মেঘদিঘির পাড়ে – ২৭
মালিহা খান
(বর্ধিতাংশ)
৫৩.
অলিন্দ ফাঁকা। আলোয় ভেসেছে। বাতি এখনো নিভানো হয়নি। বহুদূর থেকেও বনিয়াদী বাড়ির আড়ম্বরে ঘেরা আলকসজ্জা চোখে বিঁধতে বাধ্য।
ইউসুফ বুকে দু’হাত ভাঁজ করে বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। দ্বিগ্বিদিক ছেড়ে তারাহীন নীলিমায় আবদ্ধ হয়ে আছে তার পুরুষ চোখ। হরিদ্রাভ আলোর মোলায়েম দীপ্তছায়া তার উজ্জ্বলবর্ণ মুখে শোভা পাচ্ছে।
দীর্ঘদেহী মানুষটার লম্বা প্রতিবিম্ব পড়েছে পিছে। ঘড়ির কাঁটা নিষুপ্তিচ্ছন্ন হবার কাঁটায় ঘুর্ণায়মান কিন্তু অক্ষিপাতায় ব্যাকুলতা থাকলে স্বাধ্যি কার?
বিভা তেমন একটা ঘর ছেড়ে বেরোয়না। বাইরে ঘোরাফেরা অতিমাত্রায় কমে গিয়েছে। আকাশ দেখা হয়না। মন খারাপও হয়না। কান্নাও পায়না। শূন্য শূন্য লাগে কেবল।
জানলার পাল্লা খুলে দিলো বিভা। জানলার শিক থেকে একহাত দূরেই মরিচবাতি জ্বলছে। বোনটার বিয়ে। শেষ দু’বছর আগে সরফরাজ ভাইয়ের বিয়েতে এভাবে সাজানো হয়েছিলো। তখন কি আগ্রহ ছিলো তার।
ভাইয়ের সাথে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ফুললাগানো, বাড়িসাজানো দেখতো। বিভা হাত বাড়িয়ে একটু ছুঁয়ে দিলো।
বাইরে থেকে বাড়িটা দেখা হয়নি। দেখার জন্য দরজা খুলে বের হলো।
দরজার ছিঁটকিনি খোলার খুটখাট শব্দটা ইউসুফের কানে এলো সহজেই। বিভার ঘরটা ইভার ঘরের পাশেই। এই বারান্দার দিকে তিনটা ঘর। কোঁণার টা সরফরাজের, মাঝের টা ইভার, তারপরেরটা বিভার।
শরীর না ঘুরিয়ে কেবল ঘাড়টা ঘোরালো ইউসুফ। কয়েকমূহুর্ত নিরবতা..অত:পর…বিদীর্ণ হিয়া ঝলসে গেলো।।
ইউসুফের শিরদাড়া বেয়ে প্রবলগতিতে বিদ্যুৎ খেলে গেলো যেনো। চোখ নামিয়ে ধীরগতিতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে শুকনো ঢোঁক গিললো সে। পা পর্যন্ত গোল সুতির জামা, কোমড় ছাঁপানো লম্বা চুলের গাঢ় শ্যামবর্ণের মেয়েটা। নারীসৌন্দর্য্য এক আশ্চর্য জিনিস। সামান্য বর্ণনায় তা সীমাবদ্ধ করা বিস্ময়কর।
শ্যামবর্ন নিয়ে কতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ। তবে এই শ্যামরঙে সে কিকরে এতো মশগুল হলো? হাজার শুভ্রেও যা কাটানো অসম্ভবতূল্য।
বিভা ইউসুফের সামনে আসেনা। হঠাৎ সাক্ষাত হয়ে যাওয়ায় কেমন অপ্রস্তুত হলো। তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে দু’পা পিছিয়ে দরজা আটকে দিতে চাইলো। হলোনা। হাত থেমে গেলো সামান্য প্রশ্নে,
-“এদিক এসো, ঘরে কি করো সারাদিন?”
