রৌদ্রদেশে মেঘের বেশে’ পর্ব-৪১

0
544

#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[৪১]

দরজার হাতলের পাশে ছোট্ট করে একটা ছিদ্র করা। সেই ছিদ্রে চোখ লাগালো জিনিয়া। সাদা এপ্রোন পড়া ডাক্তারদের আনাগোনা চারপাশে। কি হতে যাচ্ছে? কিছুই বুঝা যাচ্ছেনা? হঠাৎ জিনিয়ার কানে এল খুব পরিচিত কন্ঠস্বর
‘ মিঃ আহম্মেদ অপারেশন কি এখুনি শুরু হবে?
গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে এল।
‘ হ্যা, এখুনি। সবাইকে রেডি হতে বলেন।
জিনিয়া কৌতূহলী। কিসের অপারেশন? কিডনির?
জিনিয়া দরজা ধাক্কালো বারকয়েক। তাননা মুননা কোথায়?
দরজা ধাক্কানোর প্রায় পাঁচ ছয় মিনিট পর দরজা খুলে গেল। সাদা এপ্রোন গায়ে মাক্স পড়া লোকটাকে দেখে চমকে গেল জিনিয়া। তাননা মুননাকে রুমের ভেতর নিয়ে এল লোকটা। মুননা জিনিয়াকে ওভাবে তাকাতে দেখে বলল
‘ আম্মা দিখো আব্বা নানভাইয়ের মুতো ডাততারের কাপল পলেছে।
সাহিল তাননা মুননাকে খেলনাপুতুল এনে দিল। মাক্স নামিয়ে থুতনির নিচে আটকে রাখল। তাননা মুননাকে খেলনা দিয়ে বসিয়ে চলে যাওয়ার আগেই সুযোগ বুঝে জিনিয়া দৌড়ে রুমের বাইরে বের হয়ে গেল। তাননার বেঁধে দেওয়া লম্বা চুল ছড়িয়ে পড়ল পিঠে। কোমরের নিচ অব্দি লম্বা চুল আর লম্বা শাড়ির আঁচল মাটিতে গড়াগড়ি। ও টি নামক রুমটার দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ডুকে পড়ল সে। দেখল সবগুলো ডাক্তারের পোশাক পড়া লোকজন। এরিজমাকে ও দেখা গেল। সবগুলো মৃত লাশ শোয়ানো এক একটা বেডের উপর। অপারেশনের যন্ত্রপাতি। মিটমিট করে জ্বলছে লাল হলুদ রঙের লাইট। সবার হাতে অপারেশনের যন্ত্রপাতি। হু হু করে কেঁদে উঠল জিনিয়া। মানুষগুলোর কিডনি নিয়ে ফেলা হবে এখন? মৃত মানুষকে ও ছাড়ছেনা এরা। আল্লাহ!
সাহিল দরজা খুলে দৌড়ে এল। কর্কশ কন্ঠে তেজ নিয়ে ডাক দিল
‘ জিনিয়া !
জিনিয়া থুতু মারল সামনে। ঘৃণা নিয়ে বলল
‘ আপনি ডাক্তার? ডাক্তারদের কাজ হয় রোগীর জীবন বাঁচানো। মরা মানুষের কিডনি নিয়ে নেওয়া নয়। আপনি এত নীচু কাজ কি করে করতে পারেন? আপনি আপনার কাজ দিয়ে মানুষের দোয়া নিতে পারতেন কিন্তু আপনি তো? ছিঃ।
সাহিল শান্ত চোখে চেয়ে রইল। জিনিয়া বদ্ধ দুইহাত দিয়ে গাল মুছার চেষ্টা করল। মাক্স আর অপারেশনের ড্রেস পড়া লোকগুলোর মধ্যে কানাঘুঁষা শুরু হলো। কৃষ্ণবর্ণের দুইটা মোটা লোক এসে দাঁড়ালো সাহিলের পিছু। এরিজমা হাঁক ছাড়ল।
‘ তাকিয়ে দেখছ কি? এই মেয়েকে রশি দিয়ে সারা শরীর পেঁচিয়ে বেঁধে রাখো। সাহিল ওর পা খুলে দিয়েছ কেন?
