স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৩

0
1669

স্বপ্নচূড়ার আহবান
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব-৩

৫.

বৈরাগী খালার চুলগুলো পায়রার ভালো লাগে। এইযে মাথার উপর কমলা রঙের টুকরো কাপড় দিয়ে এলোমেলো করে বামপাশে উঁচু করে খোঁপা করেছে। দেখতে পায়রার ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে চুল গুলোতে অনেকদিন যাবৎ চিরুনির আঁচড় লাগায়নি।
পায়রা দুই মিনিট হলো বৈরাগী খালার পাশে বসেছে।অথচ বৈরাগী খালা কিছুই বলছেনা, এতে পায়রার মন খারাপ হচ্ছে। কেউ যদি এভাবে পাশে বসিয়ে তাকে উপেক্ষা করে অন্য কাজ করে তখন পায়রার মন ক্ষুন্ন হয়। থার্মোমিটারের পারদ যেমন তরতর করে বাড়তে থাকে পায়রার মন খারাপের রেশও সেভাবেই বাড়ে। তবে কী বৈরাগী খালা তার সাথে কথা বলবেনা! সে প্রায়ই দেখে বৈরাগী খালা অন্য মানুষের সাথে হেসে কথা বলতে, অথচ তার সঙ্গে কথাই বলে না। এত লম্বা পায়রার উপর কী বৈরাগী খালার দৃষ্টি পড়ছে না? নাহ,অনেক হয়েছে। স্কুলের যে দেরি হয়ে গেলো বলে।

-‘বৈরাগী খালা’

বৈরাগী খালার বোধ হয় আটকে থাকা ধ্যান ভাংলো। কোন ভাবনার বিভোর ছিলেন কে জানে। বৈরাগী খালা পায়রাকে বললেন-

-‘ বল, কী জানতে চাস?’
-‘আপনে কেমনে জানলেন আমি কিসু জিগামু?’

পায়রা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো। বৈরাগী খালা সাদা দাঁত বের করে হাসলেন৷ সিঁড়ির পেছনে হেলে পড়ে হাঁটু গেড়ে নিলেন৷ হাঁটুতে মাথা ভর দিয়ে কেমন যেন অভিমানী স্বরে বললেন-

-‘তোরা তো শুধু এইজইন্যই আমার কাসে আসোস, কেউ স্বার্থর জন্য তো কেউ আবার কৌতুহল লইয়া ‘

হাঁটু গেড়ে বসে থাকা নারীটিকে পায়রার হুট করেই মনে হলো, এই মহিলা কিশোরী থাকাকালীন ভীষণ সুন্দর ছিলেন। পাড়া কাঁপানো সুন্দরী যাকে বলে। এই সুন্দরী মহিলাকে এই নোংরা কাপড়া কাপড়ে মানায় না। এনাকে মানাবে কোনো সুন্দর রাজপ্রাসাদের কারুকার্য খচিত সুবিশাল সিংহাসনে রাণী রূপে। আচ্ছা?পায়রার এখন কী করা উচিত? বৈরাগী খালাকে কী একবার ধরে বেঁধে নিয়ে জোর করে সিংহাসনে বসিয়ে দেখা উচিত? পায়রার মন বললো
– ”নাহ, থাক। এই কমলা রঙের ছন্নছাড়া এক বৈরাগী খালাকে প্রকৃতির প্রয়োজন। কিছু অপ্রয়োজনীয় জিনিস প্রকৃতির শোভা বাড়ায়। এই ছন্নছাড়া, জগৎসংসারহীন মানুষটি বরং এখানেই থাক প্রকৃতির শোভা বাড়াক ”

৬.

পায়রা জুতা একদফা হালকা মাটিতে বাড়ি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো৷ বৈরাগী খালার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাঁটা শুরু করলো। কিছুটা হাঁটতেই বৈরাগী খালা বললেন –
-‘পৃথিবীতে সুখ খুঁজে পাওয়া গুপ্তধন পাওয়ার চাইয়াও মুশকিল। হাঁটতে চলতে আশেপাশে কত লাশ হাঁইটে বেড়ায়, কিন্তু মুখোশ দেখে চিনার উপায় নাই। হরেক রকম মুখোশের মেলায় আসল চেহারা খুঁইজা পাওয়া চারটে খানে কথা না বাছা। ‘

পায়রা কথার বান কর্ণকুহর করলো কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না৷ থাকুক, কিছু নিরুত্তরতা।
পায়রা নাকের ডগায় জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিলো।
রোদের তাপ বাড়ছে। আরও কিছুটা হেঁটে স্কুলের ভেতর ঢুকলো , সামনে দাড়ানো প্রৌঢ় দারোয়ান মুখে পানের টুকরো মুখে পুড়ে বললেন,
-‘কীরে পায়রা আইজকা এত দেড়ি করলি কে? প্রতিদিন সক্কালে আইয়া গেট খুলো গেট খুলো নিয়া চিল্লাপাল্লা করস ‘
পায়রা তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে বললো,
-‘বেশী কথা বলো দেইখাইতো তোমারে সবাই কালাম বাঁচাল কয়। কই আমারে আগায় দিবা ব্যাগটা ধইরা তা না। রাখো তোমার পেঁচাল! ‘

পায়রা এক দৌড় দিলো স্কুলের উদ্দেশ্যে৷ কারণ একটাই, জামেল স্যারের হরেক মেলার শাস্তির ভয়। ক্লাসের মোটামুটি স্টুডেন্ট সে৷ শাস্তির তেমন কোনো রেকর্ড নেই। কিন্তু আজ যদি তাকে সবার সামনে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে রাখে তাহলে সে তো দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেনা, কারণ সে তো খাটো নয়। জিরাফের মতন লম্বা ঘাড়টা নিশ্চয়ই ফ্যানের সাথে বাড়ি না খেয়ে থাকবে না। কি বিচ্ছিরী হবে ব্যাপারটা!
ধকধক করতে থাকা হার্টের তুমুল গতির সাথে পা মিলিয়ে ক্লাসরুমের সামনে দাঁড়িয়ে পায়রা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো-
‘স্যার আসমু?’

জামেল নামের স্কুলের কুখ্যাত অর্ধবয়স্ক টাক মাথার লোকটি বোর্ডের লেখা থামিয়ে একপাশে ভাঙা চৌকাঠের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে অতি শুদ্ধতার সঙ্গে টেনে বললেন –

‘না তুমি আসতে পারো না। যা পারো তা হলো, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফার্মের মুরগীর বিখ্যাত স্টাইলে কান ধরে থাকতে। আমি বড়জোড় তোমার জন্য, আমার শহরের থেকে আনা সিটিসান কম্পানির তিন হাজারের ঘড়িটি দেখে তোমার সময় নির্ধারণ করে দিতে পারি। ‘

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here