অদ্ভুত_প্রেমবিলাস পর্ব-৪৯

0
2968

#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-৪৯|

ধারা কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়ে সম্রাট ভাইয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সবার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। ধারার আব্বাজান বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরই ধারার আম্মা কান্না করে ধারার দাদি আম্মা কে নিয়ে তার ঘরে চলে যায়। ক্রোধের কারণে সম্রাটের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। ধারা কাঁপা কাঁপা গলায় সম্রাট কে বলল,

‘ ভাইয়া আব্বাজান এইমাত্র কী বলে গেল? আমার বিয়ে দিবে মানে? আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে।’

সম্রাট রেগে থমথমে গলায় বলল,

‘ পাগল হয়ে গেছে তোর আব্বাজান তাই এমন করছে। ওই মতিন জানোয়ারটাকে আমি হাতের কাছে পেলে ওকে আমি কবর দিয়ে দেব। ওর কত বড় সাহস ইভানের নামে উল্টোপাল্টা কথা আব্বাজানের কাছে লাগায়। ওকে তো আমি।’

জোনাকি সম্রাটকে শান্ত করার জন্য ভীত গলায় বলল,

‘ তুমি আগে শান্ত হও। তুমি এই ভাবে রাগারাগি করলে তাহলে আব্বাজান কে বোঝাবে কে? তাকিয়ে দেখো তোমার বোনটার দিকে কথাটা শোনা মাত্র তোমার বোনের চোখ মুখের অবস্থা কেমন হয়েছে। শান্ত করো আগে নিজেকে।’

সম্রাট জোনাকির কথা শুনে এক নজর ধারার দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে বড় বড় পা ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

ধারা কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। বারবার ধারার আব্বাজানের বলা কথাগুলো চোখের সামনে ভাসছে। হঠাৎ করে তার এমন মতিভ্রম হলো কেন কিছুই বুঝতে পারছে না ধারা। ধারার একবার মন বলছে এখানকার ঘটে যাওয়া সব ঘটনা ইভান কে জানিয়ে দিতে। আবার মন বলছে এসব কথা শোনার পরে বেচারা ওর চিন্তায় তো ঠিক ভাবে পরীক্ষাটা দিতে পারবে না। তাহলে? কী করবে ভেবে ভেবে ধারার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এসব চিন্তা ধারা আজ রাতের খাবারটা ও খাইনি। জোনাকি ভাবি আর দাদি আম্মা এসে কয়েকবার জোর করেছিল খাওয়ার জন্য কিন্তু তারা তাদের শান্ত গলায় জবাব দিয়েছে আজ সে খাবে না। ইভানের পরীক্ষার জন্য এখন আর ওদের রাতে তেমন একটা কথা হয়না। না হলে ইভান ঠিকই ধারার না খেয়ে থাকার জন্য কড়া করে বকা দিত। ধারার দ্বিতীয় পরীক্ষার দিন ইভানের পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। এর মধ্যে হয়তো ধারার আব্বাজান বাড়াবাড়ি কিছু করবে না। এরপরের সময় সুযোগ বুঝে ইভান কে এদিকের সবকিছু বুঝিয়ে বলবে ধারা, এসব মনে মনে ঠিক করে রাখে ধারা।

