রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্বঃ২৩

0
589

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#বোনাস_পর্ব(বন্ধুত্ব)
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“আমি তোকে আমার খুব কাছের মানুষ ভাবতাম কাসফিয়া। কিন্তু তুই এমন করবি সেটা কখনো ভাবিনি।”

কাসফিয়া ভয়ে জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-

“কি হয়েছে আশু? এভাবে কথা বলছিস কেন?”

কাসফিয়ার এমন কথা শুনে আরশি রাগর জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো। আরশি রেগেমেগে চোখমুখ শক্ত করে সজোড়ে কাসফিয়ার বাম গালে থাপ্পড় মারলো। আরশির থাপ্পড়ে কাসফিয়ার গাল আগুনের মতো জ্বলে উঠলো। কাসফিয়ার হাত আপনা আপনি বাম গালে চলে গেছে। কাসফিয়া চোখ দুটো পানিতে ছলছল করে আরশির দিকে তাকালো। অতিরিক্ত রাগে আরশির গাল আর নাকে হাল্কা রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। কাসফিয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরশিকে কিছু বলার মতো শক্তিটুকুও তার মাঝে নেই। আরশি কাসফিয়া হাত শক্ত করে ধরে হসপিটালের পাশের একটা ফাঁকা জায়গায় টেনে নিয়ে আসলো। কাসফিয়ার কিছু বলছে না স্থির চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। ছোট থেকে আরশি কখনো কোনো কিছু নিয়ে এতটা রেগে যায়নি যে কাসফিয়াকে থাপ্পড় দিবে। হয়তো শাসন করছে ধমক দিয়েছে, বকেছে কিন্তু এরকম ব্যবহার কাসফিয়া কখনো আরশির কাছ থেকে পায়নি।

“কি পেয়েছিস তুই আমাকে?? সব সময় আমাকে বাচ্চা বাচ্চা বলে ডাকিস বলে কি আমি সত্যিই ছোট বাচ্চা নাকি?? কি ভেবেছিস আমি কিছু কিছু বুঝি না!! আমি বেপরোয়া!! বেখেয়ালি!! কখনো কোনো কিছুতে আমার খেয়াল থাকে না!! আমি হয়তো নিজের ব্যাপারে বেখেয়ালি হতে পারি তাই বলে কি আমি আমার আপন মানুষদের খেয়াল রাখি না!! আমার কাছের মানুষদের প্রতিটা জিনিসেই আমি যথেষ্ট খেয়াল রাখি। আমি তোকে আমার সব থেকে কাছের মানুষ ভেবে গেছি। সব সময় সব কথা তোর সাথে শেয়ার করেছি। আর তুই কি করলি?? সব সময় আমার কাছে সব কিছু লুকিয়েই গেছিস। তুই কি ভেবেছিলি তুই না বললে আমি তোর আর আদ্রাফের সম্পর্কে কিছু বুঝতে পারবো না?? আমাকে তোর এতটাই বোকা মনে হয়!!”

কাসফিয়া চমকে আরশির দিকে তাকালো। আরশিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে আরশি ভয়ংকর ভাবে রেগে আছে। কাসফিয়া অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে ফেলল। আরশি আগের থেকেও বেশি রাগান্বিত হয়ে বলল-

“তুই এতটা নিষ্ঠুর হয়েছিস কিভাবে কাসফিয়া?? আদ্রাফকে বার বার এভাবে কষ্ট দিতে পারছিস কিভাবে তুই?? ওর জন্য কি তোর একটুও মায়া হয় না?? এতদিন চুপ করে ছিলাম কিছু বলিনি। ভেবেছিলাম তোদের মধ্যের ব্যাপার তোরা নিজেরাই ঠিক করে নিবি। তুই আজ না হোক কাল হয়তো আদ্রাফকে মেনে নিবি কিন্তু নাহ ছেলেটা বার বার তোর কাছে ভালোবাসার কথা বলে আর তুই প্রতি বারই ওর মন ভেঙে দিচ্ছিস। আদ্রাফ তো তোর কাছে একটু ভালোবাসাই চায় আর তুই প্রতি বার প্রত্যাখ্যান করে ওর মন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিস। কেন এমন করছিস তুই? আদ্রাফ তো কোনো খারাপ ছেলে না। তবুও কেন তুই ওর ভালোবাসা ইগ্নোর করছিস??”

