স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-২৭

0
1060

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-২৭

সম্পূর্ণ ঘটনাটা ঘটার পর পায়রা বুঝতে পারলো ঠিক কী হয়েছে৷ মুহুর্তেই মেজাজ ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুড়ে গেলো৷ পায়রার রাগ খুব কম। সে বরাবরই শান্ত। কথায় আছে ‘শান্ত মানুষের রাগ ভয়ংকর ‘। একেবারেই সত্য কথা। পায়রা যাদের সম্মান করে তাদের সঙ্গে সবসময়ই নমনীয়, ভদ্র। কিন্তু যারা সুযোগ পেলেই মানুষকে অপমান করে তাদেরকে চোখে কাঁটার মতো বিঁধে তার ৷ সামনে দিয়ে গড়গড় করে হেঁটে যাওয়া সভ্যের মুখোশ পড়ে থাকা মহিলাটিকে ভীষণ বিরক্ত লাগলো পায়রার। তাসনুভা
ক্লাসের দরজা লাগিয়ে দিয়েছেন। পায়রা লম্বা শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলো। দরজায় অনবরত ঠকঠক আওয়াজ করে নাড়তে শুরু করলো। ক্লাসের ভেতরের সবাই নতুন মেয়েটাকে নিয়েই নানা আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত ছিলো ৷ সবার মধ্যে টানটান উত্তেজনা। তাসনুভা শিকদার বেশ কড়া চোখে সবাইকে চুপ করে পড়া শুরু করতে বললেন। কিন্তু এর মাঝেই দরজা কড়াঘাতে মনোযোগ পিষ্ট হলো। পিয়ন এসেছে ভেবেই বিরক্তমুখে দরজা খুললেন তিনি৷ দরজা খুলতেই বেশ খানিকটা অবাক হলেন। এইটুকু মেয়ের এতো সাহস কী করে হয়! একবার বের করে দেয়ার পর আবারও বেয়াদবের মতো আওয়াজ করছে ৷ পায়রার দাগযুক্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে একবার নাক ছিটকালেন। মুখ তেঁতো হয়ে যাওয়ার মতো করে বললেন-

‘আহ! চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। হাও ডেয়ার ইউ বি এডমিটেড টু দিস স্কুল?’

পায়রা স্বাভাবিক ভাবে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে।
এতক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলেও এখন চোখ তুলে তাকালো। তাসনুভা হঠাৎ করেই যেনো একটা ধাক্কা খেলেন। কারো চোখ এত ধারালো কী করে হয়!
যেনো তাকিয়েই ছুরিকাহত করে দেবে। আনমনেই তিনি ভয় পেলেন। মেয়েটার দৃষ্টি বড়ই তীক্ষ্ণতা সম্পন্ন।
পায়রার মুখ অতি স্বাভাবিক। সে সেভাবে দাঁড়িয়েই বললেন-

‘যেই সাহসে এই স্কুলের অন্য ছাত্র ছাত্রীরা পড়তে আসছে ঠিক সেই সাহসেই আমিও এইখানে পড়তে আসছি। অবশ্যই চেহারা দেখাইতে না। ‘

তাসনুভা চরম মাপের অবাক সাথে রেগে গেলেন।
তার হাঁটু বয়সী মেয়ে, যে স্কুলের গণ্ডী পেরোয়নি। সেই মেয়ে তার মুখে মুখে তর্ক করে! মুহূর্তেই ঠাটিয়ে চড় বসিয়ে দেয়ার তীব্র বাসনা জাগলো মন-মস্তিষ্কে।
তিনি আঙুল উঁচু করে বললেন-

‘ডু ইউ নো হু আই এম? গ্রামের গাইয়া মেয়ে তা তো হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছে। ‘

পায়রা হতবাক হলো ৷ একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকার আচরণ এতটা রুঢ় কী করে হয়! এত বড় নামি-দামি স্কুলে পা না রাখলে সে দুনিয়ার এই ধরনের মানুষ গুলো দেখতে পেতো না।

ক্লাস রুমের বাহিরে এমন হট্টগোলের আওয়াজে অনেক শিক্ষকরাই নিজেদের ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসেছেন। সবাই দাঁড়িয়ে দেখছেন আসল ব্যাপারটা কী। তাসনুভা যখন চোখমুখ শক্ত করে আরও কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, ঠিক তখন একজন ব্যাক্তি সেখানে উপস্থিত হলেন৷ তাসনুভা দেখে নিজেকে সামলে নিলেন। তিনি এস.টি স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপাল আভাস বোস। বয়স ত্রিশের কোঠায়।
বয়স অনুযায়ী অনেক ফিটনেস সম্পন্ন। দেখলে বোঝা যায় না বললেই চলে৷ মুখে তিরিক্ষি মেজাজ ফুটে আছে। এক হাত সাদা প্যান্টে গুঁজে রাখা। আপাদমস্তক সাদায় মোড়ানো। গায়ের রঙ থেকে শুরু করে জুতা পর্যন্ত সাদা। বেশিক্ষণ এক ধ্যানে তাকে
ধাঁধা লেগে যায়। তারপর যেদিকেই তাকানো হবে, মনে হবে সব সাদা। পায়রা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো৷ আভাস তাসনুভার দিকে তাকিয়ে বললেন –

