#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_21
রুপা কে বেশ পরিপাটি ভাবে সাজতে দেখে সাহেলা বেগম জিজ্ঞেস করে,
-‘ কোথায় যাবি তুই এখন?’
রুপা হাতে চিরুনি নিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। লম্বা চুলের থেকে এমন চুলই ভালো। আঁচড়াতে সময় কম লাগে, ঘুমানোর সময় বেনী গেঁথে ঘুমানোর ও ঝামেলা নেই,এমন কি তেল ও কম খরচ হয়, শ্যাম্পুও কম লাগে। কোন জায়গায় যাওয়ার সময় দ্রুত আঁচড়ানো যায়। রুপা নিজের মনে যথারীতি চুল নিয়ে গবেষণার শুরু করেছে। ছোট চুল থাকার কি কি সুবিধা। লম্বা চুলের কি কি অসুবিধা। এরকম আজগুবি চিন্তা ভাবনায় নিজেকে মগ্ন করে রাখে রুপা। আবার নিজের মনে হেসে উঠে। সাহেলা বেগমের কথার দিকে কোন মনোযোগ নেই। রুপা কে নিরুত্তর দেখে সাহেলা বেগম আবার জিজ্ঞেস বললো,
-‘কি হয়েছে কথা বলিস না কেন?’
রুপা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে সাহেলা বেগমের দিকে তাকায়।রুপার কাছে বিষয়টা খুব আশ্চর্য লাগে! রুপা যখনই কোন কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকবে তখনই সাহেলা বেগম এসে ডিস্টার্ব করবে।
নাক মুখ কুঁচকে রুপা বলে,
-‘ তুমি দেখছো না আমি চুল নিয়ে গবেষণা করছি! বিরক্ত করো কেন?’
সাহেলা বেগম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। রুপা আজ কাল অদ্ভুত অদ্ভুত আচরন করে।
-‘কিসের গবেষণা করিস তুই? তুই তো ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তোর চেহারা দেখিস!’
-‘ গবেষণা কি মানুষ চেঁচামেচি করে নাকি? আমি তো মনে মনে ছোট চুলের সুবিধা নিয়ে গবেষণা করছিলাম।’
রুপার এসব কথার প্রত্যুত্তরে আর কিছু বলে না সাহেলা বেগম। রুপার পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলে,
-‘ নীড়া দের বাসায় যাবি নাকি?’
-‘হুম।’
-‘ সারা দিন আমি সাধলাম তখন তো গেলি না।’
-‘তখন ভালোলাগে নি তাই যাই নি,এখন ভালোলাগে তাই যাচ্ছি।’
এই কথা বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল রুপা। সাহেলা বেগম আজকাল রুপার মতিগতি বুঝতে পারছে না। রুপা আগের মত ভাংচুর করে না, কোন ধরনের পাগলামি করে না,নিজের হাত-পা কাটে না ,রুপা এখন স্বাভাবিক প্রায়। নিজেকে কিছুটা হলেও সার্থক মনে হচ্ছে সাহেলা বেগমের।
রুপা নীড়া দের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। তুরানের তো এই সিঁড়ি তেই থাকার কথা ছিলো। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে তুরান কে দেখতে পেলো না। তুরান কি ওকে রেখে চলে গেছে? এর ভিতর রুপা পিছনে তাকিয়ে দেখলো পাঞ্জাবির হাতা ফোল্ড করতে করতে সিঁড়ির দিকে আসছে তুরান। হাতে ঘড়ি, চুল গুলো স্পাইক করা। সব মিলিয়ে এক সুদর্শন পুরুষ।
রুপা চোখ বড় বড় করে তুরানের দিকে তাকিয়ে আছে। তুরান কে অবাক হয়ে দেখছে রুপার চাহনিতে সেরকম ভাব নেই। কোন কারনে রেগে আছে রুপা তাই ওভাবে তাকিয়ে আছে।
-‘ একটু দেরি করে ফেলেছি তাই না? সরি, সরি।’
রুপা কোন উত্তর দিলো না রুপা। চুপ মেরে রইলো।
কিছুক্ষণ পর রাগের সাথে চাপা কন্ঠে রুপা বলে,
-‘ আমি একটু কাজল দিতে পারবো না। আর নিজে হিরো সেজে এসেছে। আপনার দিকে মেয়েরা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে এটা আমার ভালো লাগবে তাই না? যান রুমে যান। এসব চেঞ্জ করে টিয়া কালারের একটা লুঙ্গি পরবেন , আর হলুদ কালারের ফতুয়া পরবেন। নয়ত আমি যাবো না।’
রুপার কথা শুনে হাঁ করে তাকিয়ে রইল তুরান।
-‘কি বললা? লুঙ্গি পরে কেউ বিয়ে বাড়ি যায়?তাও আবার টিয়া কালারের লুঙ্গি! হলুদ কালারের ফতুয়া।আরে ওসব তো আমি জীবনেও পরি নি। আমি কি জোকার?’
