অদ্ভুত প্রেমবিলাস পর্ব-১৯

0
3517

#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-১৯|

বিকেল বেলা ধারার দাদি আম্মা বিছানায় শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় হাজারো কথা চিন্তা করছেন তিনি। কত ছোট বয়সে বিয়ে হয়ে তিনি এ বাড়িতে এসেছিলেন। আর আজ তিনি বৃদ্ধা। সুখ-দুঃখ হাসি আনন্দের মধ্যে পার করছে অনেকগুলো বছর। তার ভাবনা ছেদ হয় কারো কণ্ঠস্বর শুনে। কেউ কি তাকে ডাকছে? তা বোঝানোর জন্য শোয়া থাকা অবস্থায় কান খাড়া করে তিনি। শাহেদা বানুর গালা না? তা বোঝার জন্য উঁচু গলায় বলল,

‘ কে ডাকতেছে, বাইরে খাড়াইয়া?’

বাইরে থেকে শাহেদা বানু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,

‘ ভাবি আমি আইছি।’

শাহেদা বানু কে দেখে ধারার দাদি আম্মা উঠে বসে। শাহেদা বানু একা আসেনি তার সঙ্গে অপরিচিত একটা মহিলাকে নিয়ে এসেছে। ধারার দাদি আম্মা এক নজরে অপরিচিতার দিকে তাকিয়ে পরে শাহেদা বানুর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আরে ভাবি তুমি কি মনে কইরা আজ এদিকে আইলা যে? এখন আর তো তোমারে এদিকে দেখাই যায় না।’

শাহেদা বানু পান খাওয়া ঠোঁটে হেসে বলল,

‘ বোঝোই তো ছেলেপুলের বাড়ি, কাজ কাম তো কম থাকে না বাড়িতে। তাই আর এদিকে আসা হয় না।’

ধারার দাদি আম্মা শাহেদা বানুর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ খাড়াইয়া আছো ক্যান? বসো তোমরা!’

শাহেদা বানু বসে অপরিচিত মহিলা কে বলল,

‘ মিতা তুই খাড়াইয়া আছো ক্যা, বয় ওখানে।’

মিতা বেগম বসে। ধারার দাদি আম্মা মিতা বেগমের দিকে তাকিয়ে শাহেদা বানু কে বলল,

‘ ভাবি উনি কী তোমার পরিচিত?’

শাহেদা বানু হেসে বলল,

‘ হ পরিচিত তো, তুমি ও তো ওরে ছোটো বেলায় দেখছো। মনে নেই হয়তো তোমার। এটা হলো আমার ভাতিজি মিতা। যার শহরে বিয়া হইছে, শ্বশুরবাড়ি অবস্থা বিশাল। এবার মনে পড়ছে তোমার?’

ধারার দাদি আম্মা ভাবনার মাঝে বলল,

‘ মনে পড়ছে, মনে পড়ছে। মিতার না এক পোলা বিদেশে থাকে ছোটো বেলা থেকে।’

মিতা বেগম হেসে বলল,

‘ হ্যাঁ ফুপু‌। আমি আপনাকে ফুপু বললাম কিছু মনে করেন নি তো? আসলে আপনি যদি ফুপুর ভাবি হন সেই সূত্রে আপনিও আমার ফুপু।’

মিতা বেগমের এমন ব্যবহার দেখে ধারার দাদি আম্মা মুগ্ধ হন। কত অল্প সময়ের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছে মেয়েটা। ওতো বড় বাড়ির বৌ হয়েও তার মধ্যে কোন অহংকার নেই। ধারার দাদি আম্মা মৃদু স্বরে বলল,

‘ না, না আমি কিছু মনে করি নাই।‌ তোমার ইচ্ছা হইলে তুমি আমারে ফুপু কইয়াই ডাইকো।’

শাহেদা বানু পান চিবিয়ে খেতে খেতে বলল,

‘ তা ধারায় কই? আইছি পর থেইকা তো ওরে দেখলাম না!’