সাহিল ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো এরিজমার দিকে। চুপ হয়ে গেল এরিজমা। সাহিল এগিয়ে গেল জিনিয়ার দিকে। জিনিয়া দুই পা পিছু হাঁটতেই ঝনঝন করে পড়ে গেল যন্ত্রপাতি। পা পড়ল কিছু একটার উপর। অদ্ভুত আওয়াজ করে পায়ের তলায় রক্তক্ষরণ শুরু হলো। রক্তে রঞ্জিত হলো জিনিয়ার পায়ের তলা। মেঝে।
চোখ বন্ধ করে সহ্য করে নিল জিনিয়া। চোখ ফেটে জল গড়ালো। সাহিল হিংস্র জন্তুর মতো গর্জে বলল
‘ দেখা হয়েছে সবকিছু? হয়েছে? দেখে ফেলেছ?
জিনিয়া আরেক পা পিছু হাঁটতেই পায়ের লাল ছাপ দেখতে পায় সাহিল। জিনিয়ার মাথা ঘুরে উঠে। সাহিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেঝের দিকে রেখে আবার মাথা তুলে জিনিয়ার দিকে তাকায়। জিনিয়ার তখন মাথার ভেতর ঝি ঝি শব্দ। কানে ও একই শব্দ। তরতর করে কাঁপল পুরো শরীর। ঘেমে উঠল। জিনিয়া কেঁদে দিল সমস্ত কষ্টের ঝুড়ি খুলে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি দিনের পর দিন তাকে কিভাবে ঠকালো। তার সাথে প্রতারণা করল। ভালোবাসার অভিনয় করল তার সাথে। তার যত্নে গড়া সংসারটা ভেঙে চুড়মার করে দিল। কাঁদল জিনিয়া। সাহিলের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল
‘ এত কষ্ট, যন্ত্রণা আমাকে কেউ দেয়নি। বাবা ভাইয়ের কাছে আদরে আদরে বড় হয়েছি আমি। আপনি আমাকে কষ্ট দিলেন। আমার মন ভাঙলেন। আমার সুখের সংসার চূর্ণবিচূর্ণ করলেন। আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। আপনাকে আমি শাপ দিলাম। আপনি কষ্ট পাবেন, ভেঙে চুরমার হয়ে যাবেন। চিৎকার করে কাঁদবেন। আপনি বাঁচতে বাঁচতে ও মরবেন। আমি শাপ দিলাম আপনায়। আপনাকে আমি ছাড়বনা। আমার সন্তানদের আপনার পরিচয়ে বড় হতে দেবনা আমি। আপনি তিলে তিলে মরবেন। মনে রাখবেন আমার কথা।
সাহিল এগিয়ে গেল। শক্ত করে ধরল জিনিয়াকে। পাঁজাঁখোলা করে তুলে নিয়ে ফেলে দিল অপারেশনের বেডের উপর।দুইজন লোককে ইশারায় যেন কি বলল,
লোকদুটো এসে রশি ছুঁড়ে মারল সাহিলের দিকে। পেটের উপর দিয়ে রশি নিয়ে গিয়ে বেডের সাথে টেনে বাঁধল সাহিল। জিনিয়া ছটপট করতে লাগল। চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। তার কান্নার আওয়াজ ভেসে গেল তাননা মুননার রুমে। সাহিল তাদের দরজা বন্ধ করে রেখেছে। তারা দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে কাঁদল। সাহিল জিনিয়ার পা বেঁধে চেঁচিয়ে বলল
‘ গো অল।
সবাই বের হয়ে গেল হুড়মুড় করে। জিনিয়া চোখ বন্ধ করে হু হু করে কাঁদল। সাহিল ট্যাপ লাগিয়ে দিল তার মুখে। কাটা পায়ের তালু পানি দিয়ে মুছে তাড়াতাড়ি রক্ত বন্ধ করল। জ্বালা কমে আসলো জিনিয়ার। সে নিথর হয়ে পড়ে রইল। সাহিল ব্যান্ডেজ করিয়ে দিল পায়ে তারপর ট্যাপ খুলে নিল জিনিয়ার মুখ থেকে। জিনিয়া স্থবির হয়ে চেয়ে রইল সাহিলকে। সাহিল দেখল ফোলা পায়ে রশির বাঁধায় সাথে সাথে ছাপ বসে গেল। তড়িঘড়ি করে রশির গিট খুলে দিল সাহিল। জিনিয়া বেড থেকে নেমে যেতেই হাত ধরে ফেলল সাহিল। সাহিলকে জোরে ধাক্কা মারল জিনিয়া। সাহিল পিছিয়ে পড়ল আবার এগিয়ে এসে জিনিয়াকে ধরে ফেলল আষ্টেপৃষ্টে। দুর্বল শরীরের জিনিয়া পেরে উঠল না সাহিলের সাথে। সাহিল তাকে পাঁজাখোলা করে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরল। চেঁচিয়ে বলল
‘ দরজা খুলে দাও। তাননা মুননার রুমের দরজা খুলে দিল ইয়ামিন। সাহিল দরজা লাতি দিয়ে খুলল। জিনিয়াকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,
‘ পা মাটিতে ফেলবেনা। রক্ত বের হবে।
জিনিয়া মুখের উপর বলে দিল।
‘ আপনার কথা কেন শুনব আমি?
