অদ্ভুত প্রেমবিলাস পর্ব-২৯

0
3079

#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-২৯|

ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ। শীতের আমেজ তা বাতাসে উপলব্ধি করা যায়। মৃদু শীতল বাতাসের গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এমন শীতের মধ্যে ইভান কে একটা সাদা রঙের পাঞ্জাবি পায়জামা পড়ানো হয়েছে। একে তো সাদা পাঞ্জাবি তার উপরে অতিরিক্ত মাত্রায় পাতলা। বাতাস ফুর ফুরিয়ে শরীরে প্রবেশ করছে। পাঞ্জাবি টা পছন্দ করে দিয়েছে ইভানের বড় ভাই জুয়েল। এমন পাতলা একটা পাঞ্জাবী কেনার জন্য ইভান মনে মনে জুয়েল কে হাজারবার গালিগালাজ করা হয়ে গেছে। কি দরকার ছিল এমন পাতলা একটা পাঞ্জাবি কেনার? এই শীতের মধ্যে কি আর এমন পাতলা পাঞ্জাবী পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব! লাবিদ ইভান কে এমন শীতে কাঁপতে দেখে মিরাজ কে দিয়ে ওদের বাড়ি থেকে ইভানের জ্যাকেট আনায়। ইভান মিরাজের ওর পাঞ্জাবী দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এবার বুঝেছি এই শীত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

রাত দশটা বাজতে চললো অথচ কাজী সাহেবের কোন দেখা নেই। ইতিমধ্যে হাবিব আর অভি গিয়েছে কাজী সাহেবর খোঁজে। কিছুক্ষণ আগে অভি ফোন করে তার আব্বাজান কে জানায় কাজী সাহেব পাশের গ্রামে তার বোনের বাড়িতে গেছে। হঠাৎ করে জরুরি তলবে কাজী সাহেব কোন খবর না দিয়ে চলে গেছে পাশের গ্রামে। তাই কাজী সাহেব কে নিয়ে ফিরতে ঘন্টা খানিক দেরি হবে বলে জানায় অভি। মেহমান বিচরণ করছে বাড়িতে। গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হয়েছে ধারা দের বাড়িতে। ধারার আব্বাজান তাদের নিমন্ত্রণ জানিয়েছে সন্ধার পরে নিজে গিয়ে। ধারার প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরে পাড়া-প্রতিবেশী যারা ধারা কে নিয়ে কটুক্তি করেছিল তাদেরও বিয়েতে নিমন্ত্রণ জানিয়েছে ধারার দাদি আম্মা। ধারার দাদি আম্মা তাদের শুনিয়ে শুনিয়ে তার নাত জামাই এর প্রশংসা করছে। ধারার আব্বাজান গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে ইভানের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। একমাত্র মেয়ে জামাই বলে কথা। ইভান ও হাসিমুখে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করছে। গ্রামের মানুষগুলো কত সহজ-সরল। অল্পতে কিভাবে মানুষকে আপন করে নেয়। ধারার আম্মা, চাচি জান, আরো গ্রামের কয়েকজন মহিলারা মিলে রান্নাবান্নার দিকটা সামলাচ্ছে। কাজী সাহেব আসতে দেরি হবে বলে আরো কিছুক্ষণ হাতে সময় পেয়েছে তারা। সন্ধ্যা সাতটার পর থেকে আয়োজন শুরু হয়েছে। এত অল্প সময়ে বিয়ের মতো এত বড় ঝুঁকি তাদের পক্ষে সামলানো কি সম্ভব! তাও তারা তাদের আপ্রাণ চেষ্টা করছে। জোনাকি সে বাড়ির মেহমানদের নাস্তা পানি দিতে ব্যস্ত। এত অল্প সময়ের মধ্যে তার বাবার বাড়িতে কেউ ই এই বিয়েতে উপস্থিত হতে পারেননি। তাবে ধারার আব্বাজান নিজে থেকে ফোন করে আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ধারার বিয়ের কথা জানিয়েছে। ধারার বড় মামা ছাড়া কেউই এই মুহূর্তে বিয়েতে উপস্থিত হতে পারিনি। জোনাকি কাজের ফাঁকে ফাঁকে গিয়ে ধারা কে দেখে আছে। সেই সন্ধ্যার পর থেকে দেখছে মেয়েটা কেমন রোবটের মত হয়ে বসে আছে। জোনাকি পাশের বাড়ির দুইটা মেয়েকে ধারার পাশে বসিয়ে রেখে এসেছে। আর থাকবে না ই বা কেন? কিছুদিন আগে অমন একটা ঘটনা ঘটেছে মেয়েটার সঙ্গে। এরমধ্যে আবার বিয়ের আয়োজন। মেয়েটার ছোট মনে কিভাবে চাপ পড়ছে তা কি কেউ বুঝতে পারছে না? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে আছে! হয়তো তাই হবে। মেয়েদের জীবনের স্বাধীনতা নেই। মেয়েদের অর্ধেক জীবন বাবার অধীনে আর অর্ধেক জীবন স্বামীর অধীনে কেটে যায়। নিজের মতো করে নিঃশ্বাস নেওয়ার যেনো সময় ই নেই মেয়েদের। আর গ্রামের মেয়েদের অবস্থা তো আরো নিদারুণ করুন। পরিবার থেকে যার সাথে বিয়ে ঠিক করা হবে তাকেই বিয়ে করতে হবে। বিয়েতে তার মত থাক কিংবা না থাক। ধারা কে কী বলবে, জোনাকি সে নিজের বিয়ের কথা কী ভুলে গেছে। সবে ক্লাস নাইনে উঠেছে সে। নতুন বইয়ের ঘ্রান নিঃশ্বাস ভরে নেওয়ার সময় সংসার নামক ছোট্ট শব্দ টা আকাশ সমান দায়িত্ব তার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়। কোন বাড়ির ছোট মেয়ে হঠাৎ করে কারো বাড়ির বড় বউ হয়ে ওঠা। মনে হাজার ভয় উত্তেজনা নিয়ে পাড়ি জমায় শ্বশুর বাড়িতে। ইচ্ছে ছিলো লেখাপড়া শেষ করে শিক্ষকতা করা। ছোট ছোট বাচ্চাদের নিজের মত করে পড়াবে, তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য পরামর্শ দিবে। কিন্তু তা তো এখন হবার নয়। বিয়ের পরে সাহস করে কখনো কাউকে মনের ইচ্ছের কথা বলতে পারিনি। এমনকি সম্রাট কেও তার মনের কথা বলতে পারিনি। জোনাকি এসব কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হঠাৎ ঘাড়ে কারো স্পর্শ পায়, চমকে পিছন ফিরে তাকায় জোনাকি। সম্রাট দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে জোনাকি ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ ওহ, তুমি। আমি ভাবলাম কে না কে?’

