রৌদ্রদেশে মেঘের বেশে’ পর্ব-৪৪

0
770

#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[৪৫]

ফজরের আজান পড়ছে চারদিকে। নিত্যদিনের অভ্যাস অনুযায়ী জিনিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। সেই আগের দিনগুলোর মতো নিজেকে আবিষ্কার করল কারো বক্ষতলে। উপরে চোখ তুলে ঘুমন্ত মুখটা দেখে বুক মোঁচড় দিয়ে উঠল। চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো। বুকে সোজা চোখ নিক্ষেপ করতেই দেখল তার নিজের হাতের আঘাত, আঁচড়। সে নিজ হাতে আঘাত করেছে এখানে। নিজের আশ্রয়স্থলে মানুষ কখন আঘাত করে? কতটা আঘাতে জর্জরিত হলে, কতটুকু ঠকে গেলে?
জিনিয়া সেই আঁচড়ের দাগগুলোতে ঠোঁট ছুঁয়ালো। চোখের পানিতে ভিজে উঠল সাহিলের বুক। সে নড়েচড়ে উঠল। জিনিয়া ছুটে গেল। দূরে সরে পড়ল। সাহিল চোখ কচলাতেই হাতের দুই বাহুতে ব্যাথা লাগলো। একটাতে ছুরির আঘাত, অপরটাতে গুলির। সে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকলো জিনিয়ার দিকে। জিনিয়া চোখ তুলে তাকে দেখল। সাহিল কিছু বলার জন্য উসখুস করল। জিনিয়া শোনার জন্য উদগ্রীব। সাহিল গড়িয়ে আরেকটু কাছে গিয়ে মাথা রাখল। জিনিয়া ঢোক গিলল। সাহিল হাতের আঙুল নড়াচড়া করে নিয়ে গেল জিনিয়ার দিকে। জিনিয়া আঙুল গুলোর দিকে তাকালো। সাহিল আরেকটু ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। শ্বাস প্রশ্বাস আনাগোনা হলো। কিছু বলতে গিয়ে ও বলল না সাহিল, ছুঁতে গিয়ে ও ছিলনা। যদি জিনি আবার বলে উঠে,আপনি নোংরা?
সরে গেল সাহিল। উঠে বসলো। জিনিয়া বালিশে চেপে ধরল নিজের মুখ। সাহিল উঠে গিয়ে ওয়াশরুম থেকে মুখ হাত ধুয়ে আসলো।
ড্রয়ার থেকে পিস্তল নিতে গিয়ে দেখল একটি রুমাল। জিনিয়ার হাতের কাজ করা সেই রুমালে। দুইটা বাচ্চার সাথে তাদের মা বাবা। রুমালটা দিয়ে মুখ মুছতেই মনে হলো জিনিয়ার হাতের সুগন্ধি লেগে আছে। রুমালটা দিয়ে চোখ মুছে নিল সাহিল। জিনিয়া বিছানা থেকে নেমে এল। ওয়াশরুম থেকে মুখ হাত ধুয়ে নিয়ে চলে এল। সোরা রান্নাঘরে একা একা কি করছে কে জানে? জিনিয়াকে যেতে দেখে সালেহা বেগম তাড়াতাড়ি চলে এল। বলল
‘ বৌমা তুমি কেন এলে? তুমি যাও। আমরা করে নিই।
জিনিয়া বলল
‘ আমি ভালো আছি মা।
সালেহা বেগম তাকিয়ে রইল জিনিয়ার দিকে।
‘ দেখতে পাচ্ছি কত ভালো আছ।
জিনিয়া রান্নাঘরে পা বাড়ালো। সবার জন্য নাশতা বানালো। সাগর সাহেব, সাজেদ সাহেব আর নাহিলকে ডেকে আনলো। আহ শেষ।

সোরাকে বলল
‘ সোরা তোমার বড়দাভাইয়ের খাবার দিয়ে আসো।
সোরা মাথা নাড়ালো।
