রৌদ্রদেশে মেঘের বেশে পর্ব-৩৫

0
553

#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[৩৫]

প্রায় দুমাস পর।
~~~~~~~~~~
অফিসের উদ্দেশ্য বের হতে গিয়ে আবার রুমে ছুটে এল জায়িদ। আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়ানো মেয়েটির কাঁধে মুখ রেখে বলল
‘ আসছি।
আনহা সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়ল। জায়িদের দিকে ফিরে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল
‘ আপনি? চলে গিয়েছিলেন না?
জায়িদ মাথা চুলকালো।
‘ হ্যা গিয়েছিলাম। আবার এসেছি। তোমাকে বলা হয়নি।
আনহা হেসে ফেলল। দুহাত বাড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরল জায়িদের। তারপর চোখে চোখ রেখে নরম কন্ঠে বলল
‘ আসুন, একটু তাড়াতাড়ি।
ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসির ছটা দেখা দিল জায়িদের। হেসে বলল
‘ তোমাকে আজকাল একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে, ব্যাপারখানা কি বলোতো?
লজ্জায় নতজানু হলো আনহা।
‘ যাহ, কিছুনা। আপনি উলটপালট ভাবেন।
হেসে ফেলল জায়িদ। নত হওয়া মুখটা তুলে সে কপালে আঁকল স্পর্শ। তারপর নিজের পাওনাটা ও নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ সাবধানে থাকবে। আম্মার কথা শুনবে। আসি।
আনহা তার যাওয়া দেখল।

রোদের প্রখরতা ও তেমন নেই বললেই চলে। হালকা ঝিরঝিরে বাতাস চারপাশে। গাছের পাতা দুলছে। বাড়ির উঠোনে লাগানো ফুলটবগুলো ও দুলছে। সাগর সাহেব খেলছেন দুই নাতি নাতনীর সাথে। তাননা মুননা বল নিয়ে কাড়াকাড়ি। কিছুক্ষণ হাসি, আবার কিছুক্ষণ খ্যাঁচখ্যাঁচ করে ঝগড়া। সাগর সাহেব দুজনের হাত থেকে বল কেড়ে নিয়ে বললেন
‘ খেলা হবে বল ছাড়া। তোমরা বেশি বেশি ঝগড়া করো।
মুননা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। বলল
‘ তুমি আমাদেল ডিসতাব কলো কিনো? চবচময় ডিসতাব কলো। আমলা খিলতিছি না?
সাগর সাহেব বলল
‘ বল ছাড়া খেলি আমরা। কেমন?
তাননা বলল
‘ দাদাই তুমলা বল ছালা খেলো। আমি বল নিয়ে খিলবো।
সাগর সাহেব বললেন
‘ ঠিক আছে।
মুননা লুটিয়ে পড়ল সবুজ ঘাসের উপর। হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে কেঁদে কেঁদে বলে
‘ না না না না। আমি খিলবো। তুননুকে মেলে ফেলবো।
সাগর সাহেব বলেন,
‘ দাঁড়া আমি গিয়ে তোর মাকে ডেকে আনি। কথায় কথায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ার অভ্যাস কেন?
