“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৩৭
ফেয়ারি লাইটের আলোয় পুরো ছাদ ঝলমলিয়ে উঠেছে। মাঝখানে একটা রাউন্ড টেবিল যেটায় লাভ শেপের একটা কেক দেখা যাচ্ছে। আশেপাশে ফ্লোরে বেলুন ছড়ানো। গোলাপের পাপড়ি বিছিয়ে পড়ে আছে। পায়রার চোখ ভিজে উঠেছে আনন্দঅশ্রুতে।
ষোলো বছরের জীবনের প্রথম পুরুষটি হচ্ছে নীলাংশ। নারীর জীবনে বোধ হয় প্রথম পুরুষটি একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়। কারণ, তাঁকে ঘিরেই নতুন অনুভূতির সৃষ্টি হয়। কল্পনা অথবা বাস্তব জগৎ দুটো জায়গাতেই প্রথম পুরুষটির আধিপত্য হয় বিশাল বড় জায়গা নিয়ে। নিজেকে শত শত বাঁধা দিয়েও তাই পায়রা দমাতে পারেনি। নিজ থেকে দূরে সরেছে। কিন্তু অবাধ্য মনটা চিৎকার করে কেঁদে বারবার বায়না ধরেছে একটাবার স্বপ্ন পুরুষকে নিজের করে পাওয়ার। তাঁর হৃদয়ের কোণে ঠাই পাবার।
নীলাংশ মৃদু হেঁসে বললো –
‘পিচ্চিরাণী কী এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবেন? ‘
পায়রা তাঁর দিকে ভীষণ কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাকালো। নীলাংশ বিচলিত হয়ে পায়রার গাল হাতের আঁজলায় নিয়ে সযত্নে চোখে পানি মুছিয়ে দিলো। পায়রা তখন চোখ বন্ধ করে বললো –
‘আপনি এতো ভালো কেনো সুন্দর সাহেব? আমার জন্য এতকিছু করছেন এর বিনিময়ে কিছু দেয়ার সামর্থ্য যে আমার নেই!’
নীলাংশ পায়রার হাতটা মুঠোয় নিয়ে নিজের বুকে ঠেকালো। ভীষণ আবেগ মাখানো গলায় বললো-
‘কে বলেছে পিচ্চি! আমার পিচ্চির কাছে যা আছে তা পৃথিবীর কোনো রমনীর মাঝে আমার চক্ষু দর্শন করেনি। ‘
‘তা কী? ‘
‘হৃদয়স্পর্শ করা ভালোবাসা! যা আমি নিজের জন্য দেখতে পাই। যার প্রতিটি কথা আমার কানে মাদুলি তুলে। যাকে দেখতে না পেলে আমার দিনদুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে। যার দৃষ্টি আমার মনের গভীরে গিয়ে লাগে। ‘
পায়রা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। সে এতটা আশা করেনি। নীলাংশ পায়রার লজ্জা বুঝতে পেরে হাতটা ছেড়ে সামনে এগুলো। পায়রা সবকিছু পরখ করতে করতে পিছনে এসে দাঁড়ালো। নীলাংশ ছাঁদের কর্ণারে গিয়ে দাঁড়ালো,সে পায়রার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেঁসে বললো –
‘যেদিন আমি কক্সবাজার থেকে বাসে উঠি তখন আমার সামনে মোট তিনটে সিট ছিলো। হঠাৎ করেই চোখ পড়ে মুখ ঢেকে রাখা গৌরবর্ণের এক কিশোরীর উপর। প্রথমের দুটো সিট রেখে আমি অজান্তেই এগিয়ে যাই সেদিকে। তাকিয়ে দেখি কিশোরীটি ঘুমের দেশে তলিয়ে আছে। দুই বার ডাক দিতেই চোখ মুখ কুঁচকে যখন ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো তখন জীবনে প্রথম বার মনে হলো আমার হার্টবিট খুব দ্রুত চলছে, প্রচুর বাতাস থাকা সত্ত্বেও আমি বারবার ঘামছি,নিঃশ্বাস কীভাবে নিতে হয় আমি গুলিয়ে ফেলেছি। পুরো বাসে মেয়েটা কতবার হাত দিয়ে ওড়না ঠিক করলো, ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো, রাগে ফসফস করে কতবার চোখ পাকালো আমার মুখস্থ হয়ে গেলো। মেয়েটার ছোট ছোট কাজগুলোও অসাধারণ হয়ে উঠলো আমার কাছে। অত্যাধিক আদরে আগলে বড় হয়ে কখনো নিচুস্তরের মানুষের সঙ্গে মেশা