“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৫০
চারদিকে বিভিন্ন জাতির মানুষের সমাগম। জাকজমক আয়োজন হয়েছে। রয়েলস ফ্যামিলিদেরই একমাত্র এমন ভাবে অনুষ্ঠান করা হয়। নাহলে, সাধারণত সেখানের মানুষ খুবই সাদাসিধা ভাবে বিয়ে সহ যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করেন। বিশাল করে এক সাইডে খাওয়া দাওয়ার জায়গা রাখা হয়েছে। আভাস একজন পাশে দাঁড়িয়ে জোনাসের সঙ্গে কথা বলছে। পায়রা বসে মিক্সড সালাদ খাচ্ছে। খেয়ে মনে মনে ভাবলো, খাবারের মান বেশ ভালো। আভাস কথা শেষ করে পায়রার পাশে বসলো। বিশেষ এক ধরনের চা, কাপটা নিয়ে অল্প খানিকটা মুখে নিয়ে পান করে বললো-
‘মি. এন্ড মিসেস এলেক্সেকে শুভেচ্ছা জানাবে না? ‘
পায়রা কপালের সামনের চুলগুলো এক হাতে সরিয়ে বললো-
‘না গেলে হয় না?’
আভাস হেঁসে বললো –
‘আর কত লুকোচুরি করবে? ‘
পায়রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-
‘লুকোচুরি! নাহ, শুধু এত মানুষ ভালো লাগছে না। ‘
‘সবসময় তো না। আমাদের বিজনেস পার্টনারও তারা।
না গেলে খারাপ দেখায়। ‘
‘আচ্ছা, চলুন। ‘
পায়রা আভাসের পিছনে আসলো। মুখে কালো মাস্ক।
সদ্য বিবাহিত দম্পতি হাসিঠাট্টায় মেতে ছিলেন। চমৎকার ধাঁচের মানুষ। মিস্টার আডাম এল্যাক্স অনেক বছর আগে থেকেই আভাসের সঙ্গে বিজনেসে পার্টনার করছেন। আর তার বউ ফ্রিনা এল্যাক্স গত তিন বছর থেকে যুক্ত হয়েছেন। আডাম, ফ্রিনা দুজনের সম্পর্কটা বন্ধুত্ব থেকেই শুরু। আভাসকে এগিয়ে আসতে দেখে আডাম আর ফ্রিনা উৎফুল্ল হলেন। আভাস মুচকি হেঁসে জার্মান ভাষায় বললো –
‘ভিল গ্লাক ফার দাল নিউই লেবেন। ‘
(নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা। ‘
‘ভিলিন দাঙ্ক। ‘
(ধন্যবাদ।)
আভাসের পেছনে পায়রাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন –
‘মিসেস বোস, ভালো আছেন?’
পায়রা খুবই স্বল্প হাসলো। যতটুকু না হাসলে খারাপ দেখায় ততটুকু। গম্ভীর গলায় বললো –
‘জ্বী। আপনাদের দুজনকে মানিয়েছে। ‘
ফ্রিনা লজ্জামিশ্রিত হাসলো। আডামের সঙ্গে আরও দুই একটা কথা বলে পায়রা পেছনে ঘুরে যেতে নিলেই এক ওয়েটারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে জুস জামায় লেগে যায়। বিরক্ত বোধ করে সে। ওয়েটার মাথা নিচু করে ক্ষমা চায় কাজের জন্য। পায়রা বিনাবাক্য ব্যায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নেয়। পানির ছটায় আংশিক ভিজে উঠেছে। দুই হাতে ভেজা জামা ঝাড়তে ঝাড়তে বের হতেই দেখলো, দুজন ছেলের লোলুপ দৃষ্টি তার গায়ে লেপ্টে যাওয়া কাপড়ের দিকে। পায়রা দাঁত খিটমিট করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়। কিন্তু দুজনের মধ্যে একজন
পায়রার হাতটা টেনে ধরে। অচিরেই মাথা গরম হয়ে যায় তার। পেছনে ঘুরেই ডান হাতের একটা কড়া ঘুষি পড়ে ছেলেটির নাকে ৷ গলগল করে লালাভ রক্তপাত শুরু হয়। পায়রা ছেলেটার পেছনের চুলগুলো মুঠিতে নিয়ে পাশের দেয়ালে পরপর চারটে বাড়ি লাগায়। মাথা ঘুরিয়ে পায়ের কাছেই পড়ে যায় ছেলেটা। পায়রার মুখে রসাত্মক হাসি। পায়ের চিকন হিলটা ছেলেটার হাতের উপর রেখে জোরে চেপে ধরে বিড়বিড় করে বললো –
‘তোদের মতো রাস্কেলের জায়গা এই মাটিতেই। ‘
আশেপাশের মানুষেরা হালকা ভীড় জমিয়েছে। দুজনের মধ্যে আরেক জন ছেলেটি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। পায়রার মাস্ক খুলে যাওয়ায় অকপটে বললো-
‘এই দাগযুক্ত মুখটা নিয়েও এতো দেমাগ! ‘
পায়রা শক্ত চোখে তাকায়। আবার সেই পুরনো অতীত মনে পড়ে যায়। কিন্তু, সে তো আর আগের পায়রা নেই। যে চুপচাপ চলে যাবে। নিচে পড়ে থাকা ছেলেটাকে পাশ কাটিয়ে ঐ ছেলেটার কাছে এসে চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরে। এমনিতেই পায়রা প্রচুর লম্বা। হিল পড়াতে যেকোনো লম্বা পুরুষের সমান হয়ে যায়। ছেলেটা পায়রার থেকে এক ইঞ্চি খাটো। গালটা চেপে ধরতে পায়রার বেগ পেতে হয়নি একদমই। নিজের মুখটার দিকে আঙুল উঁচু করে বললো-
‘এই দাগযুক্ত মুখের মেয়েটাই, তোদের মতো দশটা মাটিতে পুঁতে দেয়ার ক্ষমতা রাখে! ‘
ধাক্কা দিতেই ছেলেটা ভয়ে দৌড়ে পালায়। নিচে পড়ে থাকা ছেলেটাও খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে যায়। পায়রা রাগে ফসফস করে বাহিরে চলে যায়। আভাস চুপচাপ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো। সে জানতো, তার এগিয়ে আসার কোনো প্রয়োজন নেই। পায়রা এখন সক্ষম নিজের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। আভাসের চিন্তা একটাই, কোন দিন মেয়েটা রাগের বশে নিজের ক্ষতি করে দেয়। গত সাত বছরে মেয়েটার রাগ আকাশ ছুঁই ছুঁই। পায়রা গাড়ির জানালায় হেলান দিয়ে বসে আছে। মনে পড়ছে সাত বছর আগের দিনটা। যেদিন পায়রা তার নতুন জীবনে পদার্পণ করে।
.
