নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা ||১৫তম পর্ব||

#নিবেদিত_প্রেম_আরাধনা
||১৫তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
কয়েক মুহূর্ত ভাবে নিবেদিতা। অতঃপর চোখজোড়া বন্ধ করে পথহারা পথিকের ন্যায় বলে উঠে,
“না, আমি ওর সাথে থাকতে চাই না। ওকে ফিরিয়ে দাও। ওকে জানিয়ে দাও যেখানে আমার নিবেদিত প্রেম আরাধনার বিনিময়ে ওর নিবেদিত প্রেম তো দূরে থাক সম্মান টুকু পাইনি, সেখানে আমার অস্তিত্ব নেই।”

নিবেদিতার কথায় ফোঁস করে শ্বাস ফেলেন রোদ্দুর সোহরাব। নাদিয়া বেগম মেয়ের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নেন। মেয়ের সংসার চোখের সম্মুখে ভাঙতে দেখলে কোন মা-বাবাই বা সহ্য করতে পারে?

“তুই নিশ্চিত তো মা? অনেক বড় সিদ্ধান্ত এটা, তুই আরেকবার ভাব। আরও সময় চাই না কি?” নাদিয়া খানোম উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।

তাচ্ছিল্যের এক হাসি ফুটে উঠে নিবেদিতার মুখশ্রীতে। চোখজোড়া অশ্রু ভেজা।

“সময় কি তোমরা আদৌ দিয়েছো আমাকে? এখন সিদ্ধান্ত জানানোর পর সময় দিতে চাচ্ছো কেন? যা, হওয়ার হবে, দেখে নিবো। জানো না করার মুহূর্ত আগেও আমি দুটানায় ভুগছিলাম, কোন পথে হাঁটবো ভেবে। পরক্ষণেই খেয়াল করলাম আমার কাছে পথই একটা। কারণ ফিরে যাওয়ার রাস্তা তো নেই, যেখানে মানুষটার মাঝে বিন্দু পরিমাণও অনুতাপ নেই।”

মেয়ের ছলছল চাহনি দেখে, কথা শুনে রোদ্দুর সোহরাব ও নাদিয়া খানোম বলার কিছুই পায় না। বরং, নিঃশব্দে রুম ত্যাগ করে চলে যান দুজনে।

আরাধ্য মনে মনে রাগে ফুঁসছে। ঘামাচ্ছেও বটে মান হারানোর দুশ্চিন্তায়।

ভাবছে,
– নিবেদিতা কি তবে ওর মা-বাবাকে সব বলে দিয়েছে? কিন্তু নিবেদিতা তো কোনোদিন তাদের ব্যক্তিগত বা বৈবাহিক জীবনের বিষয় তার মা-বাবা বলেনি। এবার কী করে? না জানি শ্বশুর-শ্বাশুড়ি তাকে কী ভাবছে? এই কাজটি একবারেই অনুচিত হয়েছে।

তার ভাবনার মাঝেই রোদ্দুর সোহরাব ও নাদিয়া খানোম আসেন। তাঁদের দেখে মোকশেদা বেগম সৌজন্যতার হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“বউমা কী রেডি হচ্ছে যাওয়ার জন্য? এমনিতেই তো লেট হয়ে যাচ্ছে।”

“আসলে নিবেদিতা বলেছে সে ফিরবে না আপনাদের সাথে।” কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে জবাব দেন রোদ্দুর সোহরাব।

শ্বশুরের কথা শুনে শুধু আশাহতই হয় না আরাধ্য, আহত হয়। ডিভোর্সের কথা কল্পনা করতেও তার মনে হচ্ছে অক্সিজেন শূণ্য হয়ে পড়ছে সারা ঘর।

বাধা দিয়ে শুধায়,
“কিন্তু বাবা…”

“দেখো নিবেদিতার সাথে তোমার পরিচয় কম সময়ের নয়। অনেকদিন ধরেই চিনো। ও আমাদের কখনো মিথ্যে বা বানোয়াট কিছু বলবে না সে সম্পর্কেও তোমার নিশ্চয়ই ধারণা আছে। তোমাদের ব্যক্তিগত বিষয়গুলো আমি চাচ্ছি না আমার বা বেয়ানের সামনে আলোচনা করতে। হ্যাঁ, আলোচনা অবশ্যই করতাম যদি তোমাদের মাঝের সমস্যাটা আলোচনা বা সমাধান করার মতো কিছু হতো।