তাননা মুননার কাছে গিয়ে বলে
‘ মুননু তুমি উতে যাওনা। আম্মা আচলে মাববে। তুমি বিশিবিশি কলো। আম্মা তুমাল জুন্য এখুন আমাকিও মাববে।
মুননা হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে কাঁদে। বলে
‘ তুমাকে মেলে ফেলব তুননু ।
তাননা বলল
‘ আমি লুকুলুকি খেলি। আম্মা চলি আচবে এখুন। আম্মা আমাকে দিখবেনা। মাববে না।
মুননা কাঁদতে কাঁদতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। বিড়বিড় করে বলে,
‘ গুড্ডু আচলে চব বলি দিবো। চবাই আমাকে মালে। বুকে।

তাননা বাড়ির পেছনে চলে গেল দৌড়ে দৌড়ে। বাড়ির পেছনে বাগান আছে। বাগানের ভেতর ডুকে পড়ল সে। হিসহিস শব্দ শুনল বাগানের ভেতর। খুশি হলো তাননা। হাত তালি দিয়ে বলল
‘ হিচহিচ হিচহিচ।
দেখল বাগানের লম্বা একটি পেয়ারা গাছের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে লম্বা রশির মতো কিছু একটা। তাননা হাত তালি দিয়ে পড়ল
‘ অচগর ওই আচচে তেড়ে। আমতি আমি খাবু ফেলে।

মুননা চোখ খুলতে পারল না আর। নাকের উপর কিছু একটা অনুভব হতেই সে একেবারেই জ্ঞান হারালো। শরীর শীতল হয়ে গেল। কোলে তুলে নিল কেউ একজন। তারপর গেইট পার হয়ে কালো কারে উঠে বসল। দিনদুপুরে এভাবে একটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে গেল কেউ টের ও পেলনা।

জিনিয়া কোর্টের উদ্দেশ্যে বের হতেই যাচ্ছিল। সাগর সাহেব এসেই তাকে মুননার কথা বলায় সে হেসে ফেলল। সব ফাইলগুলো গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হতে বলল
‘ নাহিল ভাইয়া কোথায়?
সাগর সাহেব বললেন
‘ আর কোথায়? কোথায় যায় সে কাউকে বলে? ছন্নছাড়া জীবন তার। না হচ্ছে এপার, না হচ্ছে ওপার।
বাড়ি থেকে বের হতেই সাগর সাহেব বলল
‘ এ বাদঁড় দুটো গেল কোথায়? তাননা! মুননা! কোথায় দাদুরা?
কারো আওয়াজ এলোনা। জিনিয়া ও এদিকওদিক তাকালো। প্রায় মিনিট খানেক পার হতেই নিজেই আওয়াজ করে ডাকল
‘ মুননা? তাননা? কোথায় আমার বাবুরা?
সাগর সাহেবের দিকে ফিরে তাকালো জিনিয়া। সাগর সাহেব বললেন
‘ এখানেই তো ছিল দুজন। কোথায় যাবে?
সব জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজে জিনিয়া পেলনা তাদের। হাতের ফাইল সে দূরে ছুঁড়ে মারে। গিয়ে পড়ে ফুলটবের কাছে৷ চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে জিনিয়া। তখুনি নাহিল গেইট ঠেলে ডুকে পড়ে। জিনিয়াকে কাঁদতে দেখে ছুটে যায়। সোরা আর সালেহা বেগম ছুটে আসে। জিনিয়া কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে। গায়ের কালো গাউন খুলে ছুঁড়ে মারল। কালো পাড়ের সাদা শাড়ি মাখামাখি হলো মাটির সাথে। নাহিল বলল
‘ কি হয়েছে?
সাগর সাহেব বলল
‘ তাননা মুননাকে পাওয়া যাচ্ছেনা। সবখানে খুঁজেছি। নাহিল চেঁচালো
‘ এগুলো কোনো কথা হলো? দুইটা বাচ্চাকে তোমরা একা ছাড়লে কি করে?
সাগর সাহেব বলল
‘ রোজ তো ওরা একা একাই খেলে। আমি ও থাকিনা। আজ এমন হবে আমরা কি জানি?
জিনিয়াকে সান্ত্বনা দেন তিনি।
‘ কাঁদিস না জিনু। কিছু হবেনা। সব ঠিক হয়ে যাবে।
নাহিল সাহিলকে ফোন দিতে দিতে বাড়ির পেছনটা চলে যায়। জিনিয়ার কান্নার আওয়াজ আসছে। সাহিল ও ফোন তুলছেনা।
নাহিলের কানে হঠাৎ বাগানের ভেতর থেকে একটি কন্ঠস্বর ভেসে আছে।
‘ অচগর ওই আচচে তেলে। আমতি আমি খাবু ফেলে।
নাহিল ফোন পকেটে রেখে দৌড়ে যায়। দেখে পেয়ারা গাছের সাথে ঝুলিয়ে থাকা একটি সাপ। হিসহিস শব্দ করছে। নাহিল দৌড়ে গিয়ে তাননাকে কোলে নিয়ে নেয়। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে পুরো গালে চুমু দিয়ে বলল
‘ আম্মু তুমি এখানে কি করছ? ভাই কই? মুননু কই? দেখো জুননু কিভাবে কাঁদছে।
তাননার মুখ কালো হয়ে যায়।

‘ আম্মা কিনো কাঁদে? আমি তো চাপের সাথি খিলা করি।
নাহিল চেঁচিয়ে সাগর সাহেবকে ডাকল। ততক্ষণে শফিক সাহেব ও হাজির। তারা দু’জন মিলে সাপটাকে মেরে ফেলে। কি বিষাক্ত! কেমন চকচক করছে। জিনিয়া তাননাকে দেখে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। গালে, কপালে, হাতে চুমু দিয়ে বলে
‘ আম্মা তোমার ভাই কই? মুননা কই? আমার ছেলে।
তাননা ও মায়ের দেখাদেখি কেঁদে দেয়। বলে
‘ ভাই কুথায়? আমাল সাথি আল খিলবেনা? মুননু কুথায়? লাগ কচচে?
