এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️পর্ব-২৩

এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️পর্ব-২৩
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️

গোটা শহরজুড়ে ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে।রজনীর গভীরতম প্রহর বিদ্যমান।আশেপাশের কোন বাড়িতেই আলো জ্বলছেনা।রাস্তার হেডলাইটের বাতিগুলোই অন্ধকার কাটানোর একমাত্র উৎস্য।
মাঝেমধ্য দু একটা কুকুরের আগ্রাসি বাঁকবিতন্ডতা।তারপর আবারো সব নিশ্চুপ।
মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা চিড়ে মৃদু ক্যাঁড় ক্যাঁড় আওয়াজ তুলে আলমাড়ি খুললো তোহা।তার আলমারি জুড়েই তিহানের দেয়া শাড়ি ঝুলছে।ড্রয়ারের ভেতর ঠেসে রাখা তিহানের দেয়া রাশি রাশি কাঁচের চুড়ি,কানের দুল।এই লোকটা তাকে নিয়ে মার্কেটে গেলেই পাগলামি করে।এসব কিনে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।এই ভয়ংকর প্রেমিক পুরুষকে মানা করারও স্বাধ্যি নেই তোহার।ফলস্বরূপ আলমারিতে কোন জায়গা অবশিষ্ট নেই আর।
আর আতিয়া যদি বলে,”এতকিছু কেনো কিনেছে?”তবে তিহানের সহজ সরল উওর হয়,”তিহু জেদ করেছে তাই কিনে দিয়েছে।”এ নিয়ে এপর্যন্ত মায়ের কম বকা শোনেনি তোহা।

বেশ অনেকক্ষণ যাবত একটা একটা করে শাড়ি দেখে সাদা রংয়ের একটা সুতির শাড়ি হাতে নিলো তোহা।
সাদার মধ্য সাদা সুতার কাজ করা।স্নিগ্ধশীতল মনকাড়া একটা শাড়ি।একটু হাসলো তোহা।শাড়িটায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে পাশের ড্রয়ের খুললো।লাল রংয়ের ব্লাউজের সাথে মিলিয়ে দুমুঠো লাল রেশমী চুড়ি বের করে বিছানার উপর রেখে আলমারিটা খুব আস্তে করে আটকে দিলো।এই মধ্যরাতে শাড়ি পরাটা নিছক ছেলেমানুষি হলেও এটাকেই এই মূহুর্তে মন ভালো করার ওষুধ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে তোহা।বলা বাহুল্য,আজও সারাদিন তিহানের খবর পায়নি সে।

কুঁচিগুলো গুঁজে নিয়ে শাড়ির আচঁলটা আলগা করেই গায়ে জড়ালো তোহা।কোন সেফটিপিনের ঝামেলা নেই।চুলগুলো আঁচরে নিয়ে খোঁপা করে মাঝখানে একটা খোঁপার কাঁটা ঢুকিয়ে নিলো।হাতে মাত্র দুটো চুড়ি পরেছে তখনই চিরচেনা একটা গুনগুন করা কন্ঠ কানে এসে অতি আকাঙ্ক্ষিত কিছুর জানান দিলো তাকে।একপলক থমকালো তোহা।ষষ্ট-ইন্দ্রিয়র বদৌলতে ঘটনার অর্থোদ্ধার হতেই চমকে উঠলো সে।ঠোঁটেজুড়ে খেলে গেলো অবিস্বরণীয় হাসির ঝলক।ছলছলে কাঁপা পায়ে বারান্দায় যেয়ে পাশের বারান্দায় চোখ পরতেই একটা কালো সুঠামদেহী অবয়ব দেখামাত্র চোখজোড়া পানিতে টলমল করে উঠলো তোহার।
আর একমূহুর্ত দেরি করলোনা সে।উদ্ভ্রান্তের মতো ড্রয়ের হাতরে তিহানদের ফ্ল্যাটের চাবি খুঁজে নিয়ে বিনাশব্দে বেরিয়ে পরলো।বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে রইলো লাল রেশমী চুড়িগুলো।তৃষ্ণার্থ প্রেমিকার প্রণয়পিপাসা দেখে যেনো তারাও বিদ্রুপ করে হাসছে।প্রেমিকের অপেক্ষা বুঝি এতোটাই পীড়াদায়ক?
_______________
মৃদুমন্দ হাওয়ায় মন ভাসাতে না পেরে ঘরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হচ্ছিলো তিহান।পেছনে ঘুরতেই তার পাগলপ্রায় প্রাণপ্রেয়সীর হামলে পরা ধাক্কায় আচমকাই বেসামাল হয়ে পরলো সে।দু’কদম পিছিয়ে রেলিংয়ের সাথে শরীর ঠেকে যেতেই নিজেকে যথাসম্ভব সামলানোর চেষ্টা করলো।
দুহাতে আষ্টেপিষ্টে তার গলা জড়িয়ে ধরেছে তোহা।যেন ছেড়ে দিলেই সে আবার পালিয়ে যাবে।
পায়ের পাতা সর্বোচ্চ উঁচু করে দাড়ানো সত্ত্বেও তোহার মাথা তিহানের গলা অবধি পৌছায়নি।বুকের উপরিভাগের সাথে জড়িয়ে আছে।প্রবল কান্নার দমকে গায়ের পাতলা টি-শার্ট ভিজে যাচ্ছে তিহানের।
গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা প্রেয়সীর মেয়েলি উষ্মতায় বুকের ভেতরের নিদারুণ ঝড়ো হাওয়া ইতিমধ্য বইতে শুরু করে দিয়েছে।
কয়েকবার ঢোঁক গিললো তিহান।নিজের পুরুষালি মনোভাবটাকে সংযত করে আলতো করে তোহার মাথায় হাত রাখলো।ছোট্ট করে বললো,
—“শান্ত হও।”

