নীলাম্বরীর_প্রেমে
Tuhina pakira
পর্ব : ২৪/শেষ পর্ব
-” আচ্ছা আয়ু দি, তোমার কাল বিয়ে হয়ে গেলে তুমি কী চলে যাবে?”
-” এই কথা তোকে আবার কে বললো?”
-” কেনো আমার ঠাম্মা যে সকালে বললো, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তারা নাকি সবাইকে ছেড়ে চলে যায়। তার মানে তুমিও চলে যাবে?”
কথা টুকু বলতেই তিশার চোখ ছলছল করে উঠলো। নিজের কেউ না হলেও তিশা আয়ু কে খুব ভালোবাসে। সব ক্ষেত্রে রক্তের সম্পর্ক না, আত্মার সম্পর্ক ও কখনো কখনো মানুষকে মায়ায় জড়িয়ে রাখে।
হ্যাঁ কাল স্পর্শ আর আয়ুর বিয়ে। কথা অনুযায়ী দুই বছর আগে যা ঠিক করা ছিল সেই হিসেবেই কাল ওদের বিয়ে। তবে সামনা সামনি বাড়ি হওয়ায় আয়ুর খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না এমন না, হচ্ছে তবে কিছুটা।
-” আরে পাগলী তুই কাঁদছিস কেনো? আরে আমি তো বিয়ের পর এখানে তোর কাছেই থাকবো। খালি বাড়িটা চেঞ্জ হবে। এতদিন তুই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাশের বাড়ির দিকে হেঁটে আসতিস কিন্তু এখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা সামনের বাড়িতে চলে যাবি, তাহলেই হলো। ”
-” তার মানে তুমি কোথাও যাবে না। কী মজা!”
তিশা যেনো লাফিয়ে উঠলো। আয়ু নিজের বারান্দায় দেওয়ালে হেলান দিয়ে তিশাদের বারান্দার দিকে তাকিয়ে বললো,
-” আস্তে পড়ে যাবি। তো তুতুল কী করছে?”
-” ভাই তো নীচে আছে। দাঁড়াও দেখে আসি।”
তিশা ছুটে নীচে নেমে গেলো। তিশার ভাই তুতুল, বয়স এক বছর সাত মাস। দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেছে। সময়ের সঙ্গে মানুষের জীবনের ও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। স্পর্শ চাকরি নিয়ে এখানেই শিফট করে গেছে। অপর দিকে আয়ু কিছুদিন হলো মাস্টার্স এক্সাম দিয়েছে। দিহান, দ্রুতি এর অনার্স এক্সাম শেষ। আয়ান এই বছর এইচ এস এক্সাম দেবে। সব বেশ ভালোই চলছে। বিয়ে উপলক্ষ্যে দুই বাড়িতে অনেক আত্মীয় স্বজন এসে গিয়েছে।
বিকেল পেরিয়ে এখন সবে সন্ধ্যে নামলো, সাথে সাথেই চারিদিকটা আলোকিত হয়ে গেলো। বিয়ে উপলক্ষ্যে স্পর্শ ও ওদের বাড়ি ছাড়াও সামনের কিছুটা বিজলি বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। চারিদিকটা নিঃস্তব্ধ, তবে মাঝে মাঝেই দুই বাড়ি থেকে আওয়াজ আসছে। কিন্তু কাল অল্পক্ষণের জন্যেও নিস্তব্ধতা থাকবে না। কাল ভোর থেকেই শুরু হবে স্পর্শ – আয়ুর বিয়ের আমেজ।
অনেকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আয়ু, কেউ দেখলেই নানারকম কথা বলতে পারে ভেবে আয়ু ঘরের দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু কারোর কথায় থেমে গেলো,
-” ওই শোন, তোর সাথে কথা আছে।”
আয়ু তাকিয়ে দেখলো স্পর্শ ওর ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। একবার নিজের ঘরে কেউ আসছে কিনা দেখে আয়ু গিয়ে বারান্দার কিনারায় দাঁড়ালো।
-” কী কথা? তাড়াতাড়ি বলো।”
-” শোন বিয়েতে তুই নীল বেনারসী পড়বি, কথাটা মনে আছে তো!’