জিনিয়া হুহু করে কেঁদে দেয়। নাহিল দিশেহারা হয়ে পড়ে। সোরা মেয়েকে সালেহার বেগমের কোলে দিয়ে জিনিয়ার কাছে আসে। বলে
‘ ভাবি কিছু হবেনা। কাঁদবেন না প্লিজ।
সোরা নাহিলের কাছে গিয়ে বলে
‘ বড়দাভাইকে ফোন দিননা ৷ তাড়াতাড়ি দিন। পুলিশ বাবুকে দিন।
নাহিল ফোন দেয়।
গেইট খুলে জাহেদা আর আনহা ও চলে আসে। আনহা জিনিয়ার কাছে যায়। জিনিয়ার মাথা তার বুকে চেপে ধরে
‘ কিছু হবেনা জিনি। একদম কাঁদবেনা। মুননা চলে আসবে।
জিনিয়ার কান্না থামেনা। কিছুক্ষণ আগেও তার ছেলে তার হাতে খেয়েছে। গালে আদর দিয়েছে। তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে জিনিয়াকে খাইয়ে দিয়েছে। মজা হয়েছে বলেছে তাই দাঁত দেখিয়ে সে কি হাসি!
কোথায় তার বাচ্চাটা? জুননু বলে ডাকেনা কেন?
কাঁদতে কাঁদতে পেটের ব্যাথা উঠে যায় জিনিয়ার। শফিক সাহেব এসে জিনিয়াকে মাথায় হাত বুলায়। বলে
‘ শক্ত হতে হবে হবে। অনেক লড়াই এখনো লড়া বাকি। শক্ত হ। মনোবল আন নিজের মধ্যে। তুই হারিস না।
জিনিয়া পেটের ব্যাথার কারণে কথা ও বলতে পারেনা। এই পেট ব্যাথা উঠার আগে তার হাত পা ফুলে যায়। এবার ও তাই হয়েছে।
শফিক সাহেবের কপালের ভাঁজ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়। জিনিয়াকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। মুননার মিসিং ফাইল করে জায়িদ। খোঁজ লাগায় পুরো শহরের আনাচে-কানাচে। সাহিল হন্তদন্ত হয়ে গেল হসপিটালে। জিনিয়া তাকে দেখে জোরে কেঁদে উঠল। সাহিল গিয়ে বসল তার পাশে। জিনিয়া উঠে বসল। মাথা ঠুকল সাহিলের বুকে। আমার বাচ্চাকে এনে দিন আমার কাছে। এনে দিন।
সাহিল হতবিহ্বল, অসহায়। জিনিয়ার মাথায় সে ঘনঘন হাত বুলিয়ে বলল
‘ কিচ্ছু হবেনা জিনি। মুননা ফিরবে তোমার কাছে। কেবিন থেকে বের হতেই তাননা দৌড়ে এল সাহিলের কাছে। সাহিল মেয়েকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে গালে, কপালে আদর দেয়। মুননা তাকে ঘর থেকে বেরোনোর সময় বলেছিল
‘ গুড্ডু চকলেত আনিবে আমাদেল জুন্য। লাল,নীল,হুলুদ হুলুদ চকলেত। সাহিল মেয়েকে আর ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

__________

জিনিয়ার মাথার উপরে ফোন ছিল। ফোন বেজে উঠায় কাঁপাকাঁপা হাতে সে ফোন কুড়িয়ে রিসিভ করে। কানে দিতেই ভার ভার কন্ঠ ভেসে আসল হঠাৎ।
‘ আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী মিসেস আহম্মেদ। চিনতে পেরেছেন সেই চারবছর আগের আমিকে।
জিনিয়ার মনে হলো লোকটা নাক চেপে ধরে, অথবা নাকের উপর কিছু রেখে কথা বলছে। ঠিক ওই আগের লোকটার মতো, যে বিয়ের আগে জিনিয়াকে কল করে উল্টাপাল্টা বলতো। জিনিয়া শক্ত কন্ঠে কথা বলতে গিয়ে আটকে যায়। নরম কন্ঠে বলে
‘ কে আপনি? আবার কেন ফোন দিয়েছেন? কি চান আপনি?
