#নিয়তি
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
৪.
বাবার বাড়ি সকাল বেলাতেই চলে এসেছি। আমার বড় ভাই সুমন এবং বড় ভাবী হিয়া গিয়ে আমাদের দু’জনকে নিয়ে এসেছে। গতকাল রাতের ঘটনাটা এখনো মাথা থেকে সরেনি। চিৎকার দেওয়ার কারণ কী জানতে চাইলে আমি কিছুই বলতে পারিনি তাকে! আর অবাক করা বিষয় হলো সেই চোখজোড়াও উধাও হয়ে গেছিল নিমিষেই। প্রহর সাহেবকে বারান্দায় রেখেই আমি ঘরে চলে আসি এরপর। ঘুমোনোর বাহানা করে মাঝরাত পর্যন্ত শুয়ে থাকি। তিনি আরও একবার আমার কাছে আসতে চেয়েছিলেন, কেন যেন আমার মন টানেনি। কোথাও কিছু একটা চলছে- এরকমটা মনে হচ্ছিল বারবার। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নাকী সবসময় আগে থেকে অনেক কিছুর জানান দিয়ে দেয়। আমার বেলাতেও তাই হচ্ছে হয়তো,অর্থাৎ যা-ই ঘটছে তা জানতে হবে আমাকে এবং তা অতিদ্রুতই। কোনোকিছু নিশ্চিত না হয়ে আমি প্রহর সাহেবকেও কিছু বলতে পারছি না, আবার অন্য কাউকে শেয়ারও করতে পারছি না। আচ্ছা ঝামেলাতে পড়েছি! মনের উশখুশানি নেভাতে কিছু করা অতীব প্রয়োজন। গতকাল রাতে আরও যে জিনিসটা লক্ষ্য করেছি,তা হলো- আমি শোয়ার পরেও প্রহর সাহেব শুয়ে পড়েননি। ফোন নিয়ে প্রায় ঘন্টা দুই বসে ছিলেন। উনি ভেবেছেন, আমি ঘুমাচ্ছি, কিন্তু আমি সজাগ ছিলাম এবং তাকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। হয়তো বেচারাকে কাছে আসতে দেইনি বলে মন খারাপ ছিল, অথবা ঘুম আসছিল না তাই ফোন ঘাটছিল। স্বাভাবিক একটা বিষয় তবুও কেন যেন অস্বাভাবিক লাগছে! আমার ভেতরটাই সন্দেহ দিয়ে বোঝাই! ধুর.. নিজের প্রতি নিজেরই বিরক্ত লাগছে।
হিয়া ভাবী ঘরে ঢোকায় আমি নড়েচড়ে বসলাম। তাকে দেখে বুঝলাম তিনি অবাক কোনো কারণে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হইছে ভাবী?’
‘নাইওরে জামাই বউ আসে,থাকে। দুইদিনের দিন ও-বাড়ি থেকে কেউ এসে খেয়েদেয়ে তোদের নিয়ে যাবে- এমনটাই তো নিয়ম জানতাম।’
‘হুম, কেন?’
‘তোর ননদ চলে আসছে নাচতে নাচতে,দেখ বাইরে গিয়ে।’
আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম, ‘আমার ননদ!’
‘অধরা নাম করে মেয়েটার কথা বলছি।’
আমি রীতিমতো ঝটকা খেলাম। এখানে অধরা! কেন এসেছে? কী কারণ! অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ভাবীর দিকে। ভাবীর চোখমুখ কুঁচকে রয়েছে,যা দেখে অনুমান করতে পারছি অনেক কিছু! আমার ভেতরটা ধুকধুক করে উঠল। হিসাব মেলাতে চেষ্টা করলাম। গতকাল রাতে ওই ফোনে কথা বলার ব্যাপারটার সময় অধরার নাম দিয়েই চালিয়ে দিয়েছেন প্রহর সাহেব, আবার আজকে আমাদের বাড়িতে এই মেয়ে হাজির। এছাড়াও বিয়ের সময় অধরার কিছু কিছু ব্যাপার আমাকে খুব রাগিয়ে দিয়েছিল। যেমন- বারবার আমার বরের পাশে এসে বসে থাকা, উনার হাত ধরে টানাটানি করা, উনার সাথে ঘেষাঘেষি করা, আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে উনার সাথে খুব ক্লোজলি ছবি তোলা- এগুলো স্বাভাবিক মাইন্ডে নেওয়ার চেষ্টা করলেও কেন যেন এখন সবটাই অস্বাভাবিক লাগছে। রাগে ফের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আমার। পরিবর্তনটা ভাবী লক্ষ্য করে আমার কাঁধে ধাক্কা দিলো।
‘কীরে? এভাবে মুখ শক্ত করে আছিস কেন?’