প্রথম পরীক্ষা দিন সম্রাট নিজে গিয়ে ধারা এবং জোনাকি কে পরীক্ষার হলে পৌছে দিয়ে আসে। দ্বিতীয় পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ধারা জান্নাত কে ওদের বাড়ির ঘটনা জানায়। প্রথমে জান্নাতে বিশ্বাসই করতে পারেনি যে ধারার আব্বাজান এমন করতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় পরে জোনাকির থেকে বিবরণ সহ সবকিছু শুনে। সব শোনার পরে জান্নাতের ও মন খারাপ হয়ে যায়। আল্লাহ আল্লাহ করে ধারার পরীক্ষা শেষ হতে আর মাত্র কয়েকটা পরিক্ষা বাকি। এরমধ্যে ধারার আব্বাজান ধারা আর ইভানের বিয়ে নিয়ে কোনো কথা বলেনি। সবাই ধরে নিয়েছিল তার মাথা থেকে বুঝি ভূত নেমেছে। কিন্তু তিনি মনে মনে অন্য ফন্দি এঁটে রেখেছেন। ধারা ইভানের বিয়ের বিচ্ছেদের কাগজপত্র সব ঠিক করে নিজের কাছে রেখেছেন। ধারার পরীক্ষা শেষ হলেই ওকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে ইভানের কাছে পাঠিয়ে দেবে কাগজ। এ খবর কোন ভাবে সম্রাট জেনে যায়। গ্রামের উকিলের ছোট ছেলে আবার সম্রাটের বন্ধু। তার মাধ্যমেই সম্রাটের সব খবর পেয়েছে। ইভানের সঙ্গে ও ছেলেটার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সম্রাট। খবরটা পেয়ে সম্রাট ছুটে আসে বাড়িতে, সম্রাট জানে এই সময়ে আব্বাজান কিংবা চাচাজান বাড়িতে থাকে না। তারা এই সময় দোকানে থাকে। সম্রাট নিজের ঘরে যাওয়ার সময় জোনাকি কে ডেকে বলে, বাড়ির সবাইকে ডেকে নিয়ে যেন তার ঘরে আসে, জরুরী কথা আছে সবার সঙ্গে। সবাই আসলে পরে সম্রাট একে একে সব কিছু খুলে বলে সবাইকে। সবাই এসব কথা শুনে তাজ্জব বনে যায়। ধারা তো আম্মা কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছে। সম্রাট ওর দাদি আম্মার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেয় এসব কথা ইভান কে জানানো দরকার। আর সাত-পাঁচ না ভেবে ফোন করে ইভান কে সম্রাট। ফোন রিসিভ করার পরে ইভান ওপাশ থেকে বলল,

‘ আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।’

সম্রাট নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম।’

ইভান খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলল,

‘ ভাইয়া তুমি তো আমাকে কখনো এই সময় ফোন করো না। ওদিকে সব কিছু ঠিক আছে তো? ধারা ঠিক আছে? ওর কিছু হয়নি তো?’

সম্রাট এক নজর ধারার দিকে তাকায় মেয়েটার চোখ দিয়ে এখনো পানি পড়ছে, সম্রাট ছোট করে বলল,

‘ আপাতত সবকিছু ঠিক আছে কিন্তু কতদিন ঠিক থাকবে তা আমি বলতে পারছি না।’

