রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্বঃ১৯

0
618

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ১৯(Surprise for you)
#Saiyara_Hossain_Kayanat

প্রচন্ড রাগে আরশির গাঁ জ্বলে উঠছে। চিঠির মানুষটার প্রতি খুবই বিরক্ত হচ্ছে এই মুহূর্তে। সাড়ে পাঁচটায় ছাদে আসতে বলেছে অথচ আরশি প্রায় বিশ মিনিট ধরে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে৷ কিন্তু ছাদে তো এমন কিছুই দেখছে না যা দেখে আরশি চমকে উঠবে। আরশি নিজের সাথেই বিরবির করে বলছে-

“উনি নিশ্চয়ই আমাকে বোকা বানানোর জন্য এখানে আসতে বলেছে। বিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছি কিন্তু তেমন কিছুই তো দেখছি না যা আমাকে চমকে দিবে!!”

আরশি আশাহত হয়ে ছাদের দরজার দিকে এগিয়ে যাবে এমন সময় পাশের ছাদ থেকে কেউ একজন ক্লান্তিমাখা কন্ঠে অস্পষ্ট ভাবে বললো-

“মিস আরু।”

আরশি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। ঘাড় বাকিয়ে পাশের ছাদ তাকাতেই একজনকে নিচের দিকে ঝুঁকে থাকতে দেখলো। হাটুতে দুই হাত ভর দিয়ে মাথা নিচু করে খুব জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে রৌদ্র। ক্লান্ত শরীরে নিয়ে এতোটাই গভীর ঘুম দিয়েছিল যে ঘুম ভাঙতেই তার দেরি হয়ে গেছে। পাঁচটা পয়তাল্লিশে ঘুম থেকে উঠে টাইম দেখেই রৌদ্রর মাথা বাজ পড়ে যায়। হন্তদন্ত হয়ে একটা সাদা টিশার্টে গায়ে জড়িয়েই দৌড়ে ছুটে এসেছে। এতো দ্রুত সিড়ি বেয়ে আসার ফলে প্রচুর হাঁপিয়ে উঠেছে রৌদ্র। আরশি ভ্রু কুচকে সরু চোখে তাকিয়ে আছে পাশের ছাদে থাকা মানুষটার দিকে। নিচের দিকে ঝুঁকে থাকার কারনে চেহারা দেখা যাচ্ছে না। পিঠ অস্বাভাবিক অস্বাভাবিক ভাবে ওঠানামা করছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। মাথার সিল্কি চুল গুলো নিচের দিকে ঝুলে আছড়ে পরে আছে।

“মিস আরু দাড়ান।”

রৌদ্র আবারও নিম্নস্বর বলে উঠলো। কথাটা বলেই রৌদ্র সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আরশি প্রথম বার খেয়াল না করলেও এইবার ‘মিস আরু’ নামটা স্পষ্টভাবে শুনেছে। রৌদ্রকে দেখে আরশির চোখ গুলো বিস্ফোরিত বোমার মতো ফুটে উঠেছে। রৌদ্র ছাদের রেলিংয়ের কাছে এসে আরশিকে বলল-

“সরি, আপনাকে অপেক্ষা করানোর জন্য। আসলে ঘুমিয়ে ছিলাম তাই দেরি হয়ে গেছে আসতে।”

আরশি কিছু বলছে না। এখন স্তব্ধ হয়ে আছে। আরশি মনে হচ্ছে এখন আর নিজের মধ্যে নেই। আরশিকে এভাবে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে রৌদ্র দুহাত ভাজ করে গম্ভীর গলায় বললো-

“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন মিস আরু!! আপনার চোখ গুলো তো এখনই বেরিয়ে আসবে মনে হচ্ছে।”

আরশি এখনো চুপ করে আছে। রৌদ্রকে এই সময় এখানে দেখে আরশি অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেছে। রৌদ্র কিছুটা বিরক্ত হয়ে গেল আরশির চুপ করে থাকাতে। রৌদ্র শক্ত গলায় খানিকটা উচ্চস্বরেই বলে উঠলো-

“কথা বলছেন না কেন?? যেভাবে তাকিয়ে আছেন মনে হচ্ছে কোনো ভূত দেখেছেন!!”