লোকটা বলল
‘ আপনার বাচ্চাকে ফেরত পেতে চান? তাহলে গত ছমাস ধরে যে কেসটা লড়ছেন, সেটা ছেড়ে দিন। তদন্ত বন্ধ করুন। স্বামী সংসার নিয়ে ভালো থাকুন। বাবলুর হত্যাকারীকে খোঁজা বন্ধ করুন।
জিনিয়া চেঁচাতে গেলে আবার ও পেটে ব্যাথা। কেঁদে দেয় জিনিয়া।
‘ আমার বাচ্চাকে কেন এসবের হাতিয়ার বানাচ্ছেন? কেন? আমার মাসুম বাচ্চাটা তো কোনো দোষ করেনি। কেন এমন করছেন?
লোকটা নিশ্চুপ। অনেকক্ষণ পর বলল
‘ মূল কথায় আসুন। আপনি কেসটা ছেড়ে দিলে, আপনার বাচ্চাকে গেইটের কাছে দিয়ে আসবে আমার লোক।
জিনিয়া মাথায় হাত দেয়। বলে
‘ কেসটা আমি ছেড়ে দেব কিন্তু আপনি যদি আমার ছেলেকে ফেরত না দেন। তখন? আপনাকে আমি বিশ্বাস করব কেন?
লোকটা বলল
‘ বিশ্বাস অবিশ্বাস আপনার ব্যাপার। আপনি আমার শর্তে রাজি?
জিনিয়া কেঁদে থেমে থেমে জবাব দিল রাজি। তখনি জায়িদ চলে আসে কেবিনে। জিনিয়া ডাকল
‘ ভাইয়া?
জায়িদ ছুটে আসে। বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে
‘ কিচ্ছু হবেনা জুননু। কিচ্ছু না। তোর বাচ্চাকে আমি তোর কাছে ফিরিয়ে দেব। দেবই।
জিনিয়া হিঁচকি তুলে বলে
‘ ভাইয়া এই লোকটা কি বলে দেখোনা। দেখো। বলছে বাবলু হত্যার কেস ছেড়ে দিলে নাকি মুননাকে দিয়ে যাবে৷
জায়িদ ফোনটা কেড়ে নিল। লোকটা ফোনটা কেটে দিল। জায়িদ নাম্বারটা পাঠিয়ে দিল থানায়। জিনিয়া বলল
‘ ভাইয়া আমি কেসটা ছেড়ে দেব।
জায়িদ জোরে বলল
‘ নাহ।
জিনিয়া কেঁদে দিল। জায়িদ পরক্ষণে বলল
‘ ঠিক আছে। মুননা আগে।
জিনিয়া শান্ত হলো।

তখন সন্ধ্যা হতে চলল। সাহিলকে ফিরতে না দেখে জিনিয়া আর ও চিন্তিত হয়ে পড়ল। গাল মুছতে মুছতে জিনিয়া আবার ও জায়িদকে ফোন দিল। বলল
‘ ভাইয়া ওনি কোথায়? ফোন তুলছেনা। ওনার মাথা গরম। কখন কি করে ফেলে। আমার ভয় লাগছে। যদি ওনার কিছু হয়। জায়িদ বলল
‘ আমার সাথে কথা হয়েছে ওর। চিন্তা করিস না। ও কন্সটেবলদের সাথে ছিল অনেক্ক্ষণ।
জিনিয়া বলল
‘ আমার মুননার খোঁজ পাওনি এখনো?