সাহিল কিছু বলল না। জিনিয়া পা বাড়িয়ে দিল।
‘ নিন পা বাধুন। বাধুন।
সাহিল বাধল না। বলল
‘ হাত খুলে দেব। ওয়াশরুমে শাড়ি রাখা আছে। গোসল নাও। তারপর ঘুমাও।
জিনিয়া দাঁড়িয়ে পড়ল। পায়ের ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠল।
‘ আমাকে যেতে দিন। আমার বাচ্চাদের নিয়ে চলে যাই আমি।। সাহিল গর্জন করল
‘ এক কথা কয়বার বলব?
জিনিয়া কেঁদে আবার বসে গেল। সাহিল দরজা বন্ধ করে আসল। গায়ের এপ্রোন খুলে রেখে দিল রশিতে। তাননা মুননা খেলতে লাগলো। আড়চোখে দেখতে লাগল সাহিলকে।
তাদের আব্বা এখন রেগে আছে। কোনোরূপ প্রশ্ন করা যাবেনা।
সাহিল জিনিয়াকে আবার কোলে তুলে নিল। ওয়াশরুমে দরজা খুলে দাঁড় করিয়ে দিল। হাত খুলে দিল। বলল
‘ গোসল সেড়ে নাও।
জিনিয়া দাঁড়িয়ে থাকল। তার হাত ধরা সাহিলের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকল একদৃষ্টে। সাহিল হাত সরিয়ে নিল। জিনিয়া শ্যাম্পুর বোতল ছু্ঁড়ে মারল জিনিয়ার দিকে। সাবান ছুঁড়ে মারল। যা ছিল সব ছুঁড়ে মারল। সাহিল দাঁড়িয়ে থাকল। জিনিয়া একদলা থুতু ছিটিয়ে দিল তার দিকে। সাহিলের বুকে এসে পড়ল। দিনশেষে যেখানে সে শান্তি খুঁজে পেত। আশ্রয় খুঁজে নিত সেখানেই থুতু ছিটালো। বালতি তুলে নিয়ে সাহিলের দিকে ছুঁড়ে মারল জিনিয়া। ভিজে জবজবে হয়ে গেল সাহিল। তারপর ও নড়ল না সে। জিনিয়া জোরে কেঁদে উঠে বলল
‘ আমাকে আর দ্বিতীয় বার ছুঁতে আসবেন না ওই নোংরা হাত দিয়ে।
সাহিল বের হয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে। দরজা টেনে নেয়। তাননা মুননা তার দিকে তাকিয়ে বলে
‘ আব্বা ঝগলা কললে আল্লাহ মাববে।
সাহিল ভেঁজা শরীরে বসে পড়ল ছেলেমেয়েদের কাছে। দুজনই চোখ পাকিয়ে সাহিলকে দেখে বলল
‘ আব্বা কাঁনে?
সাহিল ভার গলায় বলল
‘ না। পানি ওগুলো।
মুননা দাঁড়িয়ে পড়ে। সাহিলের গালে গাল লাগিয়ে বলে
‘ গুড্ডু পুঁচা আনতি আমাদেল মাচচে। আমলা কাননা কচচি। বিথা পাছি।
সাহিল বলল
‘ পুঁচা আনতি? কে?
তাননা বলল
‘ লিপিসতিক আনতি। ঠুটে লাল লাল লিপিসতিক দেয়। আমাদেল আম্মা ডাততে বলে।
সাহিলের গলার রগ ফুলল। চোয়াল শক্ত হলো। বলল
‘ কখন মেরেছে? কোথায় মেরেছে? কিভাবে মেরেছে?
মুননা বলল
‘ গালে মাচচে। ঠাসস কলে মাচচে। আমলা পলে গিছি।
ঠোঁট টেনে টেনে বলল মুননা।
সাহিল আদর করল দুজনকে। বলল,
‘ আমি আসছি এক্ষুণি।
সাহিল দরজা খুলে বের হয়ে গেল। এরিজমাকে ডাকল জোরে। সে হাজির হলো মুহূর্তে।
‘ তুমি মেরেছ ওদের?
