রৌদ্রদেশে মেঘের বেশে’ পর্ব-৪০

0
573

#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[৪০]

রাত তখন সাড়ে তিনটার দিকে। কনস্টেবল হামাদউদ্দীনের সহযোগিতায় সাহিল থানায় ডুকে পড়ে। তখন নির্জীব চারপাশ। অন্ধকার। জেলের ভেতর থাকা শফিক সাহেব দাঁড়িয়ে পড়ে সাহিলকে দেখে। ঘুম নেই ওনার চোখে। কালো চাদর গায়ে দেওয়া সাহিলকে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন
‘ কে?
সাহিল হামাদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। হামাদ চলে যায়।
সাহিল ধীরধীরে কালো চাদর সরায় মুখের উপর থেকে। শফিক সাহেব চমকে যায়।
‘ সাহিল তুমি এখানে? বাড়ির সবাই ভালো আছে তো?
সাহিল মাথা নাড়ালো। বলল
‘ আমি আপনার কাছে এসেছি সত্যিটা জানার জন্য। আপনি কেন কিডনি পাচার দলের সাথে যুক্ত হয়েছেন?
শফিক সাহেব পিছু করে দাঁড়ালেন। গম্ভীর স্বরে বললেন
‘ বলতে পারব না।
সাহিল বলল
‘ পারতে হবে। কি উদ্দেশ্যে ছিল আপনার?
শফিক সাহেব ত্যাড়া জবাব দেয়।
‘ পারবনা বলতে। সবাইকে দেখে রেখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
সাহিল বলল
‘ কিচ্ছু ঠিক হবেনা। আপনার মুখে সত্যিটা শুনতে চাই আমি। আপনাকে জেল থেকে বের করব আমি।
শফিক সাহেব ঘুরে তাকায়।
‘ তুমি কিভাবে আমাকে জেল থেকে বের করবে?
‘ করব।
শফিক সাহেব বলেন
‘ দরকার নেই। সময় আসলে আমি এমনিতেই ছাড়া পাবো।
কিডনি পাচার চক্রের মাস্টারমাইন্ড সাহিলকে চিনতে পারলনা শফিক সাহেব। সাহিল ও আর বুঝানোর চেষ্টা করল না। তবে বলে গেল
‘ আপনার সত্যিটা আমি জেনে ছাড়ব।
শফিক সাহেব চিল্লালেন।
‘ তুমি ওসব কাজে জড়াবেনা সাহিল। আমার মেয়েকে আমি তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। ওকে ভালো রেখো।
থানা থেকে বেরোতে বেরোতে সাহিল হাসল। ব্যঙ্গ হাসি। নিজের প্রতি তিরস্কার।
‘ ভালো। কাকে ভালো রাখবে সে? জিনিকে?
বোকার মতো কথা।
সাহিল অন্ধকারে ভেতর মিলিয়ে গেল। কালো চাদর দিয়ে নিজেকে আবার ঢেকে নিল। সোজা পৌঁছালো আহম্মেদ বাড়ি। দরজা খুলে দিল সাজেদ সাহেব। সাহিলের প্রথম বিয়ে করা বউ অস্ট্রেলিয়ার থেকে ফিরেছে তা জানেন তিনি। তবে অবৈধ ব্যবসা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। সাজেদ সাহেব বললেন সাহিলকে।
‘ জিনিকে কেন কষ্ট দিচ্ছিস? বাচ্চাদুটোর কি কান্না?
সাহিল কোনোকথা বলল না। ঘুমন্ত তাননা মুননাকে কোলে নিয়ে বের হয়ে গেল বাড়ি থেকে। সাজেদ সাহেব বিস্মিত। যা করার এখন তাকে করতে হবে। সাহিল বলে গেল
‘ জিনির কাছে নিয়ে যাচ্ছি। সবাইকে আবার একসাথে নিয়ে আসব।
সাজেদ সাহেব বলল
‘ বাড়ির সবাইকে কি বলব?
‘ দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়ো। সবাই ভাববে ওদের কিডন্যাপ করা হয়েছে।
সাজেদ সাহেব আবার চমকে গেলেন। বুক ধড়ফড় করল তার। কি করতে চাইছে এই ছেলে?
সাহিল ঘুমন্ত বাচ্চাদুটোকে নিয়ে গাড়িতে উঠে। গাড়ি এসে থামে ১৭ নম্বর বাড়ির সামনে। এরিজমা এসে কোলে নেয় তাননাকে। হাতের পোড়া অংশ জ্বলছে এখনো। রুক্ষ মেজাজ তার। সাহিল বলল
‘ জিনিয়ার পাশে শুইয়ে দিতে হবে।
এরিজমা তাই করল। মায়ের গায়ের গন্ধ পেয়ে ঘুম আর ও গাঢ় হলো তাননা মুননার। সাহিল একনজর দেখে নিল বাচ্চাদুটোকে। তারপর ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে বসল মাথার কাছে। কপালে গাঢ় চুম্বন দিতে গিয়ে আটকে গেল আবার। কানে বাজল জিনিয়ার সেই ভয়ানক উক্তি
‘ আপনি নোংরা। আপনি আমার জীবনে অভিশাপ। আমার সন্তানদের জীবনে অভিশাপ।
সাহিল আর ঠোঁট ছুঁয়ালো না। জিনিয়ার পায়ে কাছে গিয়ে থমকে গেল সে। পা ফুলছে জিনিয়ার। কাল ডক্টর মুখার্জিকে নিয়ে আসতে হবে এখানে। এরিজমা দাঁড়িয়ে রইল। সাহিল বলল
‘ তুমি তোমার ঘরে যাও।
এরিজমা বলল
‘ তুমি?
সাহিল ঘাড় ঘুরিয়ে শক্ত দৃষ্টিতে তাকালো এরিজমার দিকে। এরিজমা চলে গেল। বিড়বিড় করল,
‘ শেষমেশ তার বাচ্চা বউকে ও সহ্য করতে হবে আমাকে?
সাহিল দরজা বন্ধ করে আবার তালা মেরে দিল রুমে। বের হয়ে এল বাড়ি থেকে।