যেমনঃ পরকীয়া বা গায়ে হাত তুলা বা তোমার পরিবারের সাথে সমস্যা ইত্যাদি। এখানে তেমন কিছুই না। বরং, একান্তই ব্যক্তিগত ঝামেলা তোমাদের মাঝে। সমস্যাটা আচার-আচারণের, মানসিকতা, সম্পর্কের সম্মানের। তাই এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাইলে নিবেদিতার সাথে কথা বলো, আমাদের সাথে নয়।”

শ্বশুরের কথায় দৃষ্টি নত করে ফেলে আরাধ্য। মোকশেদা বেগম ইশারায় তাকে নিবেদিতার কামরায় যেতে বলেন। আরাধ্যও ধীরেধীরে সেখান থেকে উঠে নিবেদিতার রুমে যায়।

দরজা খোলার আওয়ার জানালার বাহিরে দৃষ্টি স্থির রাখা নিবেদিতা ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। আরাধ্যকে দেখেই চোখ ফিরিয়ে নেয়। অজান্তেই এক ফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ে তার আঁখি থেকে।

আরাধ্য বড় বড় পা ফেলে নিবেদিতার পিঠে নিজের বক্ষ মিশিয়ে দাঁড়ায়। ডান হাতের বৃদ্ধা আঙুলের আলতো স্পর্শে কপোল মুছে দেয় রমণীর।

ব্যথিত সুরে বলে উঠে,
“আমাকে ছাড়া থাকতে যেহেতু পারো না, সারাটা ক্ষণ যেহেতু আমার ভাবনাতেই পুড়ো, ভালোটা যেহেতু শুধু আমাকেই বাসো; তবে বিচ্ছেদ কেন চাচ্ছো প্রিয়?”

তার ভারী কণ্ঠে কানে তীর হয়ে বিধে নিবেদিতার মুখে হাত চেপে ডুকরে কেঁদে দেয়। আরাধ্য তার দু’কাঁধে হাত রেখে তাকে নিজের দিকে ঘুরায়। যুবতী আড়ষ্ট হয়ে থাকে। যেন সে মিশতে চায় না এই যুবকের রঙে।

“বলো না নিবেদিতা? আমি জানি আমি ভুল করেছি, আমি অপরাধী। বারবার ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার পরও একই ভুল করি। কিন্তু আমি কী করবো? আই কান্ট কন্ট্রোল ইট, আই জাস্ট কান্ট। এমন তো না আমি তোমাকে ভালোবাসি না। আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ লাইক জান্নাত, আই ওয়ান্ট ইউ লাইক জান্নাত। ডিভোর্স…? কী করে?

বিশ্বাস করো আমি আমার জীবনের একটা মুহূর্তও নিবেদিতা নামক নারীটিকে মানে তোমাকে ছাড়া কল্পনাও করতে পারি না। আমার লোমে লোমে, প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে তুমি নিবেদিতা৷ আমি কী করে থাকবো তোমাকে ছাড়া? বেঁচে হয়তো থাকবো, তবে সত্যি তার থেকে মৃত্যু শ্রেয় হবে, মৃত্যু! এত পাষাণ হয়ো না নিবেদিতা। আমাদের নিবেদিত প্রেম আরাধনাকে ব্যর্থ করে দিয়ো না।”

নিবেদিতা নির্বিকার ভাবেই কাঁদছে। তার যন্ত্রণা বোধ হচ্ছে পুরুষটির এমন দশা দেখে। কোনোরকম উচ্চারণ করে সে,
“বিচ্ছেদই শ্রেয়, বিষাদের চাইতে।”

এত আকুতির পরও নিবেদিতার এমন কঠোর উত্তর শুনে দমবন্ধ অবস্থা আরাধ্যের। তার মনে হচ্ছে কেউ একটু একটু করে ছিনিয়ে নিচ্ছে তার প্রাণবায়ু। যুবক তো জানে এই রমণীর প্রতিটি সিদ্ধান্তের অটলতা।

প্রণয়ের সম্পর্কে থাকাকালীন একবার ভুলবশত নিবেদিতার শত সাবধানবাণী বলা সত্ত্বেও বন্ধুদের সাথে মদ্যপান করেছিল পার্টিতে। হুমকি মোতাবেক আরাধ্যের বহু প্রচেষ্টার পরও সত্যিই কথা বলেনি তার সাথে নিবেদিতা। তবে কি বাস্তব অর্থেই নিবেদিতাকে হারাতে চলেছে সে?

