স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৫২

0
1019

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৫২

আভাস ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। পায়রার বিনয়ী দৃষ্টি। মুখে কৃত্রিম হাসি। সাত বছর ধরে এই কৃত্রিমতাই তাঁকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। এত এত পরিবর্তনের মধ্যে অকৃত্রিম হাসি, অকৃত্রিম পায়রা হারিয়ে গেছে। মিলিয়ে গেছে অন্ধকারের অতল গহ্বরে। আভাস দোলনায় বসে। পায়রার দৃষ্টি বরাবর চাঁদের দিকে তাকায়। মৃদু কন্ঠে বলে-

‘জিজ্ঞেস করলে না!এই সময় কেনো আসলাম?’

পায়রা নির্লিপ্ততায় বলে-

‘জিজ্ঞেস করার মতো কিছু হয়নি। আপনি এই সময় আজ প্রথম আসলেন না। ‘

আভাস হাসে। পায়রা সেদিকে তাকায়। অদ্ভুত লাগে তার। আভাস হাসলেই পায়রার স্মৃতির পাতাগুলো উল্টাতে শুরু করে। সাদা কালো আবছা কিছু একটা মাথায় বাড়ি খায়। রহস্যভেদ করতে অক্ষম হয়। খুব চেনা চেনা লাগে। মনে হয়, যেনো সাত বছর নয় বরংচ বহুপূর্ব থেকে তাদের পরিচয়। আঁটকে থাকা কিছু দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে। আভাস বিরসপূর্ণ গলায় বলল-

‘পায়রা! ‘

পায়রা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-

‘আপনি প্রায়শই কিছু বলতে চান, তাহলে আবার থেমে থাকেন কেনো?’

‘তোমার মনে প্রশ্ন জাগে না? আমি তোমাকে কেনো সাহায্য করেছিলাম?’

পায়রা গভীর শ্বাস ফেলে বললো-

‘জাগে না তা নয়। আপনি চাইলে বলতে পারেন৷ ‘

আভাস দোলনার উপরি হাতলে মাথা রাখে। তাদের দুজনের মধ্যে অনেক খানি দূরত্ব। আভাস আকাশের দিকে নিগুঢ় চাহনিতে তাকিয়ে থাকে। কী যেনো খুঁজে বেরায়। দৃষ্টি সম্পূর্ণ এলোমেলো। বিষাদ মিলিয়ে বলে-

‘বলবো একদিন। খুব দরকার তোমার জানা। ‘

পায়রা খোঁজার চেষ্টা করে। এই সাতটি বছর একসাথে থেকেও কেনো জানি, মানুষটা আজও রহস্য মনে হয়। যে রহস্য ভেদ সম্ভব না। পায়রা উঠে দাঁড়িয়ে ক্যাকটাস গাছটির দিকে তাকায়। এই সবুজ কাটা কাঁটা গাছটির দিকে তাকিয়ে পায়রার মন অস্পৃশ্য কিছুতে হারায়। ফুলগাছ এখন আর ভালো লাগে না তার। ক্যাকটাসের দিকে তাকালে পায়রার মনে হয় এটা তারই প্রতিবিম্ব। আয়নাতেও নিজেকে এতোটা পরিষ্কার দেখতে পায়না। ঠিক তার মতোই কাটায় পরিপূর্ণ। পার্থক্য এতটুকুই, এই কাঁটাগুলো দৃশ্যমান। আর তার উপরের কাটাগুলো অদৃশ্য। কী অদ্ভুত! কাঁটার সংখ্যা গুলো ক্রমশ বাড়ছে। অথচ, নিদারুণ যন্ত্রণা নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। সাত বছর আগে আভাস একটা কথা বলেছিলো, ‘কেউ কাউকে ছাড়া মারা যায় না। ‘ হ্যা কথাটা একদমই সত্য। দেহ অবিরাম চলতে থাকে। হৃদপিণ্ডও নিজের মতো বিট করে। কোনোকিছুই বদলায়না। শুধু, অন্তরআত্মার বেঁচে থাকার ইচ্ছে মরে যায়।
পায়রা টের পেলো আভাস তাঁর পিছনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর শ্বাস প্রশ্বাস গুণতে পারছে সে। আভাস খুবই ম্লান কন্ঠে বলল-

‘তুমি ভালো আছো পায়রা?’

পায়রা চোখের কোণে জলের অস্তিত্ব অনুভব করে। এদিক ওদিক তাকিয়ে তা লুকিয়ে নেয় অক্ষিকোটরে।
অন্ধকারের ভিতরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অস্পষ্টতা ব্যাক্ত করে বলে-

‘আছি। খুব ভালো আছি ৷ ‘

.
.
.

‘আপনি আবার আমার সামনে এসেছেন?’