সোরা খাবার আবার ফেরত নিয়ে এল। জিনিয়াকে বলল
‘ ভাবি খাবেনা বলছে।
জিনিয়া বলল
‘ আচ্ছা আমি দেখছি।
জিনিয়া নিয়ে গেল খাবার। সাহিল হাতের ব্যান্ডেজ খুলে আবার নতুন ব্যান্ডেজ করাচ্ছে। একা হাতে পারছেনা। জিনিয়া টেবিলে খাবার রাখল ধপ করে। বলল
‘ খাবার ।
সাহিল প্লেটের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। খাবারটা নিশ্চয়ই জিনি বানিয়েছে।
জিনিয়া এগিয়ে গেল। সাহিলের হাতে সাদা ব্যান্ডেজ মুড়িয়ে দিতে দিতে বলল
‘ নিজের লোক গুলোকে মেরে কেন দল হালকা করছেন? ভারী করা উচিত ছিল।
সাহিল সরে গেল। শার্ট কুড়িয়ে গায়ে দিতে দিতে বলল
‘ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার ওসব। নিজে আমাকে ছুঁতে বারণ করো, এখন নিজে এসে ছুঁচ্ছ কেন?
জিনিয়া খানিক্ষণ নিরবতা পালন করে বলল
‘ খাবারগুলো খেয়ে নিন।
সাহিল প্লেটের কাছে গিয়ে দেখল নুডলস। পাউরুটি, কলা।
পাউরুটি কলা খেলনা সে। জিনিয়ার হাতের বানানো নুডলস গালে দিল। দু তিন চামচ খেয়ে মনে হলো জিভ পুড়াচ্ছে। এত ঝাল?
জিনিয়া তাকিয়ে থাকলো। সাহিল চুপ হয়ে গেল জিনিয়াকে তাকিয়ে থাকতে দেখে। হাত পা মোচড়াতে মোচড়াতে খেল। খাওয়া শেষে ঠোঁট কামড়ে ধরল। সামান্য ঝাল ও সহ্য হয়না তার। জিনিয়া তাকিয়ে থাকল সাহিলের দিকে। যে মানুষ সামান্য ঝাল সহ্য করতে পারেনা সে মানুষ এত ঝাল সহ্য করছে কি করে? সে তো ইচ্ছে করে ঝাল বানিয়েছে যাতে জিনিয়ার কাছে ছুটে এসে বলে
‘ জিনি মিষ্টি দাও। ভীষণ ঝাল করছে। ভীষণ।
না, সাহিল সেরকম কিছু বলল না। পায়ের আঙুল মোচড়াতে লাগলো। সালেহা বেগম ডাকল জিনিয়াকে।
জিনিয়া বের হলো রুম থেকে।
সালেহা বলল
‘ নুডলসে ঝাল বেশি দিলে কেন বৌমা? সবাই বলছে ঝাল হয়েছে। গুড্ডু কি করে খাচ্ছে?
জিনিয়া বলল
‘ খেয়েছে।
সালেহা ডুকে গেল রুমে। সাহিল তাকালো মায়ের হাতের দিকে। মিষ্টি কিছু আনেনি?
সালেহা খেয়াল করল ছেলের চোখ লাল।কপালে ঘাম। তিনি দৌড়ে গেলেন। ফ্রিজ থেকে পায়েস বের করে নিয়ে আসলেন। সাহিলের পেছনে দাঁড়িয়ে ডাকলেন, গুড্ডু?
সাহিল সাথে সাথে পিস্তল রেখে দিয়ে পেছনে ফিরল। সালেহা বেগম চামচে করে পায়েস তুলে দিলেন। সাহিল কোনোরূপ আপত্তি ছাড়া খেল। জিনিয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখল। সাহিল ঝাল মিটে যাওয়ার পর আর খেতে চাইল না। সালেহা টেবিলে বাটি রেখে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল তাকে। কেঁদে উঠে বলল
‘ গুড্ডু তুই কেন এমন হয়ে গেলি রে? আমি না থাকায় গুড্ডু কি হারিয়ে গেল?