ইভান কিছু না বুঝে বলল,

‘ কী বলছো ভাইয়া আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

সম্রাট রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ তুমি আমাদের বাড়ির জামাই মানুষ তোমাকে কখন এসব কথা বলতে হবে আমি ভাবতে পারিনি। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে বলতে হচ্ছে। আব্বাজানের ভাবসাব কিছুদিন ধরে আমাদের ভাল ঠেকছিল না। কীসব উদ্ভট কথাবার্তা বলতেন। কিছুদিন আগে তিনি হঠাৎ করে বলেন তিনি তোমার হাতে ধারা কে তুলে দিবে না। সংক্ষেপে বললে তিনি তোমাদের বিচ্ছেদ করাতে চাইছেন। আমি তোমাকে আগেই এসব কথা জানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ধারা আমাকে নিষেধ করেছিল বলেছিল, তোমার পরীক্ষা চলছে এখন তুমি যদি এসব কথা জানতে পারো তাহলে পরীক্ষা ছেড়েছুড়ে তুমি দেশে চলে আসবে। আমিও তখন ধারা কথা মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আমাদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে ইভান। আব্বাজান তোমাদের বিচ্ছেদের কাগজপত্র ঠিক করে ফেলেছেন। ধারার পরীক্ষার পর ওকে দিয়ে স্বাক্ষর করাবেন বলে মনস্থির করেছেন। আমার যতদূর মনে হচ্ছে ধারার পরীক্ষার পরেই আব্বাজান বড় কোনো পদক্ষেপ নিতে চলেছেন। মানে ধারার দ্বিতীয় বিয়ের সম্পর্কে। ধারা এসব কথা শুনে কেঁদে অস্থির প্রায়। তোমাকে তো আমি আগেই বলেছিলাম ধারার আগে মতিন নামে একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। সেই ছেলেটা ধারা কে বিয়ে করবে বলে আব্বাজান এর কাছে দুই বছর আগে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে আছে। আমাদের দোকানে যে কর্মচারী আছে শাহিন তাকে তো তুমি চেনো। আমি বা চাচাজান দোকানের না থাকলে ঐ মতিন জানোয়ার টা দোকানে এসে তোমার নামে উল্টাপাল্টা কথা বলে আব্বাজান এর কাছে। একথা শাহিন শুনেই আমাদের কাছে বলেছে। ওই জানোয়ারটাকে এসব কথা তোমার কাছে বলতে আমার লজ্জা করছে, তুমি বিদেশে লেখাপড়া করো তোমার তো একাধিক গার্লফ্রেন্ড থাকবে, তুমি পুরুষ মানুষ তোমার কাছে বউ থাকে না তাই তুমি তাদের নিয়ে অশ্লীল কর্মকাণ্ড করো। এরকম অনেক অশ্লীল এবং অপ্রীতিকর কথাবার্তা বলছে জানোয়ার টা আব্বাজানের কাছে। জানোয়ার টা তোমার নামে আব্বাজানের কাছে বিষ ঢেলেছে।’

ইভানের রাগের কারণে পুরো শরীর কাঁপছে। রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে বলল,

‘ ভাইয়া তুমি ধারার পরীক্ষা পর্যন্ত কে সামলে রেখো। কিছুদিনের মধ্যে আমি দেশে গিয়ে ওকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। এরমধ্যে তোমাদের আব্বাজান যদি আমার বউকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করে তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।’

এইটুকু বলেই ইভান ফোন কেটে দেয়। সম্রাট ফোনের দিকে তাকিয়ে ছোট নিঃশ্বাস ফেলে। পরপরই ধারার ফোন বেজে ওঠে। ধারা আসার সময় ওর ফোনটা ওর ঘরে রেখে এসেছে। ফোন বাজার শব্দ পেয়ে ধারা দ্রুত পায়ে ওর ঘরের দিকে যায়। ইভান ফোন করেছে। ধারা ফোন রিসিভ করে কিছু না বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। ইভান উত্তেজিত গলায় বলল,

‘ কান্না করছো কেন আমি আছি তো নাকি? কান্না করো না আমি দ্রুত দেশে ফেরার ব্যবস্থা করছি। তোমার তো আর দুইটা পরীক্ষা বাকি আছে, লাস্ট পরীক্ষা দিয়ে এসে তুমি তোমার সমস্ত জামাকাপড় কাগজপত্র গুছিয়ে নেবে। আমি দেশে ফিরে আগে গিয়ে তোমাকে ওখান থেকে নিয়ে আসবো। তোমার বাপের বাড়ি থেকে কোনো কিছু আনার দরকার নেই। বিয়ের পর আমাদের বাড়ি থেকে যা দিয়েছে শুধু তাই আনবে। এখন কান্না বন্ধ করো।’

ধারা ঠোঁট চেপে কান্না থামিয়ে বলল,

‘ ঠিক আছে। আপনি তাড়াতাড়ি এসে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যায়। আমার কিছু ভালো লাগছে না।’

ইভান মৃদু স্বরে বলল,

‘ আমি এখন একটু বের হবো বিল্লু রানী। বন্ধুদের সঙ্গে একটু আলোচনা আছে ভবিষ্যতে কে কী করবো তাই নিয়ে। ওখান থেকে ফেরার পথে আমি টিকিট কনফার্ম করে ফিরবো। তুমি একদম চিন্তা করো না।’

ধারা ছোট করে বলল,

‘ ঠিক আছে।’

