#মন_ময়ূরী
#Tahmina_Akther
১৫.
সারারাত গল্পগুজব করে শেষ রাতে নিজের ঘরে এসে ঘুমন্ত ফায়েজের পাশে ঘুমিয়ে পড়ে খেয়া।
ফায়েজ খুব সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে। ঘুম থেকে জাগার পর ফায়েজের মনে হলো ওর পাশে কেউ আছে! পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে খেয়া অঘোর ঘুমিয়ে আছে।
ফায়েজের মুখে হাসি ফুটে উঠে,আজ প্রথমবার ফায়েজের মনে হলো আজকের মতো দিনের শুরু আর কোনোদিন হয়নি। ঘুম থেকে জেগে ভালোবাসার মানুষের মুখটা দেখলে বুঝি মনটা আনন্দে ভরে উঠে।
ফায়েজ কি মনে করে বালিশের পাশ থেকে ওর মোবাইল নিয়ে ঘুমন্ত খেয়ার সাথে নিজের একটা সেলফি তুলে নিলো।
এরপর, ধীরপায়ে খাট থেকে নেমে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে তৈরি হয়ে নিলো ওদের বাড়িতে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
ঘর ছেড়ে বের হবার আগমুহূর্তে আরও একবার খেয়াকে খুব ভালো করে দেখে নিচ্ছে ফায়েজ। কিন্তু, যতই দেখছে মনে হচ্ছে সে এই ঘর ছেড়ে বের হবার আগে খেয়ার চেহারা ভুলে যাবে। এখন তো ফায়েজের মনে একটি কথা চলছে,
“ইশশ্,কাউকে মন ভরে দেখার জন্য হৃদয়ে একটা দরজা রাখা উচিত ছিল, যখনি মন চাইতো দরজা খুলে মনের আয়নায় দেখা যেতো প্রিয় মানুষের মুখ”
অবশেষে, বের হতে সক্ষম হলো ফায়েজ যদি খেয়া ঘুম থেকে জেগে উঠে তবে নানান ধরনের প্রশ্ন করবে তারচেয়ে ভালো এখনই চলে যাওয়া ঠিক হবে।
খেয়ার বাবা কবির খাঁনকে গতকাল রিসিপশন অনুষ্ঠানে ফায়েজ বলে রেখেছিল, কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য ও বেশিদিন খাঁন বাড়িতে থাকতে পারবে না। সকাল হলেই ও চলে যাবে।
ফায়েজ নিচে আসতেই দেখে ওর শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি দুজন ড্রইংরুমে বসে আছে আর ফাহিম, আব্দুল জব্বার দাঁড়িয়ে আছে হয়তো ফায়েজের অপেক্ষায়।
-বাবা,আসি তাহলে।আপনাদের প্রতি খেয়াল রাখবেন এবং খেয়ার প্রতিও।
ফায়েজ খেয়ার বাবার সামনে গিয়ে বলে। খেয়ার বাবা উঠে দাঁড়ালো এরপর ফায়েজের কাঁধে হাত রেখে বলে,
-খেয়াকে না জানিয়ে তোমার চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? যদি ও তোমার সাথে আরও বেশি রাগ করে?
-বরং, ওকে বলে গেলে নানান ধরনের প্রশ্ন করবে। তাছাড়া, হুট করে বিয়ে হয়ে যাওয়াতে খেয়াকে কিছুটা ডিপ্রেসড লাগছে। আশা করছি আমার অনুপস্থিতিতে ও কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারবে।
খেয়ার বাবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলো না। খেয়ার মা’কে বিদায় জানিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো ফায়েজ,ফাহিম আর আব্দুল জব্বার।
-ভাইয়া, তোমার ফ্লাইট কখন? ফাহিম প্রশ্ন করলো।
-দুপুর ১২টায়। এখন বাড়িতে চল বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে হবে আর কিছু জামা-কাপড় নিতে হবে।
-ঠিক আছে,ভাইয়া।
ফায়েজ আনমনে বাইরে দিকে তাকিয়ে রইলো। চলন্ত গাড়ি থেকে বাইরের দিকে তাকালে, দেখা যায় ঠিক কতটা পিছনে ফেলে কত দ্রুত সামনের দিলে এগিয়ে যাচ্ছি।
চৌধুরি বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালো ফায়েজদের গাড়ি।গাড়ি থেকে সবার আগে নেমে বাড়ির ভিতরে চলে গেলো ফায়েজ। ওর বাবা-মায়ের সাথে দেখা না করে সর্বপ্রথম ওর ঘরে চলে গেলো।
ট্রলিব্যাগ গুছিয়ে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে নিচে যেতেই দেখলো, ওর মাহমুদ চৌধুরী বসে টিভিতে সংবাদ দেখছেন।ফায়েজ এগিয়ে গেলো ওর বাবার কাছে, ছেলের উপস্থিতি পেয়ে কিছুটা ভ্রু-কুঁচকে বলে ফেললেন,
-কি ব্যাপার, কাল শ্বশুর বাড়িতে যেয়ে আজই চলে এলে!খেয়া কোথায়?