ধারার দাদি আম্মা উঠে পানের ডালা এনে সামনে রেখে বলল,

‘ ওর বান্ধবী জান্নাত আইজ গ্ৰামে আইছে না। জান্নাতের লগেই আছে ওহন।’

মিতা বেগম ছোট করে বলল,

‘ কখন আসবে ও?’

ধারার দাদি আম্মা কপাল ভাঁজ করে বলল,

‘ ক্যান? দরকার আছে ওর লগে?’

শাহেদা বানু পানের ডালা থেকে পান সাজাতে সাজাতে বলল,

‘ আসলে মিতা আইছিলো ধারার লগে কথা কইতে। মিতা আর ওর ছোটো পোলা যেদিন গ্রামে আসে ধারা হেইদিন ওগো সাহায্য করে আমাগো বাড়িতে নিয়ে যায়। অনেক বছর পর আইলে কী আর রাস্তা ঘাট মনে থাকে।’

ধারার দাদি আম্মা কিছুটা অবাক হয়ে বলল,

‘ এত কিছু হইছে আর আমিই কিছু জানি না।’

শাহেদা বানু ধীর গলায় বলল,

‘ শুনলাম নাত বৌয়ের বাপজান না কী অসুস্থ, নানাবিধ চিন্তায় হয়তো ভুল হয়ে গেছে তোমাগো কইতে।’

ধারার দাদি আম্মা নিচু গলায় বলল,

‘ হইতে পারে। তোমরা বও আমি কিছু নাস্তার ব্যবস্থা করি।’

কেউ কিছু বলে ওঠার আগেই ধারার দাদি আম্মা উঁচু গলায় বলল,

‘ নাত বৌ, ও নাত বৌ। কই গেলা তুমি?’

মাথায় ঘোমটা টেনে জোনাকি ব্যস্ত পায়ে দাদি আম্মার রুমে আসলো। চিন্তিত গলায় বলল,

‘ কিছু কি হয়েছে দাদি আম্মা? এত ব্যতিব্যস্ত হয়ে ডাকলেন যে?’

ধারার দাদি আম্মা হালকা সুরে বলল,

‘ নাত বৌ তোমার শাহেদা দাদি আইছে। তার লগে তার ভাতিজি আইছে‌। বুঝলা শহরের বউ সে। এহন তুমি তাগো নাস্তা পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করো।’

জোনাকি তাকায় তাদের দিকে। মিষ্টি হেসে বলল,

‘ আসসালামু আলাইকুম।’

সালামের উত্তর দেয় দু’জনে। টুকটাক ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে তার। জোনাকি আলাপ পর্ব শেষ করে মৃদু স্বরে বলল,

‘ আপনারা বসুন আমি আপনাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করছি।’

শাহেদা বানু প্রতিবাদ করে বলল,

‘ না, না, নাত বউ তার দরকার নাই। আমরা অহনি চইলা যামু। যার জন্য আইলাম সেই তো বাড়িতে নাই। তাইলে এসবের কী দরকার?’

জোনাকি তার কথার উত্তর না দিয়ে তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ধারার দাদি আম্মা শাহেদা বানুর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আরে ভাবি বসেন তো, ধারা কিছুক্ষণের মধ্যেই চইলা আইবে।’

শাহেদা বানু আর কিছু বলে না। আর এখন বাড়িতে গিয়েই বা কি করবে। বাড়িতে তো এখন কোন কাজ নেই। তারচেয়ে বরং এখানে বসে আড্ডা দেক কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেতে উঠে তিন জন আড্ডা। আড্ডার ছলে মিতা বেগম ধারার পরিবার সম্পর্কে জেনে নেয়। ধারা দাদি আম্মা মিতা বেগম কে বেশ ভালো লাগছে। তার কথা বলার ধরণ অন্য সব মহিলাদের থেকে আলাদা। অন্য সব মহিলাদের মত তার ভিতরের নিন্দা বা হিংসা জিনিসটা নেই। এগুলো আড্ডার মাঝে ধারার দাদি আম্মা খুব ভালো করে লক্ষ করেছে। বেশ হাসিখুশি বউটা। কি অল্প সময়ের মধ্যে মিশে গেছে তার সাথে। তার কথার ছন্দ দেখে মনেই হচ্ছে না যে আজ তাদের প্রথম আলাপ। বাইরের উঠার থেকে হাসা হাসির শব্দ আসছে। জোর কদমে চলছে হাসাহাসি। কান খাড়া করে হাসা হাসির শব্দ অনুসরণ করার চেষ্টা করে তিন জনের। হাসা হাসির শব্দ অনুসন্ধান করার আগেই কেউ হাসি মাখা কন্ঠে বলল,