সাহিল বলল
‘ মা আমায় বেরোতে হবে। ছাড়ো।
সালেহা বলল
‘ না, কোথাও যাবিনা তুই। তোকে হারাতে পারবনা বাবা। এমন করিস না গুড্ডু। তোর বউয়ের কথা ভাব। মেয়েটার কি হবে? তোর বাচ্চাগুলোর কি হবে?
সাহিল বলল
‘ আমাকে ছাড়ো মা।
সালেহা ধাক্কা দিল তাকে। আবার টেনে দু গালে ঠাস ঠাস করে চড় বসিয়ে কেঁদে দিল। সাহিল মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। জিনিয়া এসে ধরল সালেহাকে। বলল
‘ নিচে চলুন মা।
সালেহা কেঁদে দিয়ে বলল
‘ তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। ডিভোর্স দিয়ে দাও একে। দরকার নেই এমন ছেলের সাথে থাকার। দিয়ে দাও ডিভোর্স।
সাহিলের চোখ স্বাভাবিকের চাইতে বড় হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। কিন্তু বিষাদে মনটা ভিজে গেল মুহূর্তেই। জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে। সাহিল বলল
‘ নাহ।
সালেহা কেঁদে কেঁদে জিনিয়াকে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ হ্যা। দিয়ে দেব আমি তাকে তার মা বাবার কাছে। কি দিয়েছিস তুই মেয়েটাকে? তোর জন্য কেন এখানে পড়ে থাকবে সে ? তোর মেয়েকে তোর লাগলে নিয়ে আসিস। ও চলে যাবে আজ। জিনিয়া টেনে টেনে নিয়ে গেল সালেহা। সাহিল দৌড়ে বের হলো। জিনিয়ার হাত টেনে ধরে বলল
‘ মা ওকে ছেড়ে দাও। আমি কিছু বলব।
সালেহা আরেক চড় বসালো তার গালে। বলল
‘ কিছু বলতে হবেনা। আমরা কি কিছু জানিনা ভেবেছিস? তোর ছোটআব্বা সব বলেছে আমাদের। তোর বউ ছিল একটা। তারপরও তুই বিয়ে করতে করেছিস জিনিয়াকে। লজ্জা করেনা তোর? করেনা?
সাহিল জিনিয়ার দিকে তাকালো। বলল
‘ জিনি?
জিনিয়া তাকালো না। সালেহা বেগম টেনে নিয়ে গেল জিনিয়াকে। সাহিল দাঁড়িয়ে থাকলো।
রুমে বসে থাকলো। কখন জিনিয়া আসবে। জিনিয়া আসলো অনেক্ক্ষণ পর। সাহিল এখনো বের হয়নি দেখে সামান্য অবাক হলো। সাহিল জিনিয়াকে দেখার সাথে সাথে দৌড়ে এল। বলল
‘ আর কতভাবে মারবে জিনি? খাবারে ঝাল দিচ্ছ মানছি, অমানুষ ডাকছ মানছি, ছেলেমেয়েকে ছুঁতে দিচ্ছ না মানছি, তাদের দূর রেখেছ তাও মানছি, নিজেকে গুটিয়ে রেখেছ তাও মানছি, কিন্তু ডিভোর্স কেন জিনি?
জিনিয়া বিছানার চাদর ঠিক করতে করতে বলল
‘ নিজ থেকে এসেছি, তাই নিজ থেকে চলে যাচ্ছি। মুক্তি দিচ্ছি আপনাকে।
‘ এমন মুক্তি আমার চাইনা। বন্দী থাকতে ভালো লাগে।
‘ আমার চাই। আমি মুক্তি চাই। আপনার সাথে একঘরে একবাড়িতে থাকতে রুচিতে বাঁধে আমার। নিজের সন্তানদের অমানুষের বাচ্চা ভাবতে ঘৃণা হয়। নিজের প্রতি ঘৃণা হয়।
‘ তুমি ভাবলেই ওরা আমার বাচ্চা সেটা মিথ্যে হয়ে যাবেনা।
‘ জানি কিন্তু নিজেকে সান্ত্বনা দিতে বাঁধা কোথায়?
