এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৪১
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
বিয়ের আজ এতসময় পর হঠাৎ নিজের বাবাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে আমি স্তব্ধ না হয়ে পারলাম না। আমার পুরো সময়টা কেমন যেন গুমুশুম মনে হচ্ছে। পরীক্ষা শেষ করে মাত্র এক্সাম হল থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম আমি। আনভীরকে কল দিয়ে জানতে পারলাম উনার এখন ডিউটি আছে অন্য ডিপার্টমেন্টের এক হলে। তাই বলেছেন আজ একা যেতে। সাথে একশো একটা ফ্রি এডভাইস তো আছেই। তবে ক্যাম্পাসের বাহিরে পার্কিং লটের একটু দূরেই বাবাকে দেখতে পেলাম আমি। প্রথমে আমার মনে হচ্ছিলো এটা বুঝি আমার দৃষ্টিভ্রম। কিন্ত না , বাবা সত্যিই এসেছেন এখানে। পূর্বের আহি হলে হয়তো আমি বাবাকে দেখে কিছুটা আবেগী হয়ে যেতাম। তবে এখন আমি আর আগের আহি’র মতো করতে পারলাম না। আবেগ জিনিসটা উনাদের জন্য আমার একেবারে নিংড়ে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। আমার দৃষ্টি শান্ত, অনুভূতিহীন। বাবা আমার সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে আসতেই আমি শক্ত গলায় বললাম,
-‘কেনো এসেছো এখানে?’
বাবা চুপ হয়ে গেলেন। আমি সেসব দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি না দিয়ে পারলাম না। লাইক সিরিয়াসলি! যে লোকটা মেয়ের বিয়ে দেয়ার পর নিজ থেকে একবারও ফোন দেয়নি যে মেয়ে বেঁচে আছে কি-না তার জন্য আমার আবার কেমন অনুভূতি কাজ করবে?বাবা এবার মিহি গলায় বলে ওঠলো,
-‘তোর সাথে কিছু কথা আছে।’
আমি কথা বাড়ালাম না আর। বাবাকে নিয়ে এখান থেকে অনতিদূরেই এক ক্যাফেটেরিয়াতে বসে পড়লাম। বাবা একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন আমায় তাকে বাসায় না নিয়ে যেয়ে এখানে নিয়ে আসাতে। হয়তো এটা সমাজে যে কেউ বেয়াদবির কাতারেই দেখবে কিন্ত আমার হাত তালাবদ্ধ ছিলো। আনভীর এর আগেও বহুবার সাফ গলায় বলে দিয়েছেন আমি যেন কখনোই বাবার সাথে যোগাযোগ না করি। সে হিসেবে কিভাবে তাকে বাসায় নিয়ে যাবো আমি?তাছাড়া সেদিন আমার বিয়ের ঘটনার পর আমার শ্বাশুড়িও তেমন একটা পছন্দ করেননা তাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়েটার গরম গরম ধূমায়িক দু মগ কফি নিয়ে আসলো। পেছনে দৃশ্যমান থাই গ্লাস ভেদ করে দেখা যাচ্ছে মানুষের সমাগমে ব্যস্তমান সড়ক।আমি সময় নষ্ট করলাম না আর। জিজ্ঞেস করলাম,
-‘যেই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলতে এসেছো সেটা বলে ফেলো।’
-‘তুই কি কখনোই এ বাড়িতে আসবিনা আর? শুরুতে তো তুই আমার সাথে যোগাযোগ করতি এখন তো তাও করিস না। আমার ভুলটা কি?’
-তোমার কোনো ভুল নেই বাবা। সব ভুল আমার। তোমাদের এতদিন মান্য করেছি, তোমার সব মেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। বাট ইটস ওকে। নিজের ভুল শুধরে নিয়েছি আমি। আর সেই বাড়িতে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। ওটা আমার শুধু একটা বিভৎস্য অতীত।’
-ভুলিস না আহি ওটাই তোর জন্মস্থান ছিলো। তোর ছোটবেলা ছিলো।
-মা মারা যাওয়ার পর আমার ছোটবেলাটা মরণবেলায় রূপ নিয়েছে। প্রতিনিয়ত,,,প্রতিনিয়ত মরণ যন্ত্রণায় ভুগতাম আমি। খুব ইচ্ছে হতো তোমার কাছে থাকার , একটুকরো স্নেহ পাওয়ার। কিন্ত তুমি কি করলে? স্বার্থপরের মতো টাকার পিছে ছুটে আমায় একা ওই জায়গায় ফেলে রাখলে। আমার পড়াশোনা ছিনিয়ে এক নষ্ট লোকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা করলে। আল্লাহ আমায় সহায় ছিলেন বলেই হয়তো আনভীরকে পেয়েছিলাম আমি।তবুও তুমি ফিরে যেতে বলো আমায়?