‘ কাদের?
‘ তাননা মুননাকে।
এরিজমা চুপ হয়ে গেল। সাহিল কষে চড় বসালো তার গালে। ছিটকে পড়ল এরিজমা। ইয়ামিন এসে ধরল। বলল
‘ তোর সমস্যা কি সাহিল? কি সমস্যা?
সাহিল গর্জে বলল
‘ এটা তাননা মুননার বাড়ি। ওদের নামে এই বাড়ি। ওদের বাড়িতে থেকে ওদের গায়ে হাত তোলার সাহস হয় কি করে তোর বোনের?
এরিজমা ইয়ামিনকে ঠেলে দিল। থমথমে মুখে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল
‘ বাবাকে ফোন দেই আমি। বাবা আসুক।
সাহিল বলল
‘ আসুক। কি করবে তোমার বাবা? আমি কি ভয় পায় নাকি কাউকে?
সবাইকে কড়া কন্ঠে আদেশ দিল সাহিল।
‘ সবাই কি এখানে?
চলে গেল সবাই। সাহিল দরজা খুলে আবার ডুকে পড়ল। তাননা মুননার পাশে বসে রইল। আজ সে অপারেশন করবে না। তাননা মুননা হাত মেলে চড়ুই চড়ুই খেলল। জিনিয়া বের হলো ওয়াশরুম থেকে। ভেজা চুল বেয়ে টপটপ পানি পড়ছে। পড়নের হালকা গোলাপি শাড়িতে স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। সাহিল চোখ সরিয়ে নিল। তাননা ডাকল
” আম্মা আসো। চুড়ুই চুড়ুই খিলি। আসো।
জিনিয়া নিজের ব্যাগ হাতড়ে ছুরিটা নিল। পেছনে লুকিয়ে রাখলো।
তাননা বলল
‘ আম্মা ছুলি দিয়ে পুঁচা আনতিকে মাববে? আব্বা মাচচে।
সাহিল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। জিনিয়া এগোলো না। সাহিল উঠে দাঁড়ালো। জিনিয়ার সামনাসামনি গিয়ে গলা কাত করে ছুরিটা দেখে বলল
‘ আমাকে মারতে নিয়েছ? মারো।
জিনিয়া শক্ত চাহনি দিয়ে তাকালো। এ মোক্ষম সুযোগ। বিড়বিড় করল জিনিয়া
‘ আল্লাহ শক্তি দিন আমায়। সহায় হোন আমার।
ছুরিটা সাহিলের গলা বরাবর নিয়ে গেল জিনিয়া। হাত কাঁপল তরতর করে। ঠোঁট বাঁকাতে শুরু করল। নিঃশ্বাস আটকে আটকে যেতে লাগলো। সাহিলের দৃষ্টি নিবদ্ধ জিনিয়ার মুখে। চোখ বন্ধ করে টান মারার আগেই চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল তাননা মুননা। হাত থেকে ধপ করে ছুরিটা পড়ে গেল। হা করে তাননা মুননার দিকে তাকালো জিনিয়া।
‘ কে মেরেছে আমার বাচ্চাদের?
তাননা কেঁদে কেঁদে বলল
‘ আম্মা।
জিনিয়া সাহিলকে বলল
‘ আমি ওদের কখন মেরেছি? মারিনি তো। আপনি দেখেছেন?
সাহিল কিছু বলল না। জিনিয়া বলল
‘ মারিনি আমি। মিথ্যে বলছ মা। আমি মারিনি।
মুননা কেঁদে কেঁদে বলল
‘ আব্বাকে মারো না। আব্বা কাঁনবে। বিথা পাবে। লততো আচবে।
জিনিয়া কেঁদে দিল মুখে হাত দিয়ে। আচমকা সাহিলের কলার ধরে ঝাঁকালো। বলল
‘ নিমকহারাম দেখুন। দেখুন আপনার বাচ্চাগুলো আপনাকে কতটা ভালোবাসে। আপনি ওদের ভালোবাসেননি কেন?
সাহিল জবাব দিল।
‘ ভালো বাসি কিনা বাসিনা তার প্রমাণ তোমাকে দেবনা আমি।
জিনিয়া কলার ছাড়ল তার। বলল
‘ ওহ, বাচ্চাদের ভালোবাসেন। কিন্তু বাচ্চার মাকে বাসেননি না? এজন্যই বলতেন আমাকে ভালোবাসেন না? এজন্যই? শুধু আমি বুঝতে পারিনি।
সাহিলের দৃষ্টি মেঝেতে। জিনিয়া আবার কলার চেপে ধরল তার।
‘ আমাকে বিয়ে করলেন কেন? কেন করলেন?