.
.
‘ম্যাডাম, স্যার আজকেও ড্রিংক করে রাস্তায় এক্সিডেন্ট করে ফেলেছে। ‘
আঁতকে উঠলো রুশানী। বিছানায় শায়িত হয়ে আছেন তানজিমা সোহরাব। বয়সের নয়, পরিস্থিতির ভারে নুইয়ে পড়েছেন। মৃত্যুর অপেক্ষায় এখন দিনরাত্রি যাপন করেন। ড্রাইভারের কথা শুনে হুহু করে কেঁদে উঠলেন। রুশানী অসহায় দৃষ্টিতে একবার সেদিকে তাকিয়ে ড্রাইভারের সাথে নিচে নামলো। দারোয়ানের কাঁধে ভর দিয়ে ঢুলতে ঢুলতে এগিয়ে আসছে নীলাংশ। সম্পূর্ণ মাতাল। রুশানী এগিয়ে আসলো। নীলাংশের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভারকে বললো-
‘রুমে নিয়ে চলো ওকে। ‘
ড্রাইভার ও দারোয়ান মিলে নীলাংশকে ঘরে নিয়ে আসে। নীলাংশ ঘরে ঢুকে নিচে বসে পড়ে। দারোয়ান উঠাতে গেলে শক্ত চোখে বলে-
‘গেট আউট! ‘
রুশানী দুজনকে বেরিয়ে যেতে বলে। পাশে এসে বসে। একবার রুমের চারদিকে চোখ বুলায়। চেনায় যায়না, এককালে ছেলেটা এতো পরিপাটি হাস্যজ্জ্বল ছিলো।
ঘরের প্রতিটি দেয়ালে অসংখ্য তৈলচিত্র। সেখানের প্রতিটি রঙও যেনো জীবন্ত। নীলাংশের হাতেও একটা তৈলচিত্রের ফ্রেম। যেখানে একটা মেয়ে বাসের জানালায় মুখ করে ঘুমিয়ে আছে। আর তার পাশে হাস্যজ্জ্বল যুবক নিগুঢ় চাহনিতে তাকিয়ে আছে। নীলাংশ মাতালের মতো কী যেনো বিরবির করছে।
রুশানী নীলাংশের কাঁধে হাত রাখতেই সে ছিটকে হাত সরিয়ে দিলো। বাচ্চাদের মতো মুখ উঁচু করে বললো-
‘দূরে বসো দূরে বসো! ও রাগ করবে। ‘
রুশানী প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে বলে –
‘কে? ‘
নীলাংশ নিজের হাতে থাকা ছবিটি তুলে ধরে। ঘুমন্ত মেয়েটির ছবি দেখিয়ে নিষ্পাপ হেঁসে বলে-
‘এইযে আমার ও! ‘
রুশানীর চোখ অশ্রুতে টুইটুম্বর হয়ে ওঠে। সাতটা বছর ধরে এসব দেখে আসছে সে। ছেলেটাকে এভাবে আর দেখতে পারে না। আনমনেই বলে-
‘নীল দা! আর কত অপেক্ষা করবে? ‘
নীলাংশ মাতাল হয়েও যেনো মাতাল নয়। ছবিটি নিজের বুকে চেপে বলে-
‘আমার জীবনটাই তো এখন অপেক্ষার রে! ‘
রুশানী হতাশ গলায় বলে –
‘এমনও তো হতে পারে, পায়রা এখন অন্য কাউকে ভালোবাসে, বিয়েও হয়ে গেছে!’
নীলাংশ হাসে। ফ্লোরে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। ভেঙে ভেঙে বলে-
‘পারবে নারে! ‘
রুশানী মাঝে মধ্যে অবাক হয়। এত ভালোবাসা কখনো সম্ভব! তারও বিয়ের সাত বছর হলো। সাহিরকে সে ভালোবাসে বিয়ের আগে থেকেই । কিন্তু এতোটা হয়তো না!
নীলাংশের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘এতোটা বিশ্বাস ! এমন কে হয় সে! ‘
নীলাংশের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। চোখ বন্ধ করতেই গড়গড় করে চোখের জলে মুখ ভিজে ওঠে।
চোখ বন্ধ রেখেই সে মাদকীয় কন্ঠে বলে-
সে আমার পাওয়া না পওয়ার,
এক অদ্ভুত সমীকরণ।
তাঁকে না পেলে আমার মৃত্যু আমরণ।
তার অপেক্ষায় কাটে অগণিত শ্রাবণ।
সে কী জানে?
সে আমার বৃষ্টিস্নাত ভোরের এক বিষন্ন শহর!
চলবে-