_________

নিজের পাশে বাচ্চা দুটোকে ঘুমোতে দেখে যেন স্বপ্ন দেখল জিনিয়া। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারলনা। হাত বাঁধা। হু হু করে কেঁদে উঠল সে। দুইপাশে তার দুই বাচ্চা। জিনিয়া দুহাত একত্রে তুলে আদর করল। হাতের ভর দিয়ে দুজনের গালে চুমু দিল। সাথে সাথে মনে হলো ফজরের আজান দিচ্ছে। তাননা উঠে বসল নড়াচড়া করে। জিনিয়াকে এলোমেলো চুলে দেখে হাসল। বলল
‘ আম্মা চুল বাঁধি?
জিনিয়া কাঁদল।
‘ আম্মা কাঁদু কিনো?
জিনিয়া আবার ও কাঁদল।
তাননা উঠে গিয়ে মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে দিল। বলল
‘ আচান দিচ্ছে। আম্মা নামাচ পবভো না?
জিনিয়া আবারও কাঁদল।
মুননা ও জেগে উঠল। এদিকওদিক তাকিয়ে বলল
‘ ওহ ওহ আমলা জুননুল কাছি চলে আচচি। ওহ ওহ।
জিনিয়ার দিকে তাকাতেই তার মুখ কালো হয়ে গেল।
‘ আম্মা কিনো কাঁদে? আম্মা?
জিনিয়া হু হু করে কেঁদে দেয়। কান্না থামেনা তার। তাননা মুননা এসেই ঝাপটে জড়িয়ে ধরে তাকে। হাতের বাঁধন খোলার জন্য তাড়া লাগায়। জিনিয়া নড়েচড়ে বসে বলে
‘ খুলে দাও আব্বা।
তাননা দাঁত দিয়ে হাত বাঁধা ওড়নাটা খোলার চেষ্টা করল। জিনিয়া বলল
‘ আম্মা আম্মুর ব্যাগে একটা ছুরি আছে। ওটা নাও তারপর খুলে দাও।
মুননা ব্যাগ থেকে ছুরি বের করে। তাননা বলে
‘ না না না আম্মার হাত কাটি যাবে মুননু।
মুননা হিজাবটার গিটের ভেতর ছুরিটা ডুকিয়ে দিয়ে নড়াতে চড়াতে বলল
‘ ইখুন খুলি যাবে। জিনিয়া মুননার দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল
‘ আমার আব্বা। কষ্ট হচ্ছে আব্বা?
মুননা দাঁত দেখিয়ে হেসে বলে
‘ আম্মা হাচে, আমি হাচি।
জিনিয়া চোখে হাসল।
মুননা খুলে ফেলল গিট। জিনিয়া ছুরিটা ব্যাগে ডুকিয়ে রেখে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল তার বাচ্চাদের। বুক ফাটিয়ে কান্না করল। দুজনের গাল আদরে ভরিয়ে দিল। দুজনই জিজ্ঞেস করল
‘ আব্বা কুথায়? গুড্ডু কুথায়?
জিনিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল
‘ মরে গিয়েছে। মৃত।
তাননা জিজ্ঞেস করল
‘ আল্লার কাছে?
জিনিয়া কেঁদে কেঁদে মাথা নাড়াল।
তাননা সাথে সাথে হাত পা ছুড়ল। জিনিয়াকে ইচ্ছেমতো মারল। কেঁদে কেঁদে বলল
‘ নাননা নাননা। তুমাকে মাববো। তুমাকে আল্লাহ মাববে। জিনিয়া থামিয়ে দেয় তাকে।
‘ আছে আছে মা।
তাননার কান্না থেমে যায়। মুননা বলল
‘ জুননু মিছিমিছি বুলে। তুননু কাঁদেনা।
তাননা উঠে বসে। জিনিয়ার গালে আদর দিয়ে বলে
‘ আদোল আম্মা।
জিনিয়া দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখল।
সকাল হতেই তাননা মুননা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করল। দরজা ধাক্কালো ঘনঘন। ডাকল
‘ আব্বা দজজা খুলো। আমলা খাবো। খিদি পাছে। আব্বা?
এরিজমা এসে দরজা খুলে দেয়। জিনিয়াকে হাত খোলা অবস্থায় দেখে আবার দরজা বন্ধ করে ডাকে
‘ সাহিল? সাহিল?
সাহিল গলির সামনে মেঝেতে দেয়ালে মাথা ঠুকে বসেছিল। চেঁচামেচি শুনে সে দৌড়ে আসল। তাননা মুননার চেঁচামেচি শুনে দরজা খুলল সে। জিনিয়া ধীরপায়ে এগিয়ে এসে বলল