সাহিল পিস্তল নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। জিনি ডিভোর্স দেওয়ার আগে সব ছেঁড়েছুড়ে চলে আসবে সে। জিনিয়া তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
‘ আবার কাকে মারতে যাচ্ছে মানুষটা?

_________

আদালতে হাজির ছিল জায়িদ। শফিক সাহেবের মুখ থেকে জবান নিল উকিল। সব সত্যিটা বলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। জর্জ বললেন
‘ আপনার মেয়ের কিডনির জন্য আপনি এমন কাজে যুক্ত হলেন? আপনার মেয়ে কি সেই কিডনি নিত কখনো? পাপের জিনিস দিয়ে মেয়েকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন? কিন্তু বাঁচাতে পারলেন কি?
জায়িদ স্তব্ধ। শান্ত। এসব কি বলছে আব্বা? জুননুর কিডনি বিকল?
শফিক সাহেবের কাছে আদালত জরিমানা দাবি করল। খালাস দিল। তবে শহরের বাইরে কোথাও যাওয়ার জন্য নিষেধ করল। শফিক সাহেব কাঠগড়া থেকে নামতে পারলেন না। কান্না করতে করতে বসে পড়লেন তিনি। আদালত খালি হলো। রয়ে গেল শফিক সাহেব আর জায়িদ। জায়িদ নরম পায়ে হেঁটে শফিক সাহেবের কাছে এল। বলল
‘ আব্বা এতবড় সত্যি তুমি কি করে লুকোতে পারলে? কি করে আব্বা?
শফিক সাহেব কোনোকথা বলতে পারলেন না। জায়িদ বলল
‘ আমি দেব আমার বোনকে কিডনি। আমি। আমি দেব। জুননু বাঁচবে।
শফিক সাহেব কেঁদে উঠে বললেন,
‘ আমি দিতাম যদি আমার সাথে ম্যাচ করতো। আমি অনেক আগে দিতাম।

শফিক সাহেব ঘরে পৌঁছাতেই জাহেদার কানে উঠে সেই খবর। তাননা মুননা খেলছে আনহার সাথে। আনহার পেট দেখিয়ে বলছে
‘ আননা ফিপি তুমাল বাবু কুথায়?
আনহা বলল
‘ আল্লাহর কাছে এখনো।
তাননা বলল
‘ নয়। তুমাল পেটে।
আনহা ঠোঁট টিপে হেসে ফেলল। মুননা বলল
‘ ওফিচারের বাবু কুথায়?
আনহা বলল
‘ মনে হয় ওফিচারের পেটে।
তাননা মুননা হা করে তাকিয়ে থাকলো আনহার দিকে। কথাটা কেমন জানি শোনালো না?
জাহেদা তাকিয়ে থাকলো তাননা মুননার দিকে। জায়িদ বসা সোফায়। শফিক সাহেব মাথা এলিয়ে বসে রয়েছেন। তাননা মুননা বলল
‘ নানাভাই আসিছে। এখুন জুননু আল কানবেনা।
জাহেদা হু হু করে কান্নায় ভেঙে পড়ল। আনহা দৌড়ে গেল। জিজ্ঞেস করল
‘ কি হয়েছে মা?
জাহেদা টেবিলে দুহাতের ভর দিয়ে কেঁদে উঠে বললেন
‘ আমার মেয়েটা বাঁচবেনা আর। বাঁচবেনা।
আনহা বলল
‘ কেন?
