এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৩৬
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
আনভীর আমার কথার প্রতিউত্তর দিলেন না। বরং শান্ত ভাবে মোবাইলের কল কেটে সুইচড অফ করে দিলেন। উনার প্রত্যেকটি কান্ডই আমি নীরব দর্শকের মতো দেখছিলাম। কিন্ত উনি আমার সাথে কথা না বাড়িয়ে ল্যাপটপ নিয়ে রিডিং টেবিলে বসে পড়লেন। আমি উনার শানত প্রতিক্রিয়া দেখে অনেকটাই অবাক। কেনো যেনো মনে হচ্ছে উনি আমার থেকে কোনো কিছু লুকোনোর প্রচেষ্টায় আছেন। এমনিতেও ডাক্তার সেদিন কি বলেছিলো সেটাও আমার অজানা। আর অপূর্ব ভাইয়া সেদিন সত্য বলেছিলো কিনা সে ব্যাপারেও আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নেই। আমি কথা বাড়ালাম না এবার। কেননা আমি আনভীরকেও চিনি আর অপূর্ব ভাইয়াকেও চিনি। তাই এখন জোর প্রয়োগ করলে উনি আরও হুংকার দিয়ে ওঠবেন আমার ওপর। আপনি আসলে ঠিক কি চাচ্ছেন সেটা আমি বের করেই ছাড়বো আনভীর।
_________________
ভার্সিটির প্রথম দিন আমার ঠিকঠাকমতোই গিয়েছে।আনভীরের ক্লাস ছিলো বলে অগত্যাই ড্রাইভার কাকু আমায় বাসায় পৌছে দিলো। ভার্সিটিতে ক্লাস করছিলাম বলে মোবাইল ভাইব্রেট করে রেখেছিলাম। মোবাইল অন করতেই দোলা আপুর ৩০+ মিসড কল দেখে আৎকে উঠলাম আমি। দোলা আপু সচরাচর কল দেন না আমায় চাচির ভয়ে। যা যোগাযোগ করার আমিই করি। আমি তৎক্ষণাৎ আপুকে কল দিলাম। আপু তখনই সাথে সাথে কল রিসিভ করলো। আমি অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-‘কি হয়েছে আপু? তুমি ঠিক আছো তো?’
দোলা আপু শ্বাস টেনে টেনে বললো,
-‘আহি……..আহি , জলদি বাসায় আয়। অপূর্ব…..অপূর্ব আবার পাগল হয়ে গিয়েছে। আব্বু-আম্মুও বাসায় নেই। তোর রুমে ঢুকে তোর মায়ের সব পুরোনো জিনিসগুলো ভেঙেচুড়ে একাকার করে ফেলছে। একটু আগে আমি থামাতে গেলে আমাকেও আঘাত করে বসে।’
আমার মাথায় যেন এবার আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি জানি অপূর্ব ভাইয়া এমনিতেও ওভার প্রোটেকটিভ। এককথায় মেন্টালি সিক। তাই বলে নিজের বোনের গায়েও এভাবে হাত তুলে বসবে তা আমি কল্পনায়ও আনতে পারিনি। সেই সাথে আমার মায়ের জিনিসগুলো তছনছ করে ফেলছে শুনে আমার নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো। আটকে এলো আমার কথাগুলো। মাথা কাজ করা যেনো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আনভীর আমাদের বিয়ের পর ও বাড়ি থেকে কোনো কিছুই আনতে দেয়নি তাই মায়ের সেই পুরোনো জিনিসগুলো আনতে পারিনি আমি। কিন্ত ওগুলোই যে আমার মায়ের শেষ স্মৃতি? আমি তাই তা যত্ন করে আলমারিতে তালাবদ্ধ করে দিয়েছিলাম। আপুকে বলেছিলাম একদিন সময় করে আমি নিয়ে যাবো। আমার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে , আমার মায়ের ওই স্মৃতিগুলো কিছুতেই আমি নষ্ট হতে দেবো না। তার ওপরও দোলা আপুও বিপদে আছে। না জানি অপূর্ব ভাইয়া আবার আমার মতো ওর সাথে করে বসে কিনা…….