু আমার জীবনে অর্নি এসেছে। যে আমার অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া জীবনে আলোতে নিয়ে এসেছে। অর্নির সাথে নিজের পথচলা আমার একান্ত সিদ্ধান্ত।

অর্নিতা স্টিয়ারিং-এ বসে চোখ রাস্তার দিকে,মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন বিজকুড়ি কাটছে। অনির সঙ্গে সম্পর্ক আজ প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দিল। লক্ষ্য করেছে অনেকের চোখে বিস্ময় আবার কারো চোখে ঈর্ষা। অনি ঠিকই বলে মানুষের সব ইচ্ছে বাইরে আসতে পারে না। মনে জন্ম নেয় আবার মনেই লীন হয়ে যায়। বেলাভাবীকে দেখে অন্তত তাই মনে হয়েছে। মিতা নাচ না দেখেই চলে গেল। সবাই ওকে কত বলল কিন্তু শরীর খারাপের অজুহাতে কারো কথা শুনলো না। অর্নিতার মনে হয়েছে শরীর নয় মিতার মন খারাপ। অনিমান দেখল অর্নি চুপচাপ গাড়ী চালাচ্ছে। ও চুপচাপ থাকার মেয়ে নয়। ওকে চুপচাপ দেখতে ভাল লাগেনা। অনি জিজ্ঞেস করল,কি ভাবছো?
অর্নিতা মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে, পাড়া কেমন লাগলো?
–পাড়াটা অনেক বদলে গেছে। রাস্তাটা সিমেণ্ট দিয়ে বাধিয়ে দিয়েছে, দেখেছো?
–ক্ষিধে লাগেনি?
অনি হাসল,ভাবখানা তুমি যা করবে।

জীপ একটা হোটেলের সামনে দাড়ায়,হোটেল মালিক মনে হয় চিনতে পেরেছে। এগিয়ে এসে বলল,আসুন স্যার।
–রুটি কষা হবে?
ভদ্রলোক লজ্জিত হয়ে বলল,রুটি এখানে হয়না স্যার। বিরিয়ানি আছে স্যার—হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি আছে।
–ঠীক আছে দুটো পার্সেল রেডী করুন। সঙ্গে গ্রেভি কিছু দেবেন। অর্নিতা কথা বলতে বলতে অনির দিকে নজর রাখে। জামা তুলে কোমরে বেল্টে বাধা ব্যাগ বের করে টাকা দেবার জন্য। রিভলবারের দিকে নজর পড়তে হোটেল মালিক বলল,টাকা দেবেন?
–তাহলে ফোকটে খাবো?গুনে গুনে টাকা দিয়ে জিপে এসে বসে বলল,বিরিয়ানি নিলাম। কিছুক্ষণ পর হোটেল মালিক নিজে পার্সেল ক্যারিব্যাগে করে নিয়ে এল। অর্নিতা জীপ স্টার্ট করে,হোটেল মালিক জিজ্ঞেস করল,শুনলাম স্যার আপনি নাকি চলে যাচ্ছেন?
খবর দুনিয়া জেনে গেছে,অর্নিতা হাসলো।
–ভালো মানুষদের কেউ পছন্দ করেনা। হোটেল মালিক সহানুভুতি জানায়।

অর্নিতা জীপ স্টার্ট করে দিল। লোকটা হয়তো তাকে তোয়াজ করে কথাটা বলেছে তবু শুনে খুব ভাল লাগল। অনি বাইরে তাকিয়ে আছে। অর্নিতা বলল,অনি তুমি আমাকে পছন্দ করো না?
অনি মুখ ফিরিয়ে হেসে বলল, অর্নি আমার ইচ্ছে করে সারাক্ষন তোমাকে ছুয়ে থাকি। ইচ্ছে হলেই তো হবেনা।
–অত দূরে বসে কেন,কাছে এসে বোসো।
অনি সরে বসতে বা হাত ধরে কোলের উপর রাখল অর্নিতা। অর্নি ঘাড় ঘুরিয়ে হাসল। জিজ্ঞেস করল,কেমন লাগলো পাড়ার মানুষজন?
–তুমি লক্ষ্য করেছো ভাবি আমাকে দেখছিল কিন্তু কথা বলল না।
–কে রবি ভাইয়ের বৌ?লজ্জা পাচ্ছিল হয়তো। বেলা ভাবি কি বলছিল?
–কি আবার?আমার লেখাটা নিয়ে আলোচনা করছিল।
অর্নিতা জোরে হেসে উঠল। অনি জিজ্ঞেস করল,হাসছো কেন?
–তুমি ঝুট বলছো তবু তোমাকে ভাল লাগে। তুমি কাউকে ছোটো করতে চাওনা। চিন্তা কোরনা তোমার অর্নি তোমাকে সামলে নেবে।
অনির কান লাল হয়,অর্নি হয়তো কিছু শুনে থাকবে।অর্নিতা কিছুক্ষণ পর বলল, রাজুর বউকে কেমন লাগল।
–সুন্দর কথা বলে।
–ব্যাস?
–মুন্নী ভাবিও সুন্দর কথা বলে। দুই জায়ে জমবে।
–তুমি একজনের নাম বলো যে সুন্দর কথা বলে না।তোমার কাছে সবই সুন্দর। সেইখানে আমার ভয়।আমিও বুঝি ওদের মত সুন্দর।
অনি বুঝতে পারে অর্নি কি বলতে চাইছে। ঝট করে জড়িয়ে ধরে বলল,তুমি সুন্দর না। তুমি বিচ্ছিরি তুমি পচা তুমি তুমি–অর্নি তুমি এক্কেবারে আলাদা। সবার থেকে আলাদা–তুমি অন্য রকম। আমার জলপরী–।
–কি হচ্ছে দুজনেই মরবো। অর্নি স্টিয়ারং ধরে বা দিকে বাক নিল। আচ্ছা আমি শিখ এ জন্য তোমার মনে কোনো আক্ষেপ নেই?
–তুমি বেলা ভাবির কথায় কিছু মনে কোরনা। সব কিছুর নিজস্ব ধর্ম আছে,এক এক ঋতুতে এক একরকম ফুল ফল হয়। জীবের ধর্ম আছে,মানুষের মন অন্য মনের সংস্পর্শ নাহলে নিজেকে মনে হবে নিঃসঙ্গ। অর্নি তুমি যে আমার কি তুমি–তুমি না থাকলে আজ আমি–উফস ভাবতেই পারছি না।