সাহিল সোজাসাপটা বলল
‘ করতে চাইনি।
জিনিয়া কলার টেনে ধরে কেঁদে দিল।
‘ ওহ হ্যা আপনি তো চাননি। আমি জোর করে আপনার হয়েছি। জোর করে। আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেননি কেন? কেন দিনের পর দিন ভালোবাসার অভিনয় করেছিলেন? কেন কাছে টেনে নিয়েছিলেন? কেন এত বড় ধোঁকা দিলেন? কেন সত্যিটা লুকালেন?
‘ যদি সঙ্গ দিতে তাহলে লুকোতাম না।
আশাজনক উত্তর না পেয়ে হতাশ জিনিয়া। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ নিন হাত বাধুন। পা বাধুন। ফেলে রাখুন এক কোণে। খোঁজ নেবেন না আর। আপনার বাচ্চাদের দিয়ে আসুন বাড়িতে। ওরা সেখানে ভালো থাকবে। আমি পঁচে যায়, গলে যায় ওরা অন্তত তা না দেখুক। ওদের শাস্তি দেবেন না দয়া করে। একটু দয়া করুন।
সাহিল বলল
‘ ওরা এখানে থাকবে।
সাহিল রশি নিয়ে বেঁধে ফেলল জিনিয়ার হাত। জিনিয়া বাঁধা দিলনা। কোনোপ্রকার নড়াচড়া করল না। সাহিল তার হাত বেঁধে তাননা মুননাকে নিয়ে বের হয়ে গেল ঘর থেকে।

__________

১৭ নম্বর বাড়িটার নিচে দাঁড়িয়ে জায়িদ। এ জায়গার আশেপাশে জুননুর দেওয়া নাম্বারটা শো করছে। অপরাধীর বোধহয় খেয়াল নেই। নইলে নাম্বারটা ট্র্যাক করা মুশকিল। জায়িদ অনেক্ক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কিছু উদ্ধার করতে পারল না। বাড়িটার মেইন গেইট বন্ধ। তারমানে কেউ থাকেনা এই বাড়িতে। অন্য বাড়িগুলোতে কয়েকটা দম্পতি থাকে। দিশেহারা জায়িদ। কোথায় গেল বোন? বোনের জামাই? ছোট্ট ছোট্ট মামাগুলো?
কনস্টেবল এসে বলল
‘ স্যার, আপনার বাবাকে রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ এসেছে আদালত থেকে। সত্যিটা বলার জন্য রিমান্ডে নিয়ে যাওয়ার আদেশ।
জায়িদের হাত পা শীতল হয়ে গেল। রিমান্ড? গাড়ি নিয়ে জেলের উদ্দেশ্য গেল জায়িদ। জেলে জায়িদ। শফিক সাহেবের কাছে দৌড়ে গিয়ে গ্রিল ঝাঁকিয়ে বলল
‘ আব্বা না। সত্যিটা বলো আব্বা। প্লিজ বলো। আমাকে বলো আব্বা। তোমাকে আমি আঘাত করতে পারবনা। পারবনা।
শফিক সাহেব বলল
‘ আমায় মাফ করিস। সঠিক সময় না আসা পর্যন্ত আমি সত্যিটা বলতে পারবনা। কিচ্ছু বলতে পারবনা।
জায়িদ হতাশ। অসহায়। চোখের কোণায় একরাশ অভিমান, অনুরাগ নিয়ে বলল
‘ তোমার গায়ে হাত তোলার জন্য আমাকে মানুষ করেছ আব্বা?
শফিক সাহেব মুখ ফিরিয়ে নেয়। মেয়ের উপর জমে অভিমান। তাকে আর দেখতে এলনা মেয়েটা। ভালো আছে তো তার মা? যার জন্য এত ত্যাগ! এত লড়াই! এত কষ্ট। মায়ের জন্য মানুষ সব করতে পারে। শফিক সাহেব ও পারবেন। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি তার সন্তানদের আগলে রাখবেন। ভালো রাখবেন। তাতে তার মর্যাদা হানি হলে হোক। মৃত্যু হলে হোক।
জায়িদ অচল পায়ে হেঁটে গিয়ে বসে চেয়ারে। এই চেয়ার তার আব্বার দেওয়া। এই চেয়ারের সম্মান আব্বার পরিশ্রমের। জায়িদ মাথা ঠুকালো টেবিলে। ফোন বাজল। ফোন তুলে কানে দিতেই ভেসে এল এক উৎকন্ঠিত স্বর।
‘ আব্বা কোথায় তুই? কিছু খেয়েছিস? ঠিক আছিস? তোর আব্বা খেয়েছে? এই জায়িদ?
