প্রেমাতাল পর্ব ৩৯

0
1999

প্রেমাতাল
পর্ব ৩৯
মৌরি মরিয়ম

-“উফ, এবার নামাও। আমি টায়ার্ড হয়ে গিয়েছি।”
কোনমতে হাসি থামিয়ে তিতির একথা বলল। মুগ্ধ ওকে তালগাছ থেকে নামিয়ে ওভাবেই পা ভাজ করলো। তিতির সেই ভাজ করা পায়ে হেলান দিয়ে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-“তালগাছে উঠালে তুমি আর টায়ার্ড হলাম আমি।”
-“স্বাভাবিক, কারন তুমি অতিরিক্ত হেসেছো।”
তিতির বলল,
-“গরম লাগছে।”
-“হ্যা, এসি রুম হলে ভাল হতো কিন্তু শুধু নন-এসিগুলোই খালি ছিল। ইশ, তোমার কষ্ট হচ্ছে না?”
-“আমার বাপের বাড়িতে এসি নেই যে এসি ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।”
একথা শুনে মুগ্ধ হাসলো। বলল,
-“গরম কিন্তু কাপলদের জন্য অনেক ভাল।”
-“কিভাবে?”
-“জানোনা?”
-“কোনটার কথা বলছো?”
-“বসন্ত প্রেমের ঋতু, আর গ্রীষ্ম ?”
-“ঘুমের?”
-“নাহ, বসন্ত প্রেমের ঋতু, আর গ্রীষ্ম কামের।”
তিতির লজ্জা পেয়ে বলল,
-“ধ্যাত।”
-“সিরিয়াসলি, এটা তুমি জানোনা?”
-“শুনেছি, কিন্তু এটা একটা ফালতু কথা।”
-“মোটেও না, এটা সত্যি। দেখোনা গরমের দিনেই মানুষের বাচ্চাকাচ্চা বেশি হয়। আগের বছর গরম থেকে প্রসেসিং শুরু হয়তো।”
তিতির মুগ্ধকে মারতে লাগলো। মুগ্ধ বলল,
-“আমাকে মেরে কি লাভ? সত্যি বলছি। আমাদের দেশের জনসংখ্যা এত বেশি কেন বোঝোনা? একমাসও তো ঠিককরে শীত পড়ে না। অলমোস্ট সারাবছরই গরম।”
যখন খোঁপা করছিল তখন মুগ্ধ হা করে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধ প্রায়ই এভাবে তাকিয়ে থাকে তাই তিতির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। মুগ্ধ বলল,
-“তিতির তোমাকে একটা কথা কখনো বলা হয়নি।”
-“কি?”
-“যখন তুমি খোঁপা করতে থাকো আমার তোমাকে দেখতে খুব ভাল লাগে।”
-“এটা কিকরে ভাললাগার মত কিছু হতে পারে?”
-“আমার ভাল লাগে। মনে আছে রেমাক্রিতে তোমাকে যখন মেঘ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম তখন তুমি খোঁপা করতে করতে কটেজ থেকে বেড়িয়ে এসেছিলে?”
-“কি জানি হতে পারে। খেয়াল নেই।”
-“হুম, সেই দৃশ্য দেখে আমার বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা লেগেছিল। অন্যরকম সুন্দর লাগে যখন তুমি খোঁপা করতে থাকো।”
-“তুমি না বলেছিলে আমাকে খোলা চুলে ভাল লাগে? আর আমারও তো মনে হয় আমকে খোলা চুলেই ভাল লাগে।”
-“তুমি আমার কথাটা ধরতে পারোনি, খোঁপা করা অবস্থায় ভাল লাগে সেটা বলিনি। চুলগুলো দুহাতে নিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খোঁপা করে হাত নামিয়ে আনা পর্যন্ত এই সময়টা খুব ভাল লাগে।”
-“ওহ। তোমার চোখ আছে বলতে হবে। তোমার মত করে যদি দুনিয়ার সব ছেলেরা তাদের গার্লফ্রেন্ড দের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতো তাহলে ঘরে ঘরে এত অশান্তি হত না।”
মুগ্ধ তিতিরের একটা হাত ধরে হাটতা কাছে নিয়ে আসলো। তারপর হাতের উল্টোপিঠে চুমু দিয়ে বলল,
-“সব মেয়েরা যদি তোমার মত করে তাদের বয়ফ্রেন্ডদের রেসপেক্ট করতো তাহলে ছেলেরাও মুগ্ধ হয়ে তাদের গার্লফ্রেন্ডদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতো।”
তিতির হেসে বলল,
-“আচ্ছা বাদ দাও, একটা কথা শোনোনা?”
-“কি?”
