#এক_মুঠো_ভালোবাসা
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ২২(অন্তিম)
পাশাপাশি কেবিনে শুয়ে আছে মেহের, নিবিড়। নিবিড় কে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে জ্ঞান হারিয়েছে সে। নিবিড়ের এখনো জ্ঞান ফিরে নি। তবে মেহেরের ফিরেছে । চোখ মেলে তাকাতেই নার্স এসে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খুশীর খবর দিয়েছে। মেহের ৩ মাসের প্রেগন্যান্ট। কিন্তু তাতে কোনোরুপ প্রতিক্রিয়া দেখায় নি মেহের। সে নিবিড়ের চিন্তায় অস্থির। প্রতিটা সময় নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।
বাইরে থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। আস্তে ধীরে উঠে বসলো সে। হাতে লাগানো স্যালাইন ক্যানেল একটানে খুলে নিল। পেটের উপর হাত রেখে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল..
— “সরি সোনা। তোর আসার খবরটা আমি তোর বাবাকে জানাতে পারলাম না। তোর বাবা যে মায়ের উপর অভিমান করে ঘুমিয়ে আছে”।
দু-হাত মুখ চেপে কেঁদে উঠলো মেহের। এলোমেলো পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে নিবিড়ের কেবিনে উঁকি দিল। এখন নিবিড়ের জ্ঞান ফিরেনি। প্রিয়-জনরা দরজার সাথে চিন্তিত হয়ে বসে আছে। এগিয়ে গেল মেহের। হাত বাড়িয়ে কেবিনের দরজা খোলার আগেই থামিয়ে দিল নাজমা । নিজের রাগ দমন করতে মেহেরের গালে চড় বসিয়ে দিল। তৃক্ষ্ম কন্ঠে বলে উঠলেন…
— “তোর জন্য, শুধুমাত্র তোর জন্য আমার ছেলেটা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কি দোষ করেছে ও। পুলিশ হয়ে দোষ করেছে। প্রোফেশন কখনো কারো দোষ হতে পারে না। আমার অবুঝ ছেলেটা তোর মতো একটা অপয়া মেয়েকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে। থাকতে দিয়েছে। বিয়ে করে নতুন জীবনটা রঙে রঙিন করে তুলেছে। আর তুই বলছিস, নিবিড় তোকে ঠকিয়েছে। আমার ছেলেটা তোর জন্য এতো কিছু করেছে আর তুই সামান্য এইটুকু মেনে নিতে পারিস নি।তোর মতো মেয়ের মরে যাওয়াই উচিত। নিজের বাবা মাকে তো হারিয়েছিস, নিবিড়কেও আগলে রাখতে পারলি না।
যদি আমার নিবিড়ের অংশটুকু তোর পেটে না থাকতো তাহলে আমি নিজে তোকে খুন করে জেলে যেতাম”।
আঁচলে মুখ লুকিয়ে নিলেন নাজমা। সন্তানের কষ্টে মেহের কে কি বলেছে, তা সে নিজেও জানে না।অনুতপ্ত মেহের। নাজমার কথাগুলো বিন্দু পরিমান মিথ্যা নয়। নিবিড় মেহেরের জন্য সব করেছে। কিন্তু মেহের কেন পারল না, নিবিড়ের জন্য সামান্য একটুকু করতে পারল না। আজ নিবিড়ের এই অবস্থার জন্য সে নিজে দায়ী। দরজাটা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো মেহের।
নিবিড়ের মাথায় মোটা ব্যান্ডজ করা। হাতে স্যালাইনের ক্যানেল লাগানো। ডাক্তার বলেছে, নিবিড়ের মাথার টিস্যু আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে।