ইভান আর রাতে ফোন করেনি। ধারা ভেবেছে ব্যস্ততার কারণে হয়তো তাকে ফোন করার সময় পায়নি। এদিকে ধারার অকারণে মন অস্থির হয়ে আছে। মন বলছে কারো খারাপ কিছু হয়েছে। অস্থিরতার কারণে ধারা ঘুমাতে পারেনি বিছানার এপাশ ওপাশ করে গেছে সারারাত। পরের দিন বেলা হয়ে গেলেও ইভান ধারা কে ফোন না করলে ধারা চিন্তায় পড়ে যায়। ফোন করে ইভান কে। মুহূর্তেই ভয় আরো বেশি দানা বাঁধে ধারার মনে, ইভানের ফোন বন্ধ। ইভান কে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে হেরি কে ফোন করে ধারা। হেরি কাঁপা কাঁপা গলায় জানায়, ইভান একটা কাজের শহরের বাইরে গেছে। তাই এখন ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। ইভান বলেছে সে তিন চার দিনের মধ্যে ফিরে আসবে। ধারার হেরির কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। যে ইভান ওকে না জানিয়ে কোন কিছু করে না, সেই ইভান ওকে না জানিয়ে শহরের বাইরে যাবে?

পুরো দুইদিন পরে ইভান ফোন করে ধারা কে। ইভানের কন্ঠ স্বর ভাঙ্গা ভাঙ্গা ছিল। ধারা তো ইভানের সঙ্গে কথা বলে অভিমানে কেঁদে দিয়েছিল। ধারা ইভান কে ভিডিও কল দিতে চাইলে ইভান তা প্রতিবার এড়িয়ে গেছে। ইভান ধারা কে শান্ত করে ভাঙ্গা গলায় বলল,

‘ বিল্লু রাণী এখন আমার কথা মন দিয়ে শোনো। একটা সমস্যার কারণে আমি এখন দেশে ফিরতে পারব না। কাল তোমার পরীক্ষা শেষ, পরশুদিন সকালবেলা লাবিদ ভাইয়া তোমাদের ওখানে যাবে। হয়তো বাড়িতে নাও ঢুকতে পারে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। তুমি সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে ভাইয়ার সঙ্গে চলে আসবে। আমাদের বাড়িতে একদিন থেকে তারপরের দিন ফ্লাইটে তুমি আমার কাছে চলে আসবে।’

ধারা চমকে উঠে বলল,

‘ মানে?’

ইভান ছোট করে বলল,

‘ মানে খুব সোজা, তুমি আমার কাছে ইতালি চলে আসবে।’

ধারা চিন্তিত গলায় বলল,

‘ দুই তিনদিনের মধ্যে কিভাবে আমার পাসপোর্ট রেডি হবে? তাছাড়া টিকিট কনফার্ম করা এছাড়া আরো অনেক ঝামেলা আছে। এগুলো কিভাবে সম্ভব দুই-তিন দিনের মধ্যে?’

ইভান থেমে থেমে বলল,

‘ আমি আম্মু কে আগেই বলেছিলাম আমার বিয়ের শপিং পুরো পরিবারকে সাথে নিয়ে আমি ইন্ডিয়া থেকে করবো। তার জন্য তোমার পাসপোর্ট আম্মু অনেক আগে থেকেই রেডি করে রেখেছিল। তুমি ক্লাস টেনে পড়াকালীন পহেলা বৈশাখে আমাদের বাড়িতে এসেছিল তখন আম্মু তোমাকে নিয়ে একদিন পাসপোর্ট অফিসে গেছিলাম। তুমি হয়তো তখন খেয়াল করনি। যাইহোক থাক এখন সেসব কথা। বাড়তি চিন্তা না করে আমি যা বলছি তাই করো। জামা কাপড় গোছানো শুরু করে দাও, হাতে বেশি সময় নেই রাখছি আমি এখন।’

এইটুকু বলে ইভান ফোন কেটে দেয়। এদিকে ধারা ইভানের কথা শুনে চিন্তায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ধারার আব্বাজান যদি একথা জানতে পারে তাহলে তো অনর্থ হয়ে যাবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here