স্পর্শের কথায় ভ্রু কুঁচকে আয়ু কোমরে হাত রাখলো,
-” না মনে নেই। বিয়েতে কেউ নীল পড়ে নাকি। বিয়েতে পড়তে হবে লাল টুকটুকে একটা শাড়ি। আর আমি লাল বেনরসীই পড়বো। ”
-” না তুই লাল না বরং নীল বেনরসী পড়বি।”
-” সেটা কাল বিয়েতে দেখা যাবে।”
আয়ু আর দাঁড়ালোনা। কেউ যদি দেখে ওরা এখানে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে, তাহলে ওদেরকেই লজ্জায় পড়তে হবে।
-” ওই সব দেখাদেখির সীন নেই। নীল বসনা কনে কেই আমি বিয়ে করবো, নাহলে বিয়ের দরকার নেই..”
আয়ু অবিশ্বাস্য চোখে স্পর্শের দিকে ঘুরে তাকালো,
কিন্তু স্পর্শ দমলো না,
-” বিয়েতো একবার হয়েই গেছে। সোজা গিয়ে বউ তুলে আনবো, মনে থাকে যেন। ”
আয়ু আর দাঁড়ালো না ভেংচি কেটে নিজের ঘরে চলে গেল।
♣
-” হ্যালো, দিহান তুই রেডি হয়েছিস?”
-” আমি রেডি ফ্রুটি। বাইরে গাড়িতে ওয়েট করছি তাড়াতাড়ি আয়। ”
দ্রুতি ফোনটা রেখে বিড়বিড় করে বললো,
-” নেহাত তোর সাথে শপিং করতে যেতে হবে, না হলে আজ আমাকে ফ্রুটি ডাকা বের করে দিতাম । ”
দ্রুতি গাড়ির কাছে এগিয়ে গেলো। সামনের সিটে দিহান আর আয়ান বসেছে। দ্রুতি পিছনের সিটে বসতেই দিহান গাড়ি স্টার্ট দিলো।
-” ফ্রুটি তোর কি কেনা কাটার শেষ নেই। কাল বিয়ে আজও তোকে শপিং করতে যেতে হবে!”
-” আমি কি করবো, এক্সামের জন্যই তো ঠিক মতো কিছু কেনা হয়নি। ভাগ্যিস আজ শেষ এক্সাম ছিল, কাল যদি একটা পেপার থাকতো না আমি তো শেষ হয়ে যেতাম।”
দিহান মুচকি হাসলো। আয়ান ভেংচি কেটে বললো,
-” যাদের বিয়ে তারা এতো কেনাকাটা করেছে কি সন্দেহ!”
♣
দূর থেকে বিয়ের পিঁড়িতে আয়ু কে আসতে দেখে স্পর্শ ওর দিকে তাকালো। স্পর্শ একবার ওই দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কতবার করে বললো, আয়ু তুই নীল শাড়ি পড়বি, কিন্তু আয়ু সেই লাল শাড়ি পড়েছে। দুজন এখন রয়েছে ছাদনাতলায় চাঁদোয়ার নীচে। আয়ু আস্তে আস্তে পান পাতা সরাতেই দুজনের দৃষ্টি এক হলো, এই দৃষ্টি একটা পবিত্র সম্পর্কের শুভ দৃষ্টি। স্পর্শের মুখে আস্তে আস্তে ভালোলাগা ছুঁয়ে গেলো, ইসস, মেয়েটাকে কে বলেছিল, এমন মোহনীয় সাজে সজ্জিত হতে। তবে স্পর্শের একটা জিনিস খুব ভালো লাগলো, আয়ু লাল বেনরসী পড়লেও কাঁধে ফেলে রেখেছে একটা নীল রঙের ওরনা; যেটা অপর হাতে অতি যত্নের সঙ্গে জড়ানো রয়েছে।
-” পলাশ ওকে ভালো করে ধরবি, যেনো ও ব্যথা না পায়।”
আয়ুর বসা পিঁড়ি ধরে রেখেছে পলাশ, আয়ান , সজল ও দ্রুতির জেঠুর ছেলে। স্পর্শের সামনে পলাশ থাকায় স্পর্শ ওর কানে কানে কথাটা বলতেই পলাশ একটু নড়ে উঠলো ফলে আয়ু আয়ানের কাঁধটা ধরে ফেললো।
-” আরে আস্তে পড়ে যাবে তো।”
দ্রুতির কথায় পলাশ সরি বলে ভালো করে ধরলো।
স্পর্শ চোখের ইশারায় পলাশ কে বকে, আয়ুর গলায় মালা পরিয়ে দেওয়ার পর আয়ু মালা পড়াতে যেতেই -দিহান, সাদ, অপূর্ব ও আরও কিছু বন্ধু মিলে স্পর্শ কে উপর দিকে তুলে ধরলো। যার ফলে আয়ুর হাত স্পর্শের গলা পর্যন্ত গেলো না। ততক্ষনে ওখানে মিথিলা ও ওর বর এসে গেছে। মিথিলা চেঁচিয়ে বলল,
-” এটা কিন্তু চিটিং হচ্ছে।”
স্পর্শ আয়েশ করে সাদের কাঁধে ওর হাত রেখে মিথিলার দিকে তাকিয়ে বললো,
-” এখানে কোনো চিটিং নেই। বিয়ের রীতি বর বড়ো না কনে বড়ো। এখানে তো বর বড়ো, কী বলিস আয়ু!”
