#ভালোবাসার রংমশাল
#পর্ব-২১/শেষ পর্ব
#সিফাতী সাদিকা সিতু
নিঝুমের আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে।তাড়াহুড়ো করে বের হয়েছে বাসা থেকে, মামনির হাতে একটু খেয়ে।ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেছে।গাড়িতে বসে অফিস ফাইল গুলো দেখতে ব্যস্ত থাকায় খেয়ালই করেনি গাড়ি অফিসের সামনে না দাঁড়িয়ে অন্য একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে!গাড়ি দাঁড়াতে দেখে নামতে গিয়ে অবাক হয়ে গেল।
ড্রাইভার সাহেব এটা কোথায় এনেছেন,আমার আজ মিটিং আছে সেটা কি আপনি ভুলে গেছেন?রাগত স্বরে নিঝুম বললো।সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
ড্রাইভারকে কোনো কথা বলতে না দেখে আরো রেগে গেল।
গাড়ি ঘোরান তাড়াতাড়ি। আমার কিন্তু ভালো লাগছে না।আমাকে রাগাবেন না প্লিজ?
গাড়ি ঘোরানোর পরিবর্তে ড্রাইভার ঘুরে নিঝুমের মুখোমুখি হলো।
নিঝুম যেন জমে গেল।নিজের চোখকে আজ বিশ্বাস হচ্ছে না।হঠাৎ মনে হলো তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে।মাথাটা ঘুরে উঠলো তার।চোখ দুটো বুঁজে এলো।
সুপ্তি ক্যাম্পাসে বসে লিখছে। রিহান এসে সুপ্তির মাথায় মেরে ধপ করে বসে পরলো।
সুপ্তি রাগী চোখে তাকালো রিহানের দিকে।
রিহান দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো।সুপ্তি প্র্যাকটিকালের খাতা দুটো এগিয়ে দিলো তার সামনে।
আমার দুটো করে দিবি,হুকুম করলো
সুপ্তি।
পারুম না,আমারে তোর কামলা লাগে!নিজের গুলা করতে জান বাইর হইয়া যাইতাছে তুই বেটি আমারে মাইরা ফেলাইতে চাইস!
শুদ্ধ ভাবে কথা বলবি আমার সাথে?এরকম ফালতুর মতো কথা বলবি না।
ওই, তুই আমায় ফালতু কইলি?
ফালতু ভাবে কথা বলবি, আর আমি বলতে পারব না?
না পারবি না,আবার বললে, চড় দিয়া তোর গাল লাল করুম?
সুপ্তি খাতা গুলো নিয়ে উঠে হনহন করে চলে যায়।যেন হাটার প্রতিটি কদমে রাগ ঝরাচ্ছে।
সুপ্তির যাওয়ার পানে তাকিয়ে হাসে রিহান।মেয়েটাকে রাগিয়ে দিতে খুব ভালো লাগে।রাগী মুখটা আড়চোখে দেখার লোভ সামলাতে পারে না সে।রিহান উঠে পিছু,পিছু গেল।এখন রাগ ভাঙাতে বেশ কসরত করতে হবে!নিঝুম আপুর কাছে এই নিয়ে বেশ বকাও খেতে হয় তবে সেটা সুপ্তির অজানা।সুপ্তিকে মনের কথা না জানালেও, নিঝুমকে আপুকে জানিয়েছে সে।অনার্সটা শেষ করে বাবার ব্যবসায় ঢুকবে সে।এরপর সুপ্তি লাল টুকটুকে বউ সাজিয়ে নিজের বুকের মাঝে ভরে ফেলবে।
***
সাম্যর কোলে নিঝুমের মাথাটা এলিয়ে পরে আছে।সাম্য দুচোখ ভরে চেয়ে আছে সবচেয়ে প্রিয় মুখটার দিকে।চোখের পলক ফেলতেও চাইছে না।কতদিন পর নিঝুমের কাছাকাছি আছে সে!বুকের ভেতরের সমস্ত জ্বালাপোড়া এক নিমিষেই উধাও হয়ে গেছে নিঝুমের স্পর্শে।একেই বোধ হয় বলে স্বামী স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্ক!কত রাত ঘুমাতে পারেনি।ছটফট করেছে যন্ত্রণায়, নিজের মানুষ গুলোর পাশে থাকতে না পেরে।সাম্য ভেবেছিল কোনদিনও নিঝুমের কাছে ফেরা হবে না তার।কিন্তু তাদের সম্পর্কের বন্ধন যে উপরওয়ালা সৃষ্টি করেছেন, তা ভুলেই গিয়েছিল।
নিঝুম পিটপিট করে চোখ জোড়া খুললো।সাম্যর মুখটা ভেসে ওঠায় আবার চোখ বন্ধ করে নিল।সে বারবার এমন দৃশ্য কেন দেখছে!সাম্যকে এতবার দেখতে পাচ্ছে কেন?