জায়িদ বলল
‘ না জুননু।
জিনিয়া ফুঁপিয়ে উঠে।
‘ মুননার এতক্ষণে খিদে লাগার কথা ভাইয়া। ওকে কি খেতে দেবে?
জায়িদ বলল
‘ জানিনা রে। তুই একটা কাজ কর, ওই লোকটা তোকে যখনি কল দেবে তুই তখন আমাকে টেক্সট করে দিবি, আমি তখন ট্র্যাক করব। তারপর জানতে পারব মুননাকে কোথায় রাখা হয়েছে।
জিনিয়া মাথা নাড়ালো।

_______

আনহা বাড়ির গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। বাড়িতে কেউ নেই তাই ভয় লাগছে। জাহেদাকে রিকশা থেকে নামতে দেখে সে মাথায় ভালো ভাবে ওড়না টেনে নেয়। জাহেদা হসপিটাল থেকে ফিরছে। চোখ ফোলা। মুখ মলিন। আনহাকে আগাগোড়া দেখে হাঁক ছাড়ল সে।
‘ এই মেয়ে তুই এমন সময় এখানে কেন হ্যা? বাড়িতে মন ঠিকছেনা? তোকে কে বলেছে এমন সময় এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে।
আনহা মাথা নামিয়ে ফেলে। মিনমিন করে বলে
‘ ভয় লাগছিল তাই। জাহেদা খেঁকিয়ে উঠে বলে
‘ ভয় লাগছিল? কিছু হলে তো তোর বরের জন্য আর থাকা যাবেনা। ঢং করিস? যাহ ঘরে যাহ। মন ভালো নেই আমার। আমার ভাইটা কোথায় হারিয়ে গেল।
আনহা পা বাড়ায়। জাহেদা আবার ডাক দেয়
‘ অসুখবিসুখ লাগলে চেপে থাকবিনা। সরাসরি এসে বলবি। আনহা এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ায়। জাহেদা ঘরে চলে যায়। শুকনো মুখে চুলোয় চা বসায় আনহা। জায়িদকে ফোন দিতে মন চাইল। মুননার খোঁজ পেয়েছে কিনা। ভাই তো পাগল হয়ে যাবে মুননাকে না পেলে। জিনির কথা আর কি বলবে?
ভাবতে না ভাবতেই ফোন কাঁপিয়ে ফোন এল। জায়িদের ফোন। আনহা কানে দিতেই জায়িদের ব্যস্ত স্বর।
‘ আম্মা ফিরেছে?
‘ হ্যা।
‘ আচ্ছা রাখি।
আনহাকে আর কোনো প্রশ্ন করতে দিলনা জায়িদ। মন খারাপ হলো আনহার। মুননার কথা জিজ্ঞেস করতে পারলনা। কোথায় গেল আব্বাটা? তাননার ও নাকি গা কাঁপিয়ে জ্বর। সোরা আর নাহিল সামলাচ্ছে। জাহেদা এসে বলল
‘ চা খাবনা। চল তাননার কাছে যাব। বাড়ির চাবি নে। তালা মেরে যাব।
আনহা চায়ের পানি নামিয়ে রাখে। ওড়না দিয়ে ভালোকরে মাথা ঢেকে জাহেদাকে নিয়ে বের হয় বাড়ি থেকে। বলে,
‘ আম্মা যদি আব্বা আসে, তখন?
জাহেদা জবাব দেয়
‘ ওনার কাছে চাবি আছে এই তালার।
আনহা মাথা নাড়ায়। আহম্মেদ বাড়ি পৌঁছে দেখল নাহিলকে। তার কোলে সোরার বাচ্চা। তাননার কথা জিজ্ঞেস করলে নাহিল বলে
‘ সোরা ঘুম পাড়াচ্ছে।
জাহেদা আর আনহা সেখানে চলে যায়।
‘ সোরা ঘুম পাড়াচ্ছে তাননাকে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা।
জাহেদা তাননাকে দেখে হুহু করে কেঁদে দেয়। সালেহা এসে ধরে বসায়। আনহাকে বলল পানি দিতে। আনহা পানি এগিয়ে দেয়। সালেহা বেগম আনহার দিকে তাকায়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
‘ টেনশন করিস না মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আনহা মাথা নাড়ায়। জাহেদা শুয়ে থাকে তাননার পাশে। তাননা জেগে উঠে বলে
‘ মুননু কুথায়? খিলবো না? আম্মা কুথায়? আব্বা কুথায়?
