যদি তুমি জানতে’পর্ব-৩০

0
520

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_30
ভার্সিটি থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো তুরান। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চুলোয় রান্না বসালো। হঠাৎ রুপা এসে হাজির। হাতে এক প্লেট ভাত আর একটা বাটিতে দুই টুকরো সরিষা ইলিশ। ভাত আর মাছ নিঃশব্দে টেবিলের উপর রাখলো।
-‘ রান্না করতে হবে না আমি খাবার নিয়ে এসেছি।’
-‘ তুমি কখন আসলে? ভয় পেয়ে গেছি আচমকা কথা শুনে।’
উচ্চস্বরে হেসে উঠলো রুপা। তুরান ভ্রু কুঁচকে বললো,
-‘ হাসির জন্য অন্তত একটা কারন থাকা চাই। মানুষ কারন ছাড়া কিভাবে হাসে তা তোমায় না দেখলে বুঝতামই না।’
তুরান চেয়ার টেনে রুপার পাশে বসে আবার বললো,
-‘ লুকিয়ে এনেছো খাবার তাই না? তোমায় না কতদিন না করেছি।’
-‘ সব বিষয়ে না আমি মানি না। গরম করে এনেছি খাবার, খেয়ে নেন ঠান্ডা হয়ে যাবে।’
তুরান একটু হেসে বললো,
-‘ খেয়ে নিবো মানে ? পারবো না খেয়ে নিতে।’
রুপা আদুরে ভঙ্গিতে হাসলো। তারপর মাছ ভাত মেখে তুরানের মুখে তুলে দিলো। মাছের কাঁটা বাচতে বাচতে বললো,
-‘ সকাল থেকে টিউশনি তারপর ভার্সিটি, ভার্সিটি থেকে এসে আবার রান্না। বিরক্তিকর বিষয়! আর আমি খাবার নিয়ে আসলেও চেঁচামেচি করেন। তার চেয়ে বরং একটা কাজ করুন আম্মুর কাছে আমাদের বিয়ের কথা বলুন। আর কষ্ট করে রাঁধতে হবে না।’
-‘ আমার লেখাপড়া কমপ্লিট হতে আর মাত্র কয়েক টা মাস।তারপর বলবো।’
তুরান একটু থেমে বললো,
-‘ আচ্ছা আমাদের সম্পর্ক উনারা মানবে তো?’
রুপা ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
-‘ কেউ মানলে মানুক, না মানলে নাই। আই ডোন্ট কেয়ার।’
রুপার কথা বলার ভঙ্গি দেখে তুরান না হেসে পারলো না।
-‘ বাব্বাহ এত সাহস!’
তুরান কিছুক্ষণ ভেবে আবার বললো,
-‘ আচ্ছা রুপা তোমার আসল গার্ডিয়ান তো তোমার মা-বাবা। তাঁরা মানবে তো?’
রুপা মুহূর্তেই মুখ ফ্যাকাশে করে বললো,
-‘ বললাম না কারো মানা ,না মানা দিয়ে আমার কিছু এসে যায় না।’
-‘ তুমি কি ছোট বেলা থেকে এখানে থাকো?’
কথাটা বলে জিব কাটলো তুরান। রুপা যদি রেগে যায়। কিন্তু তুরানের ভাবনা মিথ্যা হলো। রুপা স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
-‘ না।’
কিছুক্ষণ থেমে রুপা আবার বললো,
-‘ আমার একটা অসুখ হয় তারপর থেকে আমি এখানে থাকি। আমি প্রথম প্রথম থাকতে চাই নি কিন্তু আমায় জোর করে এখানে রেখেছে। কয়েকদিন থাকার পর আমি বুঝলাম উনারা অনেক ভালো মানুষ। তাই আমি উনাদের মা-বাবা ডাকি। আর আমার যে অসুখ হয় ,সে অসুখের ডাক্তার সাহেলা আম্মু। এই দেশের সব চেয়ে ভালো ডাক্তার। এগুলো আমি প্রথম প্রথম বুঝতাম না, এখন এগুলো বুঝতে শিখেছি। সাহেলা আম্মু আমায় সব শিখাচ্ছে।’
তুরান থ হয়ে তাকিয়ে রইলো। নিজেকে সামলে বললো,
-‘ কি অসুখ হয়েছে তোমার?’
