মেঘের আড়ালে চাঁদ
(১২)
মিজানের ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে, ফজর কাজা হয়ে গেছে ক্লান্তিতে, উঠে নামাজ পড়ে পর্দা সরালো , কুটিরগুলো একটা বড় টিলার উপর, ঢাল বেয়ে নামা যায় না, সিড়ি আছে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সবুজ প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করল। রুম সার্ভিস কে ডেকে চা চাইল, কালকের ছেলেটাই এসেছে,
•কি নাম আপনার?
•স্যার শোভন
•স্যার বলতে হবেনা, আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ, মৃত্তিকা ম্যাডামের সাথে আছি, নাহলে এখানে থাকার মত সামর্থ্য আমার নাই
•এ জন্যই আপনাকে আরো বেশি করে স্যার ডাকা উচিত!
•কেন?
•কেউ যখন নিম্নবিত্ত থেকে হুট করে উচ্চবিত্ত হয়ে যায়, তাদের আচার ব্যবহার খুব খারাপ হয়ে যায়। কত জায়গায় কাজ করেছি, কেউ হাসিমুখে অর্ডারটুকু করতে চায় না। টিপস চাই না। শুধু আমাদের মানুষ ভাবুক এটুকুই চাই।
•ভালো বলেছেন, আমার নাম মিজান। ভাই ডাকলে খুশি হব
•আচ্ছা মিজান ভাই, চায়ের সাথে আর কিছু? নাস্তা কখন খাবেন?
•ম্যাডাম উঠতে দেরি আছে, আমি চা খেয়ে আশপাশে একটু চক্কর লাগাই, তারপর খাব
•আচ্ছা ভাই চা আনছি
চা খেয়ে ঘুরতে বের হল মিজান। অনেকটা ঢাল বেয়ে নামল, মাটির সিড়ি, গাছের গুড়ি বসানো হয়েছে যাতে মাটি ধুয়ে না যায়, অনেকটা নেমে পিছনে ফিরে দেখে কুটির গুলো অনেক ছোট লাগছে! কোন জনমানব নেই, এই বিশাল এলাকায় ওরা তিনজন মাত্র?
আরেকটু নামতে চোখে পড়ে দুটো হ্যামক ঝুলিয়ে রাখা, সে আলগোছে বসতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে, চারপাশে তাকিয়ে দেখে, আম গাছের ডালে বসা একটা কাক ছাড়া কেউ দেখেনি! উঠে কাপড় ঝেড়ে আবার বসার চেষ্টা করে। এবার সুন্দর মত বসে দোল খায়! সবকিছুই আসলে শিখতে হয়, সে চাইলেই কি মিতুর মত লিখতে পারবে? তবে তার জীবনে ও অনেক পরিবর্তন এসেছে, মিতুকে ধীরে ধীরে ভালোবেসে ফেলাটা বিরাট একটা পরিবর্তন। মিতু জবাব দেয়নি। মিতুর বাসায় কথা বলার মত তো কেউ নেই, কিন্তু তার বাসায়? মা, বাবা,মোহনা, দুলাভাই কিভাবে নিবে বিষয়টা? সকালের মিষ্টি রোদ এখন মাথার উপর উঠে পুড়িয়ে দেওয়ার তাল করেছে, তাও গাছের পাতার ঘন চাদরে ঘেরা জায়গাটা, উঠে এলো মিজান, রুমে এসে হাত মুখ ধুয়ে ভাবল মিতুতে ডাকা যাক, এক সাথে নাস্তা করবে, কথাও হবে। কেসের সাথে ব্যক্তিগত জীবন মিলিয়ে ফেলা যাবেনা। কেস কেসের মত, ব্যক্তিগত জীবনে তার আঁচ আর পড়তে দেবেনা সে…..