নিবিড়ের মাথায় কাছে বসে ক্যানেলহীন হাতটা সামান্য উপরে তুলে গভীর ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। মোটা ব্যান্ডজের অংশটা হাত দিয়ে স্লাইড করলো। চোখের অশ্রুতে খানিকটা ব্যান্ডজের অংশ ভিজে গেল নিবিড়ের। অনুতপ্ত সুরে বলল…
— “পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ এবং জঘন্য মানুষ আমি। যে অন্যের ভালো সহ্য করতে পারে না। এই অপয়া মেয়েটাকে নিজের অর্ধাঙ্গিনী রুপে গ্ৰহন করলে আর আমি তার মর্যাদা দিতে পারলাম না। মেয়ে হিসেবে আমি যোগ্য নয় ,, অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে আমি তোমার যোগ্য নয়। হয়তো মা হিসেবেও আমি তোমার সন্তানের যোগ্য হতে পারবো না। আমার মতো মেয়ের মরে যাওয়াই উচিত, ভালো থেকো নিবিড়। আমাকে আর তোমার ছোট সোনার জন্য দোয়া করো যাতে ঐ দুনিয়ায় আমরা ভালো থাকতে পারি “।
_______________________
আধো আধো চোখ খুলে তাকালো নিবিড়। মাথাটা প্রচুর ব্যাথা করছে। দুহাতে মাথা চেপে উঠে বসলো নিবিড়। সামনে সাদা ড্রেস পরিধিতা একজন স্বল্প বয়সী নার্সকে নজরে এলো। নিবিড়ের জ্ঞান ফিরতে দেখে এগিয়ে এলো নার্স। পিঠের পেছনে বালিশ রেখে অতি সাবধানে নিবিড়কে বসিয়ে দিল। বৃদ্ধ আঙ্গুলের সাহায্য হাতের পাল্স চেক করতে করতে বললেন..
— “থেংঙ্ক গড। আপনার জ্ঞান ফিরেছে। আপনার ওয়াইফ কাঁদতে কাঁদতে দুবার জ্ঞান হারিয়েছে। খাওয়া দাওয়া একদম করেনি। বুঝতেই পারছেন প্রেগন্যান্ট অবস্থায় এমন অনিয়ম করলে মা ও বেবী দুজনেরই ক্ষতির সম্ভবনা থাকে।
আপনি রেস্ট নিন ,আমি আপনার পরিবারের সবাইকে খবর দিচ্ছি”।
চপল পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল নার্স। এখনও স্তব্ধ হয়ে আছে নিবিড় ।জ্ঞান ফিরার পর এমন একটা খুশীর সংবাদ পাবে, ভাবতে পারে নি সে। তার ঘরে আলো করে একটা ছোট বেবী আসবে। আধো আধো কন্ঠে ডাকবে ।ছোট ছোট হাত দিয়ে হাঁটতে শুরু করবে। ভাবতেই শরীরটা অদ্ভুত এক অনুভূতির সম্মুখীন হচ্ছে । মেহেরের কথা শুনে মৃদু হাসলো নিবিড়।
মেয়েটা বাইরে থেকে যতোই নিবিড়ের সাথে ঝগড়া করুন না কেন? ভেতরে ভেতরে অসম্ভব ভালো বাসে।
নাজমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে নিবিড়। না ,,হ্যা ছাড়া কোনো বাক্য উচ্চারণ করে নি সে। পুরোটা সময় দরজার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিল। এই বুঝি মেহের এলো কিন্তু তার ভাবনা মিথ্যা প্রমাণ করে মেহের এলো না। নিজের ভেতরের কৌতূহল দমন করতে না পেরে আমতা আমতা করে বলল ..
— “মা মেহের কোথায়” ?
মস্তিষ্ক সচল হতে শুরু করলো নাজমার। তখন বুঝে না বুঝে । যা মুখে এসেছে মেহেরকে বলে ফেলেছে। অনুসূচনায় মাথা নত হয়ে গেল। সন্তানকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে কোনো মা শান্তিতে থাকতে পারে না। নিবিড়ের হাত ধরে করুন সুরে বললেন..