ভূতের কথা শুনে আরশি টনক নড়লো। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা টিশার্ট পরা মানুষটাকে এই মুহূর্তে সত্যি সত্যিই ভূত মনে হচ্ছে। এর আগেও সাদা শার্ট পরা অবস্থায় দেখেছিল আর আজকেও!! চারপাশে হাল্কা অন্ধকার হয়ে আসছে। সূর্য প্রায় ডুবেই গেছে পশ্চিম আকাশে শুধু আছে শেষ বিকেলের রক্তিম আভা। পরিবেশটাও আজ কেমন যেন গুমোট হয়ে আছে। আরশির মস্তিষ্কে এই মুহূর্তে এরকম পরিবেশটা ভৌতিক কোনো পরিবেশের থেকে কম মনে হচ্ছে না। দু’হাতে নিজের চোখ কচলিয়ে বার বার চোখের পাপড়ি গুলো ঝাপটিয়ে আবারও রৌদ্র দিকে তাকালো। আরশি কাঁপা কাঁপা গলায় অস্পষ্ট ভাবে ‘ডক্টর’ উচ্চারণ করেই একপ্রকার দৌড়ে ছাদ থেকে চলে গেল। আরশির এমন প্রতিক্রিয়া দেখে রৌদ্র হতভম্ব হয়ে আছে। রৌদ্রর এখন হাসা উচিত নাকি কি করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছে না। রৌদ্র নিজের হাত পায়ে একবার নজর বুলিয়ে নিল। ডান হাতে চুল গুলো পেছনের দিকে ঢেলে দিয়ে আনমনেই বলে উঠলো-

“আমি কি ভূতের মতো দেখতে না-কি!! এই মেয়ে এভাবে ভয়ে সব সময় পালিয়ে যায় কেন অদ্ভুত!!”

রৌদ্র গম্ভীর ভাবে পা ফেলে ছাদ থেকে চলে আসলো। অন্যদিকে আরশি দ্রুত নিজের রুমে এসেই দরজা লাগিয়ে দিল। বড়বড় করে শ্বাস নিচ্ছে আর বিরবির করে বলে যাচ্ছে-

“উফফফ আল্লাহ এই লোকটা সব সময় রাতবিরেতে আমার সামনে চলে আসে কিভাবে!! এই বারও কি আমার হ্যালুসিনেশন না-কি সত্যি সত্যি!!”

আরশি মনে মনে নানানরকম জল্পনাকল্পনা করে যাচ্ছে কিন্তু মাথায় একবারের জন্যেও চিঠির মানুষটার কথা আসছে না। আচমকা আরশির ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। আরশি ফোন হাতে নিয়ে ডক্টরের নাম দেখে রিসিভ করলো না। পরপর তিনবার ফোন বেজে এখন থেমে গেল। একমিনিট যেতেই টুং করে মেসেজ টোন আরশির কানে এলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে রৌদ্রর মেসেজ দেখে ওপেন করলো।

“দু’মিনিটের মধ্যে বারান্দায় আসুন মিস আরু। দেরি করলে আমি নিজেই চলে আসবো আপনার কাছে।”

