যদি তুমি জানতে’পর্ব-১২

0
849

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_12
একটু তাড়াহুড়া করে কেনাকাটা শেষ করলো তুরান । রুপা গম্ভীর হয়ে আছে। একটা কথাও বলছে না। তুরানের কাছে কোন কিছু চাচ্ছেও না। না..রুপা কে গম্ভীরতায় একদম মানায়।রুপা মানেই যেন চঞ্চলতা। শূন্যতা অনুভব করছে তুরান।
-‘রুপা কেনাকাটা তো শেষ,এবার বলো তোমার কি চাই?’
রুপা শান্ত গলায় বলে,
-‘প্রমিস করেছি না কিছু লাগবে না।’
-‘তুমি তো প্রমিস করেছো তুমি কিছু চাইবে না,কিন্তু আমি তোমায় দিতে চাচ্ছি।’
-‘কিছু লাগবে না বাসায় চলুন। আজকে উনারা আসবে নাকি । এসে আমায় বাসায় না পেলে মারবে।’
-‘উনারা কারা?’
-‘আব্বু-আম্মু।’
-‘সাহেলা আন্টি তো এত তাড়াতাড়ি বাসায় আসবে না।’
-‘আমি আপনার সাহেলা আন্টির কথা বলছি না।’
একটু ভেবে তুরান বলে,
-‘ও তোমার আব্বু-আম্মু?’
রুপা মুখে কিছু বলে না,মাথা ঝাঁকায় শুধু। টাকা যা এনেছে সব খরচ হয়ে গিয়েছে তুরানের। রুপার জন্য একটা কালো শাড়ী কিনলে কেমন হবে ব্যাপার টা? রুপার অবাক হওয়া মুখটা কেন যেন দেখতে ইচ্ছা করছে তুরানের । টাকা তো শেষ,রিক্সা ভাড়া আছে শুধু। শাড়ী কিনবে কিভাবে?
একটু সামনে তুরানের এক পরিচিত দোকান আছে । উনার কাছ থেকে বাকী নিলেই তো হয়। টিউশনির টাকা হাতে পেলে শোধ করে দিবে।
-‘রুপা এখানে দশ মিনিট ওয়েট করো। আমি না আসা পর্যন্ত কোথায়ও যাবে না কিন্তু ।’
-‘আচ্ছা ।’
তুরান দোকানে গিয়ে খয়েরি পাড়ের কুচ কালো একটা শাড়ী কিনলো। শাড়ীটা দেখে রুপার অনুভূতি কেমন হবে? খুশিতে ওর মুখটা চিকচিক করবে। এসব ভেবে মুচকি হাসছে তুরান।
দশ মিনিটের জায়গায় পনেরো মিনিট হয়ে গিয়েছে। রুপা যেখানে আছে সেখানে যেতে আরও পাঁচ মিনিট লাগবে। রুপাকে ওখানে পাবে তো গিয়ে? শঙ্কা কাজ করছে তুরানের মনে।
আশেপাশে তাকালো তুরান। রুপা ওখানে নেই। রুপা কি বাসায় চলে গিয়েছে? নাকি হারিয়ে গিয়েছে? ওর তো এখানে সব কিছু চিনার কথা। প্রায় দুই ঘন্টার মত খুঁজলো রুপা কে। সন্ধান মিলে নি। রুপার আব্বু-আম্মু আসার কথা । সেই জন্য কি রুপা বাসায় চলে গিয়েছে? তুরান রিক্সা ডেকে দ্রুত বাসায় উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো।
বাসায় আসতেই তুরানের কানে আসে রুপার কান্নার শব্দ । তুরান সাত-পাঁচ না ভেবে সাহেলা বেগমের ফ্ল্যাটে গেলো। ফ্লোরে বসে কাঁদছে রুপা। তুরানের বুকের মাঝে ধ্বক করে উঠলো। রুপার হাঁটু অবধি চুল গুলো কাঁধ বরাবর! হতভম্ব হয়ে গেলো তুরান।
সোফায় সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরী বসা। মুখে তাঁদের বিরক্তির ছাপ।
-‘রুপা কে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে?’
সাহেলা বেগমের এমন কথায় আবার হতভম্ব হয়ে যায় তুরান।
-‘আন্টি আমার বাবা-মা আজ বিকালে চলে যাবে। আমি আমার ছোট বোন দের জন্য কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম,রুপা অনেক অনুরোধ করলো আমার সাথে যাবার জন্য।’
তুরানের কথা শেষ না হতেই আজিজ চৌধুরী সাহেলা বেগম কে বলে,
-‘রুপার বাবা-মা তো নেগিটিভ সেন্সের মানুষ। উনাদের মেয়ে উনাদের কাছে দিয়ে দেও। আরে কোন ছেলের সাথে কোথায়ও গেলো মানে তাঁর সাথে প্রেমের সম্পর্ক? অসুস্থ একটা মেয়ে , মেয়েটার গায়ে হাত তুলে এসব লেইম বিষয় নিয়ে। ফালতু মানুষ জন।’
তুরানের সাথে গিয়েছে বলে কি রুপা কে মেরেছে ওর বাবা-মা? এগুলো কোন কথা হলো? তুরানের সব চেয়ে খারাপ লাগলো রুপার চুল গুলো দেখে। কেমন অসহায়ের মত কাঁদছে রুপা।
-‘যেমন বাবা-মা তেমন মেয়ে। আরে মেরেছে বলে ও ওর চুল কেটে ফেলবে।’
সাহেলা বেগমের কথা শুনে বিষয়টা এবার ক্লিয়ার হলো তুরানের কাছে। মেরেছে বলে রুপা চুল কেটে ফেলেছে? এত বড় চুল কোন মেয়ে কাটতে পারে! আর কোন কিছুর প্রতি জিদ দেখাতে পারলো না। রুপার চুল গুলো যে তুরানের খুব পছন্দের ছিলো।
-‘আন্টি আমি দুঃখিত। আমার জন্য রুপার মার খেতে হলো। সব মানুষ কে তো আল্লাহ সমান বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি করে নি। রুপার হয়ত মানসিক বিকাশে সমস্যা রয়েছে। ওকে তো প্রতিদিন মারলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। এজন্যই হয়ত রুপা ওর মা-বাবার কথা শুনতে পারে না।’
এতক্ষন ফ্লোরে মুখ নুয়ে কাঁদলেও এ পর্যায়ে চিৎকার দিয়ে উঠে রুপা।
-‘বললাম না ওরা আমার বাবা-মা না। চিনি না আমি ওঁদের ।’
রুপা সাহেলা বেগমের কাছে কেন থাকে? এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করে না তুরান । এই সিচুয়েশনে এসব জিজ্ঞেস না করাই ভালো।
আজিজ চৌধুরী সাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,
-‘কত দিন বললাম ওঁদের মেয়ে ওঁদের কাছে দিয়ে আসো। ওরা যেভাবে হোক মানিয়ে নিবে। তোমার একটাই কথা আর কয়টা দিন দেখি।দেখতে দেখতে এ পর্যন্ত আর কত দেখবা?’
