নিয়তি পর্ব-৭

0
1863

#নিয়তি
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি

৭.
বর্তমানে থানায় আছি। প্রহর সাহেব ও তার প্রেমিকাকে গ্রেফতারের পর পরই আমাকে আসতে হয়েছে। বাসায় বড় কাকা ছিলেন না,আমি একা কী করে সন্ধ্যা বেলায় আসবো দেখে দাদী সঙ্গে করে সাদাফ ভাইয়া কে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি আর আমি বসে রয়েছি অফিসারের টেবিলে। প্রহর সাহেব ও অধরাকে রুমে ঢোকানো হলো। আমার আব্বা, প্রহর সাহেবের আম্মা সবাই চলে এসেছেন ইতিমধ্যে। অধরার চেহারার বিচ্ছিরি অবস্থা দেখলাম। কেঁদেকেটে ফুলে গেছে। আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে দেখে আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। মনের ভেতর একধরনের পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। এই আনন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই না। প্রহর সাহেব এখনো ঠাঁট বজায় রেখে কথা বলছেন। একজন মহিলা ও পুরুষ এসে ঢুকলো। এরা অধরার আব্বা আম্মা। আমার কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ করল যেন অধরার উপর থেকে সমস্ত অভিযোগ সরিয়ে নেই। ও ছোট মানুষ, ওত কিছু বোঝে না নাকী। অধরা হুট করে স্বর পরিবর্তন করল। জোড়ালো কণ্ঠে বলল, ‘ভালোবেসে দু’জনেই যেহেতু অপরাধ করেছি সেক্ষেত্রে দু’জনেই শাস্তি মাথা পেতে নিলাম। আমি কোত্থাও যাবো না উনাকে ছেড়ে।’
অফিসার বলে উঠলেন, ‘তুমি কী ভাবছো খুকি? এখানে তোমাদের এক সেলে হানিমুন করতে এনেছি আমরা?’
লজ্জা লাগলো আমার। পুলিশদের ঠোঁট কাটা স্বভাব হয়, ইনিও তাই। রসিয়ে রসিয়ে দু’জনকে জড়িয়ে নানান ধরনের লজ্জাজনক কথা বললেন। আমার কান ঝা ঝা করছে অথচ অধরাদের ভেতর কোনো পরিবর্তন নেই! কী নির্লজ্জ মেয়েরে বাবা! তার থেকেও বড় অবাক হচ্ছি প্রহর সাহেবের ভাব দেখে৷ মনে হচ্ছে এখানে উনাকে জামাই আপ্যায়নের জন্য ডেকে আনা হয়েছে। যাক,যখন দু’জনের ভেতর বিন্দু পরিমাণে কৃতকর্মের অনুতাপ নেই তখন আমার আর কী করার! আমাকে কিছু কাগজে সাইন করতে বলা হলো। আমি করলাম। চলে আসার সময় একটি কথাই বললাম, ‘প্রহর সাহেব। আমি একদিনের জন্য হলেও আপনার স্ত্রী ছিলাম! রোজ হাশরে আপনার স্ত্রীর মর্যাদাটাও আমাকেই পেতে হবে সেই কারণে,এই কথা ভাবতেই নিজের প্রতি ঘৃণা চলে আসছে। শুনুন, এমন যেন কখনো না হয়, আপনি সেজদায় মাথা ঠুকে ঠুকে আমাকে খুঁজছেন অথচ আল্লাহ আমার ছায়াটুকুও আপনার জন্য হারাম করে দিয়েছে! কখনো না হয় যেন! ভালো থাকবেন দু’জনে,দোয়া রইলো।’

