“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৬৫
পায়রা আকস্মিকতায় হতভম্ব , নির্বাক, স্তব্ধ। গাড়ি চলছে শো শো বাতাসের মধ্যে। চোখ এখনও আগের মতো স্থিতিশীল। কপালে বিস্ময়তার ছাপ। সামনে থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো, নীলাংশ নিশ্চিন্ত মনে সিটি বাজিয়ে ড্রাইভিং করছে। একটু আগের ঘটনা মনে করে, গাল দুটো লাল হয়ে গেছে পায়রার। সবাই তাদেরকে দেখে তালি দিয়ে হাসাহাসি করছিলো। নীলাংশ মৃদু হেসে সবার সামনেই পায়রাকে টেনে নিয়ে এসেছে। গাড়ি কোন পথে যাচ্ছে পায়রা জানেনা। নীলাংশকে জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাওয়া যায়নি। আচমকা,পায়রার টনক নড়লো। সচেতন দৃষ্টিতে তাকিয়ে চমকে উঠলো। এই রাস্তাটা চেনে সে। বলতে গেলে, খুব ভালো করে চেনে। চোখের কোণে জল জমলো পায়রার। ঠোঁট কামড়ে কান্না নিবারণ করে নেয়। রাগে নীলাংশের হাতে খামচি দিয়ে ধরে গলায় উচ্চ স্বরে বলল-
‘সাহস কী হলো আপনার! এইখানে কেনো নিয়ে এসেছেন? ‘
নীলাংশ হাতে আচমকা ব্যাথা পাওয়ায় মুখ কুঁচকে নিলো। কিন্তু মুখে টু শব্দ করলো না। পায়রা রাগে নিশপিশ করছে। এটাই সেই রাস্তা যেখানে বখাটে ছেলেগুলো তার সম্মানহানি করার চেষ্টা করেছিলো। আর এর সামনের পথও যে অতীতের বিষাক্ত একটি পাতা, সে ব্যাপারও অবগত। নীলাংশের বাড়ি এখানে। যে জায়গাটাতে কতশত মধুর স্মৃতি জমে আছে। গন্তব্যে পৌঁছাতেই গাড়িতে ব্রেক কষলো। নিজে নেমে পায়রাকেও টেনে নামিয়ে নিলো। পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে পায়রা। সাত বছর আগে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলো সে, এ বাড়ির সম্মুখীন হবে না আজীবন। কিন্তু, আসতেই হলো অবশেষে। ক্রুদ্ধ চাহনি দিয়ে নীলাংশের উপর চড়াও হলো পায়রা। কলার ধরে টেনে চিৎকার করে বলল-
‘কেনো এনেছেন আমাকে? এটা দেখাতে,যে বউ বাচ্চা নিয়ে কতটা ভালো আছেন!’
নীলাংশ শান্ত হাতে কলার ছাড়ালো। গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পায়রাকে টেনে নিলো বাহুতে। পায়রা টলমলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নীলাংশ মৃদু হাসলো।
দুই হাত পায়রার গালে রেখে বলল-
‘তোমার অনিচ্ছায় এখানে এনেছি বলে রেগে আছো? নাকি, এতগুলো বছর যা দৃষ্টির অগোচরে ছিলো তার সামনাসামনি হওয়ার ভয় পাচ্ছো?’