জায়িদ দুই তিনবার হাত দিয়ে মুখ ঢলে বলল
‘ আম্মা, আম্মা ঠিক নেই আমি। ঠিক নেই। আমি এই চাকরি ছেড়ে দেব আম্মা। করবনা এই চাকরি। আব্বার গায়ে হাত তুলতে পারবনা আমি। তারআগে আমার মরণ হোক আম্মা।
জাহেদা হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। আনহা দৌড়ে আসে। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে জাহেদাকে বলে
‘ কি হয়েছে মা? কার কি হয়েছে?
জাহেদা ফোন ছুঁড়ে মারে দূরে। কেঁদে উঠে বলে
‘ সব শেষ হয়ে গেল। আমার সুখের সংসারটা ভেঙে তছনছ হয়ে গেল। আমার মেয়েটা হারিয়ে গেল। স্বামী জেলে গেল। এখন ছেলে মরণ ডাকে নিজের। মরতে চাই সে।
আনহা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তার নিজের কানকে বিশ্বাস হলোনা। অফিসার এমন কথা কি করে কথা বলতে পারে? কত পথ যাওয়া বাকি এখনো।
আনহার দুর্বল শরীরে কাঁপন ধরল। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে সে রুমে গেল। সালেহাকে ফোন দিয়ে বলল
‘ মা, আমার কপালে কি সুখ নেই মা? কেন নেই?
সালেহা মেয়ের মুখে অমন কথা শুনে কেঁদে দিল। বলল
‘ কে বলেছে সুখ নেই। তুই কি সুখে নেই এখন?
আনহা বলল
‘ নেই মা। আমি সুখে নেই। সব থেকে ও নেই আমার। আমি আর আমার সন্তান কি অফিসারের বেঁচে থাকার কারণ হতে পারিনা মা? অফিসার কেন নিজের মরণ চায়? আমার কথা কেউ ভাবেনা মা। কেউ না।
সালেহা বেগম আশ্বাস দিল।
‘ তোর ভাইয়া ফিরুক। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে কাঁদেনা মা আমার। নিজের খেয়াল রাখিস। ভালো থাকিস, ভালো রাখিস।

____________

এরিজমার খাটের উপর বসে খেলা করা তাননা মুননার কাছ থেকে সরে গিয়ে জিনিয়ার ঘরের দিকে পা বাড়ায় এরিজমা। ইয়ামিনকে ডেকে বলে
‘ ভাইয়া তাড়াতাড়ি আসো। সাহিল আসার নামগন্ধ নেই এখন। এই মেয়েকে সব সত্যি বলে দেব আজ। ইয়ামিন দরজা খুলে দেয়। জিনিয়া বিছানায় শুয়ে ছিল। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে উঠে বসল। হাসল এরিজমা। ইয়ামিন হেসে লম্বা লম্বা পা ফেলে চেয়ার টেনে বসে বলল
‘ কতবার বারণ করেছি এসবে নিজেকে জড়াবেন না। জড়াবেন না। তারপরও জড়ালেন। দেখলেন কি হলো?
জিনিয়া বলল
‘ তারমানে ফোন করা লোকটা আপনি?
ইয়ামিন হাসল। বলল
‘ অবশ্যই।
জিনিয়া বলল
‘ আর চারবছর আগের মানুষটি?
ইয়ামিন হাসল।
‘ সেটা ও আমি৷ কি করব? সাহিলের আদেশ। কি মহান ছিল সে ভাবা যায়? নিজের দোষ আমাকে দিয়ে বলাতো। তখন তো আমি অস্ট্রেলিয়ায়।
এরিজমা বলল
‘ সব জেনেও তুমি ওকে বিয়ে করতে গেলে কেন? কেন গেলে?
