স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৫৩

0
976

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৫৩

জুরাইখের সুন্দর আঁকাবাকা রাস্তা দিয়ে ফুল স্পিডে গাড়ি চলছে। ড্রাইভিং সিটে বসে আছে পায়রা। চোখে বাদামী সানগ্লাস, গায়ে লেডিস কোর্ট প্যান্ট। উদ্দেশ্য অফিস। পায়রার অবশ্য খুব একটা কাজ থাকেনা ওখানে। বেশিরভাগ সময় আভাসই সব কাজ সামলায়। পায়রা নিজের ইচ্ছেমতোই একটা বিজ্ঞান সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। পড়াশোনা পুরোপুরি শেষ হওয়ার পর সেটাকেই ভবিষ্যতে কর্ম হিসেবে বেছে নিতে চায়।
আরেকটা বড় স্বপ্ন আছে পায়রার। সবগুলোই তো পূরণ হচ্ছে। সেটা আর বাদ রাখতে চায়না। একটা এনজিও খোলার চিন্তা ভাবনা করছে। আভাসের সঙ্গে এ নিয়ে একবার কথা হয়েছে। আভাস তার সিদ্ধান্তে কখনোই হস্তক্ষেপ করেনা। আভাসের কাছে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে, সে একটা কথাই বলে –
‘এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিবেনা, যা নেয়ার দশ বছর পর হীনমন্যতা জাগে। বরং সিদ্ধান্ত যেনো এমন হয় তা নিয়ে আজীবন গর্ব করতে পারো। ‘ সে কথা স্মরণে রেখেই পায়রা আজ এতদূর। প্রতিটি সিদ্ধান্তই সে বিচার বিশ্লেষণ করে নেয়। আবেগকে এখন আর সেই কৈশোর কালের মতো প্রশ্রয় দেয়না। পথ অতিক্রম করে পৌঁছে গেলো পায়রা অফিসে। জরুরি একটা মিটিং আছে আজকে। ডিল হয়ে গেলে অফিসের অনেক বড় একটা লাভ হবে। আর লাভ যদি আরেকটু বেশি হয় তাহলে এনজিও খুলতে অনেকটাই সাহায্য হবে। টাইমটেবল মেইনটেইনে বর্তমানের পায়রা খুবইী পটু। ঠিক যেই সময় সে বলবে, সেই সময়েই পৌঁছাবে।

অফিসে পৌঁছে গাড়ি থামাতেই গার্ডরা গেট খুলে দিলো। পায়রা ভেতরে প্রবেশ করলো। হিলের গটগট শব্দ হতেই অফিস কর্মীরা সতর্ক হলো। তবে ভয় কিংবা সংকোচ করলো না। বিনয়ী হেসে গুড মর্নিং জানালো। পায়রা অফিসের পঞ্চাশ পার্সেন্ট মালিক হলেও সবার সাথে বন্ধুত্বমূলক আচরণ করে। অফিসের কর্মীরা বেশিরভাগই তার বয়সী, অথবা দুই এক বছরের ছোট। পায়রা হাসিমুখে ভেতরের দিকে গেলো। আভাস দুই একজন ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলছিলো। পায়রা ইশারায় পাশের দুই জনকে হেলো বলে আভাসের পাশে বসলো। আরেক জন বাকি ছিলো সে আসতেই সব কাগজ পত্র, প্রজেক্টর দিয়ে মিটিং শুরু হলো। প্রেজেন্টেশন করার দায়িত্বে পায়রা চমৎকার। গলার স্বর, কথার ভঙ্গিমা, মাঝে মাঝে মৃদু হাসি সব মিলিয়ে পার্ফেকশন। কম্পানির কাজের পারদর্শীতা দেখে বিপরীত কম্পানির মালিক রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল আরেক জায়গায়। পুরো কাজটিতে মোট তিনটি কম্পানি কাজ করবে। একটা আভাস ও পায়রার ( গোল্ডেন স্টার ), মিস্টার আডাম এল্যাক্সের (রয়েলস প্যাশন), আর তৃতীয় কোম্পানীটির সঙ্গে প্রথম বার কাজ করা হবে। এর মালিক বর্তমানে বাংলাদেশে আছেন। বেশ ভালো নামডাক আছে, (এন.এস ওয়ার্ল্ড) ।

এই বিষয়ে পায়রা কী বলবে বুঝতে পারছেনা। অতীতের পাতাগুলো আবারও চোখে ভাসছে। টলমল চোখে তাকিয়ে আভাসকে বোঝালে, সে যেতে চায়না। আভাস সামনের দিকে তাকিয়ে সবাইকে হ্যা বলে দিলো। সবাই যাওয়ার পর, পায়রা ক্রোধান্বিত গলায় বললো –

‘স্যার! ‘

আভাস বার্গারের প্যাকেটটা খুলে কামড় বসিয়ে বললো-

‘কী?’

