মেঘদিঘির পাড়ে – ২৭
মালিহা খান
সামান্য মুক্লপৃষ্ঠায় লিখে রাখা শব্দ অন্ত:স্হল অবধি দামামা তুলে দিলো। উপেক্ষা করা সম্ভবপর হলোনা। দূর্বলহাতে কাগজটা ভাঁজ করে টেবিলের বইয়ের তাঁকের মাঝে ঢুকিয়ে রাখলো ইভা। অত:পর লাজ ছাঁপিয়ে কপালের সীমান্ত পর্যন্ত ওড়না টেনে চুপচাপ নিচে নেমে গেলো।
সিঁড়ির মাঝামাঝি আসতেই ইউসুফ সমাদরে ডাক দিলো তাকে,”ইভা? এদিক আয়।”
ইভার অস্বস্তি উপশম হলো। শ্বেতসরোজতূল্য পবিত্র মুখখানি নত করে এগিয়ে গেলো সে। কোথায় বসবে বোঝার আগেই ইউসুফ হাত টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো। ভাইয়ের কর্মকান্ডের কারণটা গুনেগুনে সেকেন্ডখানেক পরেই ধরতে পারলো ইভা। সে যেখানে বসেছে তার ঠিক মুখোমুখি সোফাটায় বসে অধৈর্য, অস্থির লোকটা বসা। না তাকিয়েও বোঝা গেলো সমস্ত অভিনিবেশ তার উপরই ঘোরাফেরা করছে। আপাদমস্তক, সর্বাঙ্গে। ইভার গলা শুকিয়ে এলো। পারিবারিক আলাপে মন বসলো না। বারেবারে ঢোক গিলে অন্যদিকে চেয়ে রইলো সে। মনে মনে সহস্রাধিকবার ইউসুফকে শাসাতে ভুললোনা একমূহুর্তের জন্য।
খাবার টেবিলেজুড়ে তেজি রোদের ছ’টা আসছে। দুপুরে গ্রীষ্ম অথচ সন্ধ্যা নামতেই মোটাকাপড় ছাড়া বেরোনো যায়না। ইউসুফ, সরফরাজের মাঝের চেয়ারটায় বসেছে ইভা। কোলে বাহাদুর। বিভাও এসেছে টেবিলে, সরফরাজের অপরপাশে যেয়ে বসেছে। তার ম্রিয়মান মুখমন্ডলে একটা ছদ্ববেশী ক্ষীণ হাসি শোভা পাচ্ছে।
সায়নের পরণে কালো হাফহাতা টি-শার্ট। উপরে একটা ফুলহাতা সাদাশার্ট ছিলো গরম লাগায় সেটা খুলে রেখেছে।
হাফহাতা টি-শার্ট গায়ের সাথে সেঁটে আছে। বা-হাতের কঁনুইয়ের কাছে কাঁচঢোঁকা ক্ষতটা ভরে গেলেও গাঢ় দাগের চিন্হ রয়ে গেছে। ফর্সা হাতে মাসকয়েক পুরনো ক্ষতটা এখনো স্পষ্ট। সরফরাজ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
-“তোমার হাত কেটেছিলো কিকরে সায়ন? এভাবে!”তার কন্ঠে বিহ্বলতা ঝরে পড়ছে।
উপস্থিত সবার চোখ যেয়ে আটকালো সায়নের হাতে। ইভা থতমত খেয়ে চোখ তুলল। সেই দূর্ধর্ষ প্রণয়প্রতুষ্যের স্বৃতিচারণ হতেই নিমীলিত হয়ে গেলো সে। সায়ন ক্ষতটায় চোখ বুলালো একবার। সেই আঘাত, তার আঘাতে ইভার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল, ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ঘন্টাদেড়েক ঘরে আটকে রাখা আধপাগল ভীতু মেয়েটার কান্ড সবটাই মনে পড়লো। ভীতু মেয়েটা এখনো ভয় পাচ্ছে। ছম্ছমে ভয়ার্ত চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। সায়ন একনজর চোখে চোখ রাখলো। মনোহারিনী মুখটা কি ভীতু দেখাচ্ছে। সে তাকাতে আরো চুপসে গেলো।
সায়ন চোখ সরিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
-“বাইক আ্যক্সিডেন্ট ভাইয়া। ভয়াবহ দূর্ঘটনা। ভোরবেলা হয়েছিলো। এইতো ক’দিন আগেই। শখের বসে মাঝেমধ্য চালাইতো।”
সরফরাজ আফসোস করলো। ইভা ততক্ষণে মুখনত করেছে। কি অবলীলায় বানিয়ে বলে দিলো লোকটা। হাহ্!