কাসফিয়া নিচের দিকে তাকিয়েই নিম্ন স্বরে বললো-

“আমি ওকে ভালোবাসি না আর আমি কোনো সম্পর্কেও জড়াতে চাই না। আমার এইসব ভালো লাগে না।”

কাসফিয়ার কথা শুনে আরশির রাগ তরতর করে মাথায় উঠে গেল। আরশি ধমকের স্বরে বললো-

“একদম চুপ থাক কাসফিয়া। তোর এইসব মিথ্যা কথা শুনে আমার রাগ কন্ট্রোলের বাহিরে চলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখনই তোকে গলা টিপে মেরে ফেলি। তোকে আমি তোর থেকেও বেশি বুঝতে পারি। তোর চোখে আদ্রাফের জন্য অনুভূতি আমি অনেক আগেই দেখেছি। তুই আদ্রাফের কথা ভেবে মন খারাপ করে বসে থাকতি এমনকি আদ্রাফকে কষ্ট দিয়ে তুই নিজেও ছটফট করতি এসব কোনো কিছুই আমার চোখ এড়ায়নি। কেন তুই ওকে ভালোবেসেও দূরে সরিয়ে দিচ্ছিস?? কোনো কারন বলতে পারবি আমাকে??”

কাসফিয়া কোনো কথা বলছে না। আগের মতোই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আরশিকে বলার মতো কোনো কথাই তো তার কাছে নেই। কি বলবে সে?? আরশির জন্যই সে কোনো সম্পর্কে যেতে চায় না। এটা বলবে?? নাহ এইসব বললে হয়তো আরশি আরও বেশি কষ্ট পাবে। তাই কাসফিয়া নিজের মুখ দিয়ে টু শব্দও বের করলো না। কাসফিয়াকে চুপ থাকতে দেখে আরশি আবারও শক্ত গলায় বললে উঠলো-

“কি বলতে পারলি না তো কোনো কারণ!! আচ্ছা আমিই বলছি তাহলে। এইসব কিছুর পেছনে মূল কারন হলাম আমি। হ্যাঁ আমার জন্যই তুই নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস আর আদ্রাফকেও কষ্ট দিচ্ছিস। তুই হয়তো ভাবছিস আমি অন্যসব স্বাভাবিক মানুষের মতো কাউকে ভালোবাসতে পারি না, প্রেম করতে পারি না, হয়তোবা আমি ভিতর ভিতর কষ্ট পাচ্ছি আমার ব্যর্থতা নিয়ে। হয়তো ভাবছিস আমি আমার ব্যর্থতার জন্য প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা থেকে আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। আর এইসবের মধ্যে তুই আমাকে রেখে কিভাবে অন্য ছেলের সাথে হাসিখুশি ভাবে প্রেম করবি, ভালোবাসবি তাই তো!! এইসব ভেবেই তো তুই ঠিক করেছিস আমার সাথে সাথে তুইও আমার মতো করেই থাকবি একা একা। ভালোবাসা ছাড়া আমার মতো করেই বাঁচবি। কি আমি ঠিক বলেছি তো!!”

কাসফিয়া অশ্রুসিক্ত চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে কান্না জোড়ানো কন্ঠে বললো-

“আশু তুই যেমনটা ভাবছিস আসলে ব্যাপারটা তেমন না। আমি কখনো তোকে ব্যর্থ মনে করিনি।”

আরশি কাসফিয়ার খানিকটা সামনে এসে শান্ত গলায় বললো-

“আজ তোকে কিছু বলি কাসফি তুই মনযোগ দিয়ে শুনে রাখ। আমি কারও সাথে প্রেম করিনা, ভালোবাসি না কারন আমি চাইনা আমার জন্য সেই মানুষটা কষ্ট পাক। আজ পর্যন্ত কেউ শুধু মাত্র আমার মনটাকে ভালোবাসেনি তাই তো সবাই আমার ব্যর্থতার কথা শুনেই পালিয়ে গেছে। আর যদি কেউ আমাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে তাহলে হয়তো সেই মানুষটা আমাকে আর আমার ব্যর্থতা দুটোই মেনে নিবে। হয়তো বিয়েও করতে চাইবে কিন্তু আমি তো জেনে শুনে কারও জীবনে গিয়ে তার জীবনটা নষ্ট করতে পারি না তাই না! প্রতিটা ছেলেই বাবা হতে চায়। আর আমি যদি কাওকে বিয়ে করি হয়তো প্রথম তিন চার বছর কেউ কিছু বলবে না কিন্তু তার পরই হয়তো সবাই আমার ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে তখন হয়তোবা আমার জীবনটা নরকে পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমি এখন অনেক ভালো আছি কাসসি বিশ্বাস কর আমাকে, আমি খুব ভালো আছি। এখন মাঝে মাঝে নিজের জন্য একটু আফসোস হয় কিন্তু কারও সাথে সম্পর্কে জড়ালে আমার সাথে সাথে আরও একটা মানুষের কষ্টও বহন করে বেড়াতে হবে আমাকে। আমি পারবো না রে কাসফি এতো মানুষের কষ্ট বহন করতে।”

আরশি কথা গুলো শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কাসফিয়ার কাধে হাত রেখে আবার বলা শুরু করলো-