রুপা হেসে বললো,
-‘ এই যে ধরুন অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড করি, তাছাড়া আমার অনেক কিছু মনে থাকে না। এসব রোগ।’
রুপা এবার মুখ গম্ভীর করে বললো,
-‘ এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা করলে ভালো হবে না। ভালোলাগে না আমার এসব নিয়ে কথা বলতে।’
তুরান আর কথা না বলে খেয়ে নেয়। রুপা যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে। তুরান চিন্তিত মুখে খাচ্ছে। খাওয়া শেষ হলে রুপা চলে যায়। তুরান বারান্দায় পাতানো চেয়ারের উপর বসে। অনেক প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে তুরানের মাথায়। রুপা একটু এবনরমাল। অনেক মানুষ জন্ম থেকেই একটু অদ্ভুত প্রকৃতির থাকে, তুরান ভেবেছে রুপা সে রকমেরই। রুপার প্রেমে এতটাই মগ্ন হয়েছে যে এসব নিয়ে জানারও চেষ্টা করে নি।
তুরান জানতো সাহেলা বেগম ডাক্তার, তবে কোন বিষয়ে তা জানতো না। তুরানের মনে হচ্ছে এগুলো সব জানা খুব জরুরী। রুপার বাবা-মা আছে, রুপার চলাফেরার ধরনে বুঝা যায় রুপা ভালো ফ্যামিলির মেয়ে। রুপার লেখাপড়া না করার কারনও বা কি? এমন তো না যে জন্মের পর স্কুলেই যায় নি। নিশ্চয়ই কোন কারন আছে।
এতদিন তুরানের এসব প্রশ্ন মাথায় আসলেও, এতসব ভাবে নি। কিন্তু আজ কেন জানি ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। তুরানের প্রথম জানতে হবে সাহেলা বেগম কোন বিষয়ে স্পেশালিস্ট? তুরান অনেকক্ষণ বসে বসে ভাবলো।
.
রুপা বসে বসে হাতে মেহেদি লাগাচ্ছে আর গুনগুন করে গান করছে। যখন সময় কাটানোর কোন উপায় খুঁজে না পায় তখনই হাতে মেহেদি লাগাবে নয়ত আঁকা জোকা করবে। সাহেলা বেগম রুমে বরীন্দ্র সংগীত বাজাচ্ছে। রুপার কানে ভেসে আসছে গানের শব্দ। রুপা নিজের মনে হেসে বললো,’ মন্দ নয়,ভালোই।’
রুপার হাতে মেহেদি লাগানো শেষ হতেই আস্তে আস্তে তুরানের রুমে যাওয়ার মনস্থির করলো। সাহেলা বেগম দেখলে বকবে। তাই পা টিপে টিপে তুরানের রুমের দিকে যাচ্ছে। হাতের মেহেদি তুরান কে না দেখানো পর্যন্ত শান্তি হচ্ছে না রুপার। রুপা তু্রানের রুমে গিয়ে চমকে গেলো। তুরান ব্যাগ গুছাচ্ছে। এই অসময়ে কোথায় যাবে তুরান?
রুপাকে দেখেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তুরান বললো,
-‘ রুপা বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে খুব। কথা বলতে পারছে না। আমি গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি।’
তুরান ব্যতীত গলায় কথা গুলো বললো। তুরান কে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। তুরানের চোখে পানি ছলছল করছে।
রুপা কোন কথা বলছে না। এঅবস্থায় যে কাউকে সান্ত্বনা দিতে হয় এই দায়িত্বজ্ঞান টুকুও বোধ হয় রুপার নেই। তুরান রুপার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে বললো,
-‘ আমার এক্ষুনি যেতে হবে। আমি তোমার কাছে বলে যেতাম, তা তুমিই এসে পড়লে। মন খারাপ করো না বাবাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি এসে পড়বো এখানে ডাক্তার দেখাতে।’
তুরান উদ্ভ্রান্তের মত করছে। রুপার চোখে বেয়ে জল গড়াচ্ছে। রুপা কান্না চেপে বললো,
-‘তাড়াতাড়ি এখানে নিয়ে আসবেন বাবাকে। ডাক্তার দেখালে ঠিক হয়ে যাবে।’
তুরান রুপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
-‘ কেঁদো না পাগলি। আমি খুব শীঘ্রই এসে পড়বো। শুধু বাবার জন্য দোয়া করো। বাবার কিছু হয়ে গেলে আমার পৃথিবী থমকে যাবে।’
তুরান কিছুক্ষণ চুপ থেকে কষ্ট ভরা কন্ঠে আবার বললো,