— “আমি জানি না , মেহের কোথায় গেছে। তুই যা গিয়ে মেহের কে নিয়ে আয়। আমি মেহেরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবো”।
ধীরে ধীরে পুরো ঘটনা খুলে বলল নাজমা। সব কথা শুনে আঁতকে উঠলো নিবিড়। সে মেহের কে যতদূর চিনে নিজের কোনো ক্ষতি করে না দেয়। নিজেকে সামলে হসপিটালের ড্রেস চেঞ্জ না করেই বেরিয়ে এলো।
_______________________
অন্ধকারের অতলে তলিয়ে গেছে পৃথিবীর এককোণ।আজ চাঁদহীন আকাশটায় একটা তারার অস্তিত্ব নেই। অমাবস্যার তিথি লেগেছে। নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে। রাস্তা-ঘাট পানিতে ছুঁইছুঁই। নদীর তীর অবস্থিত ঘর-বাড়ি গুলো পানিতে খানিকটা তলিয়ে গেছে। আসে পাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। জোনাকি পোকার আলোয় চারদিক ঝিকঝিক করছে । নদীর বিকট গর্জনের কাছে সবকিছু হার মেনে নিতে বাধ্য।
রাস্তার উপর শান্তমনে বসে আছে মেহের। জীবনটা ইতি টানতে গিয়েও অবুঝ শিশুটার জন্য পারছে না। বারবার ইচ্ছে করছে নিবিড়ের হাত ধরে বাঁচতে। ছোট একটা সংসার সাজাতে। তাও পারছে না। চোখ বন্ধ করে নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার আগেই একটা বলিষ্ঠ হাত তার কোমর জরিয়ে রাস্তায় নিয়ে এলো। অশ্রুসিক্ত নয়নে তার চোখের দিকে তাকাতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মেহের ।তার সামনে নিবিড় দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো নিবিড়ের চিবুকে। গলা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। অজশ্র চুমুতে ভরিয়ে দিল সে ।
বুক থেকে পাথর নেমে গেল নিবিড়ের। একটু হলেই যেন প্রিয় দুজনকে হারিয়ে ফেলতো। বাহুতে হাত রেখে সরিয়ে নিল। হাঁটু গেড়ে নিচে বসে আলতোভাবে পেটে চুমু খেল। আপনাআপনি মুখ থেকে বেরিয়ে এলো..
–” আমার অংশ”।
সেকেন্ডের মাঝেই মুখের আকৃতি পরিবর্তন হতে লাগল। গাল চেপে মেহের কে নিজের কাছে এনে চেঁচিয়ে বলল…
–” অনেক আদর ভালবাসায় ভরিয়ে রেখেছিলাম তোকে। তার ফলস্বরূপ, তোর পাখা গজিয়ে। আমাকে না জানিয়ে আমার সন্তানকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলি। ঘৃন্না করেনি নিজের প্রতি, কিভাবে পারলি মা হয়ে সন্তানকে মেরে ফেলার কথা ভাবতে।
এবার বোঝাবো আমি যতটা ভালোবাসতে পারি ততটা হিংস্র হতে পারি। আজ আমরা তিনজনে একসাথে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরবো। এখানে শেষ হবে “মেহুবিড়” ভালোবাসা। চল..
হাত ধরে টানতে টানতে এগিয়ে গেল নিবিড়। হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে মেহের। শরীরটা ক্রমশ দূর্বল হয়ে আসছে। নিজের প্রতি ঘৃণা করছে ,, কিভাবে একটা ভুলের পর অন্য আরেকটা ভুল করতে চেয়েছিল। যখন নিবিড়ের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে ব্যর্থ হলো। তখন কুপিয়ে কুপিয়ে কেঁদে উঠলো..
–” নিবিড় আই এম সরি। আমি আর কখনো মরার কথা ভাববো না, প্লীজ এমনটা করো না “।
কাঁদতে কাঁদতে নিবিড়ের পা জড়িয়ে ধরলো মেহের। পূর্ণরায় মেহের কে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল। আজ এমন একটা শিক্ষা মেহেরকে দিবে, যাতে মরার কথা মনে না আনে। হাত ছেড়ে স্রোতের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল..
