#মন_ময়ূরী
#Tahmina_Akther
৭.
খেয়াকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা-মা এবং ফায়েজের পরিবার।জন্মদিনের কেক কাঁটার পর্ব শেষ হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো এখন এনগেজমেন্টের পালা।
খেয়া একপলক ওর বাবা-মায়ের দিকে চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবছে আর ফায়েজ তার মনে কি চলছে শুধু সে জানে।
অথচ,খেয়া আর ফায়েজ বাদে বাকি প্রত্যেকটি ব্যক্তি যেন খুশির জোয়ারে ভাসছে। উপস্থিত সকলে তাগাদা দিয়ে বলছে, খুব তাড়াতাড়ি শুভ কাজটি সেরে ফেলতে তাই খেয়ার বাবা পকেট থেকে একটি আংটির বক্স বের করে বক্সটি খুললো।প্লাটিনামের আংটিটা নিয়ে খেয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলেন খেয়ার বাবা।খেয়া কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে তার বাবার কাছ থেকে আংটিটা নিয়ে নিলো।
ফায়েজকে তার মা বললো খেয়ার দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিতে। ফায়েজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডানহাত বাড়িয়ে দিলো খেয়ার সম্মুখে।
প্রত্যেকটি ক্যামেরা এবার খেয়ার দিকে তাক করা। খেয়ার মা মেয়ের কানে খুব আস্তে করে বলেন,
-সবাই তাকিয়ে আছে খেয়া, ফায়েজে হাত বাড়িয়ে আছে, আংটি পরিয়ে দে। নয়তো আরও একবার ভেবে দেখ তুই এখনো কিছু বদলে যায়নি।
খেয়া তার মায়ের কথায় কোনো প্রতিউত্তর না করে ফায়েজের ডানহাতের অনামিকা আঙুলে আংটি পড়িয়ে দিলো।
সকলের করতালিতে মুখরিত পুরো ক্লাব।এবার ফায়েজের পালা,তবে ফায়েজ হুট করে বেশ ঘামছে।
নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। কই প্রথম যেদিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তখনও তো সে এত নার্ভাস হয়নি তবে আজ কেন এমন হচ্ছে? নাকি তার সেই প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর চেয়ে খেয়ার সামনে দাঁড়ানোটা বেশ ভীতিকর!
জব্বারকে আংটির কথা বলতেই জব্বার আংটি এগিয়ে দিলো ফায়েজের দিকে। ফায়েজ হাত বাড়িয়ে আংটিটা নিলো ততক্ষণে খেয়া তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
ফায়েজ একপলক খেয়ার দিকে তাকালো,দেখলো খেয়া খুব স্বাভাবিক মুখ করে আছে। ওর মুখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে যেন, সে জানতো আজ হুট করে এমন একটি পরিস্থিতি ক্রিয়েট হবে।
ফায়েজ তার বামহাত দিয়ে খেয়ার বামহাত ধরলো। এই প্রথম ফায়েজ খেয়ার হাতের পরশ পেলো,হুট করে পুরো শরীর কাটা দিয়ে উঠলো ফায়েজের। কেমন শীত শীত অনুভব করছে সে! গা কাঁপছে আচ্ছা, আমার শরীরের কাঁপুনি কি খেয়া অনুভব করতে পারছে?যদি বুঝতে পারে তাহলে তো খেয়া বলেই বসবে, আমার হাত ধরে এভাবে কাঁপছেন, নায়িকারদের হাত ধরে নাচার সময়ে কি এভাবে কাঁপেন?
-স্যার,ম্যাডাম হাত বাড়িয়ে বসে আছে, আপনি কি ভাবছেন স্যার?
জব্বারের কথায় ফায়েজের ভ্রুম ভেঙে গেলো। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করে খেয়ার অনামিকা আঙুলে আংটি পড়িয়ে দিলো।
ফের করতালিতে মুখরিত পুরো ক্লাব জুড়ে। ফায়েজের বাবা মা এবং খেয়ার বাবা-মা একে অপরকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো। জব্বার তো এগিয়ে এসে খেয়াকে বলেই ফেললো,
-এখন কিন্তু আপনাকে ভাবি বলতে পারি তাই না ম্যাডাম?
