স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৬৮

0
1757

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৬৮
(১৪+)

আকাশের মধ্যখানে রংধনুর মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা মিশেলে রঙ বিছিয়ে আছে। ফিনফিনে শীতল বাতাস পরাণের গহীন কোণে একটু একটু করে সুখের প্রদীপ জ্বালাচ্ছে। বিকেলের শেষাংশে লজ্জ্বাবতী সন্ধ্যার আগমণ। চোখের বাদামী মণিতে জ্বলজ্বলে নব সন্ধ্যার অপরূপা দৃশ্যপট আঁকছে নববধূ। দুধে আলতা
গায়ে ভারিক্কি লেহেঙ্গা আর মুখে পাঁকা হাতের সাজ।
বধূ রূপে নিজেকে সন্ধ্যার আলোয় দেখতে অচেনা লাগছে পায়রার। আজ সেই দিন যেদিনের স্বপ্ন মানসপটে ভেসে উঠেছিলো কিশোরীর হৃদয়ে। প্রেমময় যুবকের নামে প্রলয় শুরু হয়েছিলো। নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সুখী বলতে দ্বিধা নেই পায়রার আজ। গত চারটে দিন জাঁকজমকেই কেটেছে। পুরো বাড়িতে গান বাজনায় ভরপুর। হলুদ, মেহেদীর পর্ব শেষ হয়ে আজ বিয়ে। রায়ানা ও রুশানী দু’জনেই দারুণ ভাবে লজ্জা দিচ্ছে ওকে । আনন্দের এই দিনে পুরনো বহু মানুষ উপস্থিত হয়েছে। নিশান, তেজসী, তিতিক্ষা,প্রবীর , তমাল। সবাই বাহিরেই বসে আছে। বলেনা! সময়ও কথা কয়। তেমন ভাবেই সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে।
সাত বছরে বন্ধু বান্ধবরাও আলাদা হয়েছিলো। অঘোষিত বিচ্ছেদে সবার মনেই গভীর ভাবে দাগ কেটেছিলো। কিন্তু দীর্ঘ দূরত্বের পর আজ আবারও পুণর্মিলন। নিশান ও তেজসীর বিয়ে হয়েছে বছর তিনেক আগে। তারা কখনোই আলাদা হয়নি। মান অভিমান, ঝগড়া তো আবার গাঢ় প্রেম। সব মিলিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে এতদূর আসতে পেরেছে। তেজসী চার মাসের প্রেগন্যান্ট। এতেই নিশানের অবস্থা কাহিল করে দিয়েছে। আগে তো রাগী ছিলোই, এখন উনিশ থেকে বিষ হলেই চিল্লাতে চিল্লাতে নিশানকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। এক্ষেত্রে নিশান চুপ থাকে। সে জানে তেজসী যত চিল্লাচিল্লিই করুক দিনশেষে নিশানকে খুব ভালোবাসে। প্রবীরেরও বিয়ে হয়েছে। পরিবারের পছন্দেই। সাদাসিধা জীবন যাপন তার। তিতিক্ষার বিয়ে সেসময়ই এক ইউভার্সিটির প্রফেসরের সাথে হয়েছে। তমালের কোন প্রেম ছিলো না, কিন্তু সবার দিক থেকে সে-ই এগিয়ে। চার বছরের ছেলে আছে তার। কাজিনের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিলো মাস্টার্স শেষে। তবে, সব কিছুর মাঝে একটা দুঃখের খবর হলো কারিমা মারা গেছে। আবির নামে এক ছেলের সঙ্গে কলেজ লাইফ থেকে প্রেম ছিলো। সবার ভাগ্য যে সুপ্রসন্ন হয়না তারই জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ সে। আবিরের সঙ্গে প্রেমে গভীর সম্পর্কে তৈরি হয়েছিলো কারিমার। রূপ, অর্থের দাপট দেখিয়ে স্কুল থেকে ভার্সিটির অলিগলি কাঁপানো মেয়েটা ভালোবেসে সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছিলো। মানুষ চিনতে বড্ড ভুল করেছিলো সে। সময় থাকতে বুঝতে পারেনি। কারিমার সামনে দিয়েই বিয়ে করে সুখে শান্তিতে বসবাস করছিলো আবির নামের মুখোশ পরিহিত লোকটা। সহ্য করে পারছিলো না কারিমা। ফ্যানের সঙ্গে দড়ি বেঁধে আত্মহত্যা করেছিলো। পৃথিবীতে যেমন, নীলাংশ, নিশানের মতো বিশুদ্ধ কিছু প্রেমিকের কারণে প্রেম পবিত্র। তেমনই অপর দিকে আবিরের মতো মানুষের জন্য তা ঘৃণিত। প্রকৃতি আবিরকেও ছাড় দেয়নি অবশ্য। বউ পরকীয়া করে পালিয়ে গিয়েছিলো বটে। নীলাংশ সহ সব বন্ধুরা একসঙ্গেই বসে আছে। আড্ডায় মেতে উঠেছে সবাই। মাঝে মধ্যে নিশান তেজসীর ঝগড়াঝাটি আর তমালের জোঁকারের মতো আচরণ সকল মনখারাপী দূর করে দিচ্ছে। ঘন্টা খানেক পরই কাজী সাহেব ও হুজুর আসলেন।