জিনিয়ার কথা বলতে ইচ্ছে হলোনা এই মহিলার সাথে। কিভাবে শাড়ি পড়েছে? মেদহীন পেট দেখানোর কি দরকার? চিকন দুই ফিতা দিয়ে আটকানো ব্লাউজ। এসব দেখিয়ে কাকে ইমপ্রেস করতে চায়? এরিজমা বলল
‘ সাহিলের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে ছয়বছর আগে। আমি ওর প্রথম স্ত্রী।
জিনিয়া কিছু বলল না। এরিজমা বলল
‘ ও তোমাকে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করেছে। শুধুই দয়া।
জিনিয়া ফুঁপিয়ে উঠল৷
‘ সব মিথ্যে। আমি মানিনা।
হো হো করে হাসল ভাইবোন। জিনিয়া কাঁদল। এরিজমা বলল
‘ তুমি মানো আর নাই মানো। তোমার বিয়ের আগে চারমাসের জন্য সাহিল অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিল মনে আছে?
জিনিয়া তাকালো তার দিকে।
এরিজমা বলল
‘ তখন ও আমার কাছে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করতে ওই মেয়েকে দয়া দেখাবো নাকি দেখাবোনা। আমি আবার খুবই দয়ালু। তাই তাকে পারমিশন দিলাম।
জিনিয়া বিশ্বাস করল না কিছু। সব সাজানো কথা। এই মহিলা জঘন্য। সাহিল তাকে ভালো না বাসতেই পারে, কিন্তু এই মহিলাকে বাসবেনা। নাকি রূপের মোহে? নিজের স্বামীর সাথে অন্য মেয়ের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কথা মনে হতেই গা গুলিয়ে আসল জিনিয়ার। ওই বুকে শুধু তাকেই মানায়। আর কাউকে না। এই মহিলা জঘন্য। মিথ্যুক এই মহিলা। জিনিয়া বলল
‘ বিশ্বাস করিনা আমি।।
এরিজমা ছোট ছোট চোখ করে তাকালো। জিনিয়া চেঁচিয়ে বলল
‘ ওনি মিথ্যে হলেও আমাকে ভালোবাসেন, সত্যি হলেও আমাকেই ভালোবাসেন। এসব মিথ্যে রচনা আমি শুনতে চাইনা।
দরজার বাইরে এসে দাঁড়ানো মানুষটার ঠোঁটে আচমকা একটুখানি হাসির রেখা দেখা দিল। একটুখানি। কিন্তু পরক্ষনেই তা নিভে গেল। এরিজমা হাসল হো হো করে। দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে হতবিহ্বল হলো ভাইবোন। ইয়ামিন দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বলল
‘ এক্ষুণি আসলাম।
সাহিল জিজ্ঞেস করল
‘ এই বাড়িতে অনেকগুলো রুম আছে। তোরা এখানে কি? কি চাই এখানে?
ইয়ামিন বলল
‘ তোর বউকে দেখতে এসেছি। ওইদিন শুধু শুধু মারলি আমায় তোর বউয়ের দিকে তাকালাম বলে। এখন তো একদম সামনাসামনি এনে রাখলি। জিনিয়া বলল
‘ লোক দেখানো ভালোবাসা।
এরিজমা কেটে পড়ল তাড়াতাড়ি।
সাহিল বলল
‘ দ্বিতীয় বার যদি এই ঘরে আসতে দেখি, দেখবি কি হাল করি তোদের?
ইয়ামিন বলল
‘ মাথা তো ফাটালাম। আবার ও ফাটাবো আর কি।
বলতে না বলতেই সাহিলের ঘুষি গিয়ে পড়ে ইয়ামিনের মুখে। পেটে লাতি মারতেই মুখ থুবড়ে পড়ে যায় ইয়ামিন। পা দিয়ে লাতি মারতেই থাকে সাহিল। এরিজমা দৌড়ে আসে। সাহিল ধাক্কা দেয় এরিজমাকে। চিৎকার করতে থাকে৷ সাহিল রুম থেকে বের করে ইয়ামিনকে। এরিজমা আটকাতে থাকে। দলে দলে লোক ছুটে আসে। কিন্তু আটকানোর সাহস পায়না। শেষমেশ এক শক্তপোক্ত হাত এসে আটকায় সাহিলকে। সাহিল ফিরতেই গালে চড় পড়ে তার। গালে হাত দিয়ে কার এত বড় স্পর্ধা তা দেখতেই থেমে যায় সাহিল।
‘ আন্কেল?
ইয়াজিদ সাহেব বলে
‘ একদম চুপ। তোমাকে এমন বানিয়েছি কি আমার ছেলেকে মারার জন্য? হ্যা?
সাহিল চুপ হয়ে যায়।
ইয়াজিদ সাহেব বলেন
‘ কি শুনছি এসব? কাল অপারেশনে নাকি হাত লাগাওনি। আর বউ বাচ্চা নিয়ে এসেছ?