তুরানের কোনো রকমের যুক্তি মানতে নারাজ রুপা। শেষ পর্যন্ত সিন্ধান্ত হলো পুরানো শার্ট, প্যান্ট পরে যেতে হবে।
রুপা মনে মনে খুব মজা পাচ্ছে, সারা দিন বিয়ে বাড়ি যেতে না দেওয়ায় প্রতিশোধ টা অবশেষে নিতে পারলো।
তুরান রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে এসে বললো,
-‘ এবার খুশি?’
রুপা হাসি চাপিয়ে বলল,
-‘খুব।’
তুরান হতাশ ভঙ্গিতে রুপার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘এই রুপা তুমি এত ডেঞ্জারাস কেন?’
রুপা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
-‘ নিজে আমার থেকে এক কাঠি সরেস।’
রুপা গিয়ে নীড়ার পাশে বসলো। তুরান আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। মানুষের সাথে ভাব জমাতে রুপার খুব বেশি সময় লাগে না। নীড়া আর ওর সব কাজিন দের সাথে আড্ডা জুড়ে দিলো। তুরান রুপা কে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে এই টুকু সময়ের মধ্যে মানুষের সাথে এত মিশা যায় কিভাবে? রুপা এমন ভাবে আড্ডা দিচ্ছে মনে হচ্ছে সবাই ওর কত চেনা।
তুরান একা একা বোর হচ্ছে। কারো সাথে সহজে মিশতে পারে না তুরান। তুরান কে একা বসে থাকতে দেখে আশেপাশে থাকা তরুণীর দল খোঁচা মেরে কথা বলছে। ওসবে কান দিচ্ছে না তুরান, মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে নিজের মনে। রুপার উপর রাগ হচ্ছে তুরানের। আড্ডা দিতে দিতে তুরানের কথা বোধ হয় ভুলেই গেছে। এত বেখেয়ালি হলে চলে?
রুপা নীড়া কে একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। রুপার কথা গুলো নীড়ার কাছে খুব ভালো লাগলো। রুপার সব প্রশ্নের সুন্দর করে উত্তর দিচ্ছে নীড়া।
-‘ নীড়া আপু তোমার মত আমার যদি আজ বিয়ে হতো তাহলে আমি লজ্জায় কারো সাথে কথাই বলতাম না।’
-‘আমার বিয়ে আরও এক বছর আগে হয়েছে। লজ্জা কেটে গেছে বুঝলে?’
রুপা বিস্মিত হয়ে বলে,
-‘ বলো কি! তো আবার বিয়ে করছো কেন?’
নীড়া প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই সাহেলা বেগম ডাক দেয় রুপাকে। রুপা বরাবরের মত বিরক্ত হয়ে সাহেলা বেগমের কথা শুনতে যায়।
রুপা চলে যাওয়ার পরেই নীড়ার খালাতো বোন অন্তরা নীড়া কে জিজ্ঞেস করে,
-‘এতক্ষন যে মেয়ে টা চলে গেল ওই মেয়েটা কি এ বাসায় ই থাকে?’
অন্তরার প্রশ্নের উত্তরে নীড়া বলে,
-‘ হুম কেন? চিনিস নাকি? মেয়েটা কে খুব ভালো লাগে আমার কাছে। অনেক সুন্দর করে কথা বলে । কেমন কেমন পিচ্চি পিচ্চি টাইপ।’
নীড়ার কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে দিলো অন্তরা। অন্তরার অকারণে হাসিতে বিরক্ত হলো নীড়া।
-‘অযথা হাসছিস কেন?’
অন্তরা হাসি থামিয়ে বললো,
-‘ ওই মেয়ে দেখতে পিচ্চি আসলে পিচ্চি না।তোর আর আমার এক ব্যাচ সিনিয়র।’
নীড়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
-‘ বলিস কি? আমি তো ভাবছি হাই স্কুলের গন্ডিই পার করতে পারেনি এখনো।’
নীড়ার কথা শুনে আবারও হেসে উঠলো অন্তরা।
-‘শতরুপা আপু আর আমি একই মেডিকেলে পড়ি। হেভী টেলেন্ট। নাচ,গান সব কিছু তে পাক্কা। আমার সাথে আগে মাঝে মাঝে দেখা হতো কিন্তু তেমন পরিচয় নেই।’
নীড়া অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘শতরুপা!’
-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ হিন্দু। শতরুপা থেকে রুপা আর কি!’