জাহেদা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায়।
আনহা রান্নাঘরে এসে চা বসায়। জাহেদা কিছু মুখে দেয়নি, অন্তত একটু চা খেয়ে নিক । তার পেছন পেছন সালেহা বেগম আসে। আনহাকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে দেখে। আনহা ফিরলে চোখ ফিরিয়ে নেয়। আনহা জিজ্ঞেস করল
‘ কি দেখছ মা?
সালেহা বেগম ইতস্তত বোধ করেন। শেষমেশ অনেক পরে জিজ্ঞেস করলেন
‘ তোর কি শরীর খারাপ আনু?
আনহা চমকে তাকায়।
‘ ওই একটু।
সালেহা আনহার হাত ধরে ফিরায়। বলে
‘ সবকিছু নিয়ে গাফিলতি নয় আনু। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি তোকে?
আনহা থতমত খেয়ে বলে
‘ আমি কাউকে কিছু বলিনি মা। তাছাড়া আমার শ্বশুর তো আছেন। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার দরকার নেই।
সালেহা বেগম বলল
‘ ওনি হার্টের ডাক্তার। ওনি সব চিকিৎসা করবেন এমন নয়। তুই কি মা হতে যাচ্ছিস আনু?
আনহা তোতলাতে তোতলাতে বলে
‘ মা?
সালেহা বেগম বলল
‘ তুই কাকে ভয় পাচ্ছিস?
আনহা বলে
‘ মা কিসব বলছ? ধুরর তুমিও না। এসব কিছু না। ওই একটু শরীর খারাপ এমনি, আর টেনশনে এমন লাগছে।
সালেহা বেগমের রাগ জমা হয় জায়িদের উপর। ছেলেটা কি নিজের বউয়ের খোঁজখবর ও রাখেনা? আশ্চর্য পুরুষমানুষ! আর শ্বাশুড়ি ও কেমন?
আনহা তাড়াতাড়ি মাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সে নিজেই বুঝতে পারছেনা তা কি হয়েছে? মা কিসব বলল।

_______

সাহিলের সাথে ফোনে কথা বলে জায়িদের সাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল জিনিয়া। পুরোটা পথ কাঁদল। তার কান্না দেখে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল আশেপাশের মানুষ। জায়িদ বলল
‘ কাল তো কেস ছেড়ে দিবি। নিশ্চয়ই ওরা মুননাকে দিয়ে যাবে। দেখিস। আর কাঁদিস না।
জিনিয়া মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ হ্যা হ্যা। আর কাঁদব না আমি।
জায়িদ তাকে নিয়ে রিকশায় উঠে। রিকশা থামে তাদের বাড়ি আর আহম্মেদ বাড়ির গেইটের সামনে। জিনিয়া বলল
‘ এখানে আসো। আম্মা আর আনহা এখানে চলে এসেছে।
জায়িদ সায় জানিয়ে গেইট ঠেলে ডুকতেই যাচ্ছিল।
হঠাৎ কিছু একটার শব্দে আবার পিছু ফিরে। দেখে তাদের বাড়ির গেইট খোলা। জায়িদের সন্দেহ জাগে। গেইট খোলা কেন? আব্বা এসেছিল?
জায়িদ বলল
‘ জুননু বাড়িতে কে রে?
জিনিয়া বলল
‘ কে? জানিনা তো।
তখনি ফোনে কল আসে জায়িদের। সে রিসিভ করতেই কন্সটেবলের ব্যস্ত স্বর ভেসে আসে। স্যার আপনি কি আপনার বাড়ির কাছাকাছি?
জায়িদ বলল
‘ বাড়ির গেইটেই দাঁড়িয়ে আছি। কেন?
