#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_36
দুপুরের কাঠফাঁটা রোদের মধ্যে হন্য হয়ে বাসা খুঁজছে তুরান। ব্যস্তময় শহরের সব দিকে ব্যস্ততা। এত ব্যস্ততার মাঝেও অসহায়ত্বে গ্রাস করছে তুরান কে। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় কেউ সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে কেউ বা ঘুমের ওষুধ খেয়ে বেঘোরে ঘুমায়। কেউবা বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু সেসবের কিছুই তুরানের করা সম্ভব না । তুরানের কাঁধে যে অনেক দায়িত্ব। তিন বোনের দায়িত্ব, বাবা-মায়ের দায়িত্ব যাঁরা প্রতিনিয়ত অভাবের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এত অসহ্য যন্ত্রণা, এত অসহ্য বিরহের মাঝেও তুরান কাঁধে দায়িত্ব নিয়ে বেড়াচ্ছে।
তুরান ক্লান্ত হয়ে রাস্তার কাছে বেঞ্চে বসে পড়লো। ক্লান্ত শরীর, ক্লান্ত সব চিন্তাভাবনায় হতাশ হয়ে বসে রইলো তুরান। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো রুপার কথা। রুপার প্রতিটি পাগলামি ,রুপার সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্ত। তুরান চিৎকার করে উঠলো। এই চিৎকারের মানে রুপা কে ছাড়া থাকা কখনোই সম্ভব না।
তুরানের এখান থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে এখানেই বসে থাকতে। কিন্তু জীবনেরর টানে উঠতেই হবে, হাঁটতেই হবে। এই ক্লান্ত পথ চলতেই হবে। এটাই জীবন! মানুষ ইচ্ছে করলেই পালাতে পারেনা এই ক্লান্ত পথ থেকে।
বাসা খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। কিন্তু বাসা মিলাতো পারলো না। বাবা-মা কে নিয়ে কোথায় যাবে এই অসময়ে? নিজেকেও আরো বেশি অসহায় মনে হতে লাগলো তুরানের। বার বার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠে তুরানের।
.
রুপার জ্বর কিছুটা কমেছে। কিন্তু পুরোপুরি হুঁশ ফিরেনি। খুব বেশি জ্বরের কারনে দিশেহারা অবস্থা রুপার। রুপা চোখ মেলে নিজেকে আবিষ্কার করে হসপিটালে। রুপার মাথার কাছে রুপার বাবা-মা আর ছোট ভাই বসা। সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরী বারান্দায় বসে আছে।
রুপার মা রুপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। জ্বরে একদম ক্লান্ত হয়ে গেছে রুপার।
রুপা নিজের বাবা-মা কে অগ্রাহ্য করে সাহেলা বেগম কে ডাক দিলো। রুপার ডাকে সাড়া দিয়ে সাহেলা বেগম রুমে আসলো। সাহেলা বেগম কে দেখে রুপা ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,
-‘আমার জ্বর কমে গেছে বোধ হয় দেখো। এখন বাসায় যেতে পারবো না?’
-‘ হ্যাঁ যেতে পারবে। কিন্তু আমার বাসায় না তুমি এখন থেকে তোমার বাবা-মায়ের সাথে থাকবে।’
রুপা বিস্ময়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-‘ বাবা মায়ের সাথে থাকবো মানে?’
সাহেলা বেগম ফিকে হেসে বললো,
-‘ মানে খুব সহজ।’
সাহেলা বেগম রুপার বাবা-মা কে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো,
-‘ এঁদের সাথে থাকবে।’
-‘ আমি তাঁদের সাথে কেন থাকতে যাবো? আমার ওখানে মন টানে না। তবুও কেন জোর করছো? আমি তোমাদেরকে বাসায় থাকলে খুব বেশি প্রবলেম হয় তোমার? আমার প্রতি তোমাদের একটুও মায়া হয়নি যে আমায় জোর করে বিদায় করে দিতে চাচ্ছো।’
এক নাগাড়ে একটার পর একটা কথা বলেই যাচ্ছে রুপা। সাহেলা বেগম তেমন কোন উত্তর দিচ্ছে না। সাহেলা বেগমের আচরণে রুপার মা ও অবাক না হয়ে পারলো না । সাহেলা বেগম ই তো রুপা কে কত আগ্রহ করে নিজের বাসায় রাখলো! কিন্তু আজ হঠাৎ হলো কি?