প্রশ্নটা মাথায় আসতেই আরাধ্যের মাঝে বেঁচে থাকা সামান্যতম দৃঢ়তাও ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। নিজের শিখা পুরুষের অশ্রুপাত করতে নেই নিয়মটি ভেঙে ফেলে দুঃখকে আপন করে নেয় সে।

কেঁদে দেয় ছোট্ট শিশুর ন্যায়। ভারাক্রান্ত গলায় মিনতি করে,
“বিশ্বাস করো, আমি সত্যিই দুঃখিত নিজের আচারণে। আমি আমার এই ভুলের বিনিময়ে তোমাকে কিছুতেই হারাতে পারবো না। তুমি তো জানো আমি তোমাকে ছাড়া কতোটা খারাপ থাকি, কতোটা অচল! জানো না? জানো তো। আচ্ছা, তুমি নিজেই কি ভালো থাকবে আমাকে ছাড়া বলো?

আমি তো জানি তুমি আমাকে ছাড়া ভালো থাকবে না কখনোই, ভালো থাকার নয়। আমি যতোটা তোমায় চাই, ততোটা অনুরাগেই তুমি আমায় তোমার হৃদয়ে আগলে রাখো। একটা সুযোগ দাও, আর একটা সুযোগ প্লিজ। বিশ্বাস করো, আমি আর একটাও সুযোগ দিব না তোমায় বিচার দেওয়ার।”

যুবকের উত্তেজিত ভঙ্গিমা, আকুতিভরা কণ্ঠ শুনে আরও শব্দ করে কেঁদে দেয়। আরাধ্য তখনও নিজের মতোই তার বেদনা জাহির করছে৷

অনেকটা সময় পর সে বড়সড় এক শ্বাস নিয়ে মুখ খুলল,
“আমাদের ডিভোর্সই সঠিক। আমি তোমার সংসারে থেকে থেকে মানসিক যন্ত্রণা আর নিতে পারছি না। তোমার স্থানে যদি অন্যকেউ হতো তার এমন আচারণ আমি নিতে পারতাম। ভাবতাম সেই মানুষটিই বোধহয় তেমন। কিন্তু তুমি? আমি এই তুমিকে ভালোবেসে বিয়ে করিনি। আমার সারাক্ষণ মনে হয় আমি তুমি রূপী অন্যকারো সাথে থাকছি।

দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ানক যন্ত্রণা হলো ভালোবাসা এবং ভালোবাসার মানুষের রং বদল।
দুঃখের বিষয় আমি এই দুই যন্ত্রণাই ভোগ করছি। আমার ভালোবাসার বন্ধন তথা সম্পর্কও বদলেছে। আর অতিপ্রিয় তুমিও।”

“এমনটা হয় না নিবেদিতা। একটু বুঝো তুমি। আমাদের তালাক? প্লিজ না।”

“Time has passed, love has faded. We are still together, may be in love too, but lost the sparkle. It’s faded, bitter and painful now.”
নিবেদিতা অবচেতন মনেই চোখে চোখ রেখে কথাটুকু বলে বারান্দায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।

___

আবরাহাম বাড়ি ফিরেছে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে। টাই খুলে বিছানার দিকে ছুঁড়ে ফেলতেই তার চোখ যেয়ে পড়ে ড্রেসিংটেবিলের উপরে রাখা হলদে খামে। এগিয়ে যেয়ে হাতে তুলে নেয় সে।

খামের উপরে লিখা,
– ভালোবাসার আরেকনাম বিভীষিকা, যদি তা হয় একতরফা। (সুখমাখা দুঃখ)
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here