‘ পথ ছাড়ুন। আমাকে আর আমার বাচ্চাদের যেতে দিন। সাহিল সোজা ডুকে আসে। জিনিয়া পিছু হাঁটে। তাননা মুননা সাহিলকে দেখে বলে
‘ আব্বা আম্মা কাঁদে। আদোল কলো।
সাহিল হাত বাড়িয়ে হাত ধরে নিল জিনিয়ার। জিনিয়া কেঁদে উঠল।
‘ আমার সাথে কেন করছেন এমন?
সাহিল এদিকওদিক তাকিয়ে উপরে রশির গিট দেখতে পেল। রশি পেঁচিয়ে হাত বেঁধে বলল
‘ বাড়াবাড়ি করতে বারণ করেছি না। তোমার বাচ্চাদের ও এনে দিয়েছি। আর কি চাও?
জিনিয়া হাসার চেষ্টা করে বলল
‘ ওদের দেখাতে এনেছেন আপনার পাপের সাম্রাজ্য?
সাহিল তাকে বিছানায় বসিয়ে দেয় ঠেলে। কেঁদে উঠে জিনিয়া। মুননা ফুলে উঠল
‘ আব্বা আম্মাকে মারে কিনো?
সাহিল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ছেলের দিকে। জিনিয়াকে বলল
‘ তোমার জন্য ওরা এমন বলছে। তোমাকে আমি,
জিনিয়া বলল
‘ আমাকে কি? কি করবেন? মেরে ফেলবেন? মেরে ফেলুন। মারুন। আপনার তো রূপসী বউ আছে। মেরে ফেলুন আমায়।
সাহিল বলল
‘ সময় দাও আমাকে। মারব তোমাকে।
মুননা দৌড়ে আসে। কামড় বসায় সাহিলের আঙুল টেনে।
‘ তুমাকে মেলে ফেলবো আব্বা। আমাল আম্মাকে মাববে বুলছো কিনো? তুমাকে আল্লাহ মাববে।
তাননা ও জোরে কেঁদে দেয়।
‘ আল্লাহ মাববে আব্বা। আম্মাকে মালো কিনো? আম্মা বিথা পাছে। কান্না কচচে।
সাহিল মুখ চেপে ধরে জিনিয়ার।
‘ দেখো কি বলছে ওরা? কি বলছে দেখো। তুমি বাড়াবাড়ি করবেনা জিনিয়া।
জিনিয়া শান্ত হয়ে গেল।
‘ জিনি ডাকেন আপনি আমাকে।
সাহিল ছেড়ে দিল তাকে। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল
‘ আমি খাবার পাঠাচ্ছি।
জিনিয়া বলল
‘ আমি ওদের খাইয়ে দেব কি করে? হাত খুলে দিন।
সাহিল বলল
‘ ওরা খেতে পারবে।
সাহিল খাবার এনে দেয়।
তাননা মুননা পাশের বাথরুম থেকে এসে মুখ ধুঁয়ে। জিনিয়াকে ছোট্ট হাত দিয়ে মুখ ধুঁয়ে দেয়। তারপর খাবারের প্যাকেট ছিঁড়ে পাউরুটি জেলি, কলা ছিঁড়ে ছিঁড়ে জিনিয়াকে খাইয়ে দেয়। জিনিয়া কেঁদে কেঁদে বলল
‘ তোমরা খাও।
তাননা খেতে খেতে আঙুলে কামড় খেয়ে বসে। সে কি কান্না!
তার সাথে সাথে জিনিয়া ও কাঁদে। সাহিল ছুটে আসে। মেয়ের আঙুল গালে নিয়ে চুষে, ফুঁ দিতে দিতে বলে
‘ কিছু হবেনা। কিছু হবেনা।
তাননা বলল
‘ আব্বা খাবায় দাও।
সাহিল খাইয়ে দিতে নেয়। তাননাকে খাইয়ে দেয়। মুননাকে খাইয়ে দেয়।
মুননা বলল
‘ আম্মাকে খাবায় দাও।
সাহিল তাকায় জিনিয়ার দিকে। মুখ ফিরিয়ে নেয় জিনিয়া। তাননা সাহিলের হাত ধরে জিনিয়ার মুখের কাছে এগিয়ে নিয়ে যায়। জিনিয়া থুতু মারে সেই হাতে। সাহিল হাত গুটিয়ে নেয় তাড়াতাড়ি। তাননা মুননা অবাক।
‘ আম্মা ইমুন করে কিনো?
সাহিল তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায় রুম থেকে। তালা মেরে চলে যায়। তাননা মুননা দরজা ধাক্কাতে থাকে।
এদিকে আহম্মেদ বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে যায়। কান্নাকাটির রোল পড়ে যায়। নিখোঁজ সাহিল। তারপর জিনিয়া। তারপর তাননা মুননা। অন্যদিকে শফিক সাহেব জেলে।