বিভা তাকাল। ঠোঁট কামড়ে ধরলো। দেখা হওয়াটা উচিত হয়নি। একদম উচিত হয়নি। তবু ইউসুফ ডেকেছে বলে আর পিছালোনা সে। এদিক ওদিক দেখে বেরিয়ে এলো। পায়ে জুতো নেই, পাতায় ঠান্ডা লাগছে।
ইউসুফের থেকে কয়েকবার দুরত্ব বজায় রেখে দাড়ালো সে। বিভার মলিনমুখে তাকানো দায়। শ্যামবর্ণের মেয়েদের ঠোঁট সাধারণত গোলাপী হয়না। বিভার ঠোঁট কালো। শীতে রুক্ষ হয়ে আছে।
ইউসুফ অন্যদিকে চোখ ফিরায়। রুক্ষ কালো ঠোঁটেও কি সর্বগ্রাসা মদ্যপনেশা!
বিভা রেলিংয়ে হাত রেখে নিচের দিকে ঝুঁকে বললো,
-“বেশ সুন্দর সাজিয়েছেন তো।”তার প্রাণহীন কন্ঠে সামান্য হাসি ধরা দিয়েছে তখন।
ইউসুফ মুখ ফিরিয়ে বিভার দিকে তাকায়। তার কষ্ট হয়। আস্তে করে বলে,
-“তুমি এমন চুপচাপ থেকোনা।”
-“কেনো?”
ওপাশ থেকে উওর এলোনা। দারোয়ান চাচা ঝিঁমাচ্ছে। এখান থেকে দেখা যায়। গাছের পাতাও নড়ছেনা।
অনেকক্ষণ পর ইউসুফ বললো,
-“ভালোবাসিতো। তুমি সবসময় শুনতে চাইতে না? এইযে বলছি। ভালোবাসি। কিন্তু পাওয়ার সাহস নেই। এই অধম কে তুমি ক্ষমা করো বিভা। ভালোবাসা পেতে গিয়ে তোমার জীবনটা নরক বানাতে চাই না। আমার জন্য হলেও এমন চুপ করে থেকোনা বিভা।”
বিভার ঠোঁট কাঁপলো। ধীরপায়ে এগিয়ে আস্তে করে ইউসুফের কাছে মিশে গেলো সে। দু’হাতে বাচ্চাদের মতো পিঠ জড়িয়ে ধরে, বুকে মাথা রেখে নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো,
-“বিশ্বাস করেন, আপনাকে আমি বেশি ভালোবাসি। আমার মতো করে আপনি কখনো ভালোবাসতে পারবেন না। কোনোদিন পারবেননা। কক্ষণো না।”
৫৪.
ইভা দু’দিকে দু’হাত মেলে বসে আছে। খোলা দরজা দিয়ে ঝলমলে আলো ঢুকে পড়ছে ঘরে। বাইরে উজ্জ্বল বিকেল। জলপাইরঙের কামিজের হাতাটা বাহু পর্যন্ত তোলা। চুলে শক্ত খোঁপা। দু’টো মেয়ে তার দু’পাশে বসে মেহেদি লাগাচ্ছে। মেয়েদুটো গ্রামেরই। কথাবার্তা হয়না যদিও তবে সে চেনে। তন্দ্রা ঘরে ঢোকে। ইভা মেহেদীর দিকে তাকিয়ে ছিলো। তন্দ্রা আসায় তাড়াতাড়ি মুখ তুলে বলে,”ভাবী? আপা কোথায়?”
তন্দ্রা ভ্রু কুঁচকালো। বিভা এখানেও আসেনি? দুপুরে খাবার টেবিলে খেতেও যায়নি মেয়েটা। উপোষ রয়ে আছে। ইভাকে “ডাকছি” বলে সে বেরিয়ে গেলো।
এই বিকেলবেলায় ঘর অন্ধকার করে রেখেছে মেয়েটা। দরজার ছিঁটকিনি নামানো ছিলো। তন্দ্রা টোঁকা না দিয়েই ঢুকলো। বিছানায় কাঁথামুড়ি দিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে বিভা। ঘুমাচ্ছে নাকি?