‘কিছু না ভাবী।’ গমগমে কণ্ঠস্বরে বললাম আমি।
ভাবী বিশ্বাস করলেন না। উনি আমাদের বাড়িতে আছেন বছর তিনেক সময় হবে। অথচ সম্পর্কটা যেন আজন্মের! মায়ের পর যদি কেউ ভীষণ ভালোবাসা দিয়ে থাকে আমাকে- তবে সে এই ভাবী। ইনি আমার বান্ধবীর ন্যায়, সবসময় সবকিছু শেয়ার করি, সেও করেন। ভাবীর থেকে এসব যে লুকোতে পারবো না তা জানা কথা। তাই লুকোলাম না। ভাবীকে নিজের সন্দেহের সব কথা খুলে বললাম। সব শুনে হিয়া ভাবী থ হয়ে বসে রইলেন। আমার চোখে অশ্রু টলমল করছে। বিয়ে নিয়ে,সংসার নিয়ে,স্বামী নিয়ে ভীষণ ভীষণ ভীষষষষণণণ স্বপ্ন ছিল আমার চোখ জুড়ে,তা বোধকরি ভাবীও ভালো করেই জানেন। সেই আমার কপালেই এরকম কিছু ঘটবে! আশা করিনি কখনো।
মা’কে দেখে চোখের জল সামলালাম। মা বললেন,
‘কীরে! তোমরা দু’জনে কী গুটুর গুটুর করো? আর রূপ,তোর ননদ আসছে। তুই ঘরের কোণে খুটি গাড়ছিস কেন? আয়,বাইরে আয়। ওমা,তুই কাঁদিস কেন? তোর চোখে পানি কেন?’
মা কথা বলতে বলতে কাছে এলেন, আমি দ্রুত চোখ মুছলাম। ভাবী বললেন, ‘রূপের চোখে কী যেন ঢুকছে আম্মা। আমাকে দেখাচ্ছিল।’
আমিও ভাবীর কথায় তাল মেলালাম। মা আমাদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বোধহয় বিশ্বাস করলেন না অথবা বিশ্বাস করতেও পারেন! আমি কোনো রকমে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। এসেই দেখতে পেলাম প্রহর সাহেবের কাছ ঘেঁষে অধরা বসে রয়েছে। প্রহর সাহেব বিব্রত অধরার কারণে, আমি ধীর পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম।
অধরা বলল, ‘ভাইয়া আমাকে রেখে একা একা শ্বশুর বাড়ির আদর খেতে চলে এসেছে ভাবী। তাই আমিও চলে এলাম।’
‘এটা তো তোমার শ্বশুর বাড়ি না অধরা। তোমার ভাইয়া হাজারবার আসবে,তার মানে কী তুমিও হাজার বার আসবে?’ ঠোঁটে হাসি রেখেই কথাটি বললাম আমি। অধরার মুখে কালো মেঘ জমলো দেখলাম। প্রহর সাহেব অদ্ভুত চোখে আমাকে দেখছেন। আমি প্রসঙ্গ পালটে বললাম, ‘মজা করলাম। এসেছো,খুশি হয়েছি।’
অধরা মন খারাপ করে বলল, ‘থাক ভাবী, আমার আসাতে আপনি যে একটুও খুশি হননি,তা দেখেই বুঝতে পারছি।’
পেছন থেকে হিয়া ভাবী এসে বললেন, ‘শোনো, বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী সবসময়ই পারসোনাল সময় কাটাতে চায়। এই সময় কেউ ডিস্টার্ব করুক, এটা ভালো দেখায় না আর তারাও বিরক্ত হয়। তুমি অন্য ভাবে নিও না কথাটা। তবে তোমার এখন বেড়াতে আসা ঠিক হয়নি।’
অধরা শক্ত চোয়ালে বলল, ‘তাহলে আমি চলে যাই। আমি খুব খুব দুঃখীত ভাবী।’
অধরা উঠে দাঁড়ালে প্রহর সাহেব ওর হাত টেনে ধরে বলল, ‘রাগ করিস না প্লিজ।’ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ও থাকুক, কী সমস্যা? আমাদের ব্যক্তিগত টাইমের সময় ও তো আর আসতেছে না।’