নিঝুমকে এভাবে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে হাসলো সাম্য।”আমি সত্যি এসেছি,চোখ খুলো।”
সাম্যর কন্ঠ পেয়ে কেঁপে উঠলো নিঝুম। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো।অবশেষে মানুষটা ফিরলো!পরক্ষণেই সাম্যর বাবার কথা মনে হতেই ভয় গেড়ে বসলো নিঝুমের মনে।চট করে উঠে বসলো।দেখলো,এখনো গাড়ির ভেতরেই আছে।দরজা খুলতে চাইলো কিন্তু পারলো না।লক করা আছে।সাম্য নিঝুমের হাত টেনে নিলো।
“শাস্তির ভয়ে পালাতে চাইছো?”
নিঝুম অবাক হয়ে তাকালো, জবাব দিলো না।
“খুব বেশি কি আমার অপরাধ ছিলো,নিঝুম? এভাবে শাস্তি দিলে আমায়?
নিঝুম কেঁদেই চললো।কি জবাব দিবে সে সাম্যকে?সেদিন রাফাতকে ফিরিয়ে দিয়েছিল ঠিকই তবে মন থেকে চাইতো সাম্য ফিরে আসুক।পাঁচ বছরের প্রতিটা দিন সাম্যর অপেক্ষা করেছে।প্রতিটি মোনাজাতে সাম্য থাকতো। কিন্তু সাম্য তাকে ভুল বুঝে রয়েই গেল বিদেশে।
“আমায় যেতে দিন প্লিজ?”
“শাস্তি না দিয়ে কি করে ছেড়ে দেব তোমাকে?”
“আমি ডিভোর্স পেপারে সই করে দিয়েছি,আপনাকে বলার কিছু নেই। শাস্তি দিতে গেলেও একটা সম্পর্ক থাকতে হয়, সেটা আমাদের নেই!”
সাম্যর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।নিজের রাগের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে সে।নিঝুমের দুই বাহু জোরে চেঁপে ধরলো।
“আর একবার ডিভোর্সের কথা মুখে আনলে মেরে ফেলবো, একদম।”
“তাই করুন, মেরে ফেলুন আমাকে।তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হবে”।
সাম্য কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো নিঝুমের দিকে।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”বাবাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছি ওই বাড়ি থেকে”।
***
নিঝুমদের ড্রয়িংরুমের সবাই বসে আছে।সামির, নাজনীন বেগমের হাত ধরে ঝরঝর করে কাঁদছেন।সাম্যও মাথা নিচু করে বসে আছে।আপাতত নিঝুম তার রুমে আছে।আরোহীর তার স্বামীসহ আছে।তারা কেউ সাম্যকে এভাবে দেখতে পারবে ভাবতেই পারেনি।নাজনীন বেগম তো কিছুক্ষণ চিৎকার করে কেঁদেছেন সাম্যকে জড়িয়ে ধরে। পাঁচ বছরের অপেক্ষার অবসান হয়েছে সবার।আপনজনদের চোখের পানি সাম্যর সহ্য হচ্ছে না।জামিরকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।অথচ তার নিজের জন্মদাতা মা এসব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে!সাম্যর মতো কষ্ট কি কেউ পেয়েছে? প্রতিটি সন্তানের মনে মায়ের জায়গাটা কখনো খারাপ হয় না।সাম্য কি করবে?তারই ভালো চাইতে গিয়ে তার মা যে এত অন্যায় করবে তা কোনোদিনও কি ভেবেছে।নিঝুমকে নাহয় নাই মানলো।নাজনীন বেগম,তার কি অপরাধ ছিলো?তার কাছ থেকে এভাবে সবকিছু কেড়ে নিয়ে কি সুখ পেল তার মা!তাকে এভাবে বিদেশে আঁটকে রেখে কি হাসিল করলো!সে ঠিকই ফিরে এসেছে। হোক না কষ্টের পাহাড়! ভালোবাসার মানুষগুলোই তো তার কাছে সেই পাহাড় গলে সমুদ্র সৃষ্টির মাধ্যম!