তোহা শান্ত হলোনা।উপরন্তু গুনে গুনে দুদিন পর তিহানের কন্ঠ শুনে কান্নার মাত্রাটা হু হু করে বেড়ে গেলো তার।কাঁদতে কাঁদতেই সে থেমে থেমে বললো,
—“আপনি..আপনি কোথায় ছিলেন?আমি..আমিতো”বলতে বলতেই হেঁচকি উঠে গেলো তার।

মাথায় রাখা হাতটা চুলের ভাঁজে গলিয়ে দিয়ে তাকে থামালো তিহান।নিচু কন্ঠে বললো,
—“আচ্ছা,এখনতো এসে পরেছি।”তার কথাবার্তা কোনোকিছুই কাজে দিলোনা।তোহার চোখের জলগুলো আজ বাঁধ মানার নয়।

ছোট করে একটা অস্থিরতম শ্বাস ছাড়লো তিহান।কান্নারত মেয়েটার কান্না থামাতে না পেরে নিজেকে চরম অধম মনে হচ্ছে।কিছুক্ষন চুপ থাকলো সে।অত:পর কোমল মোলায়েম কন্ঠে আঁকুতি নিয়ে বললো,
—“আর কেঁদোনা।থামো।”তিহানের শান্তশিষ্ট মোহময় কন্ঠে আরো কয়েকবার ফুঁপিয়ে উঠে কোনরকম থামলো তোহা।তবে তিহানকে ছাড়লোনা।

একটু হাসলো তিহান।তোহার শাড়ি অগোছালো।হাত উঁচিয়ে গলা ধরে রয়েছে বিধায় কোমড়-পিঠের অনেক অংশই চোখের সামনে দৃশ্যমান।মুহুর্তেই দৃষ্টি সরালো তিহান।ধীর কন্ঠে বললো,
—“এরকম আদুরে খোলামেলা আবেশে আমার সাথে লেপ্টে থাকলে যেকোনো সময় অনর্থ হয়ে যাবে।তুমি কি চাও আমার দ্বারা কোন অনর্থ হোক?”

কথার মানেটা সহজেই বুঝলো তোহা।লজ্জিত ভঙ্গিতে নতজানু হয়ে তিহানকে ছেড়ে দাড়ালো সে।শাড়ির আচঁল টেনে সামলে নিতেই তিহান হাত বাড়িয়ে তার খোঁপার কাঁটাটা খুলে নিলো।ঘনকালো চুলগুলো পুরো পিঠে ছড়িয়ে দৃশ্যমান অংশগুলো আবৃত করে নিতেই তিহান কাঁটাটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে বললো,
—“খোলাই থাক,বেঁধোনা।”

একপলক তাকালো তোহা।রক্তলাল হয়ে আছে তার ক্রন্দনরত নয়নজোড়া।চোখেমুখে ভেজাভাব।মুখের সামনের চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে নিয়ে সে অভিমানি কন্ঠে বললো,
—“আপনি কোথায় ছিলেন এই দু’দিন?”