-খেয়া ওদের বাড়িতে আছে। আসলে,গানের শুটিংয়ের জন্য আজ আমাকে কিছুদিনের জন্য ইন্ডিয়ায় যেতে হবে।
-কিন্তু, তোমার ইন্ডিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল আরও মাসখানেক পর। হুট করে আজই কেন?নতুন বৌ দেশে রেখে বাইরে যাওয়াটা কতটা দৃষ্টিকটু এটা তুমি জানোই না ফায়েজ।
-আ’ম সরি বাবা। কিন্তু, আমাকে যেতেই হবে। তাছাড়া, খেয়া অতন্ত বুদ্ধিমতি মেয়ে ও আমার সমস্যা ঠিক বুঝতে পারবে। আমি এখন বের হয়ে যাবো সাড়ে দশটা বাজতে চললো।
-ঠিক আছে। রেহনুমা…
-জী,
রান্নাঘর থেকে বের হতে হতে ডাকের সাড়া দিলেন ফায়েজের মা।
-তোমার ছেলে ফায়েজ আজ ইন্ডিয়ায় যাচ্ছে তাকে দোয়া পড়ে ফুঁক দিয়ে দাও।
রেহনুমা প্রায় অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। ফায়েজ এগিয়ে গিয়ে ওর মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো,
-মা, রাগ করো না হুট করে যেতে হচ্ছে। তুমি নিজের দিকে খেয়াল রেখো সাথে বাবার খেয়ালও রেখো।
-কিন্তু, খেয়া?
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো রেহনুমা।
-ও জানে না এবং তুমিও খেয়াকে জানাবে না। আমি আসছি, ভালো থেকো।
ফায়েজ তার মায়ের কপালে চুমু দিয়ে বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ট্রলিব্যাগ সাথে করে বের হয়ে যাচ্ছে।
ফায়েজ কারের সামনে আসতে দেখে আব্দুল জব্বার এগিয়ে এসে ব্যাগটা নিয়ে নিলো ফায়েজের হাত থেকে। ফায়েজ কারে উঠে বসলো। ব্যাগ গাড়ির পেছনে রেখে আব্দুল জব্বার কারে উঠে বসতেই ড্রাইভার কার স্টার্ট করলো।
আব্দুল জব্বার সকাল থেকে খেয়াল করছে যে,তার স্যারের মনটা ভীষণ খারাপ। নয়তো তার এত সুন্দর স্যারের ফর্সা মুখটা এমন অন্ধকার হয়ে আছে কেন?হুট করে আব্দুল জব্বারের কিছু মনে পড়লো।ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করে কিছু একটা বের করে ফায়েজকে বললো,
-স্যার, আপনাদের রিসিপশনের ছবিগুলো ফটোগ্রাফার ইমেইল করে দিয়েছে। দেখুন না আপনাদের কত সুন্দর লাগছে!পাকিস্তানী একটা ড্রামা আছে না স্যার, খোদা অর মোহাব্বতের নায়ক-নায়িকা ফরহাদ আর মাহির মতো দেখাচ্ছে আপনাকে আর ভাবিকে।
একের পর এক ছবি ফায়েজকে দেখাতে দেখতে বলছে আব্দুল জব্বার।
ফায়েজ আনমনে আব্দুল জব্বারকে বলে উঠে,
-আচ্ছা, মাহির মতোই কি খেয়া আমার ভালোবাসা বুঝতে খুব দেরি করে ফেলবে? আর আমি খেয়া অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ফরহাদের মতো একদিন এই পৃথিবীতে বিলীন হয়ে যাবো।
কথাগুলো বলবার সময় ফায়েজের কন্ঠ কেঁপে উঠছিল বারবার।
আব্দুল জব্বারের দুচোখ ভারি হয়ে যাচ্ছে তার স্যারের কথা শুনে। এখন তো আব্দুল জব্বারের মনে হচ্ছে ভাবির সাথে স্যারের দেখা না হলে বরং ভালো হতো। তার স্যার অন্তত হাসিখুশি থাকতো। কে যে বলে ভালোবাসা ভালো, তারে পাইলে আব্দুল জব্বার পঁচা ডিম ছুঁড়ে মারতো!
ফায়েজের মন রক্ষার্থে আব্দুল জব্বার বলে উঠলো,
-স্যার, কি যে বলেন আপনি? আমার মাথায় যতগুলো চুল আছে ঠিক ততগুলো দিন যেন আল্লাহ আপনাকে হায়াত হিসেবে দান করে।
-এবার মনে করো আমার হায়াত শেষ। তোমার মাথায় কি চুল আছে আব্দুল জব্বার?