বাবা কোনো কথা বলছেন না। আমি আবার বললাম,
-আমি আসলে তোমার কাঠপুতুল ছিলাম বাবা। তুমি আমায় এতদিন সহ্য করেছিলে শুধুমাত্র মায়ের সম্পত্তিগুলোর জন্য যা আমার ১৮ বছর হলেই তুমি নিয়ে নিতে চেয়েছিলে। আর সক্ষম হয়েছো তুমি।তোমার তো আবার টাকার অনেক মোহ। তাই আমায় চাচীর কাছে একা রেখে তোমার অন্যশহরে একটি সুখের সংসার চলছিলো , তুমি কি ভাবো , এটা কখনও আমি জানতে পারবোনা?
বাবা হকচকিয়ে তাকালেন আমার দিকে। কেননা উনি প্রত্যাশা করেননি এভাবে সত্যটি আমি জেনে যাবো। তবে বাবার চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে প্রচন্ড অনুতপ্ত। তাই নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠলেন,
-‘তোকে এতটা অবজ্ঞা করা আমার ভুল ছিলোরে মা।তখন আমি জোয়ান মানুষ ছিলাম। অল্পবয়সে স্ত্রী হারিয়ে যাওয়াটা যেমন আমার জন্য মেনে নেয়াটা কষ্টের ছিলো, তার থকেও কষ্টের ছিলো তোকে সামলানো। ছেলে হলেও কাজে লাগতো। কিন্ত তুই তো মেয়ে।তোর পেছনে ব্যয় ছাড়া আর কিই বা করার ছিলো আমার? টাকার লোভ অন্ধ করে দিয়েছিলো আমায়। চাকরি ক্ষেত্রে এতটাই মশগুলো ছিলাম যে ভুলে গেলাম তোর কথা।শুধু সময় মতো টাকাটাই পাঠিয়ে দিতাম। ভাবতাম এতেই বুঝি আমার কর্তব্য শেষ।
আমি এবার খাপছাড়া ভাবে বললাম,
-‘তো শেষ না তোমার দায়িত্ব? এখন দুঃখ পাচ্ছো কেনো?’
আমি কি বলছি আমি জানিনা। শুধু এতটুকু জানি রাগে দুঃখে হতাশায় রি রি করছে আমার শরীর। বাবার স্মৃতিচারণ হচ্ছে আমার সেই বিভৎস অতীতগুলো। আমি আগে দুর্বল ছিলাম। তবে এখন আর সেই দুর্বলতাটি নেই। হয়তো আনভীরের ব্যবহার আর কথাই আমায় প্রভাবে হেনে এমন করেছে। উনিই চাইতেন আমি যাতে কার্পণ্যবোধ না করি কিছুতে , সব কথার সঠিক উত্তর যেন দিয়ে আসতে পারি। আমি তপ্তশ্বাস ছাড়লাম এবার। বলে ওঠলাম,
-‘আমি এতটা মহৎ নই বাবা যে তোমার কৃতকর্মের কথা ভুলে যাবো। সর্বোচ্চ তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবো নামে মাত্র বাবা হিসেবে। তবে এর থেকে আর বেশি কিছু আশা করো না।’
বাবা মিহিয়ে গেলেন একেবারে।
-আমার এখন একটাই পরিবার। সেটা হলো আনভীর, আজরান ভাইয়া, শিউলি ভাবি আর আমার শ্বশুড় শ্বাশুড়ি। আর যাই হোক তারা তোমাদের মতো আমায় বোঝা মনে করেনি।পড়াতে চেয়েছে আমায়। চেয়েছে আমি যাতে প্রতিষ্ঠিত হই। আমি ভাগ্যক্রমে এমন মা পেয়েছি, পেয়েছি আমার জন্য চিন্তা করার মতো বাবা, আজরান ভাইয়ের মতো ভাই, শিউলি ভাবির মতো একজন শুভাকাঙ্খী। আর আনভীর? উনি আমার জীবনে সবচেয়ে বিশেষ উপহার। ভালো থেকো বাবা।’
আমি তারপর বেরিয়ে এলাম ক্যাফেটেরিয়া থেকে। রাস্তায় মৃদু বাতাস বইছে।বাতাসের মতোই অস্থির আমার মন। আমি ভাবতেও পারিনি আমি আমার অন্তরের সব ক্ষোভগুলো এভাবে বলে দিতে পারবো বাবাকে। আমার এত বছরের বোঝা হঠাৎ চলে গিয়ে বেশ হারকা হালকা লাগছে। আমি প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলাম। মনে হচ্ছে এভাবেই ধীরে ধীরে আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে তুলছে আমার জীবনচক্রকে। হঠাৎ আভীররের কল আসাতেই আমি মুচকি হাসলাম।যতক্ষণ না আমি বাসায় ফিরছি ততক্ষণ আমার এই পাগল বরসাহেব এভাবেই কল দিয়ে যাবে।এগুলো উপভোগ করার জন্য থাকুক নাহয় এমন কিছু পাগলামি!