-“এখানে কি মহুয়া পাওয়া যায়? খেতে ইচ্ছে করছে।”
-“অসম্ভব। ওই জিনিস আমি তোমাকে আরর জীবনে খেতে দেব না। মাতাল হয়ে যাও তুমি। যাদের কন্ট্রোল নেই তাদের খাওয়ার অধিকারও নেই।”
-“নাহয় একদিন একটু হলাম কন্ট্রোললেস!”
-“নো নো। এই ভুল আমি আর করতে লাগিনি।”
তিতির মুগ্ধর হাত ধরে বলল,
-“প্লিজ প্লিজ, একটুখানি খাব।”
-“না, আর এখানে ওসব পাওয়াও যায়না। আর পাওয়া গেলেও আনতাম না।”
তিতির মন খারাপ করে ফেলল। মুগ্ধ বলল,
-“রাগ করে লাভ নেই। সত্যি এখানে ওসব পাওয়া যায়না। আর গেলেও কোথায় পাওয়া যায় আমি জানিনা।”
-“আচ্ছা ঠিকাছে। রাগ করিনি তবে ওরকম কিছু হলে ভালই হতো।”
-“হুম। আমার পাগলপ্রায় অবস্থা হতো আর কি!”
-“আচ্ছা, আমাকে একটা কথা বলো না?”
-“কি”
অন্য কারো সাথে যখন বিয়ে হবে তখন কি করবে না করবে সে ব্যাপারে যে এত নিষেধাজ্ঞা দিলাম, তুমি আমাকে কোন নিষেধাজ্ঞা দেবে না?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“হ্যা একটা নিষেধাজ্ঞা আছে।”
-“কি?”
-“তুমি কারো সামনে কখনো লজ্জা পেও না।”
তিতির চোখ নামিয়ে হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-“লজ্জা পেলে তোমাকে অন্যরকম সুন্দর লাগে, লোভ হয়। চাইনা সেই লোভটা আর কারো হোক।”
-“তুমি একটা পাগল।”
-“অবশ্য এটাও ঠিক যে তুমি আমার সামনে যত লজ্জা পাও পৃথিবীর অন্য কোন ছেলের সামনে ততটা পাবে না।”
-“কিভাবে বুঝলে?”
-“মেয়েরা যার সামনে যত বেশি লজ্জা পাবে বুঝতে হবে তাকে তত বেশি ভালবাসে। তুমি আমার থেকে বেশি করে কাউকেই ভালবাসতে পারবে না। জানি সেটা।”
তিতির আর কোন কথা না বলে মুগ্ধর বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। অনেক চেষ্টা করেও কান্না আটকাতে পারলো না ও। কেঁদেই ফেলল। ওর চোখের পানি মুগ্ধর বুকে পড়তেই মুগ্ধ বলল,
-“তিতিরপাখি, কাঁদছ কেন?”
-“আমাদের দুজনের কারো ভালবাসায়ই তো কোন খাঁদ নেই। তো আমরা কেন দুজন দুজনকে পাবো না, বলো? কি ভুল করেছি আমরা?”
মুগ্ধ তিতিরের চোখ মুছে দিয়ে বলল,
-“আমার বাঁ পাঁজরের হাড় দিয়ে বোধহয় আল্লাহ তোমাকে বানায়নি। অথচ আমরা ভালবেসে ফেলেছি। ভুলটা আমাদের এখানেই।”
-“তাহলে তোমার জন্য আমার বুকটা কেন এত পোড়ে?”
-“ভালবাসো যে।”
তিতিরের কান্না থামলো না। বলল,
-“আমি মানি না এসব। আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবো না। আর তোমাকেও অন্য কারো হতে দেব না। কেউ তোমাকে বিয়ে করতে আসলে খুন করে ফেলবো আমি তাকে।”
মুগ্ধ তিতিরকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখলো কিছুক্ষণ। তারপর তিতিরের মুখটা ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“কান্না থামাও, আমার কথা শোনো।”
তিতির কান্নাটাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো। মুগ্ধ বলল,
-“হয়তো জীবনে এরকম সময় আমরা আর পাব না। এভাবে কান্নাকাটি করে এত মধুর সময়কে বিধুর করার কোন মানে হয়?”