#
গ্রামের কলেজ, ঠিকমতো ক্লাস হয়না। কিন্তু বাংলার শিক্ষক সুচিত্রা খুব ভালো পড়ান। এই গ্রামের মেয়ে, শিক্ষিতা, সুন্দরী কিন্তু এখনো বিয়ে হয়নি, তার যোগ্যতা আর গোত্র মিলছে না। তার ক্লাস কেউ মিস করেনা। বর্ষাকাল চলছে, প্রায়ই ক্লাস শেষে ঝুম বৃষ্টির কবলে পড়তে হয়, কিন্তু মোহনা আসে। সে মিস দেয়না। বাকিদের মা এটা সেটা বাহানা করে বাড়িতে আটকে দেয়, মোহনার মা কখনো তা করেননি। আজ ক্লাস শেষে মিস আশরাফুন্নেসা কেস নিয়ে আলাপ করলেন, সে ও গ্রামের মেয়ে, তাই যাদের ফেসবুক আছে তারা যেন বিচার চেয়ে পোস্ট গুলো শেয়ার দেয়, আরো মানুষকে জানায়, মোহনার চোখে পানি…
তাদের সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে এই কেসে, ভাইয়ের এই জেদে, সে এগিয়ে যায়, ম্যাডামের ফোনে লেখা গুলো পড়ে, ভিডিও দেখে, ফেরার পথে ম্যাডামের বাসা পড়ে তাই এক সাথে বের হয়, ম্যাডামের বাসা এসে গেল, সে বিদায় জানিয়ে ভিতরে গেল, একদিন চায়ের দাওয়াত ও দিল৷ হেসে সম্মতি জানিয়ে এগিয়ে চলল মোহনা, আরো কিছুটা পাকা রাস্তা ,তারপর মাটির রাস্তা হয়ে তাদের বাড়ি,
তখনই ঝুম বৃষ্টি নেমে এলো, রাস্তায় সকাল থেকেই জনমানব নেই, এখন তো মনে হচ্ছে ম্যাডামের বাসায় একটু বসে সেলিম ভাইকে ডাকা উচিত ছিল। তার কাছে ফোন নেই, গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছে আর মনে হচ্ছে এই একদল হায়েনা তার উপর ঝাপিয়ে পড়বে, বৃষ্টির তেজ বাড়ছে, কিন্তু মাথার উপর গাছের ছাউনি তাকে রক্ষা করছে, পুকুরে কোন বৌ ঝি ও নেই, মাটির রাস্তা এসে গেল, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মোহনা, এই এলাকার সবাই তো ভাই! বৃষ্টি উপভোগ করতে শুরু করে, পুকুরের পানিতে বৃষ্টির শব্দ, ভেজা মাটি,পাতার ঘ্রাণ নেয় প্রাণ ভরে, হাটার গতি বাড়িয়ে দেয়, গ্রামের মেয়ে সে, জল কাঁদায় হাটা কোন বিষয় না, মনের ভার অজান্তেই নেমে গেছে,
কি অদ্ভুত! আশরাফুন্নেসা ও তো অফিসে ভাইকে পেয়ে নিশ্চয়ই অনেক নিরাপদ বোধ করেছিল তার মত। ভাই তো পারেনি তাকে বাঁচাতে, আরো বিচার চাইতে গিয়ে বিপদ ডেকে এনেছে….. তাহলে মেয়েরা কি করবে? কি করা উচিত? সে ও তো আরো পড়তে চায়, নিজের পায়ে দাড়াতে চায়, সে ও কি ভুল? এখন বিয়ে করাই মঙ্গল? ভাবতে ভাবতে বাসায় পৌঁছে যায়, মা তার অবস্থা দেখে অবাক।
•যা গোসল করে আয়, কি অবস্থা করেছিস? মা জিজ্ঞেস করে
•মা? আমি কি ভুল? আমার পড়তে চাওয়া ভুল?
•কাঁদছিস কেন পাগলী? সেলিম তো বলেছে, তুই পড়বি, তারপর তাকে বিয়ে করতে চাইলে করবি, না চাইলে, অন্য কাউকে ভালোবাসলে, সে নিজে তোর বিয়ে দেবে। তাহলে এসব কথা আসছে কেন?