উওরে তোহার বাহু ধরে তাকে কাছে টেনে নিলো তিহান।হাত দিয়ে গাল মুছিয়ে দিয়ে বলল,
—“অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম।জরুরি কাজ ছিলো।”

—“আমার ফোন ধরেননি কেনো?কতবার ফোন করেছি আপনাকে।”বলতে বলতেই গলা ধরে এলো তোহার।ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সে।চোখের কোন বেয়ে টুপ করে একফোঁটা জল গড়িয়েই পড়লো।

—“ফোন ধরিনি কারণ আমি তখন প্রচন্ড রেগে ছিলাম তোমার উপর।তুমি তো জানোই রাগলে মাথা
ঠি ক থাকেনা আমার।রাগের বশে আরো উল্টাপাল্টা কিছু বলতে চাচ্ছিলামনা তোমাকে।বুঝতে পেরেছো?”স্বাভাবিকভাবেই উওর দিলো তিহান।

চোখেমুখে অসহায়ত্ব নিয়ে তাকালো তোহা।মাথাটা কাত করে তিহানের বুকে রেখে বললো,
—“আপনি এখনো রেগে আছেন?”

তিহান দুষ্টু হেসে বললো,
—“এমন রূপময়ী হয়ে এতো কাছে এসে এভাবে কান্না করলে রেগে থাকা যায়?অন্তত আমার পক্ষে তো সম্ভব নয়।”

মুচকি হাসলো তোহা।তবে মুখে কিছু বললোনা।চোখ বন্ধ করে ফেলতেই তিহান আবারো তার চুলের ভাঁজে হাত ডুবালো।উপর থেকে নিচে আঙ্গুল দিয়ে আঁচরে দিতে দিতে বললো,
—“এই রাতের বেলা শাড়ি পরে আছো যে?এতরাত অবধি জেগেই বা আছো কেনো?আমাকে দেখলে কি করে?বারান্দায় ছিলে?ঘুমোওনি?”

—“আমি দু’রাত যাবত ঘুমোইনি।”

তোহার এই ছোট্ট কথাটাতেই মনটা বিষিয়ে গেলো তিহানের।চুলে আঁচরাতে থাকা হাতটা থেমে গেলো অজান্তেই।কন্ঠে অদ্ভুত একটা ব্যাথা নিয়ে সে বলল,
—“খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি?”

—“খুব বেশি শান্তি দিচ্ছেন এখন।আপনার এই বুকটায় অনেক শান্তি জানেন?মনে হয় সারাক্ষণ এখানেই ঘুমিয়ে থাকি।”

—“ওটা তোমারই।ওখানটায় মাথা রাখার অধিকারো শুধু তোমার।”

একটু লজ্জা পেলো তোহা।খানিকবাদে উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,
—“আপনি জানেন অনন্তকে..”

—“জানি,সব জানি আমি।এখন আর ওসব বলতে হবেনা।মার থেকে সবটাই শুনেছি আমি।আর যথেষ্ট খুশিও হয়েছি তোমার উপর।”

মাথা তুলে তাকালো তোহা।ঠোঁট এলিয়ে হাসতেই তিহানও হাসলো।হঠাৎ তোহার হাতের দিকে চোখ পরতেই তা আঁকড়ে ধরলো তিহান।কব্জি ধরে তুলে চোখের সামনে এনে সন্দিহান কন্ঠে বললো,
—“দুটো চুড়ি?শাড়ি পরেছো অথচ চুড়ি পরোনি কেনো?লাল চুড়ি নেই আর?”

—“আছেতো,আপনাকে দেখে আর চুড়ি পরায় সময় নষ্ট করিনি।না পরেই চলে এসেছি।”

ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো তিহান।তোহাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে পাশের মোড়ায় বসিয়ে বললো,
—“একটু বসো,তোমার জিনিসগুলো ব্যাগ থেকে বের করা হয়নি।নিয়ে আসি সেগুলো।”

কথার পিঠে তোহাকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই রুমে চলে গেলো তিহান।হতাশ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো তোহা।লোকটা না জানি আবার কোন পাগলামি করেছে!