সাহেলা বেগম রুপার মায়ের উদ্দেশ্য বললো,
-‘আমি মাঝে মাঝে না হয় তোর বাসায় গিয়ে ওকে ট্রিটমেন্ট করে আসবো।’
রুপার মা বললো,
-‘ রুপা এখন থেকে আমাদের সাথে থাকবে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু তুই তো সব সময় বলতি রুপা সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তোর বাসায় থাকবে। আজ হঠাৎ রুপা কে আমাদের কাছে দেওয়ার জন্য এত তোরজোর করছিস এর পিছনে কি কোন কারন রয়েছে?’
-‘ না,না কি কারন থাকবে আবার? তোর তো একটাই মেয়ে , প্রত্যেক মা ই চায় সন্তান কে কাছে রাখতে। তাছাড়া রুপা আমার বাসায় ছিলো ট্রিটমেন্টের জন্য। রুপা প্রায় সুস্থ এখন, বাকী চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যা।’
সাহেলা বেগমের কথা শুনে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে রুপা। কেমন অপরিচিত মানুষের মত আচরণ করছে সাহেলা বেগম। রুপা আচমকা সাহেলা বেগম কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কান্না ভেজা কন্ঠে বললো,
-‘ আমি তোমাদের বাসায়ই থাকবো। কোথায়ও যাবো না।’
রুপার কথা শুনছে না সাহেলা বেগম। সাহেলা বেগম জানে রুপা কেন যেতে চাচ্ছে না। সাহেলা বেগম এখন শুধু চাচ্ছে যে করেই হোক রুপা কে রুপার বাবা-মায়ের কাছে দিয়ে আসা। রুপা যদি তুরানের সাথে পালিয়ে যায়?তখন কি করবে সাহেলা বেগম? কি জবাব দিবে রুপার বাবা-মা কে? রুপার বাবা-মা তখন সাহেলা বেগম কে দোষারোপ করতে এক মূহুর্তও চিন্তা করবে না। আর দুই জন বিপরীত ধর্মের মানুষের প্রেমের বিষয় কে কিভাবে সাপোর্ট দিবে সাহেলা বেগম? রুপা যদি সম্পূর্ণ সুস্থ হতো কিংবা হিন্দু না হতো তাহলে হয়ত এমন সিদ্ধান্ত সাহেলা বেগম নিতো না। এর জন্যই সাহেলা বেগম কঠোর হতে বাধ্য হয়েছে। তুরানের প্রতি অন্যায় করেছে কিন্তু সাহেলা বেগমের ভাবছে এই অন্যায় টাই তুরানের জন্য মঙ্গল।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো রুপা রুপার বাবা-মায়ের সাথেই থাকবে। সাহেলা বেগম কিছুতেই রুপার দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। রুপা রুপার বাবা-মায়ের কাছে থাকবে এতে রুপার বাবা-মায়ের মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে যেতে লাগলো কিন্তু সাহেলা বেগমের হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারন খুঁজে পাচ্ছে না।
রুপা ফ্লোরে পা আছড়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো। কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেলো। রুপার আজকের এই কান্না সাহেলা বেগমের মন ছু্ঁতে পারছে না বোধ হয়। আজিজ চৌধুরী নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
কষ্টে রুপার বুক ফেটে যাচ্ছে। তুরান কে ছাড়া কিছুতেই থাকা সম্ভব না। রুপা জানেই না সাহেলা বেগমের বাসায় গেলেও তুরান কে পাওয়া সম্ভব না।
কাঁদতে কাঁদতে সেন্সলেস হয়ে গেলো রুপা। বেহুঁশ অবস্থায়ই রুপা কে গাড়িতে করে নিয়ে চললো রুপার বাবা-মা।
.
তুরান এক রাতের জন্য তুরানের বন্ধুর বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। তুরান তুরানের বাবা-মা কে নিয়ে বন্ধুর বাসায় উঠলো। তুরানের বাবা-মা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না তুরানের বন্ধুর বাসায় যেতে। তাঁরা গ্রামের বাড়িতেই চলে যেত চাইলো। তুরান অনেক বুঝিয়ে তাঁদের এখানে রাখলো। তুরান খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারলো তুরানের উপর তুরানের বাবা-মা চাপা অভিমান করে আছে।
চলবে..