পায়রা ছাড়ানোর জন্য ধস্তাধস্তি করে বলে-
‘যা হয়ে গেছে, তার জন্য আর কীসের ভয়! ‘
নীলাংশ হাতের মুঠো আরও শক্ত করে। পায়রার দিকে গাঢ় চোখের দিকে তাকিয়ে বলে-
‘তাহলে, আর কী! চলো তবে,একবার দেখেই নাও। ‘
‘কিছু দেখতে চাই না আমি। বিজনেসের কাজ শেষ হলেই আমি আমার স্বামীর সাথে এদেশ ছাড়বো। ‘
নীলাংশের শান্ত মুখে অশান্ততার ছাপ স্পষ্ট হয়। চোখ লাল হয়ে যায়। কন্ঠে রুক্ষতা ভর করে।
‘এক্ষুনি আমার সাথে আসবে তুমি। ‘
হঠাৎ রেগে যাওয়ায় থতমত খেয়ে গেলো পায়রা। নীলাংশ হাত ছেড়ে দিয়েছে। রাগ নিয়ন্ত্রণে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে কড়া চোখে তাকিয়ে ইশারা দিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলো। পায়রা বুঝতে পারলো, ইশারার ভাষা। নীলাংশ বুঝিয়েছে, ‘এবার না আসলে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দেবো আমি। ‘ পায়রা মন শক্ত করে নেয়। যাই হোক, ভেঙে পড়বে না সে। মুখে গম্ভীরতার প্রলেপ ঢেলে নীলাংশের পিছু নেয়। কিছুটা অবাকই হলো, কোনো কিছুই পরিবর্তন হয়নি। আগের বারো তলা বিল্ডিংটা আগের মতোই আছে। কিন্তু, সাত বছরে পায়রা ভেবেছিলো অনেক কিছুই বদলে যাবে। অবাক মুখকে স্বাভাবিক করে।
দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজায় নীলাংশ। চটপট দরজা খুলে যায়। যেনো কেউ অপেক্ষায় ছিলো তাদের। দরজা খুলে বেরিয়ে আসে রুশানীর হাসিমুখ। চোখেমুখে লেপ্টে আছে আনন্দিত ভাব। পায়রার মনে অবাঁধ রক্তক্ষরণ হলো। আনমনে ভাবলো,বাহ! স্বামীর অপেক্ষায় দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো। এসব দেখিয়ে তাকে কষ্ট দিতেই নিয়ে এসেছে নীলাংশ। তাচ্ছিল্য ফুটে উঠলো মুখে। নীলাংশ এমন সময় পায়রার হাতটা মুঠোয় নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। নিজের বউদের সামনে এমন আচরণ করার পরও চোখ মুখ স্বাভাবিক দেখে বিস্মিত হলো পায়রা।
আরও হতবিহ্বল হয়ে গেলো যখন দেখলো, ড্রইং রুম ভর্তি মানুষ। দুই একটা নতুন মুখ। অপরিচিত মানুষকে দেখে আড়চোখে তাকিয়ে নীলাংশের দিকে তাকিয়ে রইলো। রুশানী আনন্দ মিশ্রিত গলায় বলল-
‘উফ! কত অপেক্ষা করছিলাম আমি তোমাদের। ‘
পায়রা ভ্রু কুচকে তাকালো। ড্রইং রুমে রূপসা, রায়ানা,
ফাহিম, রুশানী, সাহির,আর একটু দূরে তানজিমা। ফাহিম আর সাহির বাদে সবাই পায়রাকে দেখে হতভম্ব। এ কোন পায়রা! আগের সাথে কোনো মিলই নেই। আগের সাদাসিধা সালওয়ার কামিজ আর খোলা লম্বা চুলে পায়রা বদলে গেছে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো। পার্থক্য শুধু, মিষ্টির বদলে তা তেঁতো হয়ে গেছে। পড়নে অফিসের হালকা পিংক কোর্ট প্যান্ট, মুখে গাম্ভীর্য, দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতেও আভিজাত্য। হাত ভাজ করে যেনো কোনো প্রদর্শনী দাঁড়িয়ে আছে। এতোটা পরিবর্তন কেউ আশা করেনি। পায়রা সবাইকে দেখে অনুভূতিহীন। রূপসা এগিয়ে আসলেন। পায়রাকে জড়িয়ে নিলেন স্নেহে। পায়রার মন নরম হয়ে গেলেও বাহিরে প্রকাশ করলো না। রূপসা কান্নারত মুখে বললেন –
‘কীভাবে পারলি এতোগুলা বছর কাউকে না জানিয়ে চলে যেতে! এই ছোটমাকেও মনে পড়েনি? ‘
পায়রা আকাবেগী হয়ে গেলো। তবুও, স্বাভাবিক ভাবে তাকালো। রায়ানা দৌড়ে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো পায়রাকে। খুশিতে কেঁদে ফেলেছে মেয়েটা। ছেড়ে রাগী স্বরে বলল-