জায়িদ এসে মাকে বলল
‘ আম্মা জুননু বাঁচবে। কিচ্ছু হবেনা ওর।
জাহেদা তিতিয়ে উঠে বলল
‘ দরকার নেই তোর কিডনি। দয়া দেখাস না আমার মেয়েকে, আমি দেব আমার মেয়েকে কিডনি। আমি দেব।
জায়িদ বলল
‘ ও আমার বোন আম্মা। আমার বোন। আমার জুননু।
আনহা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল জায়িদকে। জাহেদা বলল
‘ তাহলে তোর বউ? তোর সন্তান? তাদের কে দেখবে? কে?
জায়িদ সাথে সাথে তাকালো আনহার দিকে। আনহা ছিল মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল ওর। জায়িদ বলল
‘ আনহা তুমি,
আনহা মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ কিছু শুনিনি আমি। শুনিনি।
জায়িদ আর ও কিছু বলতে চাইল। আনহা চলে গেল। জায়িদ শফিক সাহেবের দিকে দৌড়ে গিয়ে বলল
‘ আব্বা? আব্বা আমি দিতে পারব তো। জুননুকে আমি বাঁচাবো। আব্বা তুমি চেষ্টা করে দেখোনা। তাননা মুননা বাঁচবেনা জুননুকে ছাড়া।
শফিক সাহেব বলল
‘ তাহলে আনহা?
জায়িদ আনহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল। অনেক্ক্ষণ পর মিনমিনিয়ে বলল
‘ তোমরা দেখবে। আব্বা এমন হয়না একটা দিয়ে বাঁচা যায়? হয়না?
শফিক সাহেব বলল
‘ হয়,কিন্তু?
দরজা ঠেলার আওয়াজ হলো। জায়িদ চোখ তুলে দেখল। শফিক সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। তাননা মুননা হাত তালি দিয়ে বলল
‘ আম্মা আসিছে। ওহ ওহ জুননু আসি গিছে। আমলা চুড়ুই চুড়ুই খিলবো কিমুন?
জিনিয়া স্যুটকেস টেনে বাড়িতে ডুকালো। পড়নে সাদাটে আকাশি রঙের শাড়ি। জাহেদা দৌড়ে গেল। জিনিয়া তাকিয়ে থাকলো জাহেদার দিকে। জাহেদা কেঁদে উঠে বলল
‘ ভালো হয়েছে চলে এসেছিস। এবার বুঝবে তোর স্বামী, স্ত্রী, সন্তান কত বড় নেয়ামত এই দুনিয়ায়। ভালো হয়েছে ডিভোর্স দিয়ে ফেলেছিস।
জিনিয়া শফিক সাহেবকে দেখে ডাকল।
‘ আব্বা? আমাকে কিডনি দেওয়ার জন্য কিডনি পাচার চক্রের সাথে যুক্ত হলে? নিজের বাড়িতে অস্ত্র লুকিয়ে রাখলে? কেন আব্বা?
জাহেদা বলল
‘ নাহ নাহ সব মিথ্যে। তুই একদম ঠিক আছিস। কিছু হয়নি তোর।
‘ আমি সব জানি মা। সব শুনেছি ইন্সপেক্টর গিয়াশের কাছ থেকে। সবটা। আব্বাকে এমনি এমনি খালাস দেয়নি।
জাহেদা আঙুল দিয়ে তাননা মুননাকে দেখিয়ে দিল। বলল
‘ ওই দেখ মা, তোর দুই বাচ্চা। ওদের মুখের দিকে একবার তাকা। মা বাবা দুইজনই স্বার্থপর তোরা। এই বাচ্চাদুটোর কথা ভাবলিনা একবার ও কেউ। না তাদের বাপ ভাবলো, না তুই ভাবছিস। কি দোষ ওদের?
জিনিয়া বলল
‘ ওদের দোষ ওরা আমার গর্ভে কেন জন্ম নিল?