পায়রাকে নিয়ে বসানো হলো নীলাংশের পাশে। নীলাংশ অপলক তাকিয়ে আছে তার পিচ্চির দিকে।
পৃথিবীর সকল প্রেমিকের কাছেই প্রমিকা সবচেয়ে সুন্দর। এই যেমন, আশেপাশের কিছু নিচু মনমানসিকতার মানুষ পায়রার মুখের কোঁচকানো জায়গাটা দেখে নিজেদের মাঝেই আলোচনা সমালোচনা করছে। এমনকি, বিয়ের ক্ষণিক আগেই এক প্রতিবেশী মহিলা এসে সবার সামনেই বলে ফেললেন,

‘হ্যা গো,কী দেখে তোমরা নীলাংশের সঙ্গে অমন এসিডে ঝলসানো মুখের মেয়েটার বিয়ে দিচ্ছো! মানলাম, মেয়ের সুইজারল্যান্ডে বিরাট ব্যবসা আছে কিন্তু তাই বলে মেয়েদের রূপটাই তো আসল। সকালে উঠে যখন মেয়েটার চেহারা দেখবে তখনই তো ভয় পেয়ে যাবে ছেলেটা! ‘

এহেন কথায় লাজুক পায়রার ভেতরের সকল আনন্দ মাটি হয়ে গেলো। নতনাজু হয়ে বসে থাকায় অবিলম্বেই চোখের জল গড়িয়ে টুপ করে পড়লো। পায়রার মনে হলো, সত্যই সে তো আর সাধারণ আট দশটা রূপবতী মেয়ের মতো নেই আর। চেহারায় লেপ্টে থাকা দাগেই আমূল-পরিবর্তন এসেছে। নীলাংশকে ঠকাচ্ছে সে! অচিরেই মাথায় জড়ো হলো অপরাধ বোধ।

পাশ থেকে নীলাংশ মৃদু হাসলো। পায়রার হাতটা পাশ থেকে উঠিয়ে বলল,

‘তাই নাকি আন্টি! রূপই যদি আসল হয় তাহলে আপনার মেয়ের ডিভোর্স হলো কী করে! আপনার মেয়ের রূপ তো কোনো অংশেই কম ছিলো না। ‘

রুবিনার মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো।
নীলাংশ তোয়াক্কা না করে আবারও বলল,

‘আমার বউকে নিয়ে আপনার এতোটা চিন্তা না করলেও চলবে আন্টি। তবে,একটা ব্যাপার ঠিক বললেন, বউয়ের মুখ দেখে ভয় পেয়ে যাবো আমি। কিন্তু সেটা হারিয়ে ফেলার ভয় হবে। চেহারা দেখে আমি কোনো কালেই ভালোবাসিনি। আমার কাছে আমার পায়রাই সুন্দর। এর চেয়ে কম বা বেশি সুন্দর কাউকে এই নীলাংশের দরকার নেই। দাওয়াতে এসেছেন, ঘুরে ফিরে দেখুন, খাওয়া দাওয়া করে আশীর্বাদ করে বিদায় হলেই ভালো হয়। ‘