‘ দাদি আম্মা ও দাদি আম্মা। এই দেখো তোমার জান্নাতের রানী কী করছে।’

ধারার গলার স্বর শুনে উপস্থিত সবাই ওর দিকে তাকায়। ধারা ওর দাদি আম্মার রুমে দুজন মহিলা বসে থাকতে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যায়। একজন তো শাহেদা দাদি আর অন্যজন ঐদিন রাস্তায় যে ভদ্রমহিলা কে সাহায্য করেছিল সে। ধারা ওর দাদি আম্মার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

‘ তোমরা কথা বলো আমি বরং পরে আসছি।’

ধারার রুম থেকে বেরিয়ে যাবার আগে মিতা বেগমের ডাকে পা থামায়। মিতা বেগম হালকা গলায় বলল,

‘ ধারা শোনো। আমার তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।’

ধারা অবাক হয়। ভীষণরকম অবাক হয়। তার সাথে কি কথা থাকতে পারে‌। ঐদিন তার সঙ্গে শাহেদা দাদির বাড়িতে যায়নি বলে কি শাহেদা দাদি কে সাথে নিয়ে তার নামে বিচার দিতে এসেছে। ভয় বাসা বাঁধে ধারার বুকে। বুকের ধুক ধুক শব্দ মুহূর্তেই বেরিয়ে গেছে। ধারা ভয়ে ভয়ে তাকায় তিনজনের দিকে। ভীতু গলায় বলল,

‘ আমার সাথে আপনার কি কথা থাকতে পারে! আর আমি তো কিছু করিনি!’

ধারার কথা শুনে মিতা বেগম মৃদু হেসে বলল,

‘ করেছো তো তুমি। এর মধ্যেই ভুলে গেলে।’

‘ করেছো তো তুমি’ কথাটা শুনে ধারার মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। ধারার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে ওই দিনে রাস্তায় এই ভদ্রমহিলাকে সাহায্য না করলেই হত। না হলে আর আজ বাড়ি বয়ে এসে ওর নামে নালিশ করতে আসতো না। কেন যে ঐদিন সাহায্য করতে গেল ও! সাহায্য করেছে ঠিক আছে আবার যেচে বাড়ির ঠিকানা ও দিয়ে এসেছিল। নিজের এই বোকামির জন্য ভয়ঙ্কর রকম গালি দিতে ইচ্ছে করছে ধারার। এই মুহূর্তে নিজের ইচ্ছাকে দমিয়ে রেখে মিতা বেগমের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

‘ আমি কি করেছি? আমি তো কিছু করিনি। আপনি শুধু শুধু আমার নামে মিথ্যা কথা বলছেন কেন?’

ধারার কথা শুনে মিতা বেগম হাসে। তিনি ভাল করেই বুঝতে পারছে ধারা হয়তো এই মুহূর্তে কোন কারণে তাকে দেখে ভয় পাচ্ছে। তার শিক্ষাকতা জীবনে তিনি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হাজারোবার হয়েছেন। তিনি ছাত্র-ছাত্রীর মুখ দেখেই হাবভাব বুঝে ফেলতে। মিতা বেগম মৃদু স্বরে বলল,

‘ আমি কি বলেছি তুমি কিছু করেছ? বলিনি তো! তাহলে তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? এসো আমার কাছে এসে বসো।’