তিতির চুপ। মুগ্ধ আবার বলল,
-“শোনো, আমরা যে দুদিন এখানে আছি, কান্নাকাটি তো দূরের কথা। একবার মনও খারাপ করবে না। চলোনা স্বপ্নের মত করে কাটাই এই দুটো দিন।”
-“আচ্ছা, ঠিকাছে।”
ঠিকাছে বলেও তিতির কাঁদতে লাগলো। মুগ্ধ একটু সময় দিল তাই আর কিছু বলল না। ওকে জড়িয়ে ধরে রইলো শুধু।
কাঁদতে কাঁদতে তিতির কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। মুগ্ধ ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে পড়লো। বাসায় কল করে মায়ের সাথে কথা বলে নিল। কতক্ষণ টিভি দেখলো, নিউজপেপার পড়লো। ঘুমানোর চেষ্টা করলো ঘুমও আসছে না। ঘুম যখন আসছেই না এক কাপ কফি খাওয়া যায়। একটা কফির অর্ডার করে কফিও খেয়ে নিল। সময়ই কাটছে না। আসলে তিতির ঘুমিয়ে আছে বলে ওর মনে হচ্ছে ওর পৃথিবীটাই ঘুমিয়ে আছে। ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান ছিল তিতিরের জন্য প্রথমে ভেবেছিল আজই সারপ্রাইজটা দিয়ে দেবে। পরে যখন তিতির আগামীকালও থাকার পারমিশন নিল তখন ঠিক করলো কাল দেবে। কিন্তু এখন তো ইচ্ছে করছে ওকে ঘুম থেকে উঠিয়ে আজই দিতে। নাকি কালই দেবে? দোনোমনা করতে লাগলো। তিতির ঘুমিয়ে থাকলেই তো আরেঞ্জমেণ্টটা সহজ হবে। কাল যদি না ঘুমায়?”
-“তিতির? এই তিতির? ওঠোনা প্লিজ। কতক্ষণ ধরে ডাকছি বলোতো?”
-“উম্মম্মম্ম, আম্মি ঘুম্মাই।”
-“জানি তো, একটু পর আবার ঘুমাবে। আমিও ঘুমাবো। কিন্তু এখন একটু চোখ মেলে তাকাও।”
তিতির ঘুমের ঘোরেই তাকালো। বলল,
-“কি?”
-“কোলে উঠবে?”
-“হুম”
মুগ্ধ এতক্ষণ বিছানার পাশে বসে ছিল। এবার উঠে দাঁড়ালো। তিতির তাকিয়ে ছিল মুগ্ধর দিকে। ঘুমে জড়ানো কন্ঠে বলল,
-“তোমার বুকটা এত সুন্দর কেন? দেখলেই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।”
মুগ্ধ বলল,
-“হুম, আমারও। এবার উঠেন আপনি।”
-“তোমারও মানে? তুমি কিভাবে তোমার বুক খাবে? তোমার গলা কি এতটা ফোল্ড হয়? তারচেয়ে আমাকে খেতে দিলেই ভাল হতো।”
তিতিরের ঘুমের ঘোর কাটেনি। মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আচ্ছা, তো বুকে আসো।”
তিতির লাফিয়ে উঠে মুগ্ধর বুকে ঝপিয়ে পড়লো। মুগ্ধ ওকে কোলে নিতেই ওর খেয়াল হলো ঘরের লাইট বন্ধ। আর সারাঘরে অসংখ্য মোমবাতি জ্বলছে। মোহময় পরিবেশ। তিতিরের মুখ দিয়ে অজান্তেই বেড়িয়ে গেল,
-“ওয়াও।”
মুগ্ধ তিতিরকে কোলে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাড়ালো। ড্রেসিং টেবিলের উপরেও দুটো মোম জ্বালানো ছিল। মুগ্ধ ওকে কোল থেকে নামিয়ে দু’চোখের উপর চুমু দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। তিতিরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তারপর মুগ্ধ ওকে আয়নার দিকে মুখ করে দাঁড় করালো। বলল,
-“চোখ খুলবে না।”
তিতির আদুরে কন্ঠে বলল,
-“আচ্ছা।”
হঠাৎ গলায় কিছুর স্পর্শ অনুভব করতেই চোখ মেলে তাকালো তিতির। মুগ্ধ ওকে একটা নেকলেস পড়িয়ে দিচ্ছে। শাড়ির সাথে ম্যাচিং হালকা একটা নেকলেস। তারপর মুগ্ধ পেছন থেকে তিতিরের কোমর জড়িয়ে ধরে দুষ্টু হাসি একটা মুখে লাগিয়ে তাকিয়ে রইল আয়নায়। তিতিরের একে তো চোখে ঘুম তার উপর মোমের আলোয় নিজেদেরকে আয়নায় দেখতেও বেশ লাগছিল। আবেগে আর কথা বলতে পারছিল না ও। মুগ্ধ তিতিরের ঘাড়ের উপর থেকে চুল সরিয়ে একটা চুমু খেল। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে একটা চুমু দিয়ে বলল,
-“আই লাভ ইউ।”
তিতির শুধু মাথাটা মুগ্ধর দিকে ফিরিয়ে বলল,
-“আই লাভ ইউ টু।”
তারপর মুগ্ধ পেছন থেকেই তিতিরের গালে হাত রেখে ওর ঠোঁটে চুমু খেতে লাগলো। তিতিরের প্রায়ই যেটা মনে হয় সেটাই মনে হচ্ছিল তখন। ইশ, এখনি যদি ওরা মরে যেত!

To be continued…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here