আর আমার দোষ আমি কেন জন্ম দিলাম? কেন ওদের মেরে ফেলিনি আম্মা? তাহলে আমার কোনো পিছুটান থাকতো না। আমি শান্তিতে মরতে পারতাম আম্মা।
জায়িদ মাথায় হাত চেপে বসে থাকে। সে খুন করে ফেলবে সাহিলকে। সে শেষ করে দিল তার বোনের জীবনটা।

_______

সমুদ্র পাড় থেকে ফোন এল জায়িদের ফোনে। সে জিনিয়াকে দেখতে এসেছিল রুমে। ঘুম জিনিয়া। তার দুইপাশে তার দুই বাচ্চা। কত যত্ন করে ধরে রেখেছে দুই সন্তানকে। এভাবে থেকে গেলে কি হয়? জায়িদ বাঁচাবেই জুননুকে। যে করেই হোক৷
সমুদ্র পাড়ে গিয়ে জানতে পারলো অস্ত্রের জাহাজ ডুবে গিয়েছে। অনেক অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তবে কোনো মানুষ উদ্ধার করা যায়নি। গোয়েন্দা বিভাগ তথ্য দিল ইচ্ছে করেই মাঝসমুদ্রে জাহাজটা ডুবানো হয়েছে। নাবিক নৌকা করে পালিয়েছে। সাহিলকে দেখা গেল। জায়িদ সবার চক্ষুর অগোচরে গিয়ে ধরল সাহিলকে। কলার টেনে ধরে মুখ বরাবর ঘুষি বসিয়ে ফেলে দিয়ে বলল
‘ নিমকহারাম দেখ তোর প্ল্যান কিভাবে নষ্ট হলো। করতে পারলি পাচার? পারলি?
সাহিল হাসলো শুধু। জায়িদ তাকে মেরে রক্ত বের করল নাক থেকে। পুলিশ মারছে দেখে কেউ ছাড়াতেও এলোনা৷ সাহিল শেষমেশ একটা বসিয়ে ফেলে দিল জায়িদকে। ঠোঁটের রক্ত মুছে বলল
‘ এভাবে মারছিস কেন? সমস্যা কি? জাহাজটা আমিই ডুবিয়েছি। আমিই। আমি জিনির কাছে ফিরতে চাইছি, ফিরতে দিচ্ছিস না কেন? আমাকে শোধরাতে দিবি তো?
জায়িদ তাকিয়ে থাকলো৷ সাহিল মুখ মুছে বলল
‘ যাহ প্রমাণ জোগাড় কর গিয়ে। যাহ। আমি কি ভয় পাই তোদের পুলিশদের? হ্যা?
জায়িদ বলল
‘ তাহলে কিডনিগুলো কোথায়? দশহাজার কিডনিগুলো কোথায়? বল কোথায়? কোটিটাকার কিডনি!
সাহিল বলল
‘ বিক্রি করে দিয়েছি৷
জায়িদ উঠে দাঁড়ালো।
‘ ছিঃ সাহিল। ছিঃ।
‘ তাননা মুননার নামে একটি অনাথ আশ্রম তুলতে দিয়েছি। ওখানে টাকাগুলো দিয়ে দিয়েছি।
জায়িদ বলল
‘ পাপের টাকা দিয়ে?
সাহিল বলল
‘ হোক পাপের টাকা। অন্তত আমার মতো কাউকে দশ বছর বয়স থেকে খারাপ কাজে জড়িত হতে হবেনা। অনাথ শিশুগুলো অন্তত দুটো ডালভাত খেয়ে পড়তে পারবে। অন্তত আমার মতো নষ্ট হবেনা কেউ।
জায়িদ আরেক ঘুষি বসালো সাহিলকে। ফেলে দিয়ে কলার ঝাঁকিয়ে বলল
‘ এমনটা কেন হলো? আমার বোনকে বাঁচা এবার। তোর তো মৃত্যুদন্ড হবে। ফাঁসি হবে তোর।
সাহিল একটি ছোট্ট নোট দিল জায়িদকে। জায়িদ নিল।
‘ এটা কি?
