#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-৫৫|
দেশে আসার একদিন পরেই ইভান ঠিক করে সালমা আন্টির সঙ্গে দেখা করতে যাবে। ধারা ইতালি চলে যাওয়ার দুই বছর পরে সালমা আন্টি তার গ্ৰামে চলে যায়। তার ছেলে মেয়েরা চাইছে না তাদের মা আর অন্যের বাসায় কাজ করুক। এখন তারা সবাই উপার্জন করে তারা তার মাকে ভালো ভাবে রাখতে পারবে। সালমা আন্টি ও ছেলে মেয়ের কথায় অমত করেননি। ফিরে গেছেন গ্রামে তার সংসারে। ইভান আর ধারা গিয়ে সালমা আন্টি কে ইহিতা কে দেখিয়ে আনবে বলে ঠিক করেছে। জুয়েল বলেছে, ওরা গ্রাম থেকে ফিরলে সবাই মিলে কক্সবাজার ঘুরতে যাবে। এদিকে জান্নাত মন খারাপ করে আছে। তার বেস্ট ফ্রেন্ড এত বছর পর দেশে ফিরেছে অথচ সে এখনো তার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। অফিসের কাজ নিয়ে ছুটতে হয়েছে সিলেট শহরে। দুই দিনের মধ্যে ফিরে আসবে বলে জানিয়েছে ধারা কে। ইভান রা রওনা দিয়েছে অনেকক্ষণ, বিকেলের আগেই পৌঁছে যাবে গ্ৰামে। জুয়েলের গাড়ির ড্রাইভার ওদের সেখানে নিয়ে যাচ্ছে। সে আরো কয়েকবার গিয়েছি সালমা আন্টি কে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে। শেষ বারও সে দিয়ে গেছে সালমা আন্টি কে বাড়িতে পৌঁছে। এক-দুই ঘন্টা সেখান থেকে আবার সঙ্গে সঙ্গে রওনা দেবে ওরা। ধারা ইতালি থেকে ওদের বাড়ির সবার জন্য শপিং করে নিয়ে এসেছে সঙ্গে আছে চকলেট। আসার পথে ইভান নিজে তাদের জন্য রকমারির ফল মিষ্টি কিনেছে। ইহিতার খুশির অন্ত নেই। তার পাপার কোলে বসে এটা ওটা দেখছে আর খিলখিল করে হাসছে। বিকেল চারটার পর পরই ওদের গাড়ি গ্রামের রাস্তায় ঢুকে যায়। রাস্তার পাশে সবুজ ফসলের জমি, ধানের ক্ষেত্রে বিষ্ময়ের শেষ নেই ইহিতার চোখ। ইভান আর ধারা সব কিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে ইহিতার। গাড়ি গিয়ে থামে উঠানের পাশের রাস্তায়। ইভান আর ধারা গাড়ি থেকে নামে। ইহিতা ধারার কোলে। ইভান বাড়ির দিকে তাকায়। বাড়ির উঠানে অনেক মানুষ জন দেখা যাচ্ছে। হয়তো কিছু বিষয় নিয়ে বসে আলোচনা করছে তারা। ইভান ধারা কে দাঁড়াতে বলে সে দিকে পা বাড়ায়। ইভান দেখে সেখান থেকে একজন লোক উঠে এসে ইভানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ কাউকে খুঁজছেন আপনারা?’
ইভান লোকটার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
‘ হ্যাঁ, এখানে সালমা আন্টির বাড়িটা কোন দিকে একটু বলে দিতে পারবেন?’
লোকটা ভুরু কুঁচকে বলল,
‘ তাকে কী দরকার আপনাদের?’