-স্যার, কি যে বলেন?মাথার তালুতে না-হয় চুল নাই কিন্তু ঘাড়ে তো আছে। ঘাড়ে যে ক’টা আছে সেগুলো আপনার চলবে।
ফায়েজ হেঁসে ফেললো আব্দুল জব্বারের কথা শুনে।এয়ারপোর্টের সামনে এসে ফায়েজের কার থেমে গেলো।ধীরপায়ে কার থেকে নেমে আসলো ফায়েজ আর আব্দুল জব্বার।
ইমিগ্রেশন পার করার আগে কে যেন ফায়েজকে ডাক দিলো, ঠিক এমনটা মনে হচ্ছে ফায়েজের। কিন্তু, না আশেপাশে তাকিয়ে পরিচিত কাউকে দেখতে পেলো না। তাছাড়া, মাথায় টুপি দিয়ে, মুখে মাস্ক পড়ার কারনে ফায়েজকে এত সহজে চিনতে পাড়ার কথা না।
-নায়ক সাহেব নিজের স্ত্রীকে না বলে নায়িকাদের নিয়ে বিদেশ ঘুরতে যাওয়া হচ্ছে আপনার, তাই না?
ফায়েজ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো খেয়া এসেছে সাথে ফাহিমকে দেখা যাচ্ছে। ফায়েজ এগিয়ে এসে খেয়াকে বললো,
-আরে আস্তে বলো নয়তো পাব্লিক এসে আমার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আর তোমাকে কে খবর দিয়েছে, ফাহিম?
-তো আর কে দিবে?আপনি কতটা নিষ্ঠুর জানেন! আমাকে ঘুমে রেখে আপনি চলে এলেন ভালো কথা। কিন্তু, বিদেশ-বিভুঁইয়ে যাচ্ছেন আমাকে না বলে। এইজন্যই, বলেছিলাম নায়ককে বিয়ে করবো না। এরা ঘরে বৌ রেখে নায়িকাদের নিয়ে পাহাড় আর মেঘ দেখতে যায়।
-তুমি তো গতকাল বললে, আমার সাথে কোথাও যাবে না।
-বলেছি আর এখনও বলছি আপনার সাথে আমি কোথাও যাবো না। আমার দশটা না পাঁচটা না একমাত্র স্বামী বিদেশ যাচ্ছে তাই বিদায় দিতে চলে এলাম।আপনি তো আর আমাকে বলে যাবেন না কিন্তু আমি তো আর আপনাকে বিদায় না জানাতে পারলে ভালো লাগবে না তাই এসেছি।
এবার আপনি যান, ভালো করে শুটিং করুন নায়িকাদের নিয়ে।
-খেয়া,আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি?
-কেন জড়িয়ে ধরবেন আমায়? নাকি আজ নায়িকারা সাথে নেই বলে আমাকে জড়িয়ে ধরবেন?
বলেই ফায়েজকে জড়িয়ে ধরলো খেয়া। এইপ্রথম তাদের আলিঙ্গন। ফায়েজ ভেবেছিল খেয়া রাজি হবে না কিন্তু খেয়ার অভাবনীয় কান্ডতে ফায়েজের পুরো শরীর কাঁপছে।
খেয়া ফায়েজের কাঁপাকাঁপি দেখে ফায়েজকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
-বাবাহ্,আপনার তো কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গিয়েছে। জ্বর এলো নাকি?
বলেই খেয়া ফায়েজের কপালে হাত দিয়ে দেখলো।
-নাহ, জ্বর তো আসেনি। তারমানে, আমার স্পর্শে গন্ডগোল আছে।
ফায়েজ খেয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে খেয়াকে আরও একবার জড়িয়ে ধরে বললো,
-খেয়া, আপনার কথাই সত্য। আপনার স্পর্শে গন্ডগোল আছে। আপনার স্পর্শে আমার গা কাঁপছে। এত মিষ্টি আদরে আমার গা কাঁপাকাঁপি আজন্ম চলতে থাকুক।
খেয়া ফায়েজের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বললো,
-হয়েছে, এত কিছু বলার দরকার নেই। আমি জানি আপনি কোনো সিনেমার সংলাপ আমায় শোনাচ্ছেন।ভালো থাকবেন আসছি আমি আর হ্যা ওখানে গিয়ে আমাকে বারবার কল করবেন না আমি পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকবো।
এতটুকু বলে খেয়া এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে গেলো। ফায়েজ জানে এগুলো খেয়ার মনের কথা নয়। খেয়া বড্ড হিংসুটে একটা মেয়ে, তার স্বামীকে অন্যকেউ অভিনয়ের ছলে ধরবে এটা তার কাছে নিন্দনীয়।
সারারাস্তায় খেয়া কান্না করতে করতেই গেলো।খেয়ার কান্নার সাক্ষী হলো ফাহিম। ফাহিম মনে মনে বললো,
-কান্না কি অপছন্দের মানুষের জন্য চোখ থেকে
বর্ষিত হয়?
#চলবে
পরের পর্ব পড়তে পেইজে লাইক দিয়ে সাথে থাকুন।