সাহিল বলল
‘ আমার ইচ্ছে।
ইয়াজিদ সাহেব বলেন
‘ তোমার ইচ্ছে এতদিন পূরণ করে এসেছি। এটা ও করব কিন্তু কাজে যাতে কোনো বাঁধা না আসে। তাতে তোমারই ক্ষতি।
সাহিল আবার ইয়ামিনকে এক লাতি বসিয়ে বলল
‘ আমার যা মনে হয়, তাই করব আমি।
বলেই রুমের দিকে পা বাড়ালো সাহিল। রুমে জিনিয়া নেই। বুক কেঁপে উঠল সাহিলের। দৌড় লাগালো সে। সবাইকে বলল
‘ জিনিয়া কোথায়? কোথায়? সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ড্রামা দেখছিলি?
ইয়াজিদ সাহেব বলেন
‘ ওহ শিট। কি হবে এখন? এই মেয়ে তো দেখছি সব শেষ করবে।
সাহিল দেখল মেইন দরজা খোলা। গেইট ও খোলা। দাঁড়োয়ান কোথায় তা দেখতে চাইলে সাহিল দেখে রক্তাক্ত হাত নিয়ে তড়পাচ্ছে দাঁড়োয়ান। দিশেহারা সাহিল। এরিজমা সাথে সাথে ফোন দিল তার লোককে। ওই মেয়েকে কেটে টুকরো টুকরো করো। তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করো। সাহিল গেইট খুলে বের হয়ে গেইটে তালা ঝুলিয়ে দিল। ইয়াজিদ সাহেবের গাড়িতে উঠে বসে গাড়ি ছাড়ল। জিনিয়া বেশিদূর যেতে পারবেনা। বদ্ধ হাতে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে গেল জিনিয়ার। রক্ত গড়ালো আবার। কাঁদল জিনিয়া। যার কাছে ধরা দেওয়ার জন্য তার মনপ্রাণ আকুলিবিকুলি করত আজ তার কাছ থেকে পালানোর আপ্রাণ চেষ্টা। কেন এমন হলো? কেন?
মুখ থুবড়ে পড়ল জিনিয়া। শক্তি ক্ষয় হয়ে এসেছে। লোক এসে জড়ো হলো। সাহিল লোকজন ঠেলে এসে বলল
‘ আমার ওয়াইফ।
জিনিয়া কেঁদে উঠতেই লোকজন সন্দেহ করল। জিনিয়া বলল
‘ ওনি আমার কেউ নয়।
সাহিলের সাথে বাড়াবাড়ি হলো লোক দুটোর । সাহিল ঘুষি বসালো বাড়াবাড়ি করা লোক দুটোকে। তার বউ। সে যেমন ইচ্ছে তেমন করবে।
আর ও কয়েকজন এসে লাঠি দিয়ে আঘাত করল সাহিলকে। মাথায় হাত দিয়ে ঢলে পড়ল সাহিল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল জিনিয়া। বলে উঠল
‘ উনি আমার স্বামী। আমার। আমার। কেন মেরেছেন? এখন কি মরে যাবে? আল্লাহ!
সাহিল উঠে বসল নিভু নিভু চোখে। ফাটা মাথা আবারও ফাটলো। সাহিলের সচল মস্তিষ্ক সচল হলো। রক্তঝরা মাথা নিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। কোলে তুলে নিল জিনিয়াকে। গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি ছাড়ল। জিনিয়া সব ভুলে শাড়ির আঁচল ছেঁড়ার চেষ্টায় ব্যস্ত। যেই না সে ১৭ নম্বর বাড়িতে এসে পড়ল জিনিয়া টের পেল সে আবারও ফেঁসে গিয়েছে। আবার ও।
সাহিল গেইট বন্ধ করে ভেতর থেকে তালা ঝুলিয়ে শুয়ে পড়ল ঘাসের উপর। জিনিয়া শুধুই চেয়ে রইল। রক্ত গড়ানো অংশে চোখ রেখে জিনিয়া বহুকষ্টে বলল
‘ আপনি মরে যাবেন? হ্যা? আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন?
তাননা মুননা দৌড়ে এসে লুটিয়ে পড়ল সাহিলের গায়ের উপর। রক্ত মাখামাখি হলো তাদের মুখে। জিনিয়া হাঁটু মুড়ে বসে চেয়ে রইল সাহিলকে। তাননা মুননার কান্নার আওয়াজে পরিবেশ ভারী হলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here