‘না না,আমি আসাতে তোমাদের অনেক ঝামেলাতে ফেলে দিছি।’ চোখমুখ কালো করে বলল অধরা। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু’জনের তামাশা দেখলাম। প্রহর সাহেব বারবার ও’কে থাকার জন্য বলছেন। আর অধরা মোচড়ামুচড়ি করছে। আমি স্মিত হাস্যে বললাম, ‘থাকো অধরা। জীবনের সবচেয়ে বড় জিনিসটাই তোমার দায়িত্বে দিয়ে দিলাম। হয়তো এটাই শেষ দেখা আমাদের।’
বলে গটগট করে হেঁটে চলে এলাম ছাদে। রেখে এলাম তিনটি থমথমে মুখ, আমার ভীষণ খারাপ লাগছে,ভীষণ। সবকিছু কেমন খাপছাড়া হয়ে গেছে। জীবনের রঙ গুলো বেরঙিন হয়ে গেছে। চঞ্চল আর ছটফটে আমি আমাকে হারিয়ে ফেলেছি। সবচেয়ে পছন্দের কাজটি করতেও মন সায় না। কেন এমন হলো! কী দোষ ছিল আমার! যতবার ভাবি ততবারই মনটা হাউমাউ করে কাঁদে।
নিরবে চোখ মুছছি, ঘাড়ে কারো স্পর্শ অনুভব করতেই পেছন ফিরে তাকালাম। রক্ত চক্ষু করে প্রহর সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। আমি বললাম, ‘কিছু বলবেন?’
উনি খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘সমস্যা কী তোমার? এভাবে আমাকে অসম্মানিত না করলে হতো না? নাকী তোমাদের বাসায় আসছি দেখে কলিজা বড় হয়ে গেছে?’
‘এখানে কলিজা বড় হওয়ার কী দেখলেন?’
‘একটা টান দিবো ধরে, দম বের হয়ে যাবে বুঝছো?’
আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ইনি দেখছি আমার গায়ে হাত দিতেও দ্বিতীয়বার ভাববেন না!
‘তামশা করতেছো তুমি আর তোমার ভাবী মিলে? আমার বোনটা একটু আসছে না হয় কাউকে না বলেই,তাতে কী হইছে? ভাত কম পড়ছে তোমাদের বাসায়? নাকী তোমার আব্বার খাওয়ানোর সামর্থ্য নাই?’
সহ্য হলো না এইমুহূর্তে আর, সজোড়ে ধাক্কা দিয়ে বসলাম উনার গায়ে। দ্বিতীয় ধাক্কা দিতে গেলে উনি আমার হাত ধরে বসলেন। গালে থাপ্পড় লাগাতে এক সেকেন্ড ও সময় নিলেন না। শুনলাম ভীষণ বাজে ভাষায় আখ্যায়িত করছেন আমাকে। বলছেন, ‘গলায় একটা চিপা দিবো, রুহ বাইর করে ফেলবো তোর। তুই চিনোস আমাকে? চিনোস..তোর মতো মেয়ে আমার পায়ের তলারও যোগ্য না। অধরা যদি তাল-বাহানা না করতো তাহলে আজ ও আমার ওয়াইফ থাকতো। তোর মতো মেয়ের টাইম নাই আমার কাছে। যা.. সর, তালাক দিলাম তোকে। তালাক,তালাক,তালাক…’
আমি স্তব্ধ হয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখে কান্না,গালে যন্ত্রণা অথচ বুকে শান্তি। অবশেষে এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি হতে চলেছে আমার!
চলবে…
(গল্পটি প্রতিদিন দেওয়ার চেষ্টা করব এখন থেকে। আজকের পর্ব যাদের কাছেই পৌঁছোবে সবাই একটু রিয়েক্ট করবেন প্লিজ।)