কন্সটেবল বললেন
‘ দাঁড়িয়ে থাকুন স্যার। আপনাদের বাড়িতে নাকি অস্ত্র লুকানো আছে। এই মুহূর্তে কেউ একজন ফোন করে জানালো। জায়িদ বলল
‘ কে বলল?
‘ ওনি ওনার পরিচয় দিতে ইচ্ছুক নয় স্যার।
জায়িদ আর জিনিয়া গেইট ঠেলে ডুকল। মিটিমিটি লাইট জ্বলছে বাড়ির ভেতরে। এমনিতেই পুরো বাড়ি অন্ধকার। জায়িদ বলল
‘ জুননু বাড়ির দরজা তো খোলা। কে বাড়িতে?
জিনিয়ার বুক কাঁপল।
‘ ভাইয়া আমার ভয় লাগছে।
জায়িদ তার হাত শক্ত করে ধরল।
‘ শক্ত হ জুননু।
পুলিশের গাড়ি এসে থামে। হুড়মুড় করে বাড়ি থেকে একদল কালো ড্রেস পড়া লোক বেরিয়ে আসে। জায়িদ পিস্তল তাক করে বলে
‘ সাবধান। এগোনোর চেষ্টা করলে গুলি চালাবো।
জিনিয়া থরথর করে কাঁপতে থাকে। এ তো ডাকাত। পুলিশে লাল হয়ে যায় পুরো উঠান। লাইট জ্বালিয়ে দিলেই স্পষ্ট হয় কালো বোরকার মতো পোশাক পড়া লোকগুলো। মুখ ঢাকা। তাদের হাতে ও বন্ধুক। তাক করে রাখে জায়িদের দিকে। একজন তেড়ে এসে জিনিয়ার মুখ চেপে ধরে। জায়িদ গুলি চালালে গিয়ে পড়ে লোকটির হাতে। তারপরেও লোকটি ছাড়ল না জিনিয়াকে। সবাই বন্দুক তাক করে বলল
‘ আমাদের যেতে দাও। নইলে এই মেয়েকে উড়িয়ে দেব। অস্ত্র ফেলে দাও।
জায়িদ অস্ত্র ফেলে দেয়। বাকি পুলিশরা ও নিচে রেখে দেয় অস্ত্র। লোকগুলো জিনিয়াকে নিয়ে এগোতে থাকে গেইটের দিকে। জিনিয়া চিল্লিয়ে কাঁদল। ডাকল
‘ ভাইয়া আমাকে বাঁচাও। জায়িদ বলল
‘ কিছু হবেনা। এই শয়তান আমার বোনের কোনো ক্ষতি করবিনা, খবরদার।
জিনিয়া জোরে কাঁদল। লোকগুলোর বেশিরভাগ গাড়িতে উঠে বসল। আরেকজন নীরব চোখে তাকিয়ে থাকল। জিনিয়াকে ধরা লোকটি জিনিয়ার মাথায় বন্দুক ধরতেই পাশে দাঁড়ানো লোকটা ধাক্কা মারে। সাথে সাথে লোকটা ছিটকে পড়ে। আবার দৌড়ে গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি ছেড়ে দেয়। জিনিয়াকে মাটি থেকে তুলতে যাওয়া লোকটা ধরা পড়ে জায়িদের হাতে। পেছনে ফিরে পালানোর সময় দেখতে পায় জায়িদ গুলি তাক করে রয়েছে তার দিকে। গম্ভীর কন্ঠে বলল
‘ কে তুমি?