রুপার সম্পর্কে এমন চঞ্চলকর তথ্য শুনে কেন জানি খুব বেশি অবাক হয় নীড়া। বেশি অবাক হয় রুপা হিন্দু এটা জেনে। হিন্দু , মুসলিম এটা কোন ফ্যাক্ট না কিন্তু নীড়া ভেবেছিল রুপা মুসলিম।
এবার নীড়া হেসে বলে,
-‘ইস! আমি কি পিচ্চি ভেবেছি।’
-‘আর উনার গানের গলা শুনার মতো। অনুষ্ঠানে সব সময় গান করতো তাই ভালো করে চিনি। নামটাও চমৎকার শতরুপা রঙ্গন রায়।’
-‘ আমি তো এখানে থাকি না চট্টগ্রামেই থাকা পরে। মাঝে মাঝে আসলে দেখা হত তাই অত কিছু জানি না।’
এর ভিতর হাতে মেহেদী নিয়ে হাসতে হাসতে নীড়ার কাছে এসে বসে রুপা। রুপা কে দেখে রুপার সম্পর্কে আলোচনার সমাপ্তি ঘটে।
-‘ অবশেষে তোমায় মেহেদী লাগানোর দায়িত্ব টা আমার কাঁধেই চাপলো। টেনশন করো না ভালোই মেহেদি পরাতে পারি।’
রুপার কোন খোঁজ না পেয়ে হতাশ হয়ে বসে রইল তুরান। রুপা যে রুমে আছে সেখানে সব মেয়ে মানুষ। সেখানে এখন না যাওয়াই মঙ্গল। একটু আগে জানালা দিয়ে উঁকি দিতে গেছে তা নিয়েও তুরান কে কথা বলতে ছাড়ে নি রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে গুলোয়। মেয়ে দের প্রবলেম কি বুঝে না তুরান একটু চুপচাপ টাইপের ছেলে দেখলেই খোঁচা দিয়ে কথা বলতে থাকে।
এর ভিতর একটা পিচ্চি মেয়ে কে দেখে ডাক দেয় তুরান। বিয়ের আনন্দে মত্ত মেয়েটা তাই তুরানের ডাকে একটু বিরক্ত হয়। মেয়ে টার বয়স বোধ হয় পাঁচ- ছয় বছর হবে। দুই হাত ভরা আচার, চকলেট, কিটক্যাট এজাতীয় খাবার দাবারে।
মেয়েটা তুরানের কাছে এসেই ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
-‘ কেন ডেকেছেন?’
-‘ এভাবে কথা বলো কেন? ভয় পাই তো আমি।’
তুরানের কথা বলার ভঙ্গি দেখে পিচ্চি টা হেসে দেয়।
তারপর কি যেন মনে করে তুরানের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। তুরানের দিকে একটা কিটক্যাট বাড়িয়ে বললো,
-‘ খাবেন?’
এই পিচ্চির আবার কোন মতলব নাই তো? প্রথম ঝাঁঝালো কন্ঠে কথা বললো ,এখন আবার পাশের চেয়ারে বসলো। আবার কিটক্যাট সাধে।
তুরান কিটক্যাট টা নিলো। তারপর হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ নাম কি তোমার?’
-‘ লোজা।’
পিচ্চি সামনের দাঁত গুলো নেই। তাই রোজা কে লোজা বললো। তুরান হাসি চাপিয়ে বললো,
-‘ যে রুমে সব মেয়েরা আড্ডা দেয় আর কি যে রুমে বসে নীড়া হাতে মেহেদি লাগায় ওই রুমে গিয়ে বলবে রুপা কে? যদি রুপা নামে কেউ থাকে তাহলে বলবে আমি ডাকছি।’
রোজা ঘাড় বাঁকিয়ে বললো,
-‘ আচ্ছা যাচ্ছি।’
অনেকক্ষণ হয়ে গেলো রুপারও দেখা নেই রোজারও দেখা নেই। একটু পর রোজা এসে বললো,
-‘ উনি নীলা আপুল হাতে মেহেদি লাগাচ্ছে। একটু পলে আসছে।’
রোজার কথা শুনে এবার হেসে দিলো তুরান। অন্যদিকে রুপা কে না দেখে মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
অবশেষে দেখা মিললো রুপার। রুপা কাছে আসতেই তুরান রুপার হাত ধরে টেনে আড়ালে নিয়ে গেলো।
-‘ আমার কথা মনে পড়ে নি আপনার একবারও তাই না?’
রুপা ইতস্তত বোধ করে বললো,
-‘ গালি দিয়েন না প্লীজ। সবার হাতে মেহেদি লাগাচ্ছিলাম আসবো কিভাবে?’
তুরান একটু রেগে কথা বললেই কেঁদে দেয় রুপা।
-‘ হয়েছে আর কাঁদতে হবে না । তুমি হাতে মেহেদি লাগাও নি কেন?’
-‘ আমার ভালো লাগে না।’
-‘ ভালো লাগতে হবে। এক্ষুনি তোমায় মেহেদি কিনে এনে দিচ্ছি।’
-‘ ওখানে মেহেদি আছে তো।’
-‘ ওখানে মেহেদি থাকলে কি? আমি কিনা দিবো সেটা হাতে দিবা।’
রুপা কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেহেদি কিনে নিয়ে আসে তুরান। রুপার হাতে দিয়ে বলে,
-‘রুমে গিয়ে দুই হাত ভরে মেহেদি লাগাবে। আর রাত জাগা যাবে না। চলো এখন।’
রুপার যেতে ইচ্ছা করছে না । এখানে ভালোই লাগছিলো। তুরানের কথা না মেনে উপায় নেই।
-‘ তুমি যে এত স্কিলড মেহেদি ডিজাইনার আগে জানা ছিলো না তো।’
হেসে দেয় রুপা।
চলবে…