কনফিউশন পর্ব ৪

0
867

#কনফিউশন
#লেখকঃ_মৌরি_মরিয়ম
পর্ব ৪

এডমিশন কোচিং এ আজ পরীক্ষা। তিরা ও আরশি দুইবোন রাতজেগে পড়েছে তাই বেলা করে ঘুমুচ্ছিলো। কাজের বুয়া আসায় আবার উঠতে হলো আরশিকে। সব কাজ একে বলে বলে করাতে হয়। নাহলে দেখা যায় ঠিকভাবে করেনি। তিরা এখনো ঘুমে। আরশিরও ঘুম ঘুম লাগছে। ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে সোফায় গা এলিয়ে দিল। এমন সময় কলিং বেল বাজলো। আরশি বারান্দায় গিয়ে কাউকে গেটের সামনে দেখতে পেলো না। ভেতরে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কে?”
“আমি কাব্য।”
“একটু দাঁড়ান।”
আরশি ঘরে গিয়ে তিরাকে ডাকলো,
“তিরা এই তিরা তাড়াতাড়ি ওঠ। তোর কালা চণ্ডীদাস এসেছে।”
তিরা ঘুমে ভরা চোখ মেলে বলল,
“কে এসেছে?”
“তোর কাব্য। তাড়াতাড়ি ওঠ।”
তিরা লাফিয়ে উঠলো।
“এই অবস্থায় ওর সামনে যাব কী করে! হায় খোদা!”
“তুই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি দরজা খুলি।”
“বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস? তাড়াতাড়ি যা দরজা খুলে ওকে বসা।”
তিরা উঠে যতদ্রুত সম্ভব মুখ ধুয়ে, কাপড় পালটে কাজল ও লিপস্টিকে হালকা সাজগোজ করতে লাগলো।
ততক্ষণে আরশি গিয়ে দরজা খুলেছে। আরশির এলোমেলো চুল হাত খোঁপায় বাঁধা। কোঁচকানো জামা পড়া। ওড়নার কোণা মেঝে অবধি ঝুলছে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা তেলতেলে ফরসা মুখের বিষন্ন চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আছে। এই সবকিছু আচমকাই কাব্যর চোখে স্থিরচিত্র হয়ে আটকে গেলো। আরশি যেন নিজ ঘরের কেউ যাকে ঘুম থেকে উঠে দেখলেই প্রশান্তিতে ভরে যায় বুক। আরশির কথায় মোহভঙ্গ হলো কাব্যর,
“ভেতরে আসুন।”
ভেতরে গেলেই হয়তো তিরার সামনে পড়তে হবে তাই কাব্য বলল,
“না না আমি এখানেই ঠিক আছি। আমি আসলে একটা দরকারে এসেছিলাম।”
“দরকারের কথা কি ভেতরে এসে বলা যায় না?”
কাব্য কিছু বলার আগেই আরশির পেছনে এসে হাজির হলো তিরা। বললো,
“হাই কাব্য ভেতরে এসো না। বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবে কেন?”
প্রতিদিন কথা না হলেও তিরা এতদিনে ফেসবুক চ্যাটিং এ কাব্যর থেকে তুমি বলা আদায় করে নিয়েছে। কাব্য খুব সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ভেতরে ঢুকলো। কাব্য ও তিরা ড্রয়িং রুমে বসলো, আরশি ভেতরে চলে গেলো। তিরা বললো,
“বলো না কী বলবে।”
“আসলে আমার কাজের লোক দরকার ছিল। ঘর পরিস্কার রাখাটা বড়ই ভেজালের কাজ। তোমাদের বুয়া কি আমার কিছু কাজ করে দেবে? আর করলে কত করে দিতে হবে এইসব জানতে এসেছিলাম।”
“ওহ বাট আই হ্যাভ নো আইডিয়া। আসলে এসব তো ভাবীর ডিপার্টমেন্ট। যেহেতু ভাবী এখন নেই সবকিছু আরশি সামলায়। দাঁড়াও ওকে ডাকি।”
তিরা আরশিকে ডাকতে রান্নাঘরে আসতেই আরশি বললো,
“তিরা ওনার চা নাস্তাটা নিয়ে যা। প্রথমবার আমাদের বাসায় এলো একদম খালি মুখে গেলে কেমন দেখায়।”
“তুই যখন যাচ্ছিস তুই নিয়ে যা না প্লিজ।”
“আমি কেন যাব? পুরো ড্রয়িংরুম সিগারেটের গন্ধে ভরে গেছে। তুই নিয়ে যা।”
তিরা হেসে বললো,
“কিন্তু তোকে যে যেতে হবে। কাব্য সাহায্য চাইতে এসেছে, যে সাহায্য আমার পক্ষে করা সম্ভব না।”
আরশি বিরক্ত মুখে চা নাস্তা নিয়ে ড্রয়িং রুমে গেলো। কাব্য বলল,
“আরে এসব কেন? আমি জাস্ট একটা দরকারে এসেছিলাম।”
আরশি কিছু বললো না। তিরা বললো,
“আরে এটা কি চা? এটা অমৃত! আরশির হাতের চা, খাও খাও নাহয় জীবনের সবচেয়ে বড় মিসটা করে ফেলবে।”
একথা বলে তিরা নিজের কাপটা তুলে নিলো। আরশি চায়ের কাপ কাব্যর হাতে তুলে দিতে দিতে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল,
“আপনি কি যেন দরকারের কথা বলছিলেন?”