সাহিল বলল
‘ দেশের প্রতিটা হসপিটালের বেশিরভাগ কিডনি পাচার চক্রের সাথে যুক্ত আছে। এখানে তাদের নাম আছে। যারা আজ খুন হবে মনে করবি তাদের আমি মেরেছি। যারা আগে খুন হয়েছে মনে করবি তাদের আমিই খুন করেছি। বাবলুকে ও।
জায়িদ বলল
‘ না আর খুন করবিনা?
সাহিল পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলল
‘ আটকে দেখা। জায়িদ বলল
‘ সাহিল না।
সাহিল যেতে যেতে বলল
‘ আটকে দেখা। আমাকে থামিয়ে দেখা। তোদের এই আইনকে ভয় পাইনা আমি। তোদের আইনই তো জড়িত এই পাচার চক্রের সাথে। ফাঁসি আমার হবেই। আমি ভয় পাইনা মৃত্যুকে।
জায়িদ সব থানায় থানায় ইনফর্ম করে দিল। কিন্তু থানার পুলিশগুলো ও জড়িত অস্ত্র পাচারের সাথে। তাই কেউ কিছু করতে পারলনা। গুটিকতক যারা আছে তারা যাওয়ার আগেই তারা লাশ পেল ডক্টরগুলোর। সাহিলের লোক খুন করে ফেলল। জায়িদকে ফোন করল সাহিল।
” এবার পুলিশগুলোকে খুন করব আমি।
জায়িদ বলল
‘ নাহ।
সাহিল বলল
‘ তোর বিশ্বস্ত কন্সটেবল হামাদউদ্দীনের লাশ পড়েছে থানার সামনে। গিয়ে দেখে আয়। তোকে দিনের পর দিন সে ঠকিয়েছে শুধু। লাশের পর লাশ পড়ল শহরে। সারা দেশে উঠল এক বিরাট তোলপাড়। সাহিল নিজের লোক গুলোকে খুন করল নিজ হাতে। বেঁচে না থাকুক একটা পাপ ও। এখন শুধু পালা ইয়াজিদ মজুমদারকে। কোথায় লুকিয়ে আছে সে? সাহিল নির্মম মৃত্যু দেবে তাকে। নির্মম। যারজন্য সে এতদূরে পরিবার থেকে। যারজন্য সে হারিয়ে ফেলল স্ত্রী, সন্তান। যার জন্য হারিয়ে ফেলল তার জীবনের রঙিন দিনগুলো। দুইদিন পর বাড়ি ফিরল সাহিল। যেন আতঙ্ক ফিরল। সবাই ভয়ে গুটিয়ে গেল। সাহিল শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সবার দিকে। স্বাভাবিক স্বরে ডাকল
‘ তাননা মুননা?
কেউ এলোনা। সাহিল নিজের ঘরে চলে গেল৷ ডাকল
‘ জিনি?
নিচে নেমে এল সাহিল। নাহিলকে জিজ্ঞেস করল
‘ জিনি কোথায়?
নাহিল কিছু বলল না। সোরা ও বলল না৷ সাহিল চিল্লিয়ে বলল
‘ জিনি কোথায়?
কেউ কিছু বলল না। সাহিল উল্টে দিল খাবার টেবিল। গ্লাস তুলে ছুঁড়ে মেরে বলল
‘ জিনি কোথায়?
সাগর সাহেব বলল
‘ চলে গিয়েছে এ বাড়ি ছেড়ে। তোকে ছেড়ে।
স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল সাহিল। ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগর সাহেবের। সাগর সাহেব সোফায় পড়ে গেল। সাহিল উনাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে মারল হাতের বাহুতে। নাহিল আর সাজেদ সাহেব গিয়ে ধরল সাহিলকে। সাহিল সাগর সাহেবের গলা চেপে বলল
‘ তোরজন্য হয়েছে সব। আমাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠালি কেন? কেন পাঠালি? সব তোর জন্য হয়েছে।
নাহিল টেনে নিয়ে আসলো। বলল
‘ ভাই। ভাই শান্ত হও। শান্ত হও ভাই। কেন এমন করছ?