মিতা বেগমের কথা শুনে মনে মনে একটু স্বস্তি পায় ধারা। ধীর পায়ে গিয়ে মিতা বেগমের পাশে বসে। ধারা বলে না কিছু, মাথাটা একটু নিচে করে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। মিতা বেগম খতিয়ে খতিয়ে দেখছে ধারা কে। একদম ধবধবে ফর্সা গায়ের রং। চুলগুলো খোপা করার বিধায় কতটুকু লম্বা বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো উত্তপ্ত রোদের তাপের মধ্যে দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে এসেছে ধারা। তার জন্য ধবধবে ফর্সা শরীর রক্ত জবার মত লাল হয়ে উঠেছে। চোখ যায় ধারার হাতের দিকে বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুলটা দিকে, ক্ষতবিক্ষত হয়ে শুকিয়ে আসে। আঙ্গুলের নখের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। হঠাৎ করে কারো চোখ পড়লে দেখে আঁতকে উঠবে। উফ কি বাজে অবস্থা হয়ে আছে আঙ্গুলটা। বেশিক্ষণ আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে না পেরে চোখ সরিয়ে নেয় মিতা বেগম। নীরবতা ভেঙে মিতা বেগম বলল,

‘ রোদের মধ্যে এতক্ষণ দৌড়োদৌড়ি করছিলে বুঝি!’

ধারা মাথা নেড়ে তার কথায় সায় জানায়। এতক্ষণ জান্নাতের সঙ্গে প্রচণ্ড রকম দৌড়াদৌড়ি করে সে। উদ্দেশ্য ছিলো দু’জনে মিলে গ্রামের মেঠো পথ গুলো ঘুরাঘুরি করবে। তাই করছিলি দু’জনে মিলে। হঠাৎ করে মাঝ রাস্তায় জান্নাত পা উল্টে পড়ে যায়। ওই অবস্থায় ধারা কয়েকটা ছবি তুলে নেয় নিজের ফোনে। ওই ছবিগুলো ডিলিট করার জন্য এতক্ষণ ওর পিছনে দৌড়োদৌড়ি করছিল জান্নাত। ধারা ওর ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে মিতা বেগমের দিকে তাকায়। ওর দিকে তাকিয়ে আছে সে। ধারাকে তার দিকে তাকাতে দেখে মিতা বেগম বলল,

‘ আসলে মা আমি এসেছিলাম তোমার সঙ্গে আলাপ করতে। ঐদিন তোমার ব্যস্ততার কারণে তো ভালো করে দুটো কথাও বলতে পারিনি। তাই আজ ফুফু কে সাথে নিয়ে চলে এলাম তোমাদের বাড়িতে।’

ধারা পিটপিট করে মিতা বেগমের দিকে তাকায়। ইস! কত বড় গাধা সে, নিজেকেই নিজে গালি দিচ্ছে ধারা। এই ভদ্রমহিলা তার সঙ্গে আলাপচারিতায় করতে এসেছে। আর সে কি না সব উল্টাপাল্টা কথা ভেবে চলেছে তখন থেকে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ, এইসব কথা যদি তারা জানতে পারত তাহলে তো আর লজ্জার শেষ থাকতো না ওর। নিজ ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে ধারা মিতা বেগমের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল,

‘ ওহ, তা কষ্ট করে আপনি বা শাহেদা দাদি আসতে গেলেন কেন? আমাকে খবর দিলে তো আমি চলে যেতাম।’

মিতা বেগম হেসে বলল,

‘ এখানে কষ্ট কিসের আছে? বিকেল বেলা এমনিতেও বাড়িতে বসে থাকতাম তাই ফুফু কে সাথে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছি।’

ধারার দাদি আম্মা ওদের কথার মাঝে বলল,

‘ তা খুব ভালো করছো!’

ওদের টুকটাক কথার মাঝে জোনাকি নাস্তা নিয়ে হাজির হয়। জোনাকির পিছন পিছন জান্নাত ও এসেছে। তাহলে এতক্ষণ ভাবির সঙ্গে ই ছিলো জান্নাত। জান্নাত সবার চোখের আড়ালে ধারার দিকে চোখ গরম করে তাকায়। ধারা তা দেখে মিটমিট করে ঠোঁট চেপে হাসতে শুরু করে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here