নিঝুম গোসল করে নিলো।অনাহুত ঘটনা গুলো আরও একবার জীবনের মোড় পাল্টে দিয়েছে।মনে হচ্ছে চাওয়া পাওয়া গুলো হাতের মুঠোয় ধরা দিতে চাইছে!আজ অনেকদিন পর সে শাড়ি পরলো,হালকা সাজলো।আয়নায় তাকিয়ে লজ্জা পেল।এখন ঘর ছেড়ে বেরোতেই লজ্জা করছে!নিঝুম বসে রইলো বিছানায়। নাজনীন বেগম খাওয়ার জন্য ডাকতে এলেন।আজ তিনি নিজের হাতে অনেক রান্না করেছেন।কতদিন পর নিজের পরিবারের মানুষগুলোকে পেয়েছেন।নিঝুমকে দেখে থমকে গেলেন।এই পাঁচ বছরে কখনো নিঝুমকে শাড়ি পরতে দেখেননি।
নাজনীন বেগম নিঝুমকে জড়িয়ে ধরলেন।ফিসফিসিয়ে বললেন,আজ আমার সত্যিই আনন্দের দিন রে।তেকে এই রূপে আবার দেখতে পারবো ভাবিনি কখনো!
নিঝুম মামনির বুকে মুখ লুকালো।এই বুকটা যে তার খুব প্রিয়।
নিঝুম ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে। মৃদুমন্দ বাতাসে খোলা চুল গুলো এলোমেলো ভাবে উড়ছে।গোটা আকাশ তারায় ভরে আছে।সাম্য ধীর পায়ে হেটে এসে দাঁড়ালো নিঝুমের পাশে।
“আপনি ঘুমোননি, কেন?”
“তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে, আমার। যা এর আগে কখনো বলতে পারিনি,কিন্তু আজ আমাকে বলতেই হবে।”
নিঝুম কেঁপে উঠলো।মৃদুমন্দ বাতাস দুজনকে ছুঁয়ে গেল।
“বলুন!”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি নিঝুম “! সেই দশ বছর আগে থেকেই! ” যেদিন তুমি বৃষ্টিতে ভিজে প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছিলে!”সাম্য চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে ফেললো।
চোখ খুলে দেখলো,নিঝুমের ঠোঁটের কোণে হাসির আভা।
“তুমি কি আমার কথা শুনেছ?”
“আমি এই কথা গুলো তো জানি।ভেবেছি হয়ত নতুন কিছু বলবেন?”
“সাম্য খুব করে চমকায়।জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে নিঝুমের দিকে!”
“আপনি যেদিন মামনিকে সব খুলে বলছিলেন, সেদিনই আমি জানতে পেরেছিলাম।পায়েস নিয়ে ফিরে আসার পথেই দরজায় দাঁড়িয়ে সবটা শুনেছি।সেদিন খুব অবাক হয়েছি, কিন্তু আজ হলাম না। আজ আমার অভিমানটাই বেশি হচ্ছে। যাকে ভালোবাসেন তাকে এত কষ্ট কি করে দিতে পারেন? আপনি একটুও বদলান নি ,একটুও না!আবার আমাকে ভুল বুঝেছিলেন।দেশে ফিরবেন না বলে পন করেছিলেন।তাহলে কেন ফিরলেন এখন।বেশ তো ছিলেন বিদেশে।”
সাম্যর চোখ জ্বলজ্বল করছে। কান্না ঠেলে আসতে চাইছে। কিন্তু সে কান্না সুখের, আনন্দের।নিঝুমের প্রতিটা কথা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে নিঝুম তাকে ভালোবাসে।সাম্য যা কখনো আশা করেনি।সে নিঝুমকে জড়িয়ে ধরলো।নিঝুম চমকে উঠলো। তার কথা বলার শক্তি যেন হারিয়ে গেল।সমস্ত শরীরে ভালো লাগার শিহরণ জাগালো।সাম্য আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নিঝুমকে।কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,তুমি কি আমায় কম কষ্ট দিয়েছ?দশটা বছর ধরে আমি যে কষ্ট পেয়েছি তেমাকে না পাওয়ার।সেই কষ্টের কাছে তোমার কষ্ট কিছুই না।তবুও আজ তোমার অভিমান গুলো ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভেজাতে চাই!একবার শুধু ভালোবাসি বলো!
নিঝুম দুহাতে আঁকড়ে ধরলো সাম্যকে।
“ভালোবাসি আপনাকে!”
ছাঁদের এক কোণে ভালোবাসায় সিক্ত দুটো নর, নারীকে দেখে চাঁদও যেন লুকিয়ে হাসছে!
সমাপ্ত।