ইভান মিহি গলায় বলল,
‘ আমরা শহর থেকে এসেছি আন্টির সঙ্গে দেখা, আপনি যদি তাকে চিনে থাকেন তাহলে একটু ডেকে দিন তাকে।’
লোকটা ধীর গলায় বলল,
‘ আমি তার বড় ছেলে। আসুন আমার সঙ্গে।’
ইভান ধারা কে ইশারায় আসতে বলে লোকটার পিছন পিছন হাটতে শুরু করে। উঠানে দাঁড়িয়ে লোকটা মৃদু চিৎকার দিয়ে বলল,
‘ মা দেখে যাও তোমার সঙ্গে দেখা করতে শহর থেকে কারা যেন এসেছে।’
কয়েক মিনিট পরেই উঠানের পাশে ছোট একটা ঘর দিয়ে বেরিয়ে আসে এক ভদ্রমহিলা। সম্ভবত রান্নাঘর হবে। ইভানের চিনতে অসুবিধে হয়নি তার সালমা আন্টি কে। ইভান খানিকটা দৌড়ে গিয়ে সালমা আন্টি কে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আন্টি কেমন আছো তুমি? আজ কত দিন পরে তোমাকে দেখলাম।’
ইভান সালমা আন্টি কে ছেড়ে দিলে, সালমা আন্টি কিছুক্ষণ ইভানের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
‘ বাবু!’
সালমা আন্টির কথা শুনে ইভান হেসে দেয়। সালমা আন্টি ইভানের গালে হাত দিয়ে আবার বলল,
‘ বাবু তুই দেশে ফিরে এসেছিস কবে? কেমন আছিস তুই? বৌমা সে কোথায়? সে কেমন আছে? শুনেছি তোদের নাকি একটা মেয়ে হয়েছে?’
ইভান হেসে দিয়ে বলল,
‘ আরে আস্তে আস্তে একসঙ্গে কতগুলো প্রশ্ন করবে তুমি আমাকে? একে একে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, পরশু দিন বিকেলে ইতালি থেকে ফিরেছি আমরা। আর তোমার বৌমা নাতনি কেমন আছে তা তাদের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে নাও। ওই তো তারা দাঁড়িয়ে আছো ওখানে।’
ধারা ধীর পায়ে হেঁটে এসে ইভানের পাশে দাড়িয়ে সালমা আন্টি কে দেখে হেসে বলল,
‘ কেমন আছো আন্টি তুমি?’
সামলা আন্টি ধারার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, ধারার কোলে ইহিতা কে দেখে বলল,
‘ আল্লাহ এইটা তোদের মেয়ে? মাশাল্লাহ দেখতে তো একদম পুতুলের মত। নাম কিরে ওর?’
ধারা মৃদু হেসে বলল,
‘ ইহিতা, ইহিতা জুনায়েদ।’
সালমা আন্টি ইহিতার গালে হাত দিয়ে বলল,
‘ খুব সুন্দর নামটা।’
ওদের কথার মাঝে অন্য আর একটা লোক এসে সালমা আন্টি কে বলল,
‘ মা এরা কারা?’
সালমা আন্টি হাসি মুখে বলল,
‘ আরে তোরা এখনো চিনতে পারলি না এটা তো আমাদের বাবু। তোদের মিতা খালার ছোট ছেলে। যার কথা তোদের গল্প করেছিলাম না বিদেশে থাকে এই সে।’
ইভান মৃদু স্বরে বলল,
‘ আন্টি তোমাদের বৌমা তোমাদের সবার জন্য কিছু গিফট এনেছে কাউকে পাঠিয়ে গাড়ি থেকে সেগুলো আনার ব্যবস্থা করো প্লিজ।’
সালমা আন্টির চিন্তিত গলায় বলল,
‘ এসবের কী দরকার ছিল বাবু। তুই আমার বাড়িতে আসবি অন্য কারো বাড়িতে তো আর না। তাহলে এত কিছুর কিসের জন্য প্রয়োজন?’
ইভান মিহি গলায় বলল,
‘ আমি কিছু আনিনি তোমাদের জন্য তাই আমাকে বলে লাভ নেই। তোমাদের বৌমা এনেছে। তার সঙ্গে বুঝে নাও তোমরা।’
ধারা আশেপাশে তাকিয়ে সালমা আন্টি কে ধীর গলায় বলল,
‘ আন্টি বাড়ীতে এত মানুষ কিছু কী হয়েছে?’