রুবিনা সহ্য করতে না পেরে খিটমিট করে চলে গেলেন। পায়রার দিকে তাকিয়ে মনটা খারাপ হলো নীলাংশের। সঙ্গে রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। এমন মানুষদের বিয়েতে দাওয়াত দেয়ার কোনো প্রয়োজনই নেই। পায়রা মুখ নিচু করে আছে। এরকম একটা দিনে অন্তত চেহারা সম্বন্ধে কোনো কটুক্তি শুনতে হবে ভাবেনি। এতগুলো দিনে কেউ তাঁকে এক মুহূর্তের জন্যও অনুভব করায়নি সে আলাদা। কারণ, কেউই চেহারা দিয়ে তাঁকে বাচবিচার করেনি। পায়রার হাতটা মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখলো নীলাংশ।

‘কবুল’ বলতে বলা হচ্ছে। কিন্তু শক্তি পাচ্ছে না পায়রা।
নীলাংশ পায়রার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,

‘ওহে সুন্দরী, এবার তোমার পাগল প্রেমিকটাকে কবুল বলে চিন্তামুক্ত করো! নাহলে, অচিরেই সে অক্কা পাবে!’

কান্নার মাঝে হঠাৎ করেই হাসি পেয়ে গেলো পায়রার। নীলাংশের মুঠোয় নিজের হাতটা দেখেই দ্বিধা শেষ করে তিন কবুল বলে চিরকালের জন্য আপন করে নিলো। নীলাংশ মৃদু হেসে দেরি না করে কবুল বললো।

বাসর ঘরের খাটে বসে আছে পায়রা। আর তার সম্মুখে মলিন চেহারায় তানজিমা। পায়রাকে অঢেল সংকোচ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। কী বলবে বুঝতে পারছেনা৷ তানজিমা কান্না করছেন। একমাত্র ছেলের বিয়েতেও সে ঘরেই বসে ছিলো। কবুল বলার সময় দূর থেকে চক্ষু দর্শন করেছিলো। পায়রা জানে নীলাংশ তানজিমার সঙ্গে কথা বলেনা। নীলাংশের দিকটা যেমন পায়রা বোঝে ৷ তেমনই এখন তানজিমাকে দেখেও ভীষণ মায়া হচ্ছে। এই হাল কীভাবে হলো বুঝতে পারছেনা। হাফ হাতার স্টাইলিশ শাড়িতে মোড়ানো সৌন্দর্যেমন্ডিত মহিলাটি মলিন সাদা শাড়ি,আধ পাকা চুলে আর মেঘযুক্ত শরীরে করুণ দেখাচ্ছে। তিনি পায়রার হাত ধরে বললেন,

‘ অন্যায় করেছিলাম তোমার সঙ্গে। সেই শাস্তি খুব ভালো করেই পেয়ে গেছি, এখনও পাচ্ছি। একটা মাত্র ছেলে আমার। সাতটা বছর ধরে কথা বলেনা, মম বলে ডেকে ডেকে অস্থির হয়না। সত্যিই খুনী আমি। ভালো মানুষটাকে মেরে ফেলেছি! ‘

পায়রা ইতস্তত করে বলল,

‘আন্টি, আঙ্কেলের আয়ু ততটুকুই ছিলো। এতে আপনার দোষ নেই। ‘

‘নারে মা, দোষ আছে। বিবেকের দংশনে পুড়ে মরছি এখন। মরার আগে যদি ছেলেটা ক্ষমা করে তবেই একটু শান্তি পাবো। ছেলেটাকে সুখে রেখো। তোমার দূরে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছিলো একেবারে। আমি আসি। ‘

পায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। পায়রা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। শান্তনা দেয়ার ভাষা ছিলোনা তার। গায়ের লেহেঙ্গার দিকে তাকিয়ে ভাবতে ভাবতেই ঘরে এলো নীলাংশ। পায়রা চমকে উঠলো । হুট করেই লজ্জায় গাল লাল হয়ে গেলো। কিছু্ক্ষণ আগেও পাশাপাশি বসে ছিলো, কিন্তু কই তখন তো এতোটাও লজ্জা লাগেনি! বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েই কী তবে, এতো লজ্জা! নীলাংশ এসে তাঁকে অবাক করে দিয়ে ধমকে বলল,