আর ভাবলাম না আমি। এখন আমার কাছে আর কোনো উপায় নেই ওই বাসায় যাওয়া ছাড়া। আনভীরকে এখন বললে উনি সাফ গলায় না বলবেন। তাই এই রিস্ক নিলাম না। হয়তো অনেকেই বলবে আমি হয়তো বোকামি করছি। কিন্ত আমার কাছে এটা সঠিক সিদ্ধান্তই। মা’হারা মেয়ের কাছে তার মায়ের পর মায়ের ব্যবহৃত জিনিসগুলোই সবচেয়ে আপন । আর সেগুলো যদি কেউ নিঃশেষ করে ফেলার চেষ্টা করে কারই না চিন্তা হবে? আমি তাই জামা পাল্টালাম না। কাউকে না বলেই ড্রাইভারকে নিয়ে ওই বাড়িতে চলে গেলাম।
বিকেল ঢলে পড়েছে আমার পৌঁছুতে পৌঁছুতে। সারা বাড়িতে কেমন যেন নিস্তব্ধতা। সদর দরজাটা খোলা দেখে আমি খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম। আমার বিয়ের এতমাসে এই প্রথম পা রাখলাম। কিন্ত মনে ভয়টা বেশি জেঁকে গেলেও তা প্রকাশ হতে দিলাম না। বসার ঘরে সবকিছুই স্বাভাবিক। কারও কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি সময়বিলম্ব না করে দোলা আপুর রুমের দিকে গেলাম। বাহির দিয়ে আটকানো দেখে বুঝতে বাকি রইলো না অপূর্ব ভাইয়াই আটকে রেখেছে আপুকে। দরজাটি খুলতেই দোলা আপু হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলো। কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো,
-‘অপূর্ব পুরাটাই পাগল হয়ে গিয়েছে রে। তখন আমি ওকে তোর রুমে যেতে বাধাঁ দিয়েছিলাম বলে কি কষেই না থাপ্পড়টা মারলো আমায়। তারপর আমার রুমে আটকে রেখে দিলো। আব্বু-আম্মুকে বারবার ফোন দিচ্ছি কিন্ত কেউ কল ধরলো না। তুই,,,,,,,,,,,তুই জলদি তোর রুমে যা। চাচির জিনিসগুলো এখনও ও নষ্ট করেনি। তবে ওর ঠিক নাই। তুই আগেই ওগুলো নিয়ে চলে যা।’
আমি নিঃশ্বাস ফেলে শক্ত করলাম নিজেকে। কেননা ভাইয়াকে এখন ভয় পেলে চলবে না।সেদিন যদি সাহস করে ভাইয়ার গালে হাত তুলতে পারি তাহলে এখন উচুঁ গলায় কথা বলতে আমার ভয় পেলে চলবে না। আমি বড়ো বড়ো পা ফেলে আমার পরিত্যাক্ত ঘরটির দিকে গেলাম। অপূর্ব ভাইয়া বসে আছেন বিধ্ধস্ত অবস্থায়। ঘরের পুরো নাজেহাল পরিবেশ। অনবরত ভাঙচুর যে চলেছে তা বুঝতে আমার বাকি রইলো না। একপাশে আমার মায়ের একটা ভাঙা ছবির ফেম দেখেই চোখে পানি এসে ভীড় করলো আমার।প্রখর কন্ঠে বলে ওঠলাম,
-‘এটা কি করেছো তুমি ভাইয়া?’