বাঁকা হেসে আয়ুকে কথাটা বললো স্পর্শ। আয়ু কিছু বললো না এমনকি রাগ ও দেখলো না । একবার স্পর্শের দিকে তাকিয়ে মালাটা স্পর্শের গলায় পড়াবার চেষ্টা করতে হাতটা ওর দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো, কিন্তু পরক্ষণেই মালাটা নামিয়ে নিয়ে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে নিজের গলাতেই পড়ে নিলো।
আয়ুর কাণ্ডে উপস্থিত সবাই প্রথমে হাঁ হয়ে গেলেও পড়ে সকলে হেসে উঠলো। স্পর্শের মুখেও হাসি খেলে গেলো। একে একে বিয়ের সব নিয়ম মিটে
গেলে পরে রইল সিঁদুর দান। স্পর্শ আর আয়ু এখন পাশাপাশি বসে রয়েছে। স্পর্শ আস্তে আস্তে আয়ুর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
-” দেখ সোজা কথা, আমি কিন্তু তোকে ভালোবাসি না। আমি আমার বউ নীলাম্বরীকে ভালোবাসি। আর হ্যাঁ, হ্যাপি সেকেন্ড ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি বউ।”
আয়ুর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। ও কিছু বলবে তার আগেই স্পর্শের হাতে পুরোহিত সিঁদুরের
কৌটো ধরিয়ে দিলো। স্পর্শ সেটা নিয়ে আয়ুর সিঁথি রাঙিয়ে দিলো, পিছন থেকে নিশিতা আয়ুর মাথায় লজ্জা বস্ত্র দিয়ে দিলো। আয়ু লজ্জা বস্ত্র ধরে নিলো। নিশিতা গিয়ে শুভর পাশে দাঁড়ালো। শুভ হেসে ছেলেকে নিশিতার কোলে দিয়ে হেসে বলল,
-” হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি বউ। দেখতে দেখতে তেরো বছর কেটে গেলো, কী বলো!”
নিশিতা শুভর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
-” বাকি জীবনটাও যেনো এইভাবেই কাটে। তোমাতে আমাতে মিলে পাশাপাশি, হাতে হাত রেখে চলে যাবে।”
হ্যাঁ আজ থেকে তেরো বছর আগে শুভ আর নিশিতার বিয়ে হয়েছিল। ঠিক একই দিনে আয়ু আর স্পর্শের বিয়ে সুসম্পূর্ণ হলো।
বিয়ে সম্পূর্ণ, আয়ু মাথার লজ্জা বস্ত্রটা দুই হাতে ধরে, স্পর্শকে ফিসফিস করে বললো,
-” আগে বলবে তো তুমি আমাকে ভালোবাসো না, তাহলে ওই যে ডক্টর ওকেই বিয়ে করতাম। ইসস, তুমিও না, সবেতে লেট।”
আয়ুর দেখানো আঙ্গুল বাবাবর সেই বাবার আনা সম্বন্ধের ডাক্তারকে দেখে স্পর্শ বিড়বিড় করে উঠলো,
-” ওই হারের ডাক্তার এখানে কি করছে?”