‘সবাইকে কষ্ট দিয়ে বুঝি খুব ভালো ছিলি!কাঁদানোর শাস্তি পাবি এবার। আমার ভাইয়ার চোখের পানির মূল্য হারে হারে বোঝাবো তোকে। ‘
পায়রা ভ্রু কুঞ্চন করে স্পষ্ট কন্ঠে বলল-
‘আপু, আপনার ভাইয়ের কান্নার কারণ অন্তত পায়রা বোস কখনো হয়নি। তবে, সে মানুষকে কাঁদাতে প্রচন্ড রকমের অভিজ্ঞ। ‘
পায়রার কাঠ কাঠ কন্ঠ শুনে সবাই আহত দৃষ্টি দিয়ে তাকালো। তারা আর যাই হোক। এরকম আশা করেনি। কেউ তো বুঝতেও পারলো না, ভেতরে ভেতরে কী অসহায় ভাবেই কাঁদছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নির্বিকার মেয়েটি। রায়ানা আহত গলায় বলল-
‘এমন করে বলছিস কেনো? আমি কী তোর অপরিচিত? আর আপু কী? রায়াবু বল। ‘
পায়রা নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিছু মনে করার ভঙ্গিতে বলল-
‘আজ আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি বরং আসি। ‘
রূপসা এগিয়ে আসলেন। ধমকানোর স্বরে বলল-
‘যাবি মানে! এবার আর যেতে দেবো না তোকে। তুই তো এদের সাথে পরিচিতই হলি না। ‘
ফাহিম আর সাহিরকে দেখিয়ে কথাটা বললেন। পায়রা তাকালো দু’জনের দিকে। দু’জন এগিয়ে এসে সালাম দিলো। ফাহিম প্রথমে হাসি ফুটিয়ে বলল-
‘ভাবি, রায়ার মুখে প্রতিদিন আপনার নাম শুনেছি। খুব খুশি হলাম আপনাকে দেখে। ‘
‘হ্যা, রুশাও রোজ হা হুতাশ করে। ‘
পায়রা কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে আছে। রূপসা বললেন –
‘এটা হচ্ছে ফাহিম,তোর রায়াবুর স্বামী। আর এই হচ্ছে সাহির, রুশার স্বামী। ‘
প্রথমে কথাটা গুরুত্ব দিয়ে না শুনলেও পরক্ষণেই চমকে উঠলো পায়রা। সচেতন দৃষ্টি দিয়ে বলল-
‘রুশার স্বামী মানে! ‘
রুশানী এসে পায়রাকে বললো-
‘হ্যা, আমার স্বামী সাহির। ‘
বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের মতো দাঁড়িয়ে রইলো পায়রা। পুরো কথাটা মাথার উপর দিয়ে গেলো তার। মাথা এলোমেলো লাগছে পুরোপুরি। এ কীভাবে সম্ভব! এতগুলো বছর সে যা ভেবেছিলো তা কী করে ভুল হয়! পায়রা জোরে চেচিয়ে উঠলো।
‘কিন্তু, আপনার বিয়ে তো নীলাংশের সঙ্গে হওয়ার কথা! ‘
সবাই কিছুক্ষণ তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠলো। এবার বুঝতে পারলো পায়রার আচরণের কারণ। রুশানী কিছু বলার আগেই নীলাংশ মৃদু হেসে বলল-
‘রায়া, রুশা তোরা একটু খাবারের ব্যবস্থা কর। বাহির হইতে এসেছো তো, তাই মাথা ঠিক নেই। আমি ওর মাথার ট্রিটমেন্ট করে আনছি। ‘
রায়ানা খিলখিল করে হেঁসে বলল-
‘খাবারের ব্যবস্থা আমরা আগেই করেছি। তোমার ট্রিটমেন্ট করা হলে এসে বসো। ‘
কাউকে কিছু না বলে নীলাংশ পায়রার হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। পায়রা হতবাক হয়ে আছে এখনো। অবাকের রেশ কাটাতে পারেনি সে। সাত সাতটা বছর! এ-ই তো ভেবে বসেছিলো। যদি, রুশানী নীলাংশের সঙ্গে বিয়ে না-ই হয় তাহলে কার সাথে হয়েছে! নাকি হয়নি?
পায়রার ভাবনায় কড়া নাড়লো নীলাংশ। গলার টাই খুলতে খুলতে বলল-
‘ভাবা শেষ হয়েছে?’
পায়রা চমকে তাকালো। দেখলো নীলাংশের ঘর। কিন্তু একদমই আগের মতো নেই। বিরাট পরিবর্তন হয়েছে।
কত পরিপাটি ছিলো ঘরটা! অথচ এখন, অগোছালো।
তার আগেরকার অসংখ্য ছবি দেয়ালে লাগানো। পায়রার অগোচরেও অনেক গুলো তোলা হয়েছে। এতো এতো প্রশ্নের ভার সামলাতে না পেরে চিৎকার করে বলল-
‘এসবের মানেটা কী! সত্যিটা বলুন আমাকে! ‘
নীলাংশ ধীরে সুস্থে গায়ের কোর্ট খুলে বিছানায় বসলো। এসির রিমোট দিয়ে পাওয়ার বাড়িয়ে বলল-
‘খুব গরম লাগছে তাইনা?’