এমন নির্লিপ্ততায় বিরক্ত হলো পায়রা। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বললো-

‘ আমি যাবো না বাংলাদেশ। ‘

‘ তুমি যাবে। ‘

‘আপনি কী জানেন না, আমার অতীত কতটা বিভৎস!’

আভাস দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-

‘জানো পায়রা, আমরা যতই দেশ ছেড়ে ভিনদেশে বাস করে আলাদা হতে চাই। জন্মভূমি ঠিকই এক না একদিন টেনে নিয়েই যায়। গাছ যত বড়ই হোক, ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আসমানে গেলেও, ভেঙে গেলে মাটিতে এসেই পড়তে হয়। মাটিই হয় তার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। শেকড়ের টান বলেও তো কিছু আছে। ‘

পায়রা চুপচাপ বসে ভাবনায় মগ্ন। এত বছরে সেখানের কতটা পরিবর্তন হয়েছে সে জানেনা। কতরকম মানুষের সাথে মুখোমুখি হতে হবে! সে ভয়েই গুটিয়ে ছিলো। নিজেকে প্রাণপণে আঁটকে রেখেছিলো। এবার কীভাবে সেসব মানুষের সম্মুখীন হবে। সবচেয়ে বেশি ভয় সেই মানুষটার জন্য। এতদিনে নিশ্চয়ই তাঁর কথা ভুলেই গেছে! পায়রার মন শত শত প্রশ্ন কৌতূহল ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে অনবরত। আভাস এগিয়ে আসে পায়রার মাথায় হাত রেখে বলে-

‘তোমার যাওয়া উচিত পায়রা। দেখাবেনা? সেসব মানুষকে? যারা তোমাকে পদে পদে আঘাত করেছে!
তোমাকে ভেঙে দিতে চেয়েছে! তুমি তো নিজের চেহারা এজন্যই বদলাতে চাওনি, যেনো সেসব মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারো, চেহারা কখনো কারো ভেতরের আয়না হতে পারে না। জানি কষ্ট হবে। কিন্তু যে সাফল্যের জন্য এতগুলো বছর সাধনা করলে, তার মূল্য কোথায় থাকবে এত পালিয়ে বেড়ালে! ‘

পায়রা আনমনে হাসলো। আভাসের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো-

‘আমি যাবো। ‘

উঠে দাঁড়িয়ে বের হলো। সমীকরণ গুলো সমাধান করার সময় বুঝি হয়ে গেছে। যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে সে এতদূর! তা-ই তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পায়রা নিজের কেবিনে মাথা এলিয়ে আকাশের দূরপাল্লায় তাকিয়ে থাকে। মাতৃভূমির টান বুঝি একেই বলে! কী নেই জুরাইখে! আরাম আয়েশের জীবন। এক টুকরো ময়লা নেই রাস্তায়। যেদিকেই তাকায় সেদিকেই পরিষ্কার ঝকঝকে। তারপরও মন আকূল হয়ে থাকে নিজের জন্মভূমির ঘ্রাণ আস্বাদন করতে। নিজের মায়ের মাটি একটু ছুঁয়ে দেখতে। ক্লাস নাইনে পায়রা একটা কবিতা পড়েছিলো। মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটি কবিতা। তেমন কিছু বোঝনি৷ অদ্ভুত লেগেছিলো বটে। ফ্রান্সের মতো উন্নত দেশে গিয়েও বাংলাদেশকে ভুলতে পারেনি! চোখ বন্ধ করে সেই লাইনগুলো মনে করলো সে। পুরনো অনুভূতিতে আপ্লূত হয়ে উঠলো।
চোখ খুলতেই কিছু ভাবনা হানা দিলো। চোখের কার্ণিশ ভিজে উঠলো।

তবে কী এবার দুই প্রান্তের মানুষ দুটোর সাক্ষাৎ ঘটবে?আসবে কী নতুন কোনো প্রলয়ঙ্কারী ঝড়? নাকি এই সূচনা হবে নতুন কিছুর!

চলবে-

(ছোট ছোট করবেন না প্লিজ৷ যেটুকু একটা পর্বে প্রয়োজন ততটুকুই দেয়া হয়। যখন প্রয়োজন হবে, আমিই বড় করবো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here