সালেহা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলেন৷ সাহিলের গালে কষে চড় বসিয়ে দিল ডিভোর্স পেপার। বলল
‘ জিনিয়া সাইন করে দিয়েছে এবার তুই করে দে। তোর মেয়েকে তুই নিয়ে আয়। তার ছেলে তার কাছে থাকুক। যাহ।
সাহিল ডিভোর্স পেপার হাতে নিয়ে দৌড়ে বের হলো বাড়ি থেকে। তালুকদার বাড়ির গেইট খুলে বাড়ির দরজা ঠেলল। দরজা খুলল জাহেদা।
‘ কি চাই এখানে?
সাহিল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ জিনি, তাননা মুননা।
‘ মরে গিয়েছে ওরা। যাও এখান থেকে।
সাহিল হাত টেনে সরিয়ে দিল জাহেদাকে। জাহেদা পড়ে গেল নিচে । চেঁচিয়ে বলল
‘ সাহিল যাবেনা তুমি। ওই নোংরা হাতে ছুঁবেনা আমার মেয়েকে। ছুঁবেনা।
তাননা মুননা আনহার রুমে। আনহাকে রাখতে বলেছে জিনিয়া।
সাহিল জিনিয়ার রুমের দরজা ঠেলতেই খুলে গেল দরজা। জিনিয়া কেঁপে উঠল। পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে শুয়েছিল সে। সাহিলকে দেখে সোজা হয়ে বসলো। চোখ,গাল ভিজে উঠল মুহূর্তে। সাহিল দরজা বন্ধ করে দৌড়ে গেল তার কাছে। জিনিয়া সরে যেতে চেয়েও পারলোনা। এমন একটা সিরিয়াল কিলারের মনে তার জন্য কেন দয়ামায়া? কেন ভালোবাসা? কেন?
সাহিল ঠোঁট চেপে ধরল জিনিয়ার মুখে।
জিনিয়া জোরে ঠেলতেই সরে পড়ল সাহিল।
পকেট থেকে লাইটার বের করল। আগুন ধরিয়ে দিল ডিভোর্স লেটারে। জিনিয়ার শাড়ির আঁচল টেনে ধরে আগুন ধরিয়ে দিল সাদা শাড়িতে। জিনিয়া শান্ত চোখে চেয়ে থাকলো। দাউদাউ করে আগুন ধরে গেল শাড়িতে। জিনিয়া চেয়ে রইল। সাহিল একটান দিয়ে খুলে নিল সেই শাড়ি। আলমারি তন্নতন্ন করে খুঁজে নিল বিয়ের সেই লাল শাড়ি। জড়িয়ে দিল,পড়িয়ে দিল জিনিয়ার গায়ে। আগুন জ্বললো সাদা শাড়িটাতে। পুড়লো সেটি। লাল শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে শক্ত করে নিজের সাথে জিনিয়াকে জড়িয়ে ধরে রাখল সাহিল। জিনিয়া কোনোপ্রকার নড়াচড়া করলনা। কোনোপ্রকার আওয়াজ করলনা। সাহিল তাকে নিজের সাথে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলল

‘ জিনি!
আমি ওইপাড়ে চলে যাওয়ার আগপর্যন্ত তোমার জন্য সাদা শাড়ি নিষিদ্ধ করলাম। তুমি আমাকে এভাবে মারতে পারোনা জিনি । আমি তোমার জন্য মরতে পারি, কিন্তু তোমার হাতে নয়। এত নির্মম মৃত্যু তুমি দিতে পারোনা আমায়। পারোনা।
জিনিয়া শান্ত হয়ে পড়ে রইল তার বুকে। সাহিল আরও পিষ্ট করল তাকে।

চলবে
আর দুই পর্ব হবে। সবার মন্তব্য চাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here