কাব্য আরেকবার আরশিকে কাছ দেখার সুযোগটা
মিস করলো না। আরশি কাব্যর দিকে তাকালো না বলে ব্যাপারটা খেয়াল করলো না। কাব্য বললো,
“আপনাদের কাজের বুয়া কি আমার কিছু কাজ করে দিতে পারবে? যদি পারে তাহলে তাকে কত করে দিতে হবে?”
“ও আচ্ছা। আমাদের এলাকায় ছুটা বুয়াদের এক কাজ ৬০০ টাকা করে। ওনাকে এরকমই দিতে হয়। তবে কাজ করতে পারবে কীনা তা তো জানিনা। উনি এখন এখানেই আছে। আমি জিজ্ঞেস করে আসছি।”
আরশি ভেতরে চলে গেল। কাব্য চায়ে চুমুক দিতেই কোথাও হারিয়ে গেলো। ঘন সুস্বাদু চা। এত সুন্দর চা পাতার ঘ্রাণ আজ অবধি কোথাও পায়নি সে। তিরা বললো,
“তোমার ক্লাস নেই আজ?”
“না আজ অফ ডে।”
“ও আচ্ছা। তুমি অনলাইনে এত ইরেগুলার কেন বলো তো?”
কাব্য হেসে বললো,
“অফলাইনেই অনেক কাজ থাকে। অনলাইনে আসার সময় পাইনা।”
“এত কী কাজ শুনি?”
কাব্য হেসে বলল,
“মুভি দেখা, বই পড়া, রান্না করা কত কাজ!”
“এত বই পড়ে কী হবে?”
“সেটা তো বই পড়লে বুঝতে। এই যেমন ধরো বই পড়লে আজ তুমি দুবছরের বাচ্চা থাকতে না। বয়সের সাথে সাথে বড়ও হতে।”
“ধ্যাত আমি তো বড়ই, পাঁচ ফিট দুই ইঞ্চি।”
“হুম বড় শুধু হাতে পায়ে।”
আরশি বুয়াকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে বললো,
“কী কী কাজ করাবেন কথা বলে নিন। কাল থেকে শুরু করতে পারবে।”
কাব্য বুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ঘর মুছতে হবে আর কাপড় ধুতে হবে। পারবেন?”
বুয়া বললো,
“হ পারমু তয় দুই কামে ২০০০ টেকা দেওন লাগবো।”
কাব্য অবাক হয়ে বললো,
“কেন? এক কাজ ৬০০ হলে দুই কাজ তো ১২০০ হওয়ার কথা।”
বুয়া বললো,
“হ তয় পোলা মাইনষেরা জনমের গিদর হয়। এগোর ঘরবাড়ি জামাকাপড় পরিস্কার করায় কষ্ট বেশি। সময়ও লাগে বেশি, এইল্লিগা টেকাও দেওন লাগবো বেশি।”
তিরা বললো,
“না না বুয়া ও অন্য ছেলেদের মতো না। ওর ঘরবাড়ি খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।”
বুয়া বললো,
“তয় অন্য মানুষ দেখুক।”
আরশি জানে কাজের লোক পাওয়া কত মুশকিল তাই বললো,
“বুয়া আমার কথা শোনেন। সব ছেলেরা তো একরকম না। তাছাড়া উনি একদম একা থাকে। একা মানুষের আর কয়টা কাপড় হয়? আর নীচের ফ্ল্যাটটাও খুব ছোটো, পরিস্কার করতেও সময় কম লাগবে। আপনি বরং কাল ওনার বাসায় কাজ করেন। আপনার যদি মনে হয় কাজ বেশি তবে উনি বাড়িয়ে দেবে। আর যদি মনে হয় কাজ স্বাভাবিক তাহলে ১২০০ ই নেবেন। ঠিকাছে?”
“আইচ্ছা তয় আরশি আফার কথাই থাকলো। কাইলকা কাম কইরা ডিসিসন লমু করমু কিনা। না করলে কাইলকার কামের টেকা কাইলকা দিয়া দিবেন।”
কাব্য কিছু বলার আগেই আরশি বললো,
“আচ্ছা ঠিকাছে।”
বুয়া চলে গেল তার নিজের কাজে। আরশি কাব্যর দিকে তাকিয়ে বললো,
“মেনে নিন। সহজে কাজের লোক পাওয়া যায় না। তবে একদিন কাজ করলে সে আর বাড়তি চাইবে না।”
কাব্য জানতে চাইলো,
“কীভাবে বুঝলেন?”