‘এই পিচ্চি, আদব কায়দা কিছু শেখানো হয়নি! স্বামীকে সালাম করতে হয়, এটা জানো না? ‘

পায়রা হতভম্ব হয়ে তাকালো। কী বলল! নীলাংশ সালাম করতে বলল তাঁকে! অবাক হলেও সামলিয়ে লেহেঙ্গা ধরে উঠে গুটিগুটি পায়ে এসে ঢোক গিলে সালাম করতে পায়ে হাত দিলো। কিন্তু তাঁর আগেই নীলাংশ তিন কদম পিছিয়ে হেসে বলল,

‘টিপিকাল স্বামীর মতো অভিনয়টা ভালোই করলাম তাহলে! ‘

পায়রা পিটপিট করে চোখের পলক ফেলে রাগে নাক ফুলিয়ে বলল,

‘নাটক করেছিলেন! অসভ্য লোক! ‘

নীলাংশ হাস্যজ্জ্বল মুখে এসে পায়রাকে টেনে কাছে নিয়ে এসে বলল,

‘প্রবীর শিখিয়ে দিলো, বউকে প্রথম থেকেই টাইট দিয়ে রাখতে হয়। তাই ট্রাই করছিলাম আরকি! ‘

পায়রা নীলাংশের পাঞ্জাবির বোতামটা নাড়াচাড়া করে বলল,

‘ওহ, প্রবীর ভাইয়ার কান পড়া খেয়ে এখন আমাকে টাইট দিতে এসেছিলেন! ‘

‘এমা! আমার এতো সাহস আছে নাকি! আদুরে পিচ্চিটাকে টাইট দেয়ার!’

পায়রা খিলখিল করে হাসলো। নীলাংশ মাদকাসক্তের মতো তাকিয়ে বলল,

‘আদুরে পিচ্চিকে টাইট দিতে না পারলেও, আরও অথবা কিছু করতে পারি! ‘

পায়রা আড়চোখে একবার তাকিয়ে ছিটকে দূরে সরে
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গয়না খুলতে খুলতে বলল,

‘সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে না! আমি ফ্রেস হয়ে আসি। ‘

বলে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে। নীলাংশের অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। পায়রা বাথরুম থেকে বের হয়ে মিটিমিটি হাসলো। ভেজা চুল মুছতে মুছতে মুখে মাত্রই ক্রিম লাগাতে নিচ্ছিলো কিন্তু আচমকা পেছন থেকে নীলাংশের আক্রমণে খেই হারিয়ে ফেললো। নীলাংশ পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
শীতল হাতের বিচরণ পায়রার শাড়ি পরিহিত গায়ের উন্মুক্ত কোমরে। মুখ গুঁজে রেখে ঘাড়ে। লম্বা ঢোক গিলে নিলো পায়রা। পুরুষালি বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে নিজেকে শক্তিহীন লাগছে তার। আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলেই নিচে পড়ে যাবে সে। নীলাংশ পায়রাকে নিজের আরও কাছে টেনে বলল-

‘আমার প্রেমকন্যা, প্রেমিকের মাদকে সিক্ত হতে প্রস্তুত হও! ‘

তপ্ত নিঃশ্বাসে ভর ছেড়ে দিলো পায়রা। নিশব্দেই হাজারও অনুভূতির লেনদেন হলো। পায়রাকে পাঁজা কোলে তুলে খাটের দিকে এগিয়ে গেলো। ল্যাম্পশ্যাডটা নিভিয়ে দিতেই পূর্ণতিথীর আবছা আলো এসে ঘরকে মোহনীয় করে তুললো। নিভৃতেই রচিত হলো পরিপূর্ণ প্রেমকাব্য!

চলবে-

(সারপ্রাইজ পেয়ে কেমন লাগলো, সবার? শুভরাত্রি!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here