রৌদ্রর এমন হুমকিস্বরূপ মেসেজ দেখে আরশি একটা শুকনো ঢোক গিলে দ্রুত পায়ে বারান্দায় চলে আসলো। ভয়ার্ত চোখে বার বার নিচে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। আরশির মনে হচ্ছে ডক্টর হয়তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু একপলকের জন্যেও ঘাড় বাকিয়ে পাশের বারান্দায় তাকাচ্ছে না। রৌদ্র দু’হাতে ভাজ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরশির কর্মকাণ্ড দেখে রৌদ্রর আর না হেসে পারলো না। “মেয়েটা এতো বোকা কেন!! এত সহজ বিষয়টা মাথায় ঢুকছে না কেন??” রৌদ্র নিজের মনে মনে প্রশ্ন গুলো করলো। গলা খেকরিয়ে আরশির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো। আরশি তার দিকে তাকাতেই আরেকদফা চমকে উঠলো। রৌদ্র শীতল চাহনিতে আরশির দিকে তাকিয়ে বলল-

“আপনি এতো বোকা কেন মিস আরু!! এতো বড় মেয়ে হয়ে আপনি ভূতের ভয় পান কিভাবে আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না!”

আরশির ভয় চলে গিয়ে এখন রাগের আগুন জ্বলে উঠলো আরশির মাথায়। রাগে তেতে উঠে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো-

“আপনি যখন তখন আমার সামনে আসেন কেন?? আর প্রতি বারই কি এইসব সাদা রঙে শার্ট পরে আসা লাগে না-কি!! আর আপনি এই বারান্দায়…. ”

এতটুকু বলেই আরশি থেমে গেল। কপাল কুচকে গভীর ভাবে কিছু একটা ভেবে শান্ত গলায় বলল-

“আপনি আর চিঠির রৌদ্র একই মানুষ??”

রৌদ্র সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললো-

“প্রথমত সাদা শার্টের ব্যাপারটা সম্পূর্ণই কাকতালীয়। আর দ্বিতীয়ত আমি চিঠির মানুষ কি না সেটা আমার বলার প্রয়োজন নেই আপনারই বুঝে যাওয়া উচিত কিন্তু আপনার এতো বড় একটা মাথা যে এইটুকু একটা ব্যাপারই বুঝে উঠতে পারছে না সেটা আসলেই আপনার আর আমার দুজনের দুজনের জন্যই খুব দুঃখজনক।”

আরশি বিস্মিত হয়ে বলল-

“এই পাখি আর নীল চিরকুটের মালিক আপনি??”

রৌদ্র মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালে আরশি আবারও জিজ্ঞেস করলো-

“আপনি জানতেন আমি এই পাশের বারান্দায় থেকে চিঠি লিখছি??”

রৌদ্র আগেরকার মতো এবারও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আরশি রৌদ্রর দিকে সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল-

“আপনি তাহলে ইচ্ছে করেই এইসব চিঠির খেলা শুরু করেছেন??”

রৌদ্র রেলিঙের উপরদিকটায় দুহাত রেখে গম্ভীরমুখে বলল-

“আবারও বোকাদের মতো কথা বললেন আপনি। যখন চিঠির আদান-প্রদান শুরু হয়েছিল তখন তো আমরা একে অপরকে চিনতামই না তাহলে আমি ইচ্ছে করে করবো কিভাবে??”

আরশি দুহাত ভাজ করে ভাবুক হয়ে বলল-

“তাহলে!!”

রৌদ্র একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বললো-

“যেদিন বাসে আমাদের চুমু.. মানে ঐ অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে ওইদিন আমার হসপিটালে ইমার্জেন্সি ছিল তাই তাড়াহুড়ো করে পাখি গুলো ভিতরে রেখেই চলে গিয়েছিলাম যার কারনে নির্বানকে আসতে বলেছি। আর আপনাকে প্রথম চিঠিটা আমি না নির্বানই দিয়েছিল। আর সেকেন্ড টাইম যখন পা মচকে যাওয়ার কারণে হসপিটালে এসেছিলেন ওইদিনই বাসায় এসে আমি আপনাকে এই বারান্দায় দেখেছিলাম। সেদিন থেকেই আপনি আমার চিঠির রুদ্রাণী। এইসব কিছুই কাকতালীয় ভাবে ঘটেছে।”

“তাহলে এতদিন আমাকে বলেননি কেন??”

