যদি তুমি জানতে’পর্ব-৩৫

0
568

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_35
দারোয়ানের কাছে রুপার অসুস্থতার কথা শুনে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে ছিল তুরান। কিছু সময়ের ব্যবধানে সব ওলটপালট হয়ে গেলো, সব কিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে তুরানের যেন এখুনি ঘুম টা ভেঙে যাবে। দারোয়ানের কথা বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না তুরান। শেষ পর্যন্ত গেটের ভিতরে ঢুকলো। কত পরিচিত সব কিছু! এই সেই বারান্দা যেখানে রুপা দাঁড়িয়ে থাকত। তুরানের চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। বুকের ভিতরের কষ্ট গুলো আরো প্রকট হচ্ছে ক্রমশ। আজিজ চৌধুরীর বাসার মেইন গেটে বড়সড় একটা তালা ঝুলানো। তুরান বার বার তাকাচ্ছে বাসাটার দিকে,
স্মৃতি বিজড়িত প্রত্যেক টা জায়গা। তুরানের চিৎকার দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। তুরান এলোমেলো পায়ে গেটের বাইরে চলে আসলো। ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে পিছনে। কিছুদূর গিয়ে তুরান আবার ফিরে আসলো। এসে দারোয়ান কে জিজ্ঞেস করলো,
-‘রুপা‌ কে কেন হসপিটালে নেওয়া হয়েছে ?কোন হসপিটালে নেওয়া হয়েছে ?’
দারোয়ানের এক ফালি হেসে বললো,
-‘জানি না বাবা কিছুই।’
দারোয়ানের হাসির মানে খুঁজে পেলো না তুরান। তবে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসির মানুষ টা কেও কুৎসিত লাগবে।
তুরান পুনরায় হতাশ হলো, আশাহত হয়ে ফিরে গেলো।
অনেকক্ষণ হয়ে গেল রুপা কে দিশেহারা হয়ে খুঁজছে তুরান। দুই চোখ যে দিকে যায় সেদিকেই রুপা কে খুঁজে বেড়ায় তুরান। তুরান জানে রুপা কে এসব জায়গায় থেকে লাভ নেই, তবুও অবচেতন মনে খুঁজতে লাগলো।
তুরানের হঠাৎ মনে হলো বাবা-মায়ের কথা। সকাল হসপিটাল ছাড়ার কথা ছিলো, এখন দুপুর হয়ে গেলো। পৃথিবীর সমস্ত কিছু ভুলে ছিলো এতক্ষণ তুরান। এপর্যায়ে আরেকটা চিন্তা এসে জড়ো হলো তুরানের মাথায় তা হলো এই মুহূর্তে বাসা পাবে কই?মাসের মাঝামাঝি সময় এখন। বাবা-মা কে নিয়ে কোথায় যাবে এখন? চিন্তায় মাথা ধরে যাচ্ছে তুরানের। এমন সিচুয়েশন ফেস করার জন্য তুরান মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।
.
হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে রুপা। জ্বরের চোটে হুঁশ নেই। জ্বর এখনও কমেনি। জ্বরে বেহুঁশ রুপা এখনো জানেই না যে তাঁর ভালোবাসার মানুষটার সাথে কত দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে তাঁর। জানবেও বা কেমনে? জ্বরের জন্য চোখ মেলেই তাকাতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে সাহেলা বেগমও রুপা কে এসব নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে নি। রুপার বাবা-মাও আসছে হসপিটালে। সাহেলা বেগমের মুখে চিন্তার ছাপ। নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে সাহেলা বেগমের। রুপার বাবা-মা সাহেলা বেগমের প্রতি আস্থা রেখে রুপা কে সাহেলা বেগমের বাসায় রেখেছিলো চিকিৎসার জন্য। আর এখন যদি রুপার বাবা-মা তুরান আর রুপার সম্পর্কের কথা জানে তাহলে সাহেলা বেগম কিভাবে মুখ দেখাবে রুপার বাবা-মা কে? রুপার জীবনে কত যে একটা কালো অধ্যায় আছে! সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে পারছে না আজও রুপা। তার উপর বিপরীত ধর্মের দুই জন মানুষ আর রুপাকে এতটা ভালোবাসে প্রনয়! সেখানে সাহেলা বেগম কি করে তুরান কে সায় দিবে? সায় দিলেই কি এই সম্পর্ক সম্ভব? সাহেলা বেগম জানে তুরান যথেষ্ট ভালো মানুষ হিসেবে! কিন্তু রুপা আর তুরানের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলেই সাহেলা বেগম হিংস্র হয়ে উঠে। কত চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত রুপা কে একটা সুস্থ জীবন দেওয়ার জন্য , হাজার হোক রুপা সাহেলা বেগমের পেশেন্ট। আর এমন একটা পরিস্থিতি তে বাঁধ হয়ে দাঁড়িয়েছে রুপা আর তুরানের সম্পর্ক। রুপার জীবন থেকে তুরান কে সরিয়ে দিলে আবার কত শত পাগলামি করে রুপা কে জানে? এরকম একটার পর একটা এক্সিডেন্ট রুপার লাইফে ঘটতে থাকলে মেয়েটি কিভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে? সে কি আদৌ সম্ভব? সব বিপদ কি রুপার জন্যই?