___________

এরিজমা দরজা খুলে তাননা মুননাকে বের করে আনে। তারপর আবার দরজা বন্ধ করে দেয়। জিনিয়া জোরে জোরে কেঁদে কেঁদে বলে
‘ আমার বাচ্চাদের কিছু করলে আমি ছাড়বনা কাউকে। কাউকে ছাড়বনা।
এরিজমা তাননা মুননাকে খেলনাপুতুল দিয়ে বসায়। বলে
‘ আমাকে চিনো?
মুননা নাক ফুলিয়ে বলল
‘ তুমি পুঁচা আনতি।
রিজমা হেসে বলে
‘ আমি তোমাদের আব্বার বউ। তোমাদের মা। মা ডাকো।
তাননা বলল
‘ আমাল আম্মা জুননু। ওখানে আচে। তুমি আনতি।
রিজমা ধমক দেয়। তোমাদের আব্বার সামনে আমাকে মা ডাকবে। নাহলে তোমাদের আম্মাকে মেরে ফেলব। ভাইবোন দুজন উঠে দাঁড়ায়। রিজমার দুই হাত আঁকড়ে ধরে কামড় বসায় জোরে।
‘ মারি ফিলবো এদদম।
রিজমা চেঁচিয়ে উঠে। জোরে চড় বসায় দুজনের গালে। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে দুজন। জিনিয়া দরজা ধাক্কাতে থাকে। কাঁদতে থাকে। তাননা মুননা মেঝেতে পড়ে থাকা অবস্থায় কাঁদে। গাল ভীষণ জ্বলছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here