আমার কথা শুনে একপাশে হাটু গেড়ে বসে থাকা অপূর্ব ভাইয়া ধপ করে মাথা উঠিয়ে আমার দিকে তাকালো। তার চোখজোড়া লাল , অগোছালো চুলের আনাগোনায় নির্ঘাত পাগলাটে পাগলাটে লাগছে। সেই পূর্বের মতৌই কপালের কাছে রগটি দপদপ করছে। এমন ভঙ্গি দেখে আমি নিজের হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শক্ত করলাম নিজেকে। ভাইয়া উঠে দাঁড়ালো। ঘাড় হালকা কাত করে গম্ভীর গলায় বললো,
-‘এতটা স্বার্থপর তুই আহি? তোর মায়ের কথা ভেবে তুই এখানে এসেছিস আমি জানি , কিন্ত একটাবার আমার কথা ভেবে আসতে পারলি না?’
আমি ভাইয়ার কথায় কোনো প্রতিউত্তর না দিয়ে আমার মায়ের পরিত্যাক্ত জিনিসগুলো মেঝে েকে তুলতে মগ্ন হয়ে গেলাম। যদিও ভয়ে আমার হৃদয় ধুকপুক করছে। কিন্ত তা বুঝতে দিলাম না অপূর্ব ভাইয়াকে। ভাইয়া আমায় নির্বিকার দেখে আরও ক্ষেপে ওঠলেন। আমার হাত চেপে নিজের কাছে টেনে আনার চেষ্টা করতেই আমি ঝড়ের গতিতে নিজের হাত ছাড়িয়ে চিৎকার করে বললাম,
-‘আমার মায়ের জিনিস নষ্ট করে তোমার শান্তি হয়নি? এখন কি হিসেবে আমায় টাচ করছো?’
-‘তোকে ভালোবাসি বলে।’
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম। কথাগুলো কেমন যেন দলা পেকে গিয়েছে। তবুও কোনোমতে অশ্রুসিক্ত গলায় বললাম,
-‘ওয়ান্স এগেইন আই রিপিট ভাইয়া , এটা তোমার ভালোবাসা না , এটা তোমার জাস্ট জেদ। তোমার ইগোর জন্যই তুমি আমায় হাসিল করতে চাইছো। তাইতো চাচি চাচু মামু সবাই তোমায় জোরপূর্বক আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। আর একটি কথা ,,,,,,,,,,তুমি যদি আমায় ভালোবাসাতে , তাহলে কখনোই আমায় ভালোবাসার জিনিসগুলো এভাবে নষ্ট করতেন না।’
আমার মনে হয়না এসব কোনো কথা ভাইয়ের মাথায় ঢুকেছে। আমি ভাঙা জিনিগুলো একটা কার্টুনে নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই অপূর্ব ভাইয়া থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-‘কোথায় যাচ্ছিস?’
-‘আমার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি।’
-‘কোনটা তোর বাড়ি? ওই আনভীরের সাথে যেই পাতানো সংসার করছিস ওইটা?’
আমি চোখে সীমাহীন ঘৃণা নিয়ে তাকালাম মানুষটার দিকে। অপূর্ব ভাইয়া আবার চোয়াল শক্ত করে বললো,
-‘এভাবে তাকিয়ে আছিস যেন আমি মিথ্যা বলছি। আনভীর আর তোর কি ওটা পাতানো সংসার না? চেনা নেই , জানা নেই দুজন মানুষের হুট করে বিয়ে হয়ে যায় আমি মানবো কিভাবে যে তোদের মধ্যে সবকিছু নরমাল?আমি ঐ বাস্টার্ডটাকে বারবার বলেছি যে আহিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে। বাট ও কোনো রেসপন্সই করলো না। আমি যে এই দুইদিনে ও কে এতবার কল করেছি আর আনভীর প্রত্যেকটাবারই আমার কল ডিক্লাইন করে দিলো। একটা মানুষ এতটা নিচ কিভাবে হতে পারে যে আমাধের দুজনের মধ্যে একটা সম্পর্ক থাকলেও ও মাঝখান দিয়ে এসে পড়ে?’