পায়রা ক্রোধে দ্রুত পদে নীলাংশের দিকে তেড়ে আসলো। রাগে গা জ্বলছে। এতো সিরিয়াস একটা বিষয়ে এতোটা নির্লিপ্ত ছেলেটা! পায়রার রাগ আকাশ ছুঁলো।
‘ইয়ার্কি করছেন আমার সঙ্গে! ‘
‘ইয়ার্কি কেনো করবো?’
‘তাহলে, বলছেন না কেনো? ‘
‘কী বলবো? ‘
‘আমি আর সহ্য করতে পারছিনা সুন্দর সাহেব! কষ্ট থেকে মুক্তি দিন আমাকে, প্লিজ। ‘
আকুলতা উপচে পড়লো কন্ঠে। কান্নায় ভেঙে গেলো কন্ঠ। নীলাংশ পায়রাকে টেনে একদম কাছে নিয়ে আসলো। দুই হাতে অশ্রুভেজা গাল মুছে সযত্নে পায়রার ললাটে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল-
‘আমি তো কবে থেকে দিতেই চাই পিচ্চি। তুমিই দূরে সরে যাচ্ছো। ‘
পায়রা কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে আছে। নীলাংশ আলতো হাতে বুকে জড়িয়ে ধরলো পায়রাকে। পায়রা চোখ বন্ধ করে ফেললো। বহু বছর পর শান্তিতে চোখ বুজে থাকলো৷ নীলাংশ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল-
‘এখনো বুঝতে পারলে না? রুশার সঙ্গে নয় আমার তোমার সাথে বিয়ের হওয়ার কথা ছিলো পিচ্চি। আর একটা দিন অপেক্ষা করলেই এতোটা কষ্ট আমাদের কাউকে পেতে হতো না। ‘
পায়রার কৌতুহলী চোখের দিকে তাকিয়ে আবারও বললো-
‘যা বলবো মনোযোগ দিয়ে শুনবে পিচ্চি। ‘
পায়রা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। নীলাংশ ধীরে ধীরে সাত বছর আগের স্মৃতিতে চলে গেলো। একের পর এক ঘটনা ক্রমশই শরীরে কাঁপন ধরাচ্ছে পায়রাকে। সম্পূর্ণ ঘটনা বিস্তারিত পায়রাকে বললো নীলাংশ। সৌদি আরবে যাওয়ার দিন থেকে শুরু করে আয়মান সাহেবের মৃত্যুর আগ অব্ধি। বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে পায়রা। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বলল-
‘এ এতো কিছু ঘটেছে! আ আর আমি কিছুই জানতাম না! ‘
নীলাংশ মলিন মুখে পায়রার হাত টেনে চুমু খেয়ে বলল-
‘হ্যা। আর এতোগুলা বছর নিজে তো দগ্ধ হয়েছোই সঙ্গে সবাইকেও করেছো। দোষটা আমারও, সেদিন যদি না রেগে সবটা তোমাকে বলতাম তাহলে আজ এমন হতোনা। আই এম সরি পিচ্চি,সরি ফর হার্টিং ইউ, সরি ফর এভরিথিং! ‘
পায়রা হাউমাউ করে কাঁদছে। এতোগুলা বছরের জমানো কষ্ট, দুঃখ, রাগ নিমিষেই উধাও। অসহ্য রকমের যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে। নীলাংশ পায়রাকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো। নিজের সঙ্গে মিশিয়ে কষ্ট গুলো নিঃশেষ করে দিতে চাইলো। পায়রা কাঁদতে কাঁদতে মিইয়ে গেছে। বিড়ালের মতো মিশে মুখ গুঁজে আছে। কান্না থামলেও ফুপিয়ে যাচ্ছে সমানতালে। নীলাংশ মুখ নিচু করে বলল-
‘এবার তোমার অতীতের সত্যগুলো আমাকে বলবে না?’
পায়রা কান্নায় ফোলা চোখ দুই হাতে মুছে সোজা হয়ে বসলো। জানালার অদূরে তাকিয়ে বলল-
‘বলবো, সব বলবো! ‘
চলবে-
(সবাই খুশি তো?)