অর্নিতা লজ্জায় রাঙা হয়। সবাই নিজের ভাল চায়,নিজের কথা ভাবে। অন্যের কথা ভাবার ফুরসত নাই তাদের। আর এই মানুষটা অন্যের কথা ভাবতে ভাবতে নিজের কথা ভাবার সময়ই পায়না। হিন্দুদের বিশ্বাস গঙ্গার পানিতে শরীর পবিত্র হয়। সত্য-মিথ্যা জানিনা কিন্তু বলতে পারি এই মানুষটার সঙ্গ পেলে বাঁচার আশ্বাস ফিরে পাই। “আমার অনিকে পেয়েছি তাতেই আমি খুশি। আমার জীবনে কোনো আফসোস নেই। অনির ভালোবাসা আমাকে সব দুঃখ কষ্ট হতে দূরে নিয়ে যাবে।” অনি আমারে বলতো, আমি কোনো আশা নিয়ে ঘুরে বেড়াই না। যা পাই সযত্নে কুড়িয়ে নিই।

আমাকেও অনির ভালোবাসাকে স্ব-যত্নে লালন করতে হবে। এই ভালোবাসায় কোনো ছায়াকে প্রবেশ করতে দিব না। যার জন্য কেউ চোখের জল ফেলে না তার মত হতভাগা কেউ নাই। আমি অনির কাছে নিজের ভালোবাসা পেয়েছি, যার জন্য আমি এদিক ওদিক বারবার ছুটেছি– অনি তুমি আমার হৃদয়কে ভালোবাসায় সিক্ত করেছো। আন্দোলিত করেছো তোমার প্রতি আমার প্রেমের বাশি কে।

বাংলো এসে গেল। অর্নিতা নেমে চাবি দিয়ে গেটের দরজা খুলল। পার্সেল নিয়ে অনিও ঢুকে গেল। খাবার টেবিলে পার্সেল নামিয়ে রেখে অনিমান চেঞ্জ করে বাথরুম গেল।

বেলা ভাবি শুয়ে পড়লেও ঘুম আসেনা। পাশে বিজয় গভীর ঘুমে ডুবে আছে। কোনোদিন এরকম হয়নি আজ কেন মনটা এমন চঞ্চল লাগছে। অনির প্রতি একটা সহানুভুতি ছিল। অর্নিতা আই পি এস অফিসার কদিন পর অনিকে ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।দেয় দেবে তাতে তার কি?আল্পনা বলছিল,ছি-ছি করছিল। দুঃখ করে বলছিল ওদের বংশে এমন অনাচার স্বপ্নেও ভাবেনি। ভাগ্যিস মা নেই,বেঁচে থাকলে কি কষ্টটাই না পেতো। আল্পনার ঠিক নজরে পড়েছে অর্নিতার হাতে তার অনির মার দেওয়া বালাজোড়া। অনির মার মৃত্যুর পর ঐ বালাজোড়া তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল আজ স্বচক্ষে দেখল। অনি-ই সরিয়েছিল এখন বুঝতে পারছে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখল অর্নি পোশাক বদলে টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। অনিমানের খারাপ লাগে বাইরে দৌঁড়ঝাপ করে এসে আবার বাসায় ফিরেও বিশ্রাম নেই।
অর্নিতা বলল,চলে এসো,খাবার রেডি।
–অর্নি একটা কথা বলবো শুনবে?
–কথাটা আগে বলো।
–একটা রান্নার লোক রাখো।
–আমার রান্না ভাল হচ্ছেনা?
–রান্না করবে চাকরি করবে একা সব হয়?আমার খারাপ লাগেনা বল?
অর্নিতা বুকের মধ্যে মোচড় অনুভব করে,নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,তুমি বুঝবেনা। নারী হলে বুঝতে।রান্না করতে আমার ভাল লাগে। অর্নিতা প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলল,খেয়ে নেও।
–এত?একটা আনলেই হতো। অনিমান প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল।
–যতটা পারো খাও। রাইস না খাও মাংসটা খেয়ে নিও।