“আমার জীবনের সব থেকে কাছের মানুষ তুই কাসফি। তুই আমার কাছে বেস্ট ফ্রেন্ডের থেকেও বেশি কিছু। আমাদের সম্পর্কটাকে কোনো শব্দ বা বাক্যে বর্ননা করার চেষ্টা করা বোকামি ছাড়া কিছুই না। কারণ আমাদের বন্ধুত্ব কোনো কিছুর মাধ্যমেই প্রকাশ করা যাবে না। তোর সাথে আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই আমাদের সম্পর্ক হলো আত্মার। আমি ছোট থেকে আমার বাবা-মার সাথেও এত সময় কাটাইনি যতটা সময় আমি তোর সাথে কাটিয়েছি। আর আমি কিভাবে সেই মানুষটাকে কষ্ট পেতে দেখবো বল তো কাসফি! আমি নিজের জন্যেও এতটা কষ্ট পাইনা যতটা তোকে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে পাই। তুই আর আদ্রাফ তোরা দুজনেই আমার কাছের মানুষ আমি কিভাবে তোদের কষ্ট সহ্য করবো?? আর তোরা তো আমার জন্যই নিজেদের কষ্ট দিচ্ছিস। তুই এমনটা করে আমার কষ্ট কমাচ্ছিস না বরং আরও অনেক গুণ বেশি কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছিস। বুঝতে পেরেছিস আমার কথা??”

কাসফিয়া মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে সাথে সাথেই আরশিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরলো। বাচ্চাদের মতো হিচকি তুলে কান্না করছে। আরশি কাসফিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করার জন্য বলল-

“বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করিস না তো কাসফি। থাম এখন শান্ত হ।”

কাসফিয়ার কান্না থামার কোনো নামই নেই। আগের মতোই ডুকরে ডুকরে কেঁদে যাচ্ছে। আরশি কাসফিয়াকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলল-

“কাসফি তুই তো জানিস ছোট বেলা থেকেই তোর কান্না দেখলে আমিও কান্না করে দিতাম। তোকে আন্টি মারলে তোর আগে আমিই কান্না শুরু করতাম। এখন কিন্তু বড় হয়ে গেছি এখনও যদি তোর কান্না দেখে আমিও কান্না করে দেই ব্যাপারটা আমার জন্য খুবই লজ্জাজনক হবে। তাই বলছি প্লিজ তুই কান্না থামা, না হলে আমিও এখন কান্না শুরু দিব। আমারও কিন্তু কান্না কান্না ভাব পাচ্ছে।”

আরশির কথা শুনে কাসফিয়া কান্নার মাঝেই হেসে দিলো। নাক টেনে হিচকি তুলতে তুলতে আরশিকে বলল-

“আমাকে মাফ করে দিস আশু। আমি এসব কিছু তোর কাছ থেকে লুকাতে চাইনি। আমি না জেনেই তোকে আরও বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।”

আরশি কাসফিয়ার চোখ মুখ মুছে দিয়ে বলল-

“আমিও সরি তোকে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য। আদ্রাফকে রেগেমেগে চলে যেতে দেখে আমার মাথা ঠিক ছিল না তাই রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে তোর গালে থাপ্পড় দিয়ে বসেছি। এখন এইসব কথা থাক তুই এখন আদ্রাফের কাছে যা। আদ্রাফ তো রেগে চলে গেলো। নীল অবশ্য ওর পেছন পেছন গেছে। ভার্সিটিতে যা ওখানেই হয়তো পেয়ে যাবি ওদের।”

কাসফিয়া কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বলল-

“কিন্তু… ”

“কোনো কিন্তু না আজ যদি তুই আদ্রাফের রাগ না ভাঙতে পারিস তাহলে আমি আর তোর সাথে কথা বলবো না। আদ্রাফকে যেন আর কখনো তোর জন্য অপেক্ষা করতে না হয় মনে রাখিস। তাড়াতাড়ি যা এখন।”

আরশি কাসফিয়াকে একপ্রকার জোর করেই পাঠিয়ে দিল। কাসফিয়া চলে যেতেই আরশি কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। মুখের হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। কেন যেন আরশির ভিতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। বুক ফেটে কান্না আসছে তবু কান্না চেপে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কাসফিয়াকে চলে যেতে দেখেই নীলা দূর থেকে এখন আরশির দিকে এগিয়ে আসলো। পেছন থেকে আরশির কাধে রেখে জিজ্ঞেস করলো-

“কিরে কাসফি তো চলে গেল। তুই এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস কে….”

আরশি কাধে নীলার হাতের স্পর্শ পেয়ে নীলার কথা শেষ হওয়ার আগেই নীলাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল। নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। নীলা হঠাৎ করেই আরশির কান্না দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। বার বার জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে কান্নার কারন। কিন্তু কোনো উত্তর পাচ্ছে।

চলবে…..

(বোনাস পর্ব দিয়ে দিলাম। খুশি হয়েছেন সবাই??? যদি খুশি হয়ে থাকেন তাহলে বেশি বেশি রেসপন্স করে জানিয়ে দিন। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here