সালমা আন্টি এক গাল হেসে বলল,
‘ হ্যাঁ রে! আমার ছোট নাতনির বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ের পাকা কথা বলতে ছেলের বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে।’
সালমা আন্টি একে একে সবার সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দেয়। সালমা আন্টির দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে। সালমা আন্টির ছোট ছেলে লতিফের বড় মেয়ের বিয়ের কথা চলছে। সালমা আন্টির বড় ছেলে ফারুকের মেজো ছেলে ওদের বসার ব্যবস্থা করে দেয়। ধারা আর ইভান বসে সালমা আন্টির সঙ্গে কথা বলছে। ইহিতা সালমা আন্টির কোলে। এরমধ্যে ছেলের বাড়ির লোকজনের মধ্যে দিয়ে দুইজন ছেলে উঠে এসে ইভানের সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলল,
‘ কেমন আছো তুমি ভাইয়া? তুমি হয়তো আমাদের চিনতে পারোনি কিন্তু আমি তোমাকে দেখে চিনতে পেরেছি। আমি কায়েস আর ও আমার ছোট ভাই মিরাজ। আর ধারা আপু তুমিও আমাকে ভুলে গেলে? ছোটবেলায় তো তুমি আর জান্নাত আপু মিলে আমাকে নাকানি-চুবানি খাওয়াতে।’
ধারা আর ইভান দু’জন দু’জনের দিকে বিষ্ময় নিয়ে তাকায়। কায়েস সে এত বড় হয়ে গেছে? ইভান বিষ্ময় কাটিয়ে উঠে অবাক গলায় বলল,
‘ কায়েস তুমি এখানে? কেমন আছো তুমি? মিরাজ সেও তো অনেক বড় হয়ে গেছে। কত বড় হয়ে গেছে তোমরা! আমি তোমাকে দেখে চিনতে পারিনি একদম।’
ধারা বিষ্ময় গলায় বলল,
‘ কায়েস তুই এখানে? আমি তো ভাবতেই পারিনি তোর সঙ্গে আমার এখন এইভাবে দেখা হয়ে যাবে। দেখা হয়ে ভালোই হয়েছে, তোদের বাড়ির সবাই কেমন আছে?’
কায়েস লাজুক গলায় বলল,
‘ আসলে আপু আমার জন্য বাবা মেয়ে দেখতে এসেছে এই বাড়িতে। তাই আর কী।’
ধারা অবাক গলায় বলল,
‘ সেদিনকার কায়েস, যাকে কিনা সেদিনও আমি আর জান্নাত মিলে কায়েস পায়েস বল খেপিছি। সে এখন বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেছে। গুরুজনদের নিয়ে মেয়ে দেখতে এসেছে। ভাবা যায়।’
ধারার কথা শুনে কায়েস লজ্জায় পড়ে যায়। সালমা আন্টি ইভান কে মৃদু স্বরে বলল,
‘ বাবু তুই কী আমার নাত জামাই কে চিনিস?’
ইভান হেসে বলল,
‘ চিনি মানে খুব ভালো করে চিনি। ধারা দের গ্রামে আম্মুর এক ফুপির বাড়ি আছে না! আম্মুর সেই ফুপির নাতি কায়েস। আমার আরেকটা ভাই বলতে পারো।’
ইভানের কথা শুনে সালমা আন্টি ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘ তাহলে তো ভালোই হলো চেনা-পরিচিত এর মধ্যে আত্মীয়তা হবে। বাবু তোরা বস আমি তোদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি।’
সালমা আন্টি দ্রুত পায় সেখান থেকে চলে যায়। ইভান কায়েসর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তোমাদের গ্ৰামের অবস্থা এখন কেমন? গ্ৰামের লোকজন কেমন আছে?’
কায়েস মৃদু স্বরে বলল,
‘ আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া সবাই ভাল আছে। জানো ধারা আপু তোমার বড় ভাইয়া না একটা ছেলে হয়েছে। খুব মিষ্টি দেখতে। নাম রেখেছে শাওন।’
কায়েসর কথা শুনে ধারা চমকে উঠে কায়েসের দিকে তাকায়। ওর সম্রাট ভাইয়ার ছেলে হয়েছে! ভাগ্যের কী পরিহাস, নিজের ভাইয়ের ছেলে হয়েছে তা জানতে হচ্ছে বাইরের লোকের মুখে। ধারা কাঁপা কাঁপা শরীরে ইভানের দিকে তাকিয়ে। ইভান ধারার অবস্থা বুঝতে পেরে শক্ত হাতে ধারার কাঁধে হাত রেখে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়।
চলবে…