আনভীরের কথাগুলো শুনে আমি চুপ থাকতে পারলাম না আর। আমার যেন ধৈর্যের বাধ ভেঙে গিয়েছে । আমার হাতের মুষ্ঠি নিমিষেই খুলে গেলো। যথাসম্ভব শান্ত গলায় বলে ওঠলাম,
-‘ কবে সম্পর্ক ছিলো আমাদের মধ্যে? যতটুকু হয়েছিলো তা তোমার জন্য জোরপূর্বক হয়েছে আর হয়েছে আমার অনিচ্ছায়। তুমি আমায় নিয়ে এতটাই ওভারপ্রোটেকটিভ ছিলে যে কোনো ছেলেদের সাথে কথা বলা তো দূরে থাক , দেখাও করতে দিতে না। তোমার মনমনতো করলে আমি ভালো আর তোমার কথা অমান্য করলেই আমায় খাবার দিতে না , দুইদিন ঘরে আটকে রাখতে, আমায় আঘাত করতে। একবার তোমারই বন্ধু আমার চুলের প্রশংসা করেছিলো বলে তুমি আমার লম্বা চুলগুলো কাচ দিয়ে একেবারেই এবড়োথেবড়ো করে দিয়েছিলে। তুমি কি মনে করো , সেগুলো ভুলে গিয়েছি আমি? তুমি মাফ চাইলেই আমি তোমায় মাফ করবো? কখনোই না। আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি ভাইয়া আমার কিশোর জীবনটাতো বরবাদ করেই দিয়েছো , এখন প্লিজ আমায় ছেড়ে দাও। নেক্সট টাইম কখনোই আনভীরকে ছাড়ার কথা বলবে না। কারন আমি উনার সাথেই থাকবো। ‘
আমার শেষ কথাটি শুনে অপূর্ব ভাইয়া নিজের সংযত রাগ দমিয়ে রাখতে পারলো না আর। আমায় কষিয়ে চড় মারতেই আমি ছিটকে নিচে পড়ে গেলাম। ঠোঁটে লবণাক্ততা অনুভব করতেই টের পেলাম রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ভাইয়া এবার হাটু গেড়ে আমায় কাছে বসে পড়লো। থমথমে গলায় বললো,
-‘ইউ আর রাইট বেবি। নিচ ওই আনভীর না , নিচ হলি তুই। তুই জানিস যে তোকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসি , হোক এটা তোর কাছে জেদ। কিন্ত তই কি করলি , আমায় তোর থেকে দূরে সরিয়ে ওই পাতানো সংসারের দিকে মনোযোগ দিলি। একটু বলতো কতজনকে লাগে তোর? তোর রূপের বাহারে তো এ পাড়ায় ভালো ছেলে হাতিয়ে নিয়েছিলি। তাই তো তোকে ঘরে আটকে রাখতাম। আবার এখন ওই আনভীরের পিছে পড়লি। আসলে মা ঠিকই বলতো , তোর মত মা হীনা মেয়ে এমনই নষ্টা ধরনের…………..’
অপূর্ব ভাইয়া কথাটা আর শেষ করতে পারলো না , মাঝপথে কেউ তাকে ঘুষি মারতেই ভাইয়া ছিটকে পড়ে গেলো নিচে।আমি কাদতে কাদতে হিচকী তুলে ফেলেছিলাম কিন্ত হঠাৎ আমার সামনে দাঁড়ানো অবয়বটিকে দেখে আমার হাত পা নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেলে। আনভীর দাঁড়িয়ে আছেন উদ্ভ্রান্ত অবস্থায়। অপূর্ব ভাইয়ার আমার সম্পর্কে সেই নোংরা কথাগুলো শুনে আনভীর যেন নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। উনি তাই এবার এগিয়ে পুনরায় এলোপাথারি মারতে থাকলেন ভাইয়াকে।আমি স্তব্ধ। মনে হচছে যে এসব কিছু স্বপ্ন। কেননা আনভীরকে এতটা হিংস্র আমি কখনোই হতে দেখিনি।
.
.
.
~চলবে…….ইনশাআল্লাহ
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।