আমার চোখের কোণে জমা জল আমি নিরবে মুছে নিলাম,সবার অগোচরে। বোধহয় না,কেননা সাদাফ ভাই ঠিকই আমাকে জল মুছতে দেখে ফেলেছেন।
আব্বা বললেন, ‘রূপ মা, তোর চাচায় বাসায় গিয়ে বেড়াবি কয়টা দিন?’
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘না বাবা। আমি বাসায় যাবো। তোমার বাসায় আমার জায়গা হবে তো?’
বাবা ছি ছি করলেন, ‘কীসব বলিস মা! বাবারা কী কখনো সন্তানদের ফেলে দিতে পারে বল? এইধরনের কথা কখনো ভাববিও না। তোর কেউ না থাকুক, এই বুড়ো বাপটা আছে আর সবসময় থাকবে।’
আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম বিধাতার কাছে। আমাকে স্বামীর ভালোবাসা দেয়নি তাতে কী? বাবা-মা সহ আরও অনেক আপনজনদের ভালোবাসা দিয়েছেন। যা আমার জন্য যথেষ্ট…
বাবার সাথে কয়েক কদম এগোতেই পেছন থেকে ডাক শুনতে পেলাম। সাদাফ ভাই এগিয়ে আসছেন। তাকে দেখে আমি দাঁড়ালাম। সম্পর্কে কাজিন হলেও তার সঙ্গে অনেকটা অচেনা মানুষের সম্পর্ক আমার সবসময়ই ছিল। একে তো বয়সে বড় অত্যধিক,তাই ঠিক মিশতে পারিনি। দ্বিতীয়ত উনি স্কুল পাশ করেই পড়াশোনার জন্য অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। তাই বাড়িতে আসতেন কম। বলতে গেলে পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান হলেই আমাদের দেখা হতো। তখন, ‘কীরে রূপ, কেমন আছিস?’ এ-ধরনের হাই-হ্যালো টাইপ কথাবার্তা হতো। তাই সাদাফ ভাইয়ের সামনে সবসময় সংকুচিত থাকি আমি। চাইলেও ফ্রি হতে পারি না। বাবা বললেন, ‘তুই দাঁড়া, আমি গাড়ি ঠিক করে আনি।’
আমি জবাব দিলাম, ‘আচ্ছা।’
বাবা চলে গেলেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম সাদাফ ভাইয়ের জন্য। উনি আমার মুখোমুখি এসে কাচুমাচু কণ্ঠে বললেন, ‘কেমন আছিস?’
আমি অবাক নয়ন মেললাম। এটা কী ‘কেমন আছিস’ জিজ্ঞেস করার সঠিক প্লেস! নাকী সঠিক সময়? এমনভাবে জিজ্ঞেস করছেন, না জানি কত বছর পর উনার সঙ্গে দেখা হলো আমার! আমার কেন যেন খুব হাসি পেয়ে গেল। আমি ফিক করে হেসে দিলাম। সাদাফ ভাই আমার হাসি দেখে খানিকটা স্বস্তি পেলেন বোধহয়। উনার কপালের মসৃণ ভাঁজ গুলো অনেকটাই মিলিয়ে গেল। আমি হাসি থামিয়ে বললাম, ‘জি, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন সাদাফ ভাই?’
‘আরে,হুম,ভালো। আমার আবার কী!’ বলতে বলতে উনি ঘাড় চুলকালেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ডাকলেন কেন?’
‘তুই মায়ের উপর রাগ করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিস তাই না? মা তোর সাথে কেমন ব্যবহার করেছে তা আমি দেখেছি রূপ।’ ভাইয়াকে এই পর্যায়ে অপ্রস্তুত দেখালো ভীষণ। আমি পাত্তা না দেবার ভান করে বললাম, ‘নাহ, তেমন কিছুই না। এমনিই, বাড়ির জন্য মন টানে বেশি। তাই।’
‘বুঝি,বয়স কী আর এমনিই হলো? শোন, বাঁধা দেবো না কিন্তু ইচ্ছে হলে দুটো দিন থেকে যা। জারিফা তোকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল। কেমন উচ্ছাস ছিল ওর,দেখিসনি? মা’র জন্য না হোক, জারিফার জন্য হলেও ঘুরে যাস।’
আমি তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম, চাচার বাড়িতেই যাবো এখন। দুটোদিন থেকে বাড়ি ফিরবো। সত্যি বলতে, জারিফাকে ভীষণ ভালো লাগে আমার। পুতুল পুতুল একটা মেয়ে,ভীষণ মায়াবী চেহারা। কণ্ঠটাও টানা। যখন ‘রু’ বলে ডাকে,শুনলে প্রাণ ভরে যায়। ও! বলা হয়নি, জারিফা আমাকে ‘রু’ বলে ডাকে সবসময়। বাবা ঠিক সেই মুহূর্তে এসে ডাকলেন নাম ধরে, ‘রূপ, মা, রিকশা চলে এসেছে।’
আমি সাদাফ ভাইকে কিছুই বললাম না। বাবার দিকে এগিয়ে গেলাম। সাদাফ ভাইয়ের ভাঁজমুক্ত কপালে আবারও ভাঁজ পড়ল। বেচারা ভাবছে,আমি রাগ করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি! ইশ,কী দরদ! নিজের কথায় নিজেই হাসলাম মনে মনে। কেন যেন সবকিছুই ভালো লাগছে এখন, সবকিছু!
আমি বাবাকে বুঝিয়ে বললাম যে দুটোদিন চাচার বাড়িতে বেড়াতে চাই। বাবা মানা করলেন না। তিনি চলে গেলেন। সাদাফ ভাই অন্যদিকে ফিরে ফোন টিপছেন। আমি পেছন থেকে তার পিঠ বরাবর আলতো টোকা দিতেই উনি কেঁপে উঠলেন। আমাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে চমকিত গলায় বললেন, ‘রূপ! যাসনি?’
আমি প্রাণোচ্ছল ভাবে এদিক ওদিক মাথা দোলালাম, ‘জি না। আপনাদের বাড়িতে যাব। সমস্যা কোনো?’
‘না,না! আমার সৌভাগ্য!’ ভাইয়া গদগদ কণ্ঠে বলে উঠলেন। আমরা দু’জনে মিলে রিকশা ঠিক করব যখন, তখন আমার শ্বাশুড়ি মা’কে আসতে দেখলাম। সঙ্গে অধরার বাবা-মাও আছেন। আমার হুট করে মনটা বিষন্নতায় ভরে উঠল। এই মহিলার তো কোনো দোষ নেই তবুও কী কঠিন যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন উনি। আমার অবাক লাগে,এমনও মা হয়! কী পাষন্ড! আমার শ্বাশুড়ির ছলছল চোখজোড়া আমাকে অনেক কিছু বলল গোপনে। আমিও চোখের ভাষায় তাকে বললাম, ‘ভালো থাকবেন আম্মা। আপনার প্রতি আমার সামান্যতম রাগ বা অভিযোগ নেই। আমার দুর্ভাগ্য, এত ভালো শ্বাশুড়ি পেয়েও হারাতে হচ্ছে!’
পরক্ষণেই চোখজোড়া অধরার বাবা-মায়ের দিকে গেল। তাদের আক্রোশ ভরা দৃষ্টি বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হলো না। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। মাঝে মাঝে অনেক কিছু উপেক্ষা করাই উত্তম।