খেয়া মুখে নকল হাসি ঝুলিয়ে হু বললো। একে একে উপস্থিত সকল মেহমানরা এসে খেয়া আর ফায়েজকে নতুন সম্পর্কের জন্য অভিনন্দন জানাতে লাগলো।
পার্টি ঠিক তখনও চলছিল কিন্তু খেয়া চলে আসার জন্য তার বাবাকে অনুরোধ করছে কিন্তু তিনি এখনি যেতে পারবেন না কারণ অনেক গেস্ট এখনো আছে। তাছাড়া রাত তখন অনেকটাই পেরিয়ে গেছে তাই তিনি ড্রাইভারের ভরসায় ছাড়তে পারছেন না নিজের স্ত্রী আর কন্যাকে।
এমন সময় ফায়েজের বাবা-মা, ফায়েজ আর ফাহিম এসে উপস্থিত হলেন উনাদের সামনে।ফায়েজের বাবা এসে জানালেন উনারা চলে যাবেন। খেয়ার বাবা হাসিমুখে বললেন,
-জী,আজ আসুন তবে।কিন্তু, আগামীকাল আপনারা সকলেই আমাদের বাড়িতে আমন্ত্রিত। বিয়ের ডেট তো ফাইনাল করতে হবে তাই না?
-জি, নিশ্চয়ই। আজ আসি তাহলে।
একে একে বের হয়ে গেলো ফায়েজের বাবা-মা, ফাহিম। বাকি রইলো ফায়েজ, ওর এসিস্ট্যান্ট জব্বার এবং ওর দু’জন দেহরক্ষী।
ফায়েজকে দেখে খেয়া অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। ফায়েজ তা দেখে না দেখা করে ভান করে খেয়ার বাবা-মাকে সালাম দিয়ে বের হয়ে যাবে এমন সময় খেয়ার মা ফায়েজকে ডাক দেয়। ফায়েজ পিছনে ফিরে এসে বললো,
-কিছু বলবেন, চাচী?
-আসলে বাবা তোমার চাচা তো আর কিছুসময় এই পার্টিতে উপস্থিত থাকা লাগবে। কিন্তু, খেয়া এখানে থাকতে চাইছে না আর আমিও তোমার চাচাকে ছেড়ে কিভাবে চলে যাই! বুঝতেই পারছো লোকে কি বলবে? তাই বলছিলাম কি তুমি যদি খেয়াকে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে।
খেয়া চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে ওর মায়ের দিকে। ফায়েজ খেয়ার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে খেয়ার মা’কে বলে,
-যদি খেয়া রাজি থাকে তবে ওকে আমি পৌঁছে দিয়ে আসতে পারবো।
খেয়ার মা খেয়ার দিকে তাকাতেই খেয়া চোখের ইশারায় ওর মাকে বোঝাতে চাইছে সে যাবে না ফায়েজের সাথে। কিন্তু কে শুনে কার কথা খেয়ার মা মেয়েকে একপ্রকার জোর করে বলে,
-তুই চলে যা ফায়েজের সাথে। তোর দাদি বাড়িতে একা তুই ভুলে গেছিস? তাছাড়া, তুই এখানে থাকলে লোকজন বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন করবে, তুই যদি দিতে সব লোকের উত্তর দিতে পারিস তবে থাক।
কি আর করার উপায়ন্তর না পেয়ে অগত্যা খেয়াকে রাজি হতে হলো ফায়েজের সঙ্গে যাওয়ার জন্য।
এদিকে, ফায়েজ জব্বারকে এবং তার দুই দেহরক্ষীকে বিদায় করে দিয়েছে।
অবশেষে, খেয়া আর ফায়েজ খেয়ার বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একসাথে বের হয়ে এলো ক্লাব থেকে।
পার্কিং প্লেসে গিয়ে কারের একপাশের ডোর খুলে দিয়ে খেয়াকে ইশারা করলো ফায়েজ । খেয়া উঠে বসতেই ফায়েজ ঘুরে এসে ড্রাইভিং সিটে বসে কার স্টার্ট দিলো।
বেশ কিছুদূর আসার পর ফায়েজ আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখলো খেয়া উইন্ডো দিয়ে রাতের শহরের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়েজ কিছুটা হলেও আজ খেয়ার প্রতি অনেকটাই ঋনী।
এমন সময় খেয়ার কিছু কথায় ফায়েজ বাধ্য হলো কার মাঝপথে থামিয়ে দিতে। ফায়েজকে আচমকা গাড়ি বন্ধ করতে দেখে খেয়া চটে গেলো।
-মাঝপথে গাড়ি বন্ধ করেছেন কেন নায়ক সাহেব?