–” তোমার প্রানহীন দেহটা আমি দেখতে পারবো না মেহের । তাই তোমার আগে আমিই না হয় ….
বাক্য শেষ করলো না নিবিড়। নদীর মাঝে ঝাঁপ দিলো। থমকে গেল মেহের । বোধগম্য হতেই জোরে চিৎকার করে উঠলো, ” নিবিড়ড়ড়ড়ড়ড়..”
ঘনঘন শ্বাস নিয়ে নিবিড়ের ঝাঁপ দেওয়া জায়গাটার দিকে তাকিয়ে রইল। বুকের বাপাশে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করল। মেহের ঝাঁপ দেওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেল। থামিয়ে দিল নিবিড়ের সেই কথাগুলো ।
” আমাকে না জানিয়ে, আমার সন্তানকে শেষ করে দিতে চাইছিলি? ঘৃণায় করেনি নিজের প্রতি,, কিভাবে পারলি মা হয়ে সন্তানকে মেরে ফেলার কথা ভাবতে।”
মাটি খামচে নিচে বসে কেঁদে উঠলো মেহের।
— “নিবিড়ড়ড়.. প্লীজ ফিরে এসো । তুমি কিভাবে স্বার্থপরের মতো তোমার মেহু, ছোট সোনাকে ছেড়ে ..
— “ছোট সোনাকে ছেড়ে কি করেছি”?
বলেই কোলে তুলে নিল মেহেরকে ।নিবিড়কে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল মেহের। পড়নে হসপিটালের পোশাকটা ভেজা। মেহেরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল..
— “সাঁতার জানা মানুষ কখনো নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরেছে জানা ছিলো না। ঠিক এতোটাই কষ্ট লাগে যখন তোমার কোনো ক্ষতি আমাকে দেখতে হয়।
আচ্ছা একটা জিনিস ভেবে দেখেছ মেহের। এই নদীর তীরে তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিলো । আজ পাক্কা একবছর পর আমরা আবার এখানে। তবে দুজন নয় তিনজন ।
কে বলেছে নদী আমাদের জীবন থেকে প্রিয় মানুষদের কেড়ে নেয়। শুধু কেড়ে নেয় না, ফিরিয়েও দেয়। যেমন আমাকে একজন থেকে তিনজন করে দিয়েছে । আগামী বছর আবার আসব তবে তিনজন না চারজন। এরপরে বছরে বছরে একজন করে বাড়বে” ।
লজ্জার্থ মুখটা নিবিড়ের চিবুকে লুকিয়ে বলল..
— “ধ্যাত, এমন হলে আস্তে আস্তে একটা মহাদেশের পুরোটা আমাদের নিজেদেরই লাগবে “।
— “লাগলে লাগবে । সবাইকে জানাতে হবে না। “মেহুবিড়” এর ভালোবাসা কতটা গভীর”।
উচ্চস্বরে হেসে উঠলো দুজনে। সুখে শান্তিতে থাকুক “মেহেবিড়” জুটি। সামান্য “এক মুঠো ভালোবাসা” থেকে জন্ম নিক না, এক পৃথিবী সমপরিমাণ ভালোবাসা। ভালো থাকুন পৃথিবীর সব ভালোবাসা।
______________( সমাপ্ত)_________________
আসসালামুয়ালাইকুম,, কেমন আছেন আপনারা ?? আশা করি সবাই ভালো আছেন? এখানে শেষ করলাম ” মেহুবিড়” জুটির ভালোবাসা । কালকে থেকে অন্য জুটির গল্প লিখবো ।#নেশাক্ত_তোর_শহর সেখানেও আপনাদের পাশে চাই । ভালো থাকবেন সবাই ।আল্লাহ হাফেজ 💝