#এক_মুঠো_ভালোবাসা 💝
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::০৩
এক লোকমা খাবার মুখে তুলতেই গাল বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। থেমে গেল খাওয়া।অবাক চোখে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে আছে মেহের। আজ কতো গুলো বছর পর কেউ একজন তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। বাবা মারা যাওয়ার পর কেউ নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়া তো দূরে থাক, খাবার সাজিয়েও দেয়নি। বেখেয়াল বসত খাবার চিবুতে গিয়ে বাঁধল আরেক বিপত্তি। বিষম খেয়ে গেল। গলা খাঁকারি দিয়ে নিচের গ্লাসটা তুলে নেওয়ার আগেই নিজের আয়ত্বে করে নিল নিবিড়।বাম হাতে গ্লাসটা উঁচু করে এক ঢোকে সবটা শেষ করে ফেললো। গ্লাসটা স্বাভাবিক ভাবে টেবিলের উপর রেখে আরেকটা লোকমা এগিয়ে দিল মেহেরের দিকে। নিবিড়ের তাজ্জব কান্ড দেখে বোকা বনে গেল মেহের।খাবারটা মুখে না তুলে মুখ ঘুরিয়ে নিল।মেহেরের এমন কাজে মুখ চেপে হাসলো নিবিড়। মেয়েটা তার উপর রাগ করেছেন।। শক্ত করে গাল চেপে ধরলো সে। স্বল্প ফাঁকা হওয়া জায়গাটা দিয়ে খাবার পুড়ে দিয়ে আবার চেপে ধরলো।এবার বড্ড অভিমান হলো মেহেরের। করুন চোখে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে খাবার চিবুতে লাগলো। মেহের ভালো ভাবে বুঝে গেছে ,, ছেলেটা তাকে না খাইয়ে ছাড়বে না। মুখের পুরো দানা শেষ হলে হাত নামালো নিবিড়। বললো,…
— “আর একবার যদি চোখে পানি দেখেছি কিংবা বিষম লাগে। তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা। একবার থামিয়েছি , এবার আর থামাবো না। সোজা যেখান থেকে তুলে এনেছি, সেখানে ফেলে আসবো”।
অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মেহের। এতোক্ষণে তার বোধগম্য হলো , একটু আগে সে বিষম খেয়েছিল।মনের ভেতর শিতল একটা অনুভুতি খেয়ে গেল, এই প্রথমবার কোনো ছেলের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস জন্মে গেছে।
…
খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে নিল প্লেটে নিবিড়। পকেট থেকে প্রিয় রুমালটা বের করে মেহেরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো…– “চুপচাপ মুখ মুছে নাও ,, নাক নয়”।হাত বাড়িয়ে রুমালটা নিল না মেহের। পেটের কাছে ডিলেডালা টি শার্টের খানিকটা অংশ তুলে মুখ মুছে নিল মেহের।চোখ,,মুখ ,, কান মুছে নিল। দৃশ্যমান হলো পেটের অনেকটা উন্মুক্ত স্থান। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল নিবিড়। পূর্ণরায় দরজায় নক পড়লো। খাবারের দিতে এসে কনস্টেবল যায়নি। একসাথে প্লেট নিয়ে যাবে। এক নজর মেহেরের দিকে তাকালো, এখনো নাক পরিষ্কার করে যাচ্ছে। বিরক্ত হলো নিবিড়। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মেহেরের হাত থেকে টি শার্ট টেনে ঠিক করে দিয়ে, কনস্টেবল কে ভেতরে আসার পারমিশন দিলো।
কনস্টেবল কে দেখে ভয়ে নেতিয়ে গেল মেহের । হামাগুড়ি দিয়ে ক্রমশ পেছনের দিকে পিছিয়ে গেল। মাথায় দুহাত চেপে চেঁচিয়ে বললো… — ”বাঁচাও,, কে আছ প্লীজ বাঁচাও”।
— ‘মেহের তুই এখানে কি করছিস? তোর না কালকে বিয়ের কথা ছিলো”।
পরিচিত কন্ঠস্বর শুনেও শান্ত হলো না মেহের। ভয়ে আরো গুটিয়ে গেল। এখন জানতে পারলো নিবিড় ,, তার পাশে থাকা মেয়েটার নাম মেহের।
মেহেরের এমন ব্যবহারে দিশেহারা হয়ে উঠলো সে। এক লাফ দিয়ে মেহেরের পাশে বসে পড়লো।মাথাটা আলতো উপরে তুলে বললো ..
