“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৬৪
নীল আকাশের উজ্জীবিত বুকে লালাভ সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামবে ক্ষণকাল বাদে। অপূর্ব সুন্দর মনোরোম দৃশ্য। পাখিরা নিজ নিজ নীড়ে ফেরার পথে।
কলকল ধ্বনি বাজিয়ে তা-ই জানান দিচ্ছে। পাখিদের একটা আপন ঘর থাকে। খসখসে খড়কুটো দিয়ে তৈরি হলেও তা বহু আরামের, বহু প্রশান্তির। ঘরের সঙ্গী অথবা সঙ্গিনীর জন্য এতো চমৎকার। সারাদিনের উপচে পড়া ক্লান্তি সেই সঙ্গীর দেখাতেই বিলীন হয়। আরামকেদারায় হেলান দিয়ে হতাশার শ্বাস নিয়ে পায়রা আকাশের রহস্য উন্মোচন করতে ব্যস্ত। আর কী বা করার আছে!
‘সংসার’ নামের একটা সুতো পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ভেতর বেঁচে থাকার স্পৃহা জোগায়। হয়ত ঝগড়া বিবাদ, কখনো অভিমান, তো আবার ফিরে আসা। কখনো স্বপ্নের জাল বোনা। যার সংসার টান নেই তাঁর বেঁচে থাকার আকাঙ্খা অতি স্বল্প। পায়রারও তাই। পায়রা ভাবে,পায়রা নামের পাখিরাও এতো নিঃসঙ্গ নয়। যতটা মানুষ হয়ে সে একা। অন্তত কোনো অসহায় পাখিকে তাঁর মা বাবা একা ছেড়ে দেয় না। শক্তি সামর্থ্যবান হওয়ার আগ পর্যন্ত তো নিজের মুখ থেকে খাবারটুকু সন্তানের মুখে তুলে দেয়। অথচ, মানুষ হয়ে জন্মানোর পরও কী নিষ্ঠুরতার সাথেই তাঁকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছিলো!
অতীত কখনো ভোলেনা মানুষ। আর তা যদি বিষাক্ত। তাহলে তো আরও না। পায়রাও ভোলেনি৷ একটাবার দেখতে চায় সে। তাঁর নামমাত্র মা বাবা কেমন আছে।
তাঁকে বের করে কী খুব সুখেই আছে! কী হতো! যদি শক্ত করে তাঁর হাতটা ধরে রাখতো। আশ্বাস দিয়ে বলতো- ‘আমরা তোর সাথে আছি। ‘ বলেনি তারা। গ্রামে নিজেদের সম্মানই বড় ছিলো।
আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায় পায়রা। বাংলাদেশে এসেছে আজ এক মাস দুই দিন। হাহ! সময় কীভাবে পাড় হয়ে যায়। পায়রা একবার ভাবে আভাসের রুমে গিয়ে দেখা করে আসবে। ঘুমাচ্ছে নাকি আবার! বিকেলে অনেক সময় ঘুমিয়ে থাকে আভাস। যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলে এসে পড়বে সে। গায়ে লং কোটিটা জড়িয়ে নিয়ে বের হলো। বলতে গেলে পাশাপাশিই দুটো রুম। এ মাথায় একটা, আরেকটা ঐ মাথায়। বেশ ভালো ভালো একটা হোটেল। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সব সার্ভিসই উন্নত। কিন্তুু টাকার অঙ্কটাও মোটা। এতগুলো দিন থাকতে টাকা তো লাগবেই। অবশ্য টাকার কমতি নেই পায়রা বা আভাস কারোই। পায়রা যেমন একা, তেমন আভাসও একা। বছর চারেক আগেই আভাসের দাদিমা ও বাবার মৃত্যু হয়েছে। কোনো ভাই বোনও নেই। তাই সকল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী একমাত্র আভাস। সঙ্গে বিজনেসেও লাভ হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। টাকা যে মানুষকে শান্তি বয়ে এনে দিতে পারেনা তারই জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ দু’জন।
দরজা চাপিয়ে রাখা ছিলো। তাই বেখেয়ালীতেই হাত লেগে দরজা খুলে গেলো হাত লেগে। আচমকা খুলে যাওয়ায় আভাস অপ্রস্তুত হয়ে হাত পেছনে রেখে কিছু একটা লুকিয়ে রাখলো। পায়রা চমকে উঠলো। কিছু জিজ্ঞেস করতে নিয়েও করলো না। কারো ব্যাক্তিগত জিনিসে হস্তক্ষেপ করা পছন্দ না পায়রার। তাই এমন একটা ভাব করলো, সে কিছু দেখেয়নি। চুপচাপ এসে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলল-
‘আমি ভাবছিলাম আপনি ঘুমিয়ে আছেন। ‘
আভাস হাতের কালো মলাটের ডায়েরিটা আর লুকিয়ে রাখলো না। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সেটাকে পায়রার সামনেই
টেবিলে রেখে দিলো। পায়রা সেদিকে ফিরেও তাকালো না। আভাস এলোমেলো বেডশিটটা গুছিয়ে রেখে পায়রার দিকে তাকিয়ে বলল-
‘ডায়েরিটায় আমি রোজ লেখি পায়রা। ‘
‘আমি তা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। ‘
‘না করলেও, আমার দায়িত্ব তোমাকে বলার। ‘
‘কীসের দায়িত্ব? আর আমাকে জানিয়ে লাভ কোথায়?’