রৌদ্র সোজা হয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলল-

“এখনই কি সব কিছু জানতে চাচ্ছেন না-কি মিস আরু!! কিছু কিছু জিনিস আপাতত অজানা থাকুক। সব কিছু জেনে আগ্রহ কমে যাবে তো। আপনাকে চমকে দেওয়ার কথা ছিল সেটা হয়ে গেছে। এখন রুমে যান।”

আরশি কিছুটা আগ্রহ নিয়েই বলল-

“কিন্তু… ”

আরশির কথা বলার আগেই রৌদ্র থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল-

“হুশশ… এখন আর কোনো কথা না। রুমে যান মিস আরু।”

আরশি প্রচন্ডরকম বিরক্ত হয়ে চোখমুখ খিচে গাল ফুলিয়ে রুমে যেতে যেতে নিম্ন স্বরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল-

“আস্ত এক অসভ্য ডাক্তার।”

আরশি কথাটা আস্তে বললেও রৌদ্রর কানে তা স্পষ্ট ভেসে এসেছে। আরশি রুমে যেতেই রৌদ্র একটা মুচকি হাসি দিলো। ডান হাত পকেটে গুজে দিয়ে একটা নীল চিরকুট বের করলো। আরশির বারান্দায় ছুড়ে দিয়েই পাখিগুলোকে খাবার দিতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। রৌদ্রর ঠোঁটের কোণে এখনো হাসি ফুটে আছে। অবশেষে রৌদ্র তার রুদ্রাণীকে চমকে দিল। প্রচন্ডভাবেই চমকে দিয়েছে রৌদ্র।

————————

“কাসফি…. এই কাসফিইইইইই….”

আরশি কাসফিয়ার রুমে যেতে যেতে অনবরত চেচিয়ে ডেকে চলছে কাসফিয়াকে। কাসফিয়া রুম থেকেই বিরক্ত হয়ে ধমকে বলে উঠলো-

“আরশি ষাঁড়ের মতো চেচাচ্ছিস কেন!! ডাকাত ঢুকেছে নাকি তোর রুমে!! ফাজিল”

আরশির কাসফিয়ার রুমের দরজা ঠাস করে খুলে ভিতরে এসে বলল-

“এর থেকেও বড় কিছু হয়েছে রে কাসফি।”

আরশির বিছানায় এসে কাসফিয়ার পাশে বসলো। কাসফিয়া ভ্রু কুচকে আরশিকে জিজ্ঞেস করলো-

“কেন কি এমন হয়েছে যে তুই এতো উত্তেজিত হয়ে আছিস??”

আরশি কাসফিয়ার মুখোমুখি হয়ে দু পা ভাজ করে বসলো। অতিরিক্ত উত্তেজনা নিয়ে বললো-

“কাসফি তুই জানিস চিঠির মানুষটা কে??”

কাসফিয়া বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-

“আমি৷ জানবো কিভাবে তোর চিঠির মানুষ কে!!”

চলবে….
(নিচের কথা গুলো পড়ার অনুরোধ রইলো।)

[বিঃদ্রঃ- আপনাদের কমেন্ট দেখে আমার চোখেমুখে এখন সরিষা ফুল না দেখে ‘নেক্সট’ আর ‘বোনাস’ লেখাটা-ই দেখি।🤦‍♀️ কিছুদিন ধরে খুব ব্যস্ততায় সময় কাটাচ্ছি তবুও আপনাদের অপেক্ষার জন্য আমি রাত জেগে গল্প লেখি। আপনারা বোনাস পর্ব চান অথচ আমি আপনাদের কথা রাখতে পারি না এটা আমার নিজের কাছেই খারাপ লাগে। আমি সুযোগ পেলে অবশ্যই বোনাস দিব প্রমিজ❤️
আশাকরি আমার কথা গুলো বুঝবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম। ধন্যবাদ আর অনেক গুলো ভালোবাসা সবাইকে।❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here