— ‘মেহের শান্ত হও ,,কি হয়েছে তোমার’?
থামলো না মেহের, নিজের মতো পাগলামী করে যাচ্ছে সে। হাত উঠিয়ে কনস্টেবল কে উদ্দেশ্য করে বললো…
— “বাবা,,রক্ত ,, পুলিশ।”
মেহেরের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো কনস্টেবলের দিকে।। এতোক্ষণ বুঝতে না পারলেও, এবার অসুবিধা হলো না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো…
–” তুমি বাইরে একটু অপেক্ষা করো আমি এক্ষুনি আসছি।
মেহের দেখ ওখানে কেউ নেই।।যে ছিল সে চলে গেছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই”।
মাথা তুলে চারদিকে পরখ করে নিল মেহের। চারদিকে ভয়ের মতো কিছু তার নজরে এলো না। নিবিড় বালিশটা ঠিক করে, মেহেরকে টেনে শুইয়ে দিল। পাতলা কাঁথা টা কোমর পর্যন্ত টেনে দিয়ে বেরিয়ে এলেন।
_____________
— “কি হয়েছে বলো তো ? দেখছি তুমি ওর নাম জানো, হয়তো পরিচিত।যদি পরিচিতই হও। তাহলে মেহের তোমার কাছে না এসে পেছনে গুটিয়ে গেল কেন”? (জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিবিড়)
–” স্যার ও আমাকে ভয় পায়নি। ভয় পাইছে আমার পরনের এই পুলিশের পোশাক টাকে। আমি যতবার ওর সামনে গিয়েছি ,, যতবার এই পোশাকটা ছাড়া গিয়েছি”।
সন্দিহান চোখে তাকালো নিবিড়। পুলিশের পোশাককে কি এমন থাকতে পারে। যাতে একটা মেয়ে ভয়ে এতোটা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে।আজ পর্যন্ত পুলিককে বিনা শর্তে বিশ্বাস করতে দেখেছে,, কিন্তু ভয় পেতে দেখে নি। কিছুক্ষণ কপালের কাছে স্লাইড করে বললো…
— “কেন কি লুকিয়ে আছে এই পোশাকে”?
— “স্যার তাহলে আপনাকে প্রথম থেকে বলতে হবে! মাঝখানে থেকে বললে আপনার বুজতে অসুবিধা হবে”।
সাথে সাথে মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছে নিবিড়। দু’জনে কাঠের ভাঙ্গা টুল টার উপর বসে পড়লো । তারপর বলতে শুরু করলো…
— ” তা অনেককাল আগের কথা। এই গ্ৰামে একজন ব্যবসায়ী লোক বাস করতেন। তার নামটা অবশ্য আমি জানি না। তার একটা রানীর মতো বউ ছিল। এমন কাজ নেই তা তিনি করতে পারতেন না। এক কথায়,, যেমন রাধে তেমন চুল বাঁধে। বিয়ের দু বছর পেরুতে না পেরুতেই তিনি একজন কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়।কন্যা সন্তানের বাবা হয়ে ব্যবসায়ী লোকটি পুরো গ্ৰামবাসীকে মিষ্টি মুখ করায়। কিন্তু আফসোস, তিনি পরে জানতে পারে কন্যা সন্তানের জন্মের পরপরই তার স্ত্রী পৃথিবী ছাড়েন। ভেঙ্গে পড়েছিলেন তিনি। তবে মেয়ের কথা ভেবে আবার নিজেকে শক্ত করে। সেই মেয়েটা আর কেউ নয় ,, মেহের ছিলো। মেহেরের কষ্ট হবে বলে ,, তিনি আর দ্বিতীয় বিয়ে করলেন না। ভালোই চলতো তাদের বাবা মেয়ের সংসার। হঠাৎ একদিন….
বলে থামলেন কনস্টেবল। নিবিড়ের হাত পা ঠান্ডা করে আসছে,, আবার কি হয়েছে। চিন্তিত কন্ঠে বললো..