•আমি কি নিরাপদ?
• এই গ্রামের সবাই তোকে চেনে, কি হবে তোর?
•কিন্তু আমি যদি ঢাকা যেতে চাই? চাকরি করি?
•সবকিছু সবার জন্য না। যা গোসল করে আয়, খেতে দেই
•আচ্ছা
#
তাহিয়া (নিলয়ের স্ত্রী) , তোহফা (কন্যা) ইন্দোনেশিয়া থেকে ফিরে এসেছে। একটা কেসে পুরো সপ্তাহটা খুব ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে নিলয়৷ মিতু আপুর কেসটা এখন ঠান্ডা এক মাস পর শুনানি, তার চেয়ে বড় কথা হল ফেসবুক, ইউ টিউব ঠান্ডা হয়ে গেছে, শাহবাগে ইডেন, ঢাবির কিছু মেয়ে প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করে ,ছবি তুলে চলে যায়, কারো কিছুই আর যায় আসে না! আশরাফুন্নেসার বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না, নিলয় এক পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে খবর পায়, সেদিন যেতে পারেনি, তিন দিন পরে গিয়ে দেখে বাসায় তালা, নিলয় দোকানদারকে নিজের ফোন নম্বর দিয়ে চলে আসে, সেদিন রাতে আশরাফুন্নেসার মা কল দেন, তার বক্তব্য কেস আর তারা চালাবেন না, কর্মক্ষম দুজন মানুষ নেই হয়ে গেল, ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে তিনি আর এসবে জড়াবেন না। ঐ ভাড়া বাড়ি ছেড়ে বোনের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছেন, যতদিন কিছু করতে না পারেন থাকবেন , মাথার উপর ছাদটুকু হারাতে চান না,
এর পর এই কেস সংক্রান্ত কোনকিছুতে তিনি নেই, পুলিশ কে জানালেন না কেন, এই প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে গেলেন, খটকা লাগলো নিলয়ের, পরদিনই চলে গেল ঐ ভাড়া বাড়িতে,
বাড়ি ওয়ালার কাছে চাবি নিয়ে ঘর দেখতে গেল নিলয়, কেসের সুবাদেই ঢাকা আসা, ভাড়া দুই মাস ছিলেন, এক মাসের ভাড়া দিয়েছেন, আরেক মাসের টা এ্যাডভান্স নেওয়া ছিল, নাহলে এই বিধবা মহিলার কাছ থেকে কিভাবে টাকা চাইতেন? বাড়ি ওয়ালার মুখ ফসকে বিধবা শব্দটা টং করে বাজে নিলয়ের কানে, উনি স্বামীহারা বলতে পারতেন, ফরেনসিককে ফোন করার আগেই রান্নাঘরের বারান্দায় রক্তের ছিটা দেখে নিলয়, বাড়ি ওয়ালার মুখ সাদা!
•এটা কি?
•ঐ হবে কিছু একটা! মুরগির রক্ত মনে হয়! বারান্দায় জবাই দিয়েছে
•এই মহিলার দেশি মুরগি কিনে খাওয়ার বিলাসিতা করার টাকা ও মন কোনটাই ছিল না, আর একটু আগেই বললেন তিনি বিধবা। তার মানে আলতাফ হোসেন মারা গেছেন।
•ইয়ে মানে….. মুখ ফসকে….
•হ্যা, মুখ ফসকে সত্য বেরিয়ে এসেছে
•আমি কোন ঝামেলায় পড়ব না তো?
•আইন অনুযায়ী পড়ার কথা, কিন্তু আমি আপনাকে কোনরকম বিপদে ফেলব না, কারণ আপনি আলতাফ সাহেবের পরিবারকে অনেক সাহায্য করেছেন।
•আপনি কিভাবে জানলেন?