পরমুহুর্তে আয়ুর হাতটা ধরে নিজের কাছে এনে বললো,
-” ওই সব ডাক্তারের দিকে একদম তাকাবিনা, আমি না তোর বর।”
আয়ু ভেংচি কেটে অন্যদিকে তাকালো। মনে মনে তার বেশ হাসি পাচ্ছে, শেষে কিনা স্পর্শ জেলাস, ভাবা যায় না।
♣♣
রাতের আকাশের চাঁদ যেনো আজ পুরো প্রকৃতিতে মুগ্ধতা বিরাজ করছে। ছাদে বসানো রজনীগন্ধা, বেলফুল, গোলাপের গাছ থেকে সুগন্ধ চারিদিকে এক আলাদা শোভা বিচরণ করছে। অপরদিকে গোলাপের ঝরে যাওয়া পাপড়ি গুলো মৃদুমন্দ বাতাসে সারা ছাদময় ছড়িয়ে রয়েছে। নীল রঙের শাড়ি পরিহিতা রমণী ও লাল রঙের পাঞ্জাবী পড়া আয়ু – স্পর্শ ওখানেই রয়েছে।
স্পর্শের বুকে হেলান দিয়ে আয়ু আধ শোওয়া হয়ে আকাশের চাঁদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। পিছন থেকে একটা হাত অতি যত্নের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে রয়েছে।
-” এই যে চাঁদ মামা, আমার টুইন বাবুর মাকে বলে দিও তাকে আমি খুব খুব খুব ভালো বাসি। শুধু মুখে বলাটা বাকি ছিল, তাও আজ বলে দিলাম। ”
স্পর্শের জড়িয়ে থাকা হাতে আয়ু হালকা মেরে বললো,
-” যতসব ঢং। কাল বিয়ের মণ্ডপে বেশ বলছিলে আমি তোকে ভালবাসি না। আজ আবার ঘটা করে বলে কিনা ভালোবাসি।”
স্পর্শ হেসে আরেকটু নিবিড় ভাবে আয়ু কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো,
-” ইশ, ওই কথাটা বলিস না এখন। পুরো বুকে গিয়ে লাগে, ওটা বলার এখনও ধের সময় আছে। এই ধর আমাদের চুল গুলোতে পাক ধরেছে। দুজনে মিলে কোনো এক ছুটির দিনে নাতি নাতনির হাত ধরে আমরা এগিয়ে যাবো আমাদের ফেলে আসা সেই ঝিলের ধারে, যেখানে অনুভূতিরা ডানা মেলেছিল।
সেখানে গিয়ে তোকে রাগিয়ে নাতি – নাতনীদের বলে উঠবো তোর বোকা বোকা সব কাজ, সেখানকার সব স্মৃতি। তখন তুই মিছে রাগের ভান করে বলে উঠবি, ‘ যতসব ঢং। তবে বুড়ো কথাটা অ্যাড করিস। আমিও তখন তোকে ক্ষেপাতে বলবো, আর তুমি বুড়োর বুড়ি। ”
আয়ু লজ্জা পেয়ে গেল ভীষণ ভাবে। মানুষটা তাকে নিয়ে কতোটা ভেবে ফেলেছে। আয়ু হেসে ঘুরে স্পর্শের বুকে মুখ লুকালো। স্পর্শ হেসে আয়ুর মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে আয়ুর মাথায় নিজের থুতনি রেখে বলে উঠলো,
-” নীল বসনা নীলাম্বরী; অভিমানের স্বরুপী।
ভালোবাসার রাগ – রাগিণী; তুইই আমার প্রেয়সী।।”
আয়ু স্পর্শের বুকের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে নিলো। বিরবির করে বললো,
-” ভালোবাসি।”
-” নীলাম্বরীর প্রেমে আবেশিত আমি খুব খুব ভালোবাসি তোকে। ”
(সমাপ্ত)
{ বিঃ : শুভ দশমী। গল্পটি শেষ। অনেক ভুলের মাঝেও কেমন লাগলো বলবেন, খারাপ ভালো যাই হোক। ভুল ক্ষমা করবেন । হ্যাপি রিডিং }