হয়নি। বরাবরই মম বলতো, এদের থেকে যত দূরত্ব রেখে চলা যায় তত ভালো। সুযোগ হয়নি বললেও চলে। তেইশ বছরের জীবনে প্রথম অশুদ্ধ বাক্যগঠন আমার কানে পৌঁছাতেই চমৎকার শোনালো। বারংবার ইচ্ছে করলো এই আদুরে মেয়েটাকে আমার কাছেই বসিয়ে রাখি, ঘন্টার পর ঘন্টা শুনে যাই। মেয়েটা যখন বাস থেকে নেমে বিদায় নিচ্ছিলো অসংখ্য বার হৃদয় কেঁপে উঠেছে। মনে মনে প্রার্থনা করে গিয়েছি, এই মেয়েটার সঙ্গে জীবনে অন্ততপক্ষে একবার হলেও আমার দেখা হোক। বাসায় গেট খুলে মেয়েটাকে দেখতেই মনে হলো আমার বুকে স্বর্গসুখ নেমে এসেছে। এর থেকে খুশি আমি স্কুল কলেজে বড় বড় ট্রফি জিতেও পাইনি।
দিন যত যেতে লাগলো আমি বুঝতে পারলাম নিজের অস্তিত্বের কতখানি অংশ জুড়ে আছে মেয়েটা। নির্ঘুম অগণিত রাত আমি মেয়েটাকে ভেবেই পাড় করে দিয়েছি। পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের সকল মনোযোগ থাকে একমাত্র খাতা ও প্রশ্ন। আমিই বোধ হয় প্রথম পুরুষ যে কিনা, পরীক্ষার খাতায় শেষ দশ মিনিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়টায় রিভিশন দেয়ার বদলে প্রেয়সীর ছবি এঁকে চলে এসেছি। ‘
পায়রা স্তব্ধ হয়ে কথা শুনছে। এতদিন সে ভেবে এসেছে একমাত্র সে একাই তাঁর জন্য এত কিছু অনুভব করে। কিন্তু না! তাঁর ধারণা ভুল! সম্পূর্ণ ভুল।
পায়রা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। নীলাংশ ভুবন ভোলানো হাসি ফুটিয়ে বললো –
‘বলেছিলাম না পিচ্চি! ভালো রেজাল্ট করলে জীবনের সেরা উপহারটা দেবো! তোমাকে আমার প্রাণ দিলেও হয়তো ফিকে পড়ে যাবে। তোমার মতো নির্মল স্নিগ্ধ সেরা কিছু আমার কাছে নেই। আমার অজস্র অনুভূতির প্রকাশটা নিশ্চয়ই নিতান্ত সাধারণ।
তবুও আজকের দিনটাকে স্মরণীয় করতে চাই আমি।’
পায়রা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। নীলাংশ এতক্ষণ ধরে তাঁর যে হাতটা আঁকড়ে ধরে ছিলো সেটা নিজের দুই হাত দিয়ে অতি যত্নে ধরে বললো-
‘সাধারণ কীভাবে হয় সুন্দর সাহেব! এত আকাঙ্খিত দিনটির জন্য বহু অপেক্ষায় থেকেছি আমি। আজ মরণ হলেও দুঃখ থাকবে না আমার! ‘
নীলাংশ আচমকা পায়রাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। ধমকের গলায় বললো –
‘আজ বলেছো আর কখনো বলবে না। বার্ধক্য কাটাতে চাই আমি এই পিচ্চির সাথে। ‘
পায়রার মন সীমানাহীন তীব্র খুশিতে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। দুজনের জমানো কথা, রাগ , অভিমান চুপ করেই আদান প্রদান হয়ে গেলো।
পাটি বেছানো মেঝেতে বসে আছে পায়রা। চমৎকার একটা জোৎস্না রাত। চাঁদটুকুর দিকে তাকিয়ে পায়রা মুগ্ধ হয়ে আছে। সবটুকু আকর্ষণ সেদিকেই। নীলাংশ পাশেই অনেকখানি দূরত্ব রেখে বসেছে। বাড়ির সবাই নিদ্রারত, তাই যাওয়ার তেমন কোনো তাড়া নেই। নীলাংশ বারকয়েক গলা খাঁকারী দিলো, কিন্তু দুঃখজনক যে পায়রা তাঁর দিকে তাকালো না । নীলাংশের খুব হিংসে হলো চাঁদটাকে। কই তাঁর দিকে তো এমন অপলকভাবে তাকিয়ে থাকেনা পায়রা। তুড়ি বাজিয়ে পায়রার ধ্যান ভেঙে দিলো নীলাংশ। নীলাংশের এহেন কান্ডে পায়রা তাঁর দিকে তাকালো। নীলাংশের কাজটা বোধ হয় চাঁদের পছন্দ হয়নি। তাই রাগে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেলো। নীলাংশ পায়রার দিকে তাকিয়ে বললো-