***

টুংটাং আওয়াজে রিকশা এগিয়ে চলছে। রাস্তা মোটামুটি খালি। আমি চেপে বসে আছি, সাদাফ ভাইয়ের সঙ্গে বিন্দু পরিমাণে শরীর স্পর্শ হচ্ছে না। নিরব থেকে রাতের নিস্তব্ধতাকে অনুভব করছি। আজ কেন যেন খোলা পাখির ন্যায় লাগছে নিজেকে। অনেকদিন যাবত পিঞ্জরাতে বন্দী পাখি হঠাৎ মুক্তি পেলে যেমন লাগবে, ঠিক তেমন। সাদাফ ভাই ও চুপ করে আছেন। কিছু একটা না বললে ভালো দেখায় না, তাই নিজ থেকেই প্রশ্ন করলাম, ‘ভাবীর কী খবর ভাইয়া?’
ভাইয়া অপ্রস্তুত কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘আছে,ভালোই।’
‘এত গা-ছাড়া ভাব?’
ভাইয়া জবাব দিলেন না।
আমি ফের বললাম, ‘উনার প্রতি আপনার এত রাগ,কী নিয়ে? কী কারণে?’
ভাইয়া হঠাৎ কণ্ঠে কাঠিন্য যোগ করে বললেন, ‘তুই বুঝবি না। তোর বৈবাহিক পরিস্থিতি যেমন আলাদা,আমার টাও আলাদা।’
‘আমি ধরে রাখতে চেয়েছিলাম ভাইয়া, কিন্তু সে-ই থাকতে চায়নি।’
‘আর আমি রাখতেই চাই না রূপ।’
‘কেন? জারিফার কথা ভাবেন একবার!’
‘আমিই ওকে মায়ের আদর দেবো।’
‘এটা হয় না ভাইয়া। মা মা-ই হয়, আর বাবা বাবা। কেউ কারো শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে না।’
ভাইয়া ক্ষণকাল চুপ থেকে বললেন, ‘যে শূন্যস্থান ও আমার ভেতরে তৈরি করেছে,তা কোনোদিন পূরণ হবার নয় রূপ। তবুও বেঁচে আছি তো, আছি না? আমি যদি শূন্যস্থান নিয়েই বেঁচে থাকি, তাহলে আমার মেয়েও পারবে।’
এরপর কী বলতে হয় আমার বোধগম্য হলো না। বাড়ি কাছাকাছি তাই চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করলাম।

ভাইয়া কলিংবেল টিপলেন। আমার বুক ধুকপুক করছে। যদিও চলে এসেছি তবুও কাকী আবার কেমন রিয়্যাক্ট করবেন এই ভেবে ভীষণ ভয় লাগছে। কিন্তু আমাদের দু’জনকেই অবাক করে দিয়ে তন্দ্রা ভাবী দরজা খুললেন।

চলবে…
[সামনে ২-৩ দিনের ছুটি নিতে হবে আমার। তাই এখন ২-৩ দিন নিয়মিত প্রতিদিন ছোট ছোট পর্ব দিবো গল্পের।একটু সবাই লাইক দিয়েন। এত মানুষ পড়ে অথচ অল্প রিয়েক্ট আসে! আগ্রহ হারিয়ে ফেলার লেখার!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here