এপর্যায়ে খুব বেশি বিরক্ত হয়ে গেছে সাহেলা বেগম। সাহেলা বেগমের এখন মনে হচ্ছে রুপার দায়িত্ব নিয়ে ভুল করেছেন। তুরানের মত একটা মিউচুয়াল ছেলে কিভাবে রুপার সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারলো?
তুরান কি জানে না রুপা হিন্দু? এত কষ্ট করে তিলে তিলে রুপা কে সুস্থ করে তুলছে আর সেখানে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা! সাহেলা বেগমের মেজাজ ক্রমশ খারাপ হচ্ছে।
সাহেলা বেগম কে এভাবে আনমনে বসে থাকতে দেখে আজিজ চৌধুরী এগিয়ে গেলো সাহেলা বেগমের দিকে।
সাহেলা বেগমের মুখ দেখেই বুঝতে পারছে রুপার বিষয় নিয়ে চিন্তা করছে। ব্যাচেলর ছেলেদের এজন্যই বাসা ভাড়া দিতে নেই।
আজিজ চৌধুরী গিয়ে সাহেলা বেগমের পাশে বসলো। আজিজ চৌধুরীর উপস্থিতি টের পেলো সাহেলা বেগম।
-‘এত কি ভাবছো শুনি?’
সাহেলা বেগম মুখ তুলে তাকালো আজিজ চৌধুরীর দিকে। ক্ষীণ শ্বাস ফেলে বললো,
-‘কই কিছু না তো।’
-‘অত ভাবাভাবির কাজ নেই আমাদের আর। যাঁদের মেয়ে তাঁদের কাছে দিয়ে দেও।’
আজিজ চৌধুরী একটু থেমে আবার বললো,
-‘মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে একদম রুপা তাই না? দুনিয়াধারির কিছুই বুঝেনা! প্রেমটা তো ভালোই বুঝে। জাতে পাগল তালে ঠিক!’
সাহেলা বেগম এক রাশ বিরক্তি নিয়ে আজিজ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘এত চেঁচামেচি করেছো কেন? আস্তে কথা বলো এটা হসপিটাল! তাছাড়া রুপার বাবা-মা এখানে, শুনে ফেলবে ওরা। আর স্বার্থপরের মত কথা বলছো? মেয়েটার জীবনে যা ঘটেছে তাতে মানসিক ভারসাম্য হারানো অস্বাভাবিক কিছু না। রুপা যদি তোমার মেয়ে হতো?’
-‘ সব সময় ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করবা না। ওর জীবনে যা হয়েছে সত্যিই দুঃখজনক। তাই বলে অন্যের মেয়ের গ্লানি আমরা আর কতদিন বয়ে বেড়াবো? আচ্ছা মানলাম ওর সমস্ত দায়িত্ব আমরা পালন করবো! এর মানে এই না ওর জন্য আমাদের মান-সম্মান‌ নষ্ট করবো।’
সাহেলা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-‘তোমার এই আজাইরা প্যাঁচাল আমার শুনতে ভালো লাগছে না সেটা কি তুমি বুঝতে পারছো?’
-‘এগুলো আজাইরা প্যাঁচাল না? আচ্ছা রুপা তো আমাদের মেয়ের মত। আনফরচুনেটলি রুপার সাথে তুরানের সম্পর্ক হয়ে গেছে , মনে করো আমরা রুপা কে গাইডলাইন দিয়ে ঠিকমতো রাখতে পারি নি এটা আমাদের ফল্ট। কিন্তু এই সম্পর্কের কথা যদি রুপার বাবা-মা জানে তবে আমাদের দিকে আঙুল তুলে দোষারোপ করতে ভাববে না একবার। আমরা তাঁদের মেয়ের জন্য কি করেছি কি না করেছি সেটাও ভাববে না। দুনিয়াটা বড্ডো স্বার্থপর।’
-‘ প্যাঁচিয়ে গ্যাচিয়ে কথা না বলে সোজাসুজি বলো কি বলতে চাও? রুপা কে ওর বাবা-মায়ের কাছে দিয়ে দিবো এটা চাও?’
-‘এছাড়া আর উপায় কি? রুপা যখন সুস্থ হয়ে তুরানের কথা জিজ্ঞেস করবে তখন কি করবে? ওকে ওর বাবা-মায়ের কাছে দিয়ে দেও,কারো কাছে এসব জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাবে না । আর আমাদের জিজ্ঞেস করলে বললো তুরান বাসা ছেড়ে চলে গেছে আমরা কিছুই জানি না।’
সাহেলা বেগম কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
-‘হুম।’
-‘ আমরা তুরানের প্রতি রাগের বশে যা করেছি তা অন্যায়।’
সাহেলা বেগম অগ্নিচোখে আজিজ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘তুরানকে যদি পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতাম তাহলে কি ও বুঝতো? কখনোই বুঝতো না। হয়ত রুপাকে নিয়ে পালিয়ে যেতো। তাই যা হয়েছে রুপার জন্যও ভালো হয়েছে তুরানের জন্যও ভালো হয়েছে।’
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here