লোকটা মুখোশের আড়ালে ছটপট করতে থাকে পালানোর জন্য। একজন কনস্টেবল গিয়ে পেছন থেকে হাত ধরে রাখল লোকটার। জিনিয়া উঠে দাঁড়ায়। কাঁপা-কাঁপা হাতে খুলে ফেলে লোকটার মুখোশ । সাথেসাথে দৃশ্যমান হয় অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রত্যাশিত একটি মুখ। বুকে যেন রক্তক্ষরণ থামেনা ভাইবোনের। চোখ ফেটে জল বের হয় জিনিয়ার। আর জায়িদের দুচোখ জলে টলোমলো। হাত পা তরতর করে কাঁপে জায়িদের। কাঁপাকাঁপা হাতে ধরা পিস্তল সে ঠেকায় জন্মাদাতা পিতার কপালে। ঠেসে পিস্তল ধরে, হ্যান্ডক্যাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলে
‘ ইউ আর আন্ডারএরেস্ট মিঃ তালুকদার। জঘন্যতম অপরাধ কিডনি পাচার ও অবৈধ অস্ত্র পাচার ব্যবসায় জড়িত থাকার অপরাধে আপনাকে গ্রেফতার করা হলো।
জিনিয়া দূরে ছিটকে পড়ে। মাটিতে বসে মাথার হিজাব টেনে ধরে উচ্চস্বরে কেঁদে বলে
‘ না। আমি বিশ্বাস করিনা। আমার আব্বা এমন কাজ করতেই পারেনা। আমি আমার আব্বার দেওয়া শিক্ষা নিয়ে গর্ব করি। সেই আব্বা এমন কাজ করতে পারেনা। পারেনা। এসব ভুল। এসব মিথ্যে। মিথ্যে সবটা।

জায়িদ চেয়ে থাকে শফিক সাহেবের দিকে। শফিক সাহেবের চোখ শান্ত, নির্মল। অপরাধ বোধ নেই চোখে। জায়িদের দিকে বাড়িয়ে দেয় দুহাত। জায়িদ তাড়াতাড়ি ঘাড় ঘুরিয়ে ফেলে চোখ লুকায়। শফিক সাহেব জিজ্ঞেস করল
‘ মুখ ফিরিয়ে নিলি কেন? গ্রেফতার করবিনা?
জায়িদ হ্যান্ডক্যাপ ফেলে দেয় মাটিতে। আঙুল দিয়ে পেছনে বাবাকে দেখিয়ে কনস্টেবলকে বলে
‘ ওনাকে নিয়ে যাও হামাদ। আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাও।
শফিক সাহেবকে নিয়ে গেলেন। তিনি বারবার ফিরে ফিরে তাকালেন জিনিয়ার দিকে। মেয়েটা কাঁদছে! যার জন্য এতকিছু!
জায়িদ গিয়ে জিনিয়ার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে। জিনিয়া হাউমাউ করে কেঁদে ঝাপিয়ে পড়ে ভাইয়ের বুকে। হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলে
‘ আইন অন্ধ ভাইয়া। বিশ্বাস করো আমার আব্বা এমন কাজ করতে পারেনা। পারেনা।
জায়িদ বলল
‘ তোর আব্বা আমার ও আব্বা জিনি। আমার। যে আব্বা পুলিশের চাকরির প্রথম দিন আমার মাথায় ক্যাপ পড়িয়ে দিয়ে বলেছিল
‘ দেশের দায়িত্ব আর দেশের মানুষকে ভালোরাখার দায়িত্ব আজ থেকে তোর কাঁধেও উঠল জায়িদ। এই পোশাকের মর্যাদা রাখিস। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করিস না। সত্য থেকে বিচ্যুত হসনা কখনো।
এই আব্বা বলেছিল জুননু। আমি আব্বার কথা সেদিন মগজে ঢুকিয়ে নিয়েছি জুননু। আব্বার কথা রেখেছি কিন্তু আব্বা রাখেনি। আব্বা অপরাধী । দেশের কাছে, দেশের মানুষের কাছে। আম্মার কাছে, আমাদের কাছে। আব্বা অপরাধী।
জিনিয়া নারাজ সে কথা মানতে। আমার আব্বাকে ফাঁসানো হয়েছে। আসল মাস্টারমাইন্ড এখনো আড়ালেই আছে। আব্বা এমন কাজ করতেই পারেনা। পারেনা ভাইয়া।
জায়িদের বুকে পড়ে বিড়বিড় করতে করতে জ্ঞান হারায় জিনিয়া। আজকের দিনের ভেতর চেহারা ভেঙে পড়েছে মেয়েটার। আর কত ঝড় যাওয়ার বাকি আছে? আর কত?
সাহিল দৌড়ে এসে ঢুকে পড়ে গেইট ঠেলে। জিনিয়াকে নিথর হয়ে জায়িদের হাতের উপর পড়ে থাকতে দেখে সে চেঁচিয়ে ডাকে, জিনি?
জিনিয়া চোখ খুলল না।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here