মেঘের আড়ালে চাঁদ পর্ব ১১

0
451

মেঘের আড়ালে চাঁদ ১১

মিজানের জীবনে অনেক আগেই পরিবর্তন এসেছে, আমিই যুদ্ধ শুরুর আগে এর ভয়াবহতা বুঝিনি, আমি এখনো শিউরে উঠছি বারবার, শিমুল ভাই নিজে এসে আমাকে ধানমন্ডি থেকে সরাসরি রওনা দিতে বললেন, আমি পূর্বাচলে গিয়ে আগে ফ্রেস হতে চাইলাম, কি ভেবে রাজি হলেন,

আমি ফিরে দেখি মিজান রেডি, আমার ব্যাগ ও প্যাক করে ফেলেছে, একটু লজ্জা পেলাম, পুরুষ মানুষ আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র গুছিয়েছে…. শিমুল ভাইয়ের ড্রাইভার তাড়া দিল, আলো থাকতে শ্রিমঙ্গল পৌঁছাতে চেষ্টা করবে।

গাড়িতে উঠলাম, এই যাযাবর জীবনের শেষ কোথায়? এত তাড়াতাড়ি ক্লান্ত আমি! মিজান সামনে বসেছে, তার চোখে মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই৷ দারোয়ান আর মালিকে বকসিস দিতে মনে নেই, ড্রাইভার কে কথাটা বলতেই মিজান বলল, সে দিয়েছে, আমি অবাক হলাম, ও টাকা পেল কোথায়। গাড়ি হাইওয়েতে উঠার পরেই ঘুমে শরীর জড়িয়ে আসতে শুরু করল, সারাদিনের ক্লান্তি ভর করেছে শরীরে, কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা, ঘুম ভাঙল হাইওয়ে রেস্তোরাঁয়, মিজান আমাকে ডেকে ফ্রেস হয়ে নিতে বলল, ড্রাইভার ও কিছু খাবে, আমি নামলাম গাড়ি থেকে, মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো, মিজান যেন তৈরিই ছিল, তড়িৎ গতিতে সামলে নিল

•আসুন, দোতলায় যাই, নিচে মানুষ বেশি
•চল
সিড়িতেও আমার পিছনে ছিল, যাতে সমস্যা হলে ধরতে পারে।
ফ্রেস হয়ে এসে,
দুটো চায়ের অর্ডার দিলাম। এখানকার খাবার কেমন বুঝতে পারছি না, মিজান আসুক। কিন্তু প্রায় আধাঘন্টা হয়ে গেছে, ওর খবর নেই, আমি এক ওয়েটার কে অনুরোধ করলাম রেস্ট রুমে খুঁজে আসতে, সে জানালো, মিজান নামের কেউ নেই
! কি বিপদ! ফোন ও নেই ওর কাছে! যদিও বাস ছাড়ার টেনশন নেই! এটা মনে হতেই চেয়ারে গা এলিয়ে চা খেতে শুরু করলাম, গেছে হয়তো আশেপাশে, চা সিগারেট খেতে…. কিন্তু ও তো সিগারেট খায়না! অন্তত আমি দেখিনি। ব্যাগে ফোন বাজতে শুরু করল, রিসিভ করলাম, শিমুল ভাই
•হ্যালো
•তোমরা বেশি থেম না। হালকা নাস্তা করে চলে যাও। আমি রিসোর্টে বলে দিয়েছি, ওরা সব অ্যারেঞ্জ করেছে, কোন সমস্যা হবে না।
•জি ভাইয়া
উনি ফোন রাখার পর মনে হল, মিজানের কথা বলতে হত?
থাক, অযথা টেনশনে পড়বেন। মিজান এলো পুরো এক ঘন্টা পর।

আমি কয় কাপ কফি সাবাড় করেছি এই ঘন্টায়, তা বিল দেখে বুঝলাম। মিজান কোন কৈফিয়ত না, কিছুই না এমন মুখ করে খাচ্ছে, যেন একটা বিশাল ভার তার কাধ থেকে নেমে গেছে, সে মুক্ত, আমি খাওয়ার মধ্যে কোন কথা বললাম না। আমরা আবার গাড়িতে উঠলাম,

শ্রীমঙ্গল রিসোর্টে পৌঁছে গেলাম প্রায় সন্ধ্যায় ,সূর্য যখন ধরিত্রীর সাথে বিদায় আলাপে মত্ত।
এত অদ্ভুত সুন্দর জায়গা আছে বাংলাদেশে? আমার খুব আফসোস হল, এই জায়গা শিশির দেখে যেতে পারেনি, ছয়টা মাটির ঘর ছনে ছাওয়া, আমাদের দেখে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হল, পুরো এলাকায় আর কোন আলো নেই, ছয়টার মধ্যে শুধু দুটো আলোকিত, ছনের উপর মরিচ বাতি সাজানো, একজন কেতাদুরস্ত পোশাক পরা কর্মচারী এলো, আমাদের অভিবাদন জানিয়ে ঘর দেখিয়ে দিল, ঘরগুলো টিলার উপর, দরজা খুলেই আমি হতবাক!
বাইরে গ্রামের আবহ, কিন্তু ভিতরে আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে সুসজ্জিত। আমি ফ্রেস হতে গেলাম। মাটির দেয়াল শুধু, বাকিসব অত্যাধুনিক। ফ্রেস হয়ে বের হয়ে দেখি টেবিলে মেন্যু কার্ড রাখা, কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না, দরজায় শব্দ পেয়ে খুলে দিলাম, মিজান একেবারে গোসল সেরে নিয়েছে, চুল ভেজা!
•খাবেন কিছু? ভেতরে আসি?
•এসো, মাথা দপদপ করছে, ঘুমিয়ে যাব হয়তো
•তাহলে রাতের খাবারের কথা বলি?
•আচ্ছা ডাক
বেল টিপতেই ছেলেটা হাজির,
•রাতের খাবারে কি কি আছে?
•ম্যাম দেশি মুরগি, ডাল,ভাত, সবজি আজ রাতের জন্য , চিকেন আর মাছের বারবিকিউ এর জন্য আমাদের একদিন আগে বলে রাখলেই হবে।
•আচ্ছা, যা আছে দিন।
•জি ম্যাম
•এক মিনিট, পুরো রিসোর্ট ফাঁকা কেন?
•ম্যাম এটা প্রাইভেট রিসোর্ট, পিছনে অনেক বড় জায়গা জুড়ে পাখির অভয়ারণ্য।

রাতের খাবার শেষে কুড়ে ঘরের পিছনে ব্যালকনিতে বসলাম, একদম খোলা, মিজান চুপ করে প্রকৃতির শব্দ শুনছে, নিস্তব্ধতার ও যে কণ্ঠ হয়, আমার জানা ছিল না, শুনশান নীরবতার মাঝে ঝিঝি পোকার ডাক, দূরে শেয়ালের ডাক শুনে একটু নড়েচড়ে বসলাম, মিজান হেসে বলল,
•ভয় পাচ্ছেন?
•উহু
•কখনো গ্রামে থেকেছেন?
•ঈদে যেতাম
•মাটির ঘরে থেকেছেন?
•না, টিনের ঘর ছিল
•মাটির ঘরে এত এসি লাগেনা, যদিও এখানে দেওয়া আছে, রাতে পোকার জন্য স্লাইড ডোর খোলা রাখা যাবেনা, সে জন্য বোধহয়, আর গ্রামে এত আলো থাকেনা,
•আলো নিভিয়ে আসব?
•ভয় পাবেন না?
•না!
•একটু আগেই শেয়ালের ডাকে কেমন কেঁপে উঠলেন, হাহা!
•আমাদের একটা ব্যক্তিগত আলাপ আধা রয়ে গেছে
•কোথায় আধা?
•সেদিন, ঐ যে ফোন এলো….. আমি আমার কথা বলে দিয়েছি, আপনি আপনার মতামত দেননি
•তুমি কি কেসের জন্য আমায় বিয়ে করতে চাও?
•না, ঐ কেস শেষ হলে আপনি আপনার আগের জীবন ফিরে পাবেন, আমিও কষ্টে শিষ্টে দিন পার করে নেব। কিন্তু যে অসীম একাকীত্ব আপনি ভোগ করে চলেছেন, নির্ঘুম রাতগুলোর অবসান চাই এবার!
•আমি এমন জীবন চাইনি, আমিও চেয়েছি স্বামীর ভালোবাসা, ভরা সংসার, সন্তান
•আল্লাহ চাইলে সব পাবেন
•কিন্তু
•হ্যা, কিন্তু আছে….. আমার আপনার বয়স, সামাজিক, অর্থনৈতিক দূরত্ব, এটা পেরিয়ে কি কাছে আসা যায়? সিদ্ধান্ত আপনার! কারণ কথা এই সমাজে মেয়েদেরই শুনতে হয়।
•তা ঠিক, মিজানের সরাসরি প্রস্তাবে ভালো লাগছে। অনেক হালকা লাগছে….. একা একা এই অনুভূতির বোঝা বহন করে চলেছি এতদিন!
•আপনি ভাবুন, জলদি নেই, এখানে আমাদের বেশ কিছুদিন থাকতে হবে।
•সামনের মাসেই তো শুনানি
•দেখা যাক, কেমন শুনানি হয়। আসুন সবকিছু লক করে ঘুমিয়ে যান। জানালাও খোলার দরকার নেই।
•কেন?
•পোকা, ফড়িং আসবে আলোর টানে!
•হুম ঠিক আছে, রুম সার্ভিস কে বলে দিয়েছি, আপনার রুমের জেনারেটর যেন কোনভাবেই বন্ধ না হয়।
•কেন?
•সার্বক্ষণিক আলোর প্রয়োজন।
•তোমার?
•আমার অভ্যাস আছে।
•আসি, শুভ রাত্রি।
•শুভ রাত্রি।

গভীর রাতে ঘুম ভাঙল,
কেন ভাঙল জানিনা, বাইরে টিপটিপ শব্দ, খড়ের ছাদে পানি পড়ার শব্দ৷ উঠে পানি খেলাম, আমার রাতে ঘুম হয়না, জার্নির ধকলে ঘুমিয়েছিলাম৷ লাইট জ্বালাতে গিয়ে দেখি লাইট জ্বলে না, মোবাইলের আলোয় টেবিলে রাখা মোমবাতি চোখে পড়ল, তাড়াতাড়ি জ্বালিয়ে নিলাম, এতে যেন অন্ধকার আরো বেড়ে গেল, ঘরময় পায়চারি করছি, আমার ব্র‍্যান্ড নিউ ল্যাপটপ খোলা নিষেধ, শিমুল ভাই জানাবেন। ফোনেই একটা উপন্যাস পড়তে শুরু করলাম, এই পরিবেশে বুদ্ধদেব গুহ বেস্ট, উনার মত করে কি ডিটেইলিং টা পারব কোনদিন? ভেতরের লেখক সত্ত্বা আবার জেগে উঠেছে, অসমাপ্ত একটা গল্প শেষ করে, প্রুফ দেখে মেইল করলাম পত্রিকার সম্পাদককে, শিমুল ভাইয়ের নিষেধাজ্ঞা ভুলে গিয়ে!
তারপর ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে গেলাম।

#
মোহনার রাত নির্ঘুম। বাবা,মা দুলাভাইয়ের সাথে তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে,
হ্যা, এটা ঠিক যে, আপা, বাবুর মৃত্যুর পরও দুলাভাই নিরলস ভাবে তাদের সাহায্য করেছে। তার মামার জমিতে ঘর তুলে দিয়েছে, তাকে নতুন করে কলেজে ভর্তি করিয়েছেন৷ এটাও সত্যি যে তিনি মানুষ ভালো, বোনের দৃষ্টিতেই দেখেছেন, কিন্তু তার কি দোষ? ভাইয়ের জেদের কারণে আপা চলে গেল, আজ তার জীবন ও কেমন অদ্ভুত পথে চলছে, বাবা তো কোনকিছুর অভাব রাখেননি, অথচ আজ এক মরা মেয়ের জন্য এভাবে পরের ভিটায় ভিখিরির মত আছে তারা….

পুরো দেশে কত কত রেপ হচ্ছে, খুন হচ্ছে! কই? কয়টার বিচার হচ্ছে? একবারের জন্যও কি ভাই পরিবারের কথা ভাবল না? দুই বোনের কথা ভুলে গেল? আশরাফুন্নেসাকে সে বোন মানত! আপন বোনের চেয়েও বেশি? সে স্পষ্ট শুনেছে,
পুলিশের লোক বলছিল বাবাকে,
এক বুড়ি লেখিকা ও যুক্ত হয়েছে কেসের সাথে, ভাইয়ের নাকি লাইফ সেট, মহিলা বিধবা, অনেক টাকার মালিক, ভাই আর ঐ মহিলা নাকি এক বাসায় থাকে….. ছিহ! আদালতে খুব ছি ছি হয়েছে, মান সম্মান বলে কিছু নেই!

মোহনা দরজা খুলে বের হয়, উঠান পেরিয়ে, পুকুর ঘিরে ফলের বাগান, তারপর ধানক্ষেত, সে পুকুর পাড়ে বসতে গেল, বাশের তৈরি পুকুর ঘাট আছে, শ্যাওলা জমা সবুজ পানিতে পা ডুবিয়ে দুলাভাই বসে আছে!

মোহনার পায়ের শব্দে সেলিম মুখ তুলে তাকায়।
•তুমি? এই সময়?
•ঘুম আসেনি
•আচ্ছা, বসবে? বস, আমি যাই
•না দুলাভাই, আপনি থাকেন, আমার কোন সমস্যা নাই, ইতস্তত ভাবে বসল মোহনা
•সে আমি আগেই বুঝেছি….. তোমাকে ছোট থেকে দেখছি! মামা যে কিভাবে বিয়ের কথাটা বলল, আমি মামার সঙ্গে আলাপ করে নেব, তুমি টেনশন করো না, পড়াশোনায় মন দাও।
•আর আপনি?
•আমি ছুটি শেষে, সিলেট চলে যাব।
•না, মানে বাকি জীবন একা থাকবেন?
•তা জানিনা, ভবিষ্যতে কি হবে…. এই দেখ মৃত্তিকা ম্যাডাম কি ভেবেছিলেন, তার জীবনে মিজান আসবে?
•মৃত্তিকা ম্যাডাম?
•হ্যা, সেই লেখিকা, যিনি এত সাহায্য করছেন।
•ঐ মহিলা ভাইকে বিয়ে করার জন্য এসব করছে?
ছি ছি!
•আরে? কি বল এসব? উনি তোমার ভাইকে বিয়ে করতে কেন চাইবে?
•ভাইয়ের বয়স কম, দেখতে ভালো…
হো হো করে হাসে সেলিম, অবাক চোখে দেখে মোহনা,
•হ্যা মানছি সব বোনের কাছে তার ভাই সুন্দর! তাই বলে একজন সম্মানিত ব্যক্তির সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ করা ঠিক না। উনি বিখ্যাত লেখিকা, বাংলাদেশ ছাড়াও বিদেশেও উনার বইয়ের কদর অনেক ,উনি দেশ বিদেশ ঘুরেছেন, বিয়ের দুই বছরের মাথায় উনি বিধবা হয়ে একাই আছেন। এতগুলো বছর সম্মানের সাথে একা ছিলেন। কত লেখক, কবির সাথেই পরিচয় আছে উনার….. যদি খারাপ কিছু করতেন তাহলে সেই খবর বাতাসের আগে কানে যেত! আর এত এত পুরুষ দেখেও তিনি শেষমেশ মিজানের প্রেমে পড়ে কাজ করছেন! এটা ভাবা ভুল। তবে কাজ করতে করতে তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেললে ভুল কোথায়? আর তোমার দৃষ্টিতে তাহলে আমিও খারাপ! বৌ মরে যেতেই বিয়ে করতে চাইছি!
•আমি সেটা বলিনি
•তোমার বয়স কম, অনেক কিছু বোঝ না। কিন্তু এসব ভুল চিন্তা থেকে বের হও।
•জি ঠিক আছে
•আমি উঠি, মামার সঙ্গে কথা বলব আজই, তোমার এখনো সেই পরিপক্কতা আসেনি। এভাবে বিয়ে করলে দুটো জীবন নষ্ট হবে। আর এই যে ঘর তোলা হয়েছে, পুরো টাকা দিয়েছেন ঐ লেখিকা, যাকে নিয়ে বাজে বকছ। আর তোমার ভাই এমন কিছু হয়ে যায়নি যে তার প্রেমের জন্য, উনি এত কিছু করবেন। উনি যা করছেন মানবিকতার খাতিরে করছেন।

মোহনা পুকুর ঘাটে বসে, দু হাতে মুখ ঢেকে কাদতে থাকে, দুলাভাই রাগত স্বরে কোনদিন তার সাথে কথা বলেনি, আসলেই এসব তার ভুল চিন্তা? ভাই যা করছে, ঐ মহিলা যা করছে তাই ঠিক? এতগুলো জীবন ধ্বংস করে হলেও বিচার চাইতে হবে? কি হবে বিচার হলে? মরা মেয়েটা ফিরবে?
এত এত প্রশ্নে জর্জরিত মন তার….. কে দেবে এর জবাব?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here