‘এর পরবর্তী মালিক তো তুমিই হবে। ‘
পায়রা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। আভাস হাসলো।
হয়ত রহস্য পেচাতে খুব পটু সে। এমনটাই মনে হয় পায়রার। আভাস বসে বলল-
‘আমি মোটেও রহস্য পেচাই না পায়রা। ‘
পায়রা কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলো। মনের কথাটা ধরে ফেললো কী করে! ধ্যাত। পায়রা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দেখার বাহানায় প্রস্থান করলো। আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়ত মনের কৌতূহলও ধরে ফেলবে লোকটা। ডায়েরিটা নিয়ে সত্যিই কৌতূহল জেগেছিলো পায়রার। মানুষ মাত্রই রহস্য উন্মোচনে আগ্রহী। যেতে যেতে পায়রা একটা কথাই ভাবে, ডায়েরিটার পরবর্তী মালিক তাঁকে কেনো বলল আভাস?
_____________________
অফিসের কেবিনে ঢুকতেই সহসা অবাক হয় পায়রা।
এতদিন যদিও কেবিনে হুটহাট ঢুকে বসে নীলাংশ। কিন্তু, আজ হঠাৎ তাঁর আসার আগেই কেনো বসে আছে? ব্যাপারটা কী! ঠোঁট চেপে দরজা ঠেলে হিলের গটগট শব্দ করে ঢোকে। নীলাংশ পায়রার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিতেই মুখ হা করে থাকে পায়রা। রাগমিশ্রিত মুখে বলে-
‘অফিসে আপনার হলেও একজন বিজনেস পার্টনারের পার্সোনাল কেবিনে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করার সাহস কোথায় পেলেন?’
নীলাংশ হো হো করে হাসে। চঞ্চল পায়ে এগিয়ে এসে পায়রার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে-
‘শুধু বিজনেস পার্টনার? ‘
গরম নিঃশ্বাস চোখে মুখে পড়তেই আন্দোলিত হয় পায়রার নারী সত্তা। বৈদ্যুতিক শকের মতো কিছু একটা শিরদাঁড়া বেয়ে নিচে নেমে গেল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয় সে। কিছু বলার আগেই নীলাংশ আচমকা পায়রার হাতটা খপ করে ধরে নেয়। কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কেবিন থেকে বের করে আনে। এহেন টানাটানিতে হতভম্ব পায়রা। তাঁকে নীলাংশ টেনে নিচে নিয়ে যাচ্ছে। সামনে বাহিরের পথ। কিন্তু বাহিরে কেনো নেয়া হচ্ছে তাঁকে! পেছনে থেকে স্টাফরা হাসাহাসি করছে। তাঁরা অনেকেই ভাবে দু’জনের প্রেমের সম্পর্ক আছে। এই এক মাসে দু’জনকে তাই মনে হয় সবার। আভাসের বউ হিসেবে নয় একজন আলাদা পার্টনার হিসেবেই পরিচিত পায়রা এখানে। একজন ছেলে স্টাফ পাশের জনকে বলল-
‘ম্যাম মনে হয় স্যারের গার্লফ্রেন্ড । ‘
নীলাংশ থেমে যায়। কিছুটা সামনে এগিয়ে ছিলো সে। তাই শুনে ফেলেছে। পায়রা আগে থেকেই সম্মোহনের মতো পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলাংশ চট করে পেছনে ফিরে বলে –
‘তুমি ভুল বললে মিলন। ‘
মিলন নামের স্টাফটা ভড়কে গেলো। মুখ কাচুমাচু করে সরি বলার আগেই, নীলাংশ হেঁসে পায়রাকে টেনে নিজের সামনে আনে। অফিসের সকল স্টাফ সেখানে জড়ো হয়ে গেছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে নীলাংশ পায়রাকে পেছনে থেকে জড়িয়ে কাধের মুখ রেখে নরম গালে নিজের গাল মিশিয়ে বলে-
‘আমার হবু বিল্লিবউ। কিউট না?’
চলবে-