-‘ আমায় নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন,আমি বড় হবো অনেক। চাকরি করবো। পরিবারের হাল ধরবো, সব অভাব ঘুচে যাবে। সেদিন হয়ত বেশি দূরে না। বাবার এই স্বপ্ন গুলো যদি অপূর্ণ থেকে যায়..।’
তুরান এই পর্যন্ত বলে থেমে যায়। তুরানের চোখ বেঁয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। রুপা তুরান কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কিছুক্ষণ পর রুপা কান্না থামিয়ে বললো,
-‘ সব সময় ভালো চিন্তা করবেন। তাহলে সবকিছু ভালো হবে। আপনি বাবাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন।’
-‘ তোমার সাথে তো যোগাযোগ করার কোন সুযোগ নেই। তোমার কাছে একটা মোবাইল থাকলে কোন প্রবলেম হতো না।’
তুরান ব্যাগ গুছিয়ে রওয়ানা হয়। রুপা ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রুপা তুরানের সাথে গেট পর্যন্ত যায়। তুরান কে যতক্ষন দেখা গেছে ততক্ষন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রুপা। তারপর দৃষ্টি বিলীন হয়ে যায়। আর দেখা গেলো না তুরান কে, ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেলো।
রুপা রুমে এসে ধপ করে বিছানায় বসে পরলো। পৃথিবীর সমস্ত একাকিত্ব , শূন্যতা যেন ভর করেছে রুপার উপর। তুরান কখন ফিরবে? যদি কখনো না ফিরে? অদ্ভুত অদ্ভুত ভাবনায় তলিয়ে যাচ্ছে রুপা।
তুরান কে ছাড়া থাকার কথা ভাবতেও পারে না রুপা। যেমন টা চলছিলো, এমন ভাবেই যদি সারাটা জীবন চলতো! রুপা নিঃশব্দে কাঁদছে। ধীরে ধীরে কান্নার বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রুপা কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো।
রুপার ঘুম ভাঙে সাহেলা বেগমের ডাকে।রুপা ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলো । রুপার চোখ গুলো ফুলে আছে। চুল গুলো উস্কখুস্ক দেখাচ্ছে। চেহেরায় ক্লান্তির ছাপ।
সাহেলা বেগম রুপার পাশে বসলো। রুপার চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
-‘ কি হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে? শরীর খারাপ লাগে নাকি? কোন বিষয়ে মন খারাপ?’
রুপা শুকনো মুখে বললো,
-‘ না কিছু হয় নি।’
সাহেলা বেগম রুপার সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বসলো,
-‘ রুপা তুই বোধ হয় ভুলে যাচ্ছিস আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। মানুষের চোখ দেখেই বুঝতে পারি মনে কি চলে।’
রুপা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললো,
-‘ ঘুম থেকে উঠেছি তো তাই একটু শরীর খারাপ লাগছে।’
সাহেলা বেগম কথা না বাড়িয়ে বললো,
-‘পূজা আসবে আজকে।’
রুপা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে সাহেলা বেগমের দিকে তাকালো। সাহেলা বেগম আবার বললো,
-‘ আরে তোর আম্মু আসবে।’
রুপা মাথা নিচু করে বললো,
-‘ও।’
সাহেলা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-‘ তোর মায়ের সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করবি না। যদি এবার কোন উল্টাপাল্টা করিস তো খারাপ হবে। তোর মা কতদিন তোকে দেখতে এসে আড়াল থেকে দেখে গেছে। তোর সামনে আসে নি।একজন মায়ের জন্য এটা কত কষ্টের তা কি তুই জানিস?’
রুপা আনমনে বললো,
-‘ করবো না খারাপ বিহেভ। যদি আমায় আলতু-ফালতু কথা জিজ্ঞেস না করে। তাঁরা এমন সব কথা বলে যে আমার মাথায় পেইন শুরু হয়ে যায়।’
এই টুকু বলে আবার তু্রানের কথা ভেবে মন খারাপে তলিয়ে যায় রুপা। কারো সাথে কোন রকম কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। রুপার সমস্ত চিন্তাভাবনা তুরান কে ঘিরে।
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here