‘আমার দিকেও তাকাতো পারো, আমি মাইন্ড করবো না। ‘
পায়রা হেঁসে ফেললো। নীলাংশের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপলো। সে দুষ্ট ভঙ্গিতে বললো –
‘তোমাকে একটা বই এনে দেই তাহলে। ‘
পায়রা অবাক হয়ে বললো-
‘বই কেনো? ‘
‘কারণ, পড়ানোর সময় তুমি পড়ার থেকে বেশি আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই কাটিয়ে দিতে পারো। ‘
পায়রা চুরি ধরা পড়ার মতো মুখ করে ফেললো। এটা সত্যিই যখন নীলাংশ তাঁকে পড়তে বসিয়ে টিচারের মতো গম্ভীর মুখে বসে থাকতো পায়রার অবচেতন মন শুধু সেদিকেই তাকিয়ে থাকতে চাইতো। এভাবে ধরা পড়বে ভাবেনি। আমতা আমতা করে বললো –
‘মোটেও তেমন কিছু নয়, একধ্যানে পড়তে পড়তে চোখ ধাঁধিয়ে যায় বলেই আশেপাশে তাকাই। আপনাকে দেখবো কেনো! তাকানোর হলে আমি সুন্দর কন্ঠের কারো দিকে তাকাবো। যেমন,স্বপ্নীল ভাইয়ার। ‘
শেষের কথাটা পায়রা মজা করেই বলেছিলো। যাতে আগের প্রসঙ্গটা নীলাংশ ভুলে যায়। কিন্তু হলো বিপরীত। পায়রা ভাবেনি নীলাংশ কথাটা শুনে রেগে যাবে। নীলাংশের কোমল হাসি মিলিয়ে গেলো। মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। রাগী কন্ঠে বললো-
‘স্বপ্নীল!ঐ পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটা তাইনা? আমার নাম ধরে তো কখনো ডাকোনা৷ তাহলে, এত বড় কারো নাম নিয়ে কেনো ডাকবে! সেদিনও তুমি ঘন্টার পর ঘন্টা ঐ ছেলেটার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছিলে। ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম আমি। খবরদার পিচ্চি! কখনো ওর ব্যাপারে কোনো প্রশংসা আমার সামনে বলবে না। ‘
পুরো কথাটা নীলাংশ এক নিঃশ্বাসে বলে উঠে দাঁড়িয়ে সাইডে চলে গেলো। পায়রা আজ এতদিন পরে সে জানতে পারলো নীলাংশ কেনো সেদিন এতো ভাঙচুর রাগারাগি করছিলো। নাহ! তাঁরই ভুল। মজা করতে গিয়ে অন্য কারো নাম নেয়াটা ঠিক হয়নি। সে মৃদু পায়ে এগিয়ে গেলো নীলাংশের দিকে। নীলাংশ মুখ কালো করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। পায়রা নীলাংশের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে বললো-
‘সরি! আর বলবো না তো। ‘
নীলাংশের সাড়া শব্দ না পেয়ে নিজের মতো করে বললো –
‘এইযে! ‘
‘শুনুন না! ‘
‘সরি তো! ‘
‘আর হবেনা! ‘
‘ভুলেও না! কক্ষনো না। ‘
‘করলে বকে দিয়েন! ‘
‘আচ্ছা আমার দোষ! ‘
‘কথা বলবেন না? ‘
গলা ভেঙে কান্না আসতে চাইলো পায়রার। অভিমান করে চলে যেতে নিলেই পেছনে থেকে নীলাংশের টান তাঁকে যেতে দিলো না। নীলাংশ পায়রাকে টেনে সামনে দাঁড় করিয়ে ঝুঁকে চোখে চোখ রেখে মোহনীয়তার সঙ্গে বললো-
‘ছাড়তে তো সবাই পারে,
তুমি শুধু ধরে রাখো!
প্রেমে তো সবাই পড়ে,
তুমি আমার অস্তিত্বে মিশে যেও!
কথা তো মুখও বলে,
তুমি শুধু আমায় অনুভবে মেখো। ‘
চলবে-
(যে পাঠকরা কাল সাড়া দিয়েছেন তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করি তারা শেষ পর্যন্ত পাশে থাকবেন।সবার এত রিসপন্স করেছেন, সে হিসেবে আজ বড় করে দিলাম। গল্পের মাঝে কোনো ভুল-ত্রুটি হলে ধরিয়ে দেবেন। আলোচনা সমালোচনা দুটোই করতে পারেন। )