কোন কথা বলে না সাহেলা বেগম । রুপা কে ফ্লোর থেকে তুলে রুমে নিয়ে গেলো। তুরান চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সবটা।
কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে তুরান বাসায় চলে আসলো। তুরান কে দেখেন উৎসুক কন্ঠে তুরানের মা বলে,
-‘রুপা মেয়েটা এমন কেন রে? কত বড় চুল গুলো কেটে ফেললো। ‘
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হতাশ কন্ঠে তুরান বলে,
-‘তুমি দেখলে কিভাবে?’
-‘ওর কান্নার শব্দ শুনে গিয়ে দেখি দরজা বন্ধ । জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম।’
-‘ওর বাবা-মা কে দেখেছো?’
-‘না উনারা অন্য রুমে ছিলো গলার স্বর শুনেছি কিন্তু দেখি নি।’
-‘সাহেলা আন্টি বাসায় ছিলো না ওকে যখন মেরেছে?’
-‘না,উনি তো একটু আগে আসলো।’
-‘ওর বাবা-মা এত তাড়াতাড়ি চলে গেল কেন?’
-‘জানি না।’
শপিং ব্যাগ গুলো মায়ের হাতে ধরিয়ে দিলো তুরান । শুধু রুপার জন্য যে শাড়ীটা কিনেছে ওটা তুরানের হাতে ছিলো।
-‘ওটার ভিতর কি?’
-‘আমার শার্ট ।’
মায়ের কাছে মিথ্যা বলে ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত রুমে চলে গেলো। ব্যাগটা ড্রয়ারের ভিতর রেখে খাটে শুয়ে পরলো । রুপা চুল গুলো কেন কাটলো? অসহায়ের মত কাঁদছিলো মেয়েটা ফ্লোরে বসে। বুকের ভিতর চিনচিন ব্যাথা অনুভব করে তুরান। রুপার বাবা-মা কে কাছে পেলে কড়া কয়টা কথা শুনিয়ে দিতো। অমানুষ! এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলে কোন কিছু ভালো ভাবে না জেনে। নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে তুরানের। রুপা কে কি ওর মা-বাবার কাছে পাঠিয়ে দিবে? শাড়ীটা কি রুপাকে দেওয়া হবে না? রুপার আনন্দিত মুখটাও কি দেখা হবে না? রুপার পাগলামী ,রুপার হাসি..ভাবতে পারছে না তুরান আর!
অনেকক্ষন হয়ে গেলো রুপা না আসলো ছাদে,না তুরানের বাসায়। তুরানের বাবা-মা ব্যাগ গুছাচ্ছে। বাবা-মা চলে যাবে । রুপারও খোঁজ নেই। সব মিলিয়ে শূন্যতা নাড়া নিয়েছে তুরানের মনে।
আফসোস করে তুরানের মা বলে,
-‘মেয়েটা কে ওভাবে মেরেছে কেন বল তো? মেয়েকে অন্যের বাসায় রাখে আবার মারে! খুব মায়া লাগে ওর জন্য । সারাক্ষন ও আমার কাছে থাকতো অথচ এখন চলে যাবো……’
-‘থাক মা বাদ দেও ওসব।’
বাসা থেকে বের হওয়ার পর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তুরানের বাবা বলে,
-‘রুপা মেয়েটা বড়ই অবুঝ। খামখেয়ালির বশে অনেক কিছু করে। মায়ায় জড়াস না বাপ।’
কথা গুলো বুকে বিঁধে তুরানের। বাবার বলার কথা গুলোর গূঢ়ার্থ গভীর। উত্তরে কিছু বললো না তুরান। মাথা ঝাঁকালো শুধু। মনটা ভীষন খারাপ করেছে কথা বলার ইচ্ছা নেই মোটেও।
বাবা-মা চলে যাওয়ার পর একা রুমে শুয়ে আছে তুরান। মনটা ছটফট করছে। রুপা কি সব খামখেয়ালির বশে করছে? কেন এমন করছে রুপা? সত্যি উপলব্ধি করতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে তুরানের। নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছে বোধ হয়! এটা সত্যি ।
রুপা কে কি ওর বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।
তুরান খাট থেকে নেমে আস্তে আস্তে রুপার রুমের কাছে যায়। জানালার কপাট গুলো চাপানো।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here