______________________
পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে আমার। এখন শুধু শান্তিই আর শান্তি। ভাবির ডেলিভারির ডেটও এগিয়ে আসছে। দিন যত এগোচ্ছে , আজরান ভাইয়ার চোখেমুখে ততটাই দুশ্চিন্তার ছাপ। শিউলি ভাবিকে অতিরিক্ত যত্ন নামক মাইনটর্চারে রীতিমতো অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। এর মধ্যেই হঠাৎ এক কান্ড ঘটলো।সন্ধ্যাবেলা আজরান ভাইয়া অফিস থেকে এসেই সরাসরি ডাকলেন আমায়। আনভীর যেহেতু ড্রইংরুমেই ছিলেন তাই উনাকে আলাদা করে আর ডাকতে হলো না।আমার আর আনভীরের দুজনের চোখে মুখে প্রশ্নের ছাপ। আজরান ভাইয়া সময় বিলম্ব না করে নিজের ব্যাগ থেকে একটা বিয়ের কার্ড বের করলেন। আনভীর জিজ্ঞেস করলেন,
-‘কি এটা?’
-‘দেখতে পাচ্ছিস না এটা কি?’
আজরান ভাইয়া বললেন তাজ্জব হয়ে। আনভীর মিহিভাবে প্রতিউত্তর দিলেন,
-‘তা তো দেখতেই পেলাম। কিন্ত এটা আমাদের দিচ্ছো কেনো?’
-‘রাফিদের বিয়ের কার্ড এটা?রাফিদকে মনে আছে তো? আমাদেরই চাচাতো ভাই। ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। এই শুক্রবার অনুষ্ঠান। আর তোরা যাচ্ছিস সেখানে।’
-অসম্ভব। এখন আগামী কিছুদিন বের হওয়া অসম্ভব ভাই।পরীক্ষা শেষ হলো ভার্সিটিতে। আজ কালের মধ্যেই খাতার বান্ডিল হাতে ধরিয়ে মার্কশীট প্রস্তুত করতে বলবে।’
-‘আরে খাতা তো আজীবনই দেখবি। কিন্ত বউ নিয়ে খাগড়াছড়ির এই ট্যুর মিস করার মতো ছাগলামি করবি কেনো?’
এতক্ষণ আমি নীরব দর্শকের মতো শুনছিলার উনাদের কথা। তবে খাগড়াছড়ির কথা শুনে রীতিমতো আমার চোখ বড় বড় হয়ে এলো।আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-বিয়ে খাগড়াছড়িতে হবে?
-হ্যাঁ, আমার চাচ্চুরা খাগড়াছড়িতে থাকেন।
আমার মনে হঠাৎ যাওয়ার মতো এক ব্যাকুলতা তৈরি হলো। পরীক্ষাও শেষ। এই চশমিশ বিলাইটাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসলে মন্দ হয়না। তাও আবার বিয়ে বাড়ির আমেজ। আজরান ভাইয়া ধরতে পেরেছেন আমার উদ্দীপনাটি। তাই আগ বাড়িয়ে বললেন,
-দেখলি আহিও যেতে চায়। ফটাফট ব্যাগ গুছা। কাল রাতেই থোরা যাবি। আমি সব ব্যবস্থা করবো নে। আর শোন! একটা সারপ্রাইজও দেবো।
-আমরা না গেলে হয়না?
আনভীর বিরক্ত হয়ে বললেন কথাটি। আজরান ভাইয়াও নিজের ভাইয়ের এমন রসকষহীনভাব দেখে অতিষ্ঠ। বলে ওঠলেন,
-তোর মতো বেখাইপ্পা মানুষ আজও দেখিনাই আমি। আর আত্নীয়ের বিয়ে কি মিস করা যায়? সমাজ বলে এক ব্যাপার আছে না? আমিই যেতাম তবে তোর ভাবিমণির যা অবস্থা, আমি তো পারবোই না। আব্বু আম্মুরেও তো লাগবে যেহেতু সামনে ডেলিভারি ডেট আসছে।’
অগত্যাই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য রাজি হলেন আনভীর। আমার খুশি আর দেখে কে। মনের আনন্দে গুনগুন করে বেড়াচ্ছি। উফফফফ! এবার খাগড়াছড়ি ট্যুর হবেই হবে।
.
.
.
.
~চলবে…….ইনশাআল্লাহ
কেমন হয়েছে জানাবেন।