তন্দ্রা যেয়ে কপালে হাত রাখলো। সাথেসাথেই চোখ মেলে তাকালো বিভা। হতচকিত হয়ে একটু ভয় পেলো, সে বুঝতে পারেনি ঘরে কেউ এসেছে। কিসব ভাবছিলো। তন্দ্রার মুখ দেখে শান্ত হলো।
-“জেগে জেগে শুয়ে আছিস কেনো? ওঠ, চল আমার সাথে। ইভাকে মেহেদি পড়াচ্ছে। তুই পড়বিনা? আয়।”
বিভা আমতাআমতা করে বললো,”ভাবি শরীর ভালো লাগছেনা। এখন না যাই?”
তন্দ্রা একহাতে কোমড়ের সাইড ধরে ঝুঁকে গেলো। বিভার চুলে আঙুল চালিয়ে বললো,”শরীর খারাপ? আগে বলিসনি কেনো? দুপুরেও খেলিনা। কি হয়েছে?”
তন্দ্রার কষ্ট হচ্ছে দেখে বিভা নিজেই উঠে বসে। চুলে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বলে,
-“তুমি বসো ভাবি। আমার কিছু হয়নি। মুখটা ধুয়ে আসি তারপর যাচ্ছি।”
তন্দ্রাকে বসিয়ে বালিশের পাশ থেকে চুলের কাঁটাটা খোপায় গুঁজে নিলো বিভা। গায়ের কাঁথা সড়াবে তার আগেই হুট করে তার গালে হাত রাখলো তন্দ্রা। চোখভরে দেখে নরম গলায় বললো,
-“তোর কি হয়েছে সোনা?”
বিভা যেনো ধরা পড়া অপরাধীর মতো থমকালো। মমতামাখা কন্ঠে তার ভেতরটা চুরমার হয়ে গেলো। চোখ নামিয়ে এলোমেলো কন্ঠে বললো,”কিছু হয়নি ভাবি।”চোখে পানি চলে এসেছে।
তন্দ্রা হাত ধরলো। শক্ত করে। বললো,
-“আমাকে বল বিভা। আমি বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে। বল।”
এরপর আর পারা গেলোনা। ভীষণ আবেগী মেয়েটা আচমকা খরস্রোতা নদীর মতো জড়িয়ে ধরলো তন্দ্রা। এতদিনের চেপে রাখা কান্নার জোয়ারের মতো আছরে এলো। তন্দ্রার চোখ আতঙ্কিত হয়ে গেলো। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে অস্থির হয়ে বললো,
-“কি হয়েছে সোনা?”
৫৫.
হাতভরে মেহেদি দেয়া হয়ে গেছে ইভার। ডানহাতের তালুর দিকে ছোট একটা অংশ ফাঁকা রাখা। ছেলের নাম লিখবে বলে। আঙ্গুলগুলোতে একটু বাকি ছিলো। ততটুকু দিয়ে শেষ করে ইভার দিকে তাকালো সেই হাতে মেহেদী লাগানো মেয়েটা।
বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে। খাটের পিছে মাথা ঠেকিয়ে ইভা প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলো। মেয়েটা আস্তে করে ডাক দিলে সে সজাগ হলো। সোজা হয়ে বসে হাতের দিকে চেয়ে বললো,”শেষ?”
মেয়েটা ইশারায় ‘হ্যাঁ’ জানালো। অত:পর মুচকি হেসে নামটা জিজ্ঞেস করলো। ইভা আমতাআমতা করলো কিছুক্ষণ। শেষমেষ বুজে আসা গলায় মিনমিন করে উওর দিলো,”সায়ন। উনার নাম সায়ন।”
চলবে~
[রি-চেক হয়নি। বানান ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]
[বি:দ্র:১ পর্বটা গতকাল দেবার কথা ছিলো। কিন্তু আইডিতে একটু সমস্যা হওয়ায় আমি পেইজে আসতে পারিনি। সেজন্য দিতে পারিনি।]
[বি:দ্র:২ অনেকে হয়তো বলতে পারেন গল্প ধীরে ধীরে আগাচ্ছে কেনো? কিন্তু সত্যি বলতে আমি এপর্যায়ে এসে হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে ফেললে কাহিনীর ধারাবাহিকতার সাড়ে বারোটা বেজে যাবে। তাই তাড়াহুড়ো করতে চাচ্ছিনা।]