— “কি হয়েছে সেদিন..
— “প্রায় দশ বছর আছে ব্যবসার কাজে শহরে যান তিনি। কিন্তু আর ফিরে এলেন না। ফেরে এসেছিলো,, তবে জীবিত নয় ,, মৃত। কার এক্সিডেন্টে মেহেরের বাবা মারা যান। আট বছর বয়সী মেহের বাবার লাশের পাশে বসে ক্রমাগত বাবাকে ডাকতে থাকে। কিন্তু তিনি মেয়ের ডাকে সারা দিলেন না। কোথা থেকে পুলিশ এসে লাশটিকে ময়না তদন্তের জন্য নিয়ে যান। করে ফিরবে বাবা, এই ভেবে দরজার সামনে বসে থাকতো ছোট মেহের ।।যেদিন বাবাকে দিয়ে গেল। সেদিন এক নজর বাবাকে দেখে চিৎকার করে জ্ঞান হারালো মেহের। জ্ঞান ফেরার পর পাগল পাগল অবস্থা হয়েছিল তার। বাবাকে আর দেখেনি।।সেই থেকে পুলিশ কে সহ্য করতে পারে না”।( গড়িয়ে পড়া পানি গুলো হাতের আঙ্গুল দিয়ে মুছে নিল সে)
–” কি এমন ছিলো লাশের মাঝে”?(কৌতূহল নিয়ে নিবিড়)
— “ময়নাতদন্ত করার জন্য সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সচল রাখার দরকার হয়। তাই বিভিন্ন মেডিসিন ব্যবহার করা হয়। মেহেরের বাবার ক্ষেত্রেও তাই। জমাটা বাঁধা রক্তগুলো পূর্নরায় তরলে পরিনত করা হয়।তার উপর সেলাই টাও ভালোভাবে করা হয় নি।তাই যতবার গোসল করানো হয়েছে ততবারই রক্তে সাদা কাপড় লাল হয়ে গেছে। এতেই মেহেরের,’।
বুকের ভেতর অদ্ভুত তোলপাড় শুরু হয়ে গেল নিবিড়ের। একটা মেয়েকে ছোট বেলা থেকে এতোটা কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। তাহলে এতোটা দিন কোথায় ছিল..? সাথে সাথে প্রশ্ন ছুঁলো সে!
দিধা না করে আস্তে আস্তে সব খুলে বললো নিবিড়কে। নিবিড় সব শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।মনে হাজার প্রশ্ন দানা বেঁধে থাকলেও মুখের আসছে না। একটা মেয়ের জীবনে এতো কিছু লুকিয়ে থাকতে পারে।
ভিশন চিন্তায় পড়ে গেল নিবিড়। এই অসহায় মেয়েটাকে একা এখানে রেখে কিভাবে বাড়িতে ফিরবে সে। যদি পূর্ণরায় কালকের ঘটনাটার আবৃত্তি হয় তখন নির্ঘাত মেয়েটা মরে যাবে। কিন্তু কালকে যে করেই হোক তাকে অফিসে জয়েন করতেই হবে। আজকের দিন অনেক কষ্টে মেনেজ করেছে। বললো..
— “বাসের টিকেট আনতে বলেছিলাম এনেছ’??
সাথে সাথে পকেটে হাত রেখে একটা বাসের টিকেট বের করে নিবিড়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো…
— “জি স্যার এনেছি। অনেক কষ্টে একটা ম্যানেজ করতে পেরেছি। (কিছুক্ষণ দিদ্বা বোধ করে )
স্যার একটা কথা বলবো.?
মৃদু আওয়াজ করে হু বললো নিবিড়।। উত্তর পেয়ে বলতে শুরু করলো..
— “স্যার আপনি যদি মেহেরকে সাথে করে নিয়ে যেতেন। আসলে এখানে কার কাছে থাকবে ও। তাছাড়া পুলিশকে ও বেশী ভয় পায়” ।
কনস্টেবল কে চলে যেতে বলে কিছুক্ষণ ঠোঁট চেপে ভাবতে লাগলো নিবিড়। প্রায় ঘন্টা খানেক ভেবে ঠিক করলো, যাওয়ার সময় মেহেরকে নিয়ে যাবে।
(চলবে… ইনশাআল্লাহ)