‘এটা কী কোনো স্কুলের পরিবেশ হতে পারে? মিস তাসনুভা শিকদার? ‘

ভরাট কন্ঠের স্পষ্ট বাক্য উচ্চারণে ঘাবড়ে গেলেও বেশ সাহস সঞ্চয় করে তাসনুভা উচ্চ স্বরে বললেন-

‘সম্পূর্ণ দোষটা এই মেয়ের স্যার। দেখুন কী অসভ্যের মতো টিচারের সঙ্গে তর্ক করছে!’

আভাস বোস, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে তাকালেন। মেয়েটির দৃষ্টি সামনের দিকে। একদমই নির্লিপ্ত ভঙ্গি৷ মুখের পাশটায় নজর দিতেই বুঝতে পারলেন মেয়েটার মুখের পাশটা এসিড ঝলসানো।
তিনি কিছু একটা ভাবলেন, তাসনুভার দিকে তাকিয়ে বললেন-

‘ ঠিক কী কারণে আপনার সঙ্গে তর্ক করছে? ‘

তাসনুভা মনে মনে হাসলেন। এবার বেয়াদব মেয়েটাকে উচিত শিক্ষা দেয়া যাবে৷ বেশ রসিয়ে রসিয়ে বললেন-

‘স্যার, ক্লাসের সবাই মেয়েটাকে দেখে খুব ভয় পাচ্ছিলো তাই আমি বের করে দিয়েছি। একজনের জন্য তো আর পুরো ক্লাসের পরিবেশ নষ্ট করতে পারি না আমি। কিন্তু এই মেয়েটা অনবরত ঠকঠক আওয়াজ করে ক্লাসের সবার মনোযোগ নষ্ট করে দিচ্ছে। ‘

আভাস বোস স্মিত হেঁসে বললেন –

‘আপনি তো দেখছি বেশ সচেতন স্কুলের পরিবেশ রক্ষায়! ‘

তাসনুভা প্রশংসিত হয়ে মুচকি হাসলেন। তার মতে মুখের এমন কুৎসিত বিকৃত কোনো মেয়েকে ঘরে বন্দী করে রাখা উচিত। না হলে, হুট করে মানুষ এদের চেহারা দেখে হার্ট অ্যাটাক করে বসতে পারে। তিনি যা করেছেন তা ভালোই হয়েছে।

আভাস বোস এবার ভ্রু বাকিয়ে বললেন-
‘মিস তাসনুভা, আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমিও এই স্কুল কলেজের একজন সচেতন ব্যাক্তি?’

‘জ্বি, তা তো অবশ্যই জানি। ‘

‘তাহলে, আমারও উচিত স্কুলের সুশৃঙ্খল পরিবেশ রক্ষায় আপনাকে বের করে দেয়া। ‘

তাসনুভা বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে বললেন –

‘মানে? ‘

‘বাংলা নিশ্চয়ই বোঝেন। আপনার সাহস কী করে হয় স্কুলের একজন শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করার?’

শেষের কথাটা এতো জোড়ে বলা হলো তাসনুভা ভয়ে দুই কদম পিছিয়ে গেলেন। তোতলানো গলায় বললেন-

‘সসরি স্যার..’

‘হোয়াট সরি! একজন শিক্ষকের ব্যবহার যদি এমন হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে?’

তাসনুভা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বুঝতে পারলেন ভুল জায়গায় দাপট দেখিয়ে ফেলেছেন। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলেন। আভাস বোস, নতুন আগত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন –

‘গো টু ইউর সিট। ‘

পায়রা একবার তার দিকে তাকালো। কৃতজ্ঞতা মূলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রস্থানের আগে বললো-

‘ধন্যবাদ। শিক্ষকদের স্কুলে নিয়োগ দেয়ার আগে তাদের উচ্চ ডিগ্রির সার্টিফিকেটের সঙ্গে, মনস্তাত্ত্বিক
যোগ্যতাও পরখ করে দেখবেন। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তাহলে শিক্ষক জাতির চক্ষু। শিক্ষক চোখ দিয়ে যা দেখাবে শিক্ষার্থীরা মনে প্রাণে তাই ধারণ করবে। ‘

চলবে…
আগের পর্বে যারা কমেন্ট করেছিলো, আজ তারা কষ্ট করে নিজেদের মতামত প্রকাশ করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here