৫১.
বিভার অস্বাভাবিক মৌনতা বেশ ভাবাচ্ছে তন্দ্রাকে। চিন্তা হচ্ছে খুব। মেয়েটার ঘরে গেলেই দেখে হয় ঘুমিয়ে আছে নয়তো শুয়ে শুয়ে চোখ মেলে রেখেছে। সে গেলে আগে কতো কথা বলতো, বাচ্চাটাকে নিয়ে তার কতো ভাবনা। সপ্তাহখানেক ধরে ঘর থেকে বেরই হয়না তেমন। সে নিজ থেকে গেলে,”ভালো আছো ভাবি? শরীর ভালো?” জিজ্ঞেস করেই চুপ হয়ে যায়। তাছাড়া আরো কিছু সে লক্ষ্য করেছে। ভাবনাটা সেখানেই প্রখররূপ ধারণ করছে।
সরফরাজ পান্জাবি খুলে রেখে বাথরুমে গেছে। বাইরে সন্ধ্যা গড়িয়েছে। অন্ধকার তমসাচ্ছন্ন সন্ধ্যা। কিন্তু বাইরে অন্ধকার নেই। বাড়িতে মরিচবাতির সোনালী আলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।
তন্দ্রা আচ্ছন্ন হয়ে ভাবতে ভাবতে পান্জাবি ভাঁজ করছে।
মুখ ধুয়ে বেড়িয়ে এলো সরফরাজ। তন্দ্রা তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে বিছানায় বসলো। মুখ ধুঁতে গিয়ে গলা, কাঁধ ভিজিয়ে ফেলেছে সরফরাজ। গমরঙা ত্বকের পানির ছিঁটেফোটা মুছে নিচ্ছিলো সে। তন্দ্রা হঠাৎই বললো,”ইভার বিয়ে তো দিয়ে দিচ্ছেন, বিভা ইউসুফের কথা ভেবেছেন?”
সরফরাজ একবার তাকালো। তন্দ্রা উওরের অপেক্ষায় তার দিকেই চেয়ে আছে। মুখ ফিরিয়ে গা মুছতে মুছতে উওর দিলো,
-“ওদের বিয়ে ওদের সময়মতো হবে। তাছাড়া ইভার বিয়ে তো তাড়াতাড়ি হচ্ছে। ওকে আমি কখনোই এই ছোট বয়সে বিয়ে দিতাম না। নেহাতৎই সায়ন অন্যরকম বলে। আর বিভা…বিভার বিয়ে আরো পরে দিবো। বাড়ি খালি হয়ে যাবে আমার। বাকি ইউসুফ, ও তো ছেলে মানুষ। ওকে তো আর ধরেবেঁধে বিয়ে দিবেনা চাচা-চাচী। যখন ওর মন চাবে তখন করবে।” বলে তোয়ালে রেখে তন্দ্রা মাথায় বারদুয়েক চাপড় মারলো সরফরাজ। নরম হেসে বললো,”বুঝেছো?”
তন্দ্রা আমতাআমতা করলো। ইতস্ততভাবে বললো,
-“আমি আলাদা আলাদা বলিনি। আপনি বড় মানুষ। আপনি কি কিছুই লক্ষ্য করেননি?”
সরফরাজ ভ্রু কুঁচকালো। কয়েকসেকেন্ড বিমূর্ত চেয়ে থেকে হো হো করে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই বললো,”কিসব বলছো তনু? তুমিওনা! কি যে বলো।”
তন্দ্রা অসহায়ের মতো চেয়ে রইলো। চোখদুটোতে রাজ্যসম চিন্তা।
~চলবে~
[বর্ধিতাংশ কালকে দিবো। ছোট হলেও আমি গ্যাপ কম দেবার চেষ্টা করছি।]