পাড়ার আড্ডায় পিকনিকে যে অর্নিকে চিনতো তার মধ্যে এমন মমতাময়ী অর্নি থাকতে পারে কখনো ভাবেনি। হেসে চোখের জল আড়াল করে অনিমান।
মাংস খেতে খেতে একটা হাড়ের নলা পেল মুখে দিয়ে হুস হুস করে কয়েকবার টেনে মজ্জা বের করতে না পেরে বিরক্ত হয়ে রেখে দিল। অর্নি দেখেছে প্লেট থেকে তুলে দু-বার ঠুকে মুখ দিয়ে টানতে দেখল কেচোর মত অর্নির ঠোঁট থেকে ঝুলছে মজ্জা। ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে বলল,নেও।
অনি ঠোঁট অর্নির মুখে ঠেকিয়ে শুরুক করে টানতে মজ্জা মুখে ঢুকে গেল।
অর্নি বলল,আমি বের করে দিলাম তুমি পুরোটা খেয়ে ফেললে?
অনিমান লাজুক হাসল। মনে মনে বলে ভালবাসা দিয়ে পুষিয়ে দেবো।

অর্নিতা কাত হয়ে ডান পা রতির কোমরে তুলে দিয়ে বাম হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথা উচু করে অনিকে জিজ্ঞেস করল,বিকেলে যারা তোমাকে ধরেছিল,তাদের আগে কোথাও দেখেছো?
–আমি ভাবছি কি সাহস এসপির বাংলোয় কত পুলিশ থাকে এখানে এসেছে?
–ওরা খবর নিয়ে এসেছে। কি বলছিল তোমাকে?
— বিচ্ছিরি-বিচ্ছিরি গালি দিচ্ছিল। ওদের থেকে আমার শক্তি অনেক বেশি। না হলে গাড়ীতে তুলে নিত।
অনিকে বলা হয়নি রাকিব হোসেন ভোরে ফোন করেছিল। ইউ ওন দা গোল্ড। অনির মুখের দিকে তাকিয়ে নাকটা ধরে নেড়ে দিয়ে বলল,গোল্ড। অর্নিতা বলল,আমার মনে হয় রাকিব হোসেনের কাজ।
–না না আঙ্কেল আমার সঙ্গে এরকম করবে না।
–কেন তোমার এরকম মনে হল?
–আমাকে খুব ভালবাসত। বলতো তুই আমার ছেলে।
–তোমাকে সবচেয়ে কে বেশি ভালবাসে?
অনির চোখ ছলছল করে ওঠে বলল,জানো অর্নি মায়ের কথা মনে পড়ল। মা আমাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসতো।

–আণ্টী তো নেই। এখন-?
অনি ফিক করে হেসে কাত হয়ে মুন্নিকে জড়িয়ে ধরে বলল,আমার অর্নি সোনা।

–অনি তোমার অর্নিকে একটু আদর করবে না?

অনিমান জড়িয়ে ধরলো অর্নিকে। কপালে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে ঘুমিয়ে যেতে বললো।
নারীজাতি সম্পর্কে অনির বরাবর উচ্চ ধারণা। অর্নিকে দেখলে তার প্রত্যয় আরো দৃঢ় হয়। ইতিহাসে অনেক ত্যাগের কথা লেখা আছে কিন্তু নারীর ত্যাগ ঘটা করে কোথাও লেখা না হলেও তারা নিরন্তর নীরবে ত্যাগ করে চলেছে তার কতটুকু খবব আমরা রাখি। যারা নারীকে কেবল ভোগের সামগ্রী মনে করে তাদের মত হতভাগা আর কেউ নেই। অনির মায়ের কথা মনে পড়ল। অনির মা বলতো অনি মানিয়ে চলতে হয় সংসারে, মানিয়ে চলার মধ্যে কোন গ্লানি নেই। ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স মানে হেরে যাবার ভয় মানিয়ে চলার অন্তরায়।

আমাকেও এই সংসারকে ভালোবাসায় ভরে রাখতে হলে অর্নিকে আগলে রাখতে হবে। অর্নি মাঝে মাঝে চঞ্চল হয়ে উঠে। মনে হয় না অর্নি বড় হয়ে গেছে। বাচ্চাদের মতো করে আবদার করে থাকে। তার ছোট ছোট ভালোবাসার কারণগুলো মনের কোণে জমিয়ে রেখে দিতে চাই। জীবনের সকল ঝড় ঝাপটা হতে আমার অর্নিকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
.
.
চলবে…!

[গল্পটি কেমন হয়েছে কমেন্ট বক্সে আপনাদের মতামত জানান।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here