তিহান ফিরে এলো হাতে বড় একটা ব্যাগ নিয়ে।আরেকটা মোড়া টেনে মুখোমুখি বসে ব্যাগটা তোহার কোলের উপর রেখে বললো,
—“সেদিন তোমার দুটো চুড়ি চাপ দিয়ে ভেঙে ফেলেছিলাম।বহু খুঁজেও ওই সেম ডিজাইনের পাইনি তবে এখানে নতুন বিশটা ডিজাইনের চুড়ি আছে।সুন্দর লেগেছে তাই নিয়ে এসেছি।তোমার পছন্দ না হলে বলো,বদলে আনবোনে।আর একটা শাড়ি আছে।ভালো লাগলো তাই নিয়ে আসলাম।”

—“আপনি কি পাগল নাকি?এতকিছু কোথায় রাখব আমি?”চিন্তিত বিস্মিত কন্ঠ তোহার।

তিহান হেসে ফেললো।বললো,
—“সেটা তোমার ব্যাপার।আচ্ছা,দেখি দাওতো এখানে লাল চুড়ি ছিলো।তোমার হাতদুটো খালি খালি লাগছে।”বলে তোহার হাত থেকে ব্যাগটা টেনে নিলো তিহান।অনেকক্ষণ হাতরে হাতরে পর্যবেক্ষণ করে অবশেষে লাল চুড়ির প্যাকেটটা হাতে এলো তার।ব্যাগটা নামিয়ে রেখে চুড়ির কাগজটা খুললো সে।তোহার হাতের জন্য নিজের হাতটা মেলে ধরতেই আলতো করে তার হাতের উপর হাত রাখলো তোহা।তিহান যত্ন করে খুব সাবধানে তার হাতে চুড়ি গুলো পড়িয়ে দিলো।হাল্কা ঝাঁকিয়ে নিতেই রিনঝিন শব্দতরঙ্গে মুখে প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠলো তিহানের।

—“আপনার গালে কি হয়েছে?”হঠাৎই তিহানের গালের মধ্যভাগটায় হাত ছুঁইয়ে বললো তোহা।

—“সেভ করতে যেয়ে কেটে গেছে।”তোহার অপরহাতে পড়ানো চুড়ি গুলো নাড়াচাড়া করতে করতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উওর দিলো তিহান।

তোহা ঝুঁকে গেলো অনেকটা।কাঁটা জায়গাটায় বৃদ্ধাআঙ্গুল বুলিয়ে নিজেই আর্তনাদ করে বললো,”ইশ!কতখানি কেটেছে।”
বলে আরো একটু সামনে ঝুঁকতেই তিহান তার গালে হাত রেখে আটকে দিয়ে খানিকটা আহাজারি করে ধরা গলায় বললো,
—“আর কাছে এসোনা ‘প্রেমনন্দিনী’।তোমার এই মেয়েলি ঘ্রাণটায় কবে যেনো আমি উন্মাদ হয়ে যাই।”

কথাটা শোনামাত্র যারপরনাই তুমুল লজ্জা ঘিরে ধরলো তোহাকে।একপ্রকার ছিঁটকে সরে অন্যদিকে তাকিয়ে বসলো সে।চোখেমুখে কেমন অস্বচ্ছলতা।তিহানের দিকে তাকানোর সাহস নেই।

তিহান মাথা ঝুঁকিয়ে হাসলো।তার লজ্জায় বুঁদ হওয়া প্রানভোমরাটার চেহারার দিকে তাকালেই মনটা ক্ষনে ক্ষনে ভালো লাগার উচ্চপর্যায়ে পৌছে যাচ্ছে।
হুট করেই তোহার দুগালে দুহাত রাখলো তিহান।নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চোখে চোখ রাখলো।ভড়কে গেলে তোহা।তাকে আরো একটু জ্বালানোর জন্য তিহান খালি গলায় মৃদু স্বরে গাইলো,

হয়তো তোমারই জন্য
হয়েছি প্রেমে যে বন্য
জানি তুমি অনন্য
আশার হাত বাড়াই।

যদি কখনো একান্তে
চেয়েছি তোমায় জানতে
শুরু থেকে শেষ প্রান্তে
ছুটে ছুটে গেছি তাই।
~~
আমি যে নিজেই মত্ব
জানি না তোমার শর্ত
যদি বা ঘটে অনর্থ
তবুও তোমায় চাই।

হয়তো তোমারই জন্য
হয়েছি প্রেমে যে বন্য
জানি তুমি অনন্য
আশার হাত বাড়াই…।

~চলবে~

[সারা বিকাল না ঘুমিয়ে কষ্ট করে এতবড় পর্বটা লিখেছি।তাই আজকে সবাই কমেন্ট করবেন।কমেন্ট পড়ে যেনো আমার মন ভালো হয়ে যায়❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here