-আপনি, কিসব বলছেন খেয়া?
-আমি তো ভালো কথা বললাম। ঠিকই তো আজ আংটি পরিয়েছেন বলে, হুটহাট আমার মোবাইলে কল দিবেন না। কারণ, আমি পড়াশোনায় ভীষণ ব্যস্ত সময় পাড় করি। নায়কদের সাথে আমার কথা বলার সময় নেই। আপনি গিয়ে আপনার ওই নায়িকাদের সাথে ঢলাঢলি করবেন আমি একবার আপনার জীবনে কি করছেন তা নিয়ে টু শব্দ করবো না।
-আচ্ছা খেয়া নায়করা কি সত্যিই অনেক খারাপ হয়?
ফায়েজের কাছ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে খেয়া হাসিমুখ করে বলে উঠে,
-আপনার থেকে ভালো এই প্রশ্নের উত্তর কে জানে! আপনি বলুন নায়করা কি ভালো? তারা ঠিক কখন সত্য বলে কখন মিথ্যে বলে তা ধরা এবং বোঝা অনেক কঠিন। তাদের রিল লাইফের অভিনয় রিয়েল লাইফে কেচ করা অনেক কঠিন ব্যাপার।
আমরা সাধারণ মানুষ চাইলেও নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছে নিজেদের ভালোলাগার কথা খুব ভালো করে প্রকাশ করতে পারি না, বলতে পারি না তোমাকে ছাড়া আমার এক মূহুর্ত চলবে না। অথচ, আপনারা নায়ক-নায়িকারা একঝটকায় কারো কোমড় জরিয়ে খুব অশালিন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে খুব সহজে ভালোবাসার কথা জাহির করতে পারেন। কন্ঠস্বর একটিবারের জন্যেও কেঁপে উঠে না কত সাবলীল সেই ব্যক্ত!
“যেদিন আপনি সত্যিকারের কাউকে ভালোবাসবেন ঠিক সেদিন আপনি বুঝবেন কাউকে হুট করে ভালোবাসা গেলেও ভালোবাসি কথাটা বলা যায় না”
কারণ, এই অনুভূতি গড গিফট, অনেক দামি অনুভূতি, যা চাইলেও হুট করে কারো প্রতি জন্মায় না, আর যে কাউকে বলা যায় না।
ফায়েজ এতসময় ধরে খেয়ার সব কথা শোনার পর বলে,
– এখন মনে হচ্ছে আমার মানসম্মান,ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে গেলে বরং ভালো হতো। বরং আপনার এই কাটা কাটা কথা থেকে তো মুক্তি পেতাম। আপনি তো সবাইকে একপাল্লায় মাপতে গিয়ে আমাকে বারবার আপনার কথার সুঁইয়ের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করো দিচ্ছেন।
খেয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ফায়েজের দিকে। ফায়েজ আর কোনেদিকে না তাকিয়ে কার স্টার্ট দিলো।
ফায়েজের অন্তর্দেহ থেকে শুধু একটি বাক্য প্রতিধ্বনি হচ্ছে,
“আপনার সাথে আমার দেখা না হলে বরং ভালো হতো খেয়া”
এই রকম আরো সুন্দর সুন্দর গল্প পড়তে চাইলে পেইজে লাইক দিয়ে সাথে থাকুন।
#চলবে