‘না খেয়ে ঘরে যাসনা নীল! ‘

‘দিলেন তো আমার মেজাজটা খারাপ করে ! ধ্যাৎ! ‘

বিরক্ত মুখে আক্রোশ নিয়ে টেবিল থেকে উঠে পড়ে নীলাংশ। চোখ মুখ শক্ত। তানজিমা অশ্রু ভেজা চোখে তাকিয়ে থাকে। ভুলগুলো ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারছেন প্রতিনিয়ত। অথচ, অসহায় হয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই। নিজের হাতে নীলাংশের পছন্দের কাজুবাদামের সেমাই করেছিলেন। নীলাংশের বারণ করা সত্ত্বেও বানিয়ে নীলাংশের সামনে এনে রাখলো। ফলস্বরূপ যা হওয়ার তাই হলো। সাত বছর ধরে এই নিয়মেই বাড়ি চলছে। রূপসা তানজিমার দিকে তাকিয়ে বললেন-

‘তুমি ঘরে যাও আপা। কালকে তো অসুস্থ ছিলে। ‘

তানজিমা কান্না মাখা চোখে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে যান। রূপসা নীলাংশের দিকে তাকিয়ে অনুরোধ স্বরে বললেন-

‘এমন করিসনা নীল। তোর মা হয়। ‘

নীলাংশ চিৎকার করে বলল;

‘তাকে বলবেন আমার থেকে দূরে থাকতে। নাহলে, আমি এ বাড়ি ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে যাবো। ‘

‘আচ্ছা আচ্ছা! যা ঘরে যা রাত হয়েছে। ‘

নীলাংশ দ্রুত পা চালিয়ে ঘরে চলে যায়। রাগে অস্থিমজ্জা জ্বলে ওঠে। শাওয়ার চালিয়ে বাথরুমে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁতে দাঁত চেপে বের হয়। মেইড ঘরের দরজায় নক করে বলে-

‘স্যার আপনার কফি। ‘

নীলাংশ জলন্ত চোখে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলে-

‘আমি কী বলেছি আমার কফি লাগবে? ‘

মেইড কাঁপতে কাঁপতে বলল-

‘ন না.. কিন্তু ‘

‘কিন্তু কী! জাস্ট গো টু হেল। ‘

দরজা সর্বশক্তি দিয়ে বন্ধ করে দেয়। হাতের কাছে ফুলদানি পেয়ে সেটাই ড্রেসিং টেবিলের দিকে ছুঁড়ে মারে। আয়না চুর্ণ বিচূর্ণ হয়ে পড়ে। ড্রয়ার থেকে একটা স্লিপিং পিল বের করে শুকনো মুখেই গিলে নেয়। পানি নেয়ার সামান্য প্রয়োজন বোধ টুকু হয়না। অন্ধকার জেলখানার মতো ঘরে নিজেকে আঁটকে আসামির মতো বসে থাকে। নিজের চুল টানতে টানতে বিরবির করে উল্টো পাল্টা কিছু বলতে থাকে। যার প্রতিটিই অর্থসারশূন্য। ঘুম না আসায় আরও পাগলের মতো আচরণ করতে শুরু করে। হাতে নিজেই কামড়ে রাগ নিবারণের চেষ্টা করে। খাটের পাশেই তৈলচিত্রের ফ্রেমটি বুকে চেপে টলমল চোখে হাঁপিয়ে ওঠে। বিছানায় জোড় করে মাথা গুঁজে রাখে। ঘুম না আসা যে কী যন্ত্রনার! নীলাংশের মনে পড়ে, একবার স্লিপিং পিল খেতে খেতে বারোটা পার হয়ে গেছিলো। চোখে ঘুম আসেনা বলে পুরো কৌটাটাই মুখে উপুড় করে ট্যাবলেট গিলে নেয়। সেদিন সারারাত ওভাবেই পড়েছিলো। ঘরে গুটিকয়েক মানুষ বাদে আসা নিষেধ করে দিয়েছে সে। সকালে একজন মেইড ঘর পরিষ্কার করতে এসে দেখে মুখ দিয়ে ফ্যানা বের হচ্ছে। সেদিন হাসপাতালে না নিলে আর বাঁচা হতো না। নীলাংশ পাগলের মতো হাসে, আবার কাঁদে। যদিও উদ্দেশ্য আত্মহত্যা ছিলো না। তবুও মনে আক্রোশ জাগে, সেদিন ভুলক্রমে মারা গেলে এমন কী হয়ে যেতো! এত কষ্ট, যন্ত্রনা থেকে কী সহজেই মুক্তি পেয়ে যেতো! নিদ্রাবিহীন, সুখ-শান্তি হীন জীবনটা এক প্রকার শাস্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৃত্যুর জন্য হাহাকার করে মন রাতবিরেতে। একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলো নীলাংশ। রাস্তায় হঠাৎ-ই একটা মানুষকে গাড়িতে ধাক্কা খেয়ে এক্সিডেন্ট হতে দেখলো। সব মানুষ জড়ো হয়ে ব্যাক্তিটিকে উঠাচ্ছিলো। একমাত্র সেই হাসিমুখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো। তাঁর ইদানীং কাউকে মারা যেতে দেখলে মনে হিংসা জাগে। কত সুন্দর না চাইতেই মুক্তি পেয়ে গেলো! আত্মচিৎকার করতে ইচ্ছে করে, এত চাওয়ার পর সে কেনো মুক্তি পাচ্ছে না! ইশশ! পাশের লোকগুলো তাঁকে হাসতে দেখে পাগল বলে বলাবলি করছিলো৷ নীলাংশ আনমনে ভাবে, সে কী সত্যিই পাগল হয়ে গেছে! মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে! হাতের ছবিটির দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি চোখে বলে-

‘তোমার সুন্দর সাহেব পাগল হয়ে গেছে পিচ্চি। সবাই বুঝলো। শুধু তুমি বুঝলে না! ‘

দেখো আমার নিদ্রাহীন জীবন কত বিষাক্ত!
চারপাশ এখন তোমায়বিহীন তিক্ত!
অপেক্ষায় কেটে গেলো বিবর্ণ বসন্ত।
তবুও একবার দেখে যেও, আমি শুধু তোমাতেই মত্ত।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here