“আপনার বাসায় তো আর এত কাজ নেই। সে তো ভেবেছে ব্যাচেলর বাসা অনেকজন মিলে থাকেন। বুঝতেই পারছেন।”
“ওহ আচ্ছা।”
আরশি ভেতরে চলে যাচ্ছিলো। কাব্য ডাকলো,
“শুনুন..”
আরশি ঘুরে তাকালো। কাব্য বললো,
“আপনি সত্যি খুব ভালো চা বানান।”
“থ্যাংকস।”
“এটা কি সিলেট থেকে আনা কোনো বিশেষ পাতা দিয়ে বানানো?”
“না এটা মুদি দোকান থেকে কিনে আনা সাধারন কোনো ব্রান্ডের পাতা। কোন ব্রান্ড সেটা এখন মনে নেই।”
“তাহলে চা পাতার এই ঘ্রাণ টা? আমিও ঘন করে চা বানাই কিন্তু এই ঘ্রাণ টা তো থাকে না। যদি কিছু মনে না করেন আমাকে শেখানো যাবে?”
তিরা বললো,
“আরু কাব্যকে চা বানানোটা এবার শিখিয়ে দে। জানো কাব্য ও আমাকে অনেকবার চা বানানো শেখাতে চেয়েছে৷ আমি শিখিনি। শিখলেই তো সবাইকে বানিয়ে খাওয়াতে হবে। কী বিপদ হবে বুঝতে পারছো?”
তিরা কথাটা বলে খিলখিলিয়ে হাসলো। কাব্যও মৃদু হাসলো। আরশি বলল,
“এক কাপ চা বানালে দেড় কাপ পানি বসাবেন। পানি ফুটলে দুই চা চামচ পাতা দেবেন। চুলা কমাবেন না। সর্বোচ্চ আঁচে অল্প সময় জ্বাল দেবেন। দেড় কাপ থেকে আধা কাপ পানি শুকিয়ে এক কাপ হলে নামিয়ে নেবেন। এক কাপ চায়ে দুই চা চামচ গুঁড়ো দুধ আর চিনি নিজের স্বাদমতো দেবেন। চা বেশিক্ষণ জ্বাল দিলে পাতার ঘ্রাণ টা নষ্ট হয়ে যায়। আর অল্পক্ষণ জ্বাল দিলে কাচা পাতার গন্ধ থেকে যায়। তাই জ্বাল দেয়ার সময়ের পারফেকশন টা জরুরি।
“থ্যাংকস। এবার বুঝেছি।”
“ওয়েলকাম। আর আমি আপনার বইটা এখনই ফেরত দিতে পারছি না। সামনে এডমিশন টেস্ট তো তাই অল্প অল্প পড়ছি। ফেরত দিতে দেরী হবে।”
“কোনো সমস্যা নেই। ওটা আমার পড়া বই, এখন আবার পড়ার সম্ভাবনা নেই।”
“ঠিকাছে।”

আরশি ভেতরে চলে গেল। তিরা এবার নানান ধরনের গল্প শুরু করলো। কাব্য কী বলে উঠবে বুঝতে পারছিল না। কাব্য আরশির যত কাছে আসতে চায় আরশি যেন তারচেয়ে বেশি দূরে চলে যায়। তাই আরশির সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য তিরার বন্ধুত্ব দরকার। কিন্তু দিনদিন তিরা যেমন বিপজ্জনক ভাবে আগাচ্ছে তার দিকে তাতে সেফ জোনে থাকাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে কাব্য সরাসরিই বললো,
“আচ্ছা তিরা আজ তাহলে আমি উঠি। আবার আরেকদিন কথা হবে।”
“এক্ষুণি চলে যাবে মাত্রই তো এলে।”
“বাসায় অনেক কাজ ফেলে এসেছি। একা কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়েই বুয়া খুঁজতে আসলাম। আমার রান্নাবান্না সব বাকী। জানোই তো আমি একদিন রান্না করি তিনদিন খাই। কাল তো ক্লাস আছে রান্নার সময় পাব না। তাই এনিহাও আজকেই করতে হবে।”
“আচ্ছা কাব্য এক কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?”
“চলো আমি তোমাকে রান্না করে দেই। তোমারও কষ্ট করতে হলো না আর রান্না করতে করতে আমাদেরও গল্প করা হলো।”
“পাগল নাকি তুমি?”
একথা বলে কাব্য উঠে দরজা খুললো। তিরা বললো,
“কেন পাগল কেন হবো?”
কাব্য জোরে হেসে উঠে যেতে যেতে বললো,
“হায়রে মেয়ে! গ্রো আপ দুবছরের বাচ্চা।”
কাব্য সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো। তিরা দরজায় দাঁড়িয়ে রইলো। সে কাব্যর কথাটা শুনলো কিনা বোঝা গেল না কারণ কাব্যর হাসি দেখলেই সে দিন দুনিয়া ভুলে যায়। একটাই কথা শুধু ভাবতে থাকে, এত সুন্দর করে কেউ কীভাবে হাসে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here