সম্রাট নিখুঁত চোখে তাকায় জোনাকির দিকে, কেমন অন্যমনস্ক লাগছে তাকে। সম্রাট মৃদু স্বরে বলল,

‘ কী হয়েছে? তখন থেকে দেখছি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবছো? ওদিকে যে আম্মা তোমাকে ডেকে ডেকে হয়রান হচ্ছে। কাজী সাহেব এসে গেছে। চাচি জান তাদের নাস্তা পানি দিয়ে দিয়েছে। তোমাকে ধারার কাছে গিয়ে দেখতে বলেছে ওর সাজগোজ সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি-না।’

জোনাকি মৃদু চিৎকার দিয়ে বলল,

‘ কাজী সাহেব এসে গেছে আর আমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি সরো আমার এখন অনেক কাজ পড়ে আছে।’

সম্রাটকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জোনাকি হনহনিয়ে ওখান থেকে চলে যায়। সম্রাট একনজর জোনাকির দিকে তাকিয়ে পরে সেও তার কাজে চলে যায়।

ধারার আব্বাজান কাজী সাহেব সহ আরো কয়েকজন নিয়ে ধারার ঘরে প্রবেশ করে। কাজী সাহেব এগিয়ে গিয়ে ধারার বিছানায় পাশে বসে একটা কাগজে কি সব লেখালেখি শুরু। খানিকক্ষণ পরে ধারার দিকে তাকিয়ে তাকে কবুল বলার জন্য বলল। ধারা মাথা নীচু করে দু হাত শক্ত করে মুঠো করে আছে। আশেপাশে কারো কথাই তার কানে যাচ্ছে না। সে তার নিজ ভাবনায় মগ্ন। জোনাকি ধারা কে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বাস্তবে ফিরায়। ধারা চোখ ভর্তি পানি নিয়ে জোনাকির দিকে তাকায়। জোনাকির ধারার মনের অবস্থা বুঝতে পারে। কিন্তু জোনাকি যে নিরুপায় কিছুই করতে পারবে না ধারার জন্য। জোনাকি ছোট নিঃশ্বাস ফেলে ধারা কে সামনে তাকাতে বলল, জোনাকির কথা মতন ধারা ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকায়। ধারার আব্বাজান তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে ধারার মাথা হাত রেখে ছোট করে বলল,

‘ আম্মাজান কবুল বলেন আপনি, কাজী সাহেব যে বসে আছে।’

ধারা ওর আব্বাজানের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে, চোখ বন্ধ করে ‘কবুল’ বলে দেয়।

কিছুক্ষণ আগে শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয়েছে ইভান আর ধারার। বিয়ের সময় ও ইভান ধারা কে দেখতে পায়নি। নিজের ঘরে বসেই ‘কবুল’ বলেছে সে। সেই শব্দটার এখনো ইভানের কানে বাজছে। কি মিষ্টি গলার সুর। এর আগেও কয়েকবার ধারার কণ্ঠস্বর শুনে সে, কিন্তু এবারের ‘কবুল’ বলা শব্দ টা ইভানের কাছে ভিন্ন লাগছে। বারবার কানে বাজছে শব্দ টা।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here