•জানতে চাইলেই জানা যায়…. বাকিটা আপনি বলুন।
•এক রাতে আমি টিভি দেখছি, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, দেখি ভাড়াটিয়ার ছোট মেয়েটা কাঁদছে, আমাকে নিচে ডাকছে, আমি তো খুবই অবাক, দরজা খোলা রেখেই আমি নিচে যাই, একবারের জন্যও আমার খারাপ কিছু মনে হয়নি। বাচ্চাগুলো পরীক্ষা দিতে গ্রামে গিয়েছিল, এসে দেখে আলতাফ হোসেনের লাশ পড়ে আছে, বস্তাবন্দি। টপটপ করে রক্ত ঝরছে বস্তা থেকে, ডাইনিং টেবিলের উপর একটা চিঠি কাউকে জানালে বাকিরাও বাঁচবে না। আমি বুদ্ধি করে ইমাম সাহেব কে ডাকি, উনি এসে সব দেখে বললেন, এখানে গোসল, জানাজা সারতে গেলে মানুষ জানবেই, তার চেয়ে গ্রামে সব হোক তিনি মসজিদের খেদমতগার দের ডেকে লাশ এ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিলেন, বাকিরাও তাতেই উঠে গ্রামে চলে গেল, টুকটাক যা আসবাব ছিল আমি কিছু নিয়েছি, কিছু বিক্রি করে টাকা বিকাশ করেছি, মসজিদের খেদমতগারেরাই বাসা ধুয়েমুছে সাফ করে গেছে, ওরা কথাটা গোপন রেখেছে, নিজের জানের হুমকি ভেবেই, আর বারান্দায় ওরা কাপড় ধুয়েছে, পানি নিয়েছে তখন লেগেছে এই ছিটা….
•হুম রাতের বেলা, অপরাধ ঘটলে প্রমাণ তো থাকেই, আর কারা দায়ী তাও আমরা জানি, কিন্তু কিছুই করার নেই, শুধুশুধু আপনাকে হয়রানি করার কোন মানে দেখিনা। অন্তত ছয় মাস ফ্ল্যাট ভাড়া দিবেন না। নিজেও বিপদে পড়বেন, আরেকটা পরিবার ও জড়িয়ে যাবে।
বাড়িওয়ালা যেন হাপ ছেড়ে বাচল, সে আপাতত ভাড়া দেওয়ার চিন্তা করছেই না ।নিলয় বাড়ি ফিরে গেল,
তাহিয়া চুল আচড়ে নিলয়ের কাছে এসে বসল।
নিলয় ভাবনার জগত থেকে কামনার জগতে পা দেওয়ার আগেই বেরসিক ফোন বেজে উঠল, ফোন সরিয়ে স্ত্রীর দিকে মনোযোগ দিতেই তাহিয়া ইশারা করল ফোন ধরতে, সে ইমার্জেন্সি অফিসার না, আগে পুলিশ যাবে, তদন্তের লেজে গোবরে করবে, তারপর থেকে তার কাজ শুরু, এই বর্ষণমুখর রাতে, ফারহান শিকদার ও হয়তো কোন মেয়ে জুটিয়ে নিয়েছে, তার কপালটাই ফাটা। ফোন ধরতেই জুনিয়র অফিসারের কণ্ঠ ফারহান শিকদারের ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, স্পট ডেড! যা শালা! আইসিইউ তে দশ দিন থেকে মরলেও তো বিলটা পেত জনগণ! উঠে পোশাক বদলে বের হল, ফারহানের অ্যাক্সিডেন্ট স্পট দেখতে। পুলিশের গাড়ি তার বাসার নিচেই অপেক্ষা করছে, তাহিয়া কে আলতো করে চুমো খেয়ে, দরজা ভালো করে তালা দিয়ে ঘুমাতে বলল, আজ ফিরেই এদের আবার